এক ফোটা জল



 এক ফোটা জল
মাহবুব এ রহমান

বাহির থেকে এসেছি মাত্র। প্যান্ট না খুলেই বসে পড়েছি বই নিয়ে। খানিকক্ষণ যেতে না যেতেই পাশের রুম থেকে রুমানের ডাক। ওর রুমে মোবাইল চার্জে লাগিয়েছিলাম। ফোন আসছে। দৌঁড়ে গেলাম। একি, সাজিদ ভাইয়ের ফোন! রিসিভ করে সালাম দিলাম।
‘কই?
‘বাসায়।
‘খামটা কোথায়?
‘ব্যাগে।
‘রাতের ট্রেনে আস। আবার ওইটায় চলে যাবে।
‘জ্বী, ঠিকাছে।
লাইন কেটে দিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখন ক্যাম্পাস যাব! ধুর, দিনে যাইনি ক্লাসে। তাই বলে এরকম শাস্তি! না গিয়ে উপায়ও নেই। খুব নাছোড়বান্দা। এক কথার লোক। কিছু বললে ফিরানোও যায়না। মোবাইল চাপলাম। আটটা বাজতে আর তিন পাঁচ মিনিট। ট্রেন তো সাড়ে আটটায়। শার্টটা জড়িয়ে নিলাম গায়ে। হ্যাডফোন তো নষ্ট। রুমানেরটা ডুকিয়ে নিলাম পকেটে। হ্যাডফোন ছাড়া শাটলট্রেন জার্নি কল্পনা করা যায়! বেরিয়ে পড়লাম। ভাল্লাগছেনা। একা একা হাঁটছি। সেদিনের মত যদি স্টেশনে মাসুম ভাইকে পাওয়া যেত, মন্দ হতনা। কিন্তু কেমনে সম্ভব! উনি তো ক্যাম্পাসে। মনে মনে ওসব ভাবছি আর পা ফেলছি সামনে।

দাঁড়িয়ে আছি স্টেশনে। এইতো ট্রেন আসবে। মিনিট চারেক বাকি।
‘কিতারে কিতা খবর?
পেছন চেয়ে দেখি চয়ন দা। ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে পড়েন। এবার থার্ড ইয়ারে। টিউশন থেকে ফিরছেন।
‘অত্ত বালা আছি, আফনে?
‘বালা, বাড়িত কোনদিন যাইতে?
‘এখনও টিক নায়, বন্ধ অইলে যাইমুগি।
কথা বলছি। উনার সাথে উনার এক ফ্রেন্ড। উনার বাড়িও সিলেট। যদিও আগ থেকে পরিচয় ছিলনা। হঠাৎ দেখি মাসুম ভাই ও নাঈম ভাই আসছেন।  অবাকই লাগলো!  একটু আগে যা ভাবছিলাম, আর তা কিনা সত্যিই হয়ে গেল। একটা আলাদা ভাল লাগা কাজ করল। ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করিতেই ট্রেন চলে এলো।
সবাই ছোটাছুটি শুরু করছে সিট ধরতে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
‘ধাক্কাধাক্কির দরখার নাই। আমরা মালবগিত উটিযাই’ বলে সামনে বাড়লেন মাসুম ভাই। একসাথে মালবগিতে উঠে গেলাম সবাই।

বসার সিট না থাকায়  মালবগিতে সবাই ওঠেনা। তা ছাড়া এটাতো মালামালের জন্যই। সব সময় তো আর মালামাল থাকেনা! তাই সংগত কারণেই অন্যান্য বগির চেয়ে ফাকা থাকে।
নিজ নিজ সুবিধা মতো দাঁড়িয়েছে সবাই। আরও কয়েকজন ছিল আগ থেকে। চারজন পা লটকিয়ে বসেছে দরজায়। আরও দু’জন জুতো নিচে দিয়ে বসেছে। আমাদের সবাই মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে কথা চালাচালি করছে। সবাই আমার সিনিয়র। আবার দু’একজন ছাড়া সবার সাথে সম্পর্কটাও ওরকম না! সুতরাং দর্শক আর শ্রোতার ভূমিকায় আমি। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই খেয়াল করলাম গাঁজার গন্ধ! অন্ধকারে তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছেনা স্পষ্ট। নিচের দিকে তাকালাম। চলন্ত ট্রেনে রাস্তার নিয়ন  আলো ঝলক দিচ্ছে বজ্রপাতের আলোর মত। সাথে মোবাইল স্ক্রিনের সহযোগিতা নিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।
একজন সিগারেট টানছে একমনে। পাশের কয়েকজন হাতে কি যেন ঘষছে। বুঝতে আর বাকি থাকল না। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগলে দেখে যে, একজন একটান দিয়ে দিচ্ছে পাশের জনকে। ও আবার দিচ্ছে ওর পাশের জনকে। এরকমভাবে চক্রাকারে টানাটানা চলছে চারজনের মধ্যে। একটা শেষ করে আরেকটা শুরু।  আমার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
একবার মাসুম ভাইকে বললাম-
‘ভাই ইতা কিতা?
‘কুস্তা মাতিছনা, যেতা দেখরে ওতা।
সহ্য করতে না পেরে সরে বিপরীত দরজায় দাঁড়ালাম। চুপচাপ শুধু দেখেই যাচ্ছি।

ওরাও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। টিউশন শেষ করে বাসায় ফিরছে।
আহারে মা-বাবা কতই না স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। আর ওরা কিনা......!
ওসব ভাবতে ভাবতেই মনেপড়ে গেল সেদিনের ক্লাসের কথা। শাখাওয়াত স্যার ক্লাসে বলেছিলেন এক ছাত্রের কথা- সবার মত ভর্তি হয়েছিল সেও। ১ম বর্ষে ক্লাস নিয়মিত করলেও ২য় বর্ষ থেকে দেখা মেলেনি তেমন। কিন্তু ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি কিংবা রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে প্রায়ই চোখে পড়ে। ইতোমধ্যে ক্লাসসহ নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ায় বাতিল হয়েছে ছাত্রত্ব। একদিন ওর বাবার ফোন আসে।
কুশলবিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করেন ছেলের ব্যাপারে।
‘স্যার আজ অনেকদিন হয় আমার ছেলের কোনো খবর পাচ্ছিনা। ফোন দিলে ফোন বন্ধ পাচ্ছি। ওরে প্রতি মাসে ৩০০০ করে টাকা পাঠাতাম তাও দিতে পারছিনা। স্যার আমি দিনমজুর। আর পারছিনা। কখন আমার ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করে কিছু একটা করবে সে অপেক্ষায় আছি। অনেক কষ্টে আপনার নাম্বার জোগাড় করেছি। সেদিন সবার মত আমার চোখের কোণেও জমেছিল একফোঁটা জল।
‘কিতারে নামতে নানি?
মাসুম ভাইয়ের ডাক। বুঝলাম চলে এসেছি। নেমে হাঁটা ধরলাম। খেয়াল করলাম ডান দিক থেকে স্ট্রবেরির ঘ্রাণ আসছে। তাকালাম ডানে। এক আপুর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়া উড়ছে মুখ থেকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গিয়ে থামলাম জিরো পয়েন্টে। সাজিদ ভাইয়ের নাম্বার ডায়াল করতেই দেখি উনি সামনে দাঁড়িয়ে। খামটা হাতে দিয়ে আবার উঠলাম ট্রেনে।

মধ্যখানের বগি। জানালার পাশ দেখে একটা বগিতে বসেছি। ছেড়ে দিয়েছে ট্রেন। ক্যাম্পাস থেকে শহরমুখি হওয়ায় ভিড় নেই ততটা। কানে বাজছে শাটলেরর জানাশোনা সেই মিষ্টি গানের কলি। অনেকদিন থেকে একটা ছড়ার থিম মাথায় ঘুরঘুর করছে। ভাবলাম নামানোর এটাই মোক্ষম সুযোগ। পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। কয়েকলাইন লিখে অন্ত্যমিল  নিয়ে ভাবতে ভাবতে জানলা দিয়ে তাকালাম। বাহিরে অন্ধকার। আকাশটাও বেশ কালো। মেঘলা আকাশে একটা তারাও নেই। ঝাপসায় লুকোচুরি খেলছে মেঘেদের দল। যেন ঝকঝক ট্রেনের সাথে তাল মিলিয়ে দৌঁড়াচ্ছে ওরাও। অনেক খোঁজার পরও রূপোর থালাটার দেখাই পেলাম না। একটা ঝাঁকুনিতে ভাবনায় ছেদ পড়ে। বুঝলাম ব্রেক কষছে ট্রেন। বায়ে থাকাতেই চোখে পড়লো ষোলশহর স্টেশনের ফ্লাইওভার। হুঁ, তাইলে চলেই এসেছি। মোবাইলটা এখনও হাতে। স্ক্রিনে তাকালাম। ও, আমিতো ছড়া লিখছিলাম। দাঁড় করিয়েছিলাম এই ক’লাইন-
মন ভাল নেই লিয়ার;
মজনু এখন আগের মতো আর করেনা পিয়ার!
হয়না এখন আগের মতো রাত্তিরেতে চ্যাটিং
অনেক জোরের পরও লিয়া, চায়নি যেতে ডেটিং।
মনে ভীষণ ভয়-
কী থেকে কী হয়
দেখলে তাকে মজনু; পরে করতে পারে ব্রেক আপ
যে পিকগুলা হয় শেয়ারিং তা তো পুরো মেকাপ।

মোবাইলটা পকেটে ঠেলে দিয়ে হাঁটা ধরলাম। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, একটা ফোনকল উপহার দিয়েছে একটি ছড়ার। জন্ম দিয়েছে একটি গল্পের উপকরণ। অভিজ্ঞতার ঝুলির ওজন বাড়িয়েছে খানিকটা। সব মিলিয়ে এক চমৎকার রাত। কম কিসে !



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট