ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : পর্ব ১২



রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

(গত সংখ্যার পর)
আমি প্রাণভয়ে হাজারো গলি দিয়ে দৌড়াতে থাকি। এক সময় ধরা পড়ে যাই। ওরা আমাকে পাঁজাকোলা করে একটা পোড়াবাড়িয়ে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করছে আর নিরোপায় সব সহ্য করে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে ওরা প্লান করে, আমাকে মেরে ফেলবে। চাপাতি দিয়ে আমাকে টুকরো টুকরো করে মাংসপি-গুলো সারা শহরময় ছড়িয়ে দেবে। কাক-পক্ষীর খাদ্য বানাবে। অথবা মাংসগুলো প্যাকেটজাত করে কোনো রেস্তোরায় চালিয়ে দেবে। প্লান মোতাবেক ওরা যখন একটা নতুন গামছা আমার গলা দিয়ে ঠেসে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে, ঠিক তখনই সজাগ হয়ে যাই।
কী যে দেখছেন, সে-তো আপনিই আমাদের চেয়ে বেশি জানেন।
বেশি জানি বলেই বিপদ। শামুক জীবন বেছে নিতে হচ্ছে। তবে এটাও এক প্রকার ভালোই আছি বলা যায়। ঘরে বসে একাকি মরমিচর্চা কি চাট্টিখানি কথা? তোমরা চাইলে আরো দুটো গান শোনাতে পারি, শোনাবো?
একজন বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে অবুঝ শিশুর মতো এমন সরল আহ্বান শুনে আমাদের এক ধরনের অস্বস্তি লাগে। কেবলই পালাতে ইচ্ছে করে তখন। ইচ্ছে হয় আলো-বাতাস-রোদ সবকিছু থেকে পালিয়ে সূর্যের উল্টো পিঠে চলে যাই। যেখানে এসবের কিছুই চোখের সামনে পড়বে না। কখনো ইচ্ছে হয়, একটা লাথি এই গুমোট সময়টাকে সাত-সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে পাঠিয়ে দিই। পরক্ষণেই মনে পড়ে, কী ভাবছি এসব? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? এমনিতেই আমাদের সবুজ ছেলেরা অশুভ বাঁশির সুরে আসক্ত। কে কখন হারিয়ে যায় বলা যায় না। রশিদ চৌধুরীর যে-ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতে পড়তো, সে আজ তিন বছর ধরে নিখোঁজ। ফারুক ভূঁইয়ার মেজো ছেলে দু’বছর ধরে নিখোঁজ। আরমান ব্যাপারির একমাত্র ছেলে এক বছর নিখোঁজ থেকে সেদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়লো। পুলিশের বয়ান, সে নাকি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। আমরা এ-শহরের বাসিন্দা আজ পর্যন্ত কোনো উগ্রপন্থি দল আমাদের চোখে পড়েনি। তাদের কোনো নেতা-কর্মীরাও দাওয়াত নিয়ে আমাদের কাছে আসেনি। যা শুনি সবজান্তা পুলিশের মুখ থেকেই। আগেই বলেছি, পুলিশের মুখ থেকে শুনেই বিশ্বাস করতে হয় সব। এসব বাংলা-টিম, ইংরেজি-টিম, আরবি-টিমের সদস্যরাই নাকি অশুভ বাঁশির সুরে পাগল করে আমাদের ছেলেদেরকে অজ্ঞাতাবাসে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে চোরাবালির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশটাকেও।
এসব কথা কতোটুকু সত্য কিংবা কার স্বার্থে হচ্ছে এগুলো? কোনো কিছুই আমাদের মগজহীন মাথায় ঢোকে না। আসলে আছি তো অন্ধকারে, এজন্যই অন্ধকারের কোনো কিছু দেখতে পারি না। ঘটনাগুলো আলোতে ঘটলে ঠিকই বুঝতে পারতাম। কারণ, অন্ধকার থেকে আলোর সবটুকু দেখা যায়। কিন্তু অন্ধকারে থেকে অন্ধকারের কিছুই দেখা যায় না। তবে আন্দাজ করা যায়। ঘটনারও একটা গন্ধ আছে, সেটা অন্ধও টের পায়। আমরাও আন্দাজ করতে পারি পুলিশের সব কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, ‘কাজির খাতায় লেখা গোওয়ালে নাই’ বলে একটা কথা সমাজে বেশ চালু আছে। তারপরও অদৃশ্যের খবর বলে কথা। বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরের প্রমাণ না মিললেও কিতাবের লেখায় বিশ্বাস রাখতে হয়। না রাখলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাবে যে। এসব ভেবে মাঝে-মধ্যে হতাশ হয়ে পড়ি। মনে হয় এটাই বুঝি আমাদের নিয়তি। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, অন্ধকার যতো ঘনিভূত হয় ভোর ততোই নিকটে। নবজাত শিশু যেমন তার মাকে মৃত্যুর হিমঘরে ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ খুশিতে ভরে দেয় সব, তেমনি করে আমরাও হয়তো অন্ধকারের অচেনা-অজানা হাজারো বাঁকা গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে ভোরের দেখা পেয়ে যাবো। যে-অন্ধকার থেকে পিতৃপুরুষেরা বেরিয়ে যেতে পারেনি, আমরা হয়তো পারবো। এমন একটা ক্ষীণ আশা যখন বুকে বেঁধে অপেক্ষার প্রহর গোনার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই শুনি হঠাৎ পত্রিকার কাটতি বেড়ে গেছে। ঘটনা কী? পরে শুনি ইলেকশনের তফসিল ঘোষণা করেছে। লোকে বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। নির্বাচন মানেই অস্ত্রের মহড়া, হুমকি-ধুমকিতে মোবাইল ফাটা। মহল্লার অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াবে মৃত্যুর মিছিল। পোস্টারে পোস্টারে ঢেকে দেয়া হবে সব বঞ্চনার দাগ। সে সাথে আমাদেরও কাজ বেড়ে গেলো। চোখ খোলা রেখে পাঞ্জাবির ফ্যাশন শো দেখতে হবে আর কান খাড়া করে মাইকের পাবলিসিটি শুনতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও শুনতে হবে। কোমরের ব্যথায় মরে গেলেও সোজা হয়ে ওঠে ফ্যাশন শো’র মডেলদের সাথে কোলাকুলি করতে হবে। এর সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটলেই খবর আছে। আমি দেখি, লোকেরা কম চালাক না। ভোটের রেজাল্ট যে কী হবে তা জেনেও বিনা পয়সায় নুন চা পান করতে করতে বলে—ভাই, যদি হাত-পা নিয়া কোনো-মতে কেন্দ্রে যাইতে পারি, তাহলে মনে রাইখেন আপনি নিশ্চিত—। আমার ভাই তোমার ভাই—।
অভিনয় কাকে বলে? উহা কত ও কী কী? মহল্লার লোকদেরকে দেখলে অস্কারপ্রাপ্ত হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও লজ্জায় মিইয়ে যাবে।
লোকেরা অভিনয় করতে থাকে। সে-অভিনয় মিডিয়ায় প্রচারের জন্যে ঢাউস ঢাউস ক্যামেরা হাতে মিডিয়ার কর্মীরা ছুটে আসে। তাদের পেছনে ঘুর ঘুর করে। পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়। চ্যানেলের সূচক বেড়ে যায়। বড়ো পর্দা, ছোটো পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তখন দীর্ঘদিনের ছুটি পেয়ে বাসায় বসে বসে উকুন মারে। ক্যামেরার চোখ তখন কেবলই ভোটারদের দিকে। তারা কীসব বলাবলি করে? কোথায় কোথায় যায়? শুনতে চায়। চোখের ভেতর, জবানের ভেতর কী লুকিয়ে রেখেছে? দেখতে চায়। কিন্তু ভোটাররা কিছুই প্রকাশ করে না। কেবল অভিনয় করে। কারণ তারা জানে, ক্যামেরার পেছনেও ক্যামেরা আছে। উল্টা-পাল্টা বললেই খবর...
ভাবটা যেনো এমন—কী দরকার অসময়ে জবান খরচ করে বিপদ ডেকে আনার? তার চেয়ে অভিনয় করা সহজ। ক্যামেরার সামনে অভিনয় করবে, ক্যামেরা চলে গেলে যা ইচ্ছে বলবে। উত্তর কুরিয়ার মৃত্যুদানব প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে নাকি সে-দেশের লোকেরা আড়ালে-আবডালে মটকু ডাকে। খাতার পাতায় তাঁর ছবি এঁকে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তাতে থুথু নিক্ষেপ করে। পত্রিকায় খবরটা পড়ে মনে হলো, ওদের আর আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি দেখি আমাদের ভোটাররাও ক্যামেরার আড়ালে আমাদের সম্মানীত মটকু-মটকিদের নিয়ে অনেক বকাবকি করে। রাস্তার পাশে মটকু-মটকিদের ছবিযুক্ত ঢাউস ঢাউস ব্যানার-ফেস্টুন দেখে থুথু নিক্ষেপ করে। কেউ দেখে না। কেউ সামনে পড়লে সালাম দিয়ে ভালো মানুষের মতো পাশ কাটিয়ে চলে আসে। সেদিন তো প্রায় ধরা পড়েই যাচ্ছিলো। মর্নিং ওয়াক করে এসে কয়েকজন রহিম মিয়ার চা-দোকানে লবণ মেশানো আদা-চা খেতে খেতে সকালের পত্রিকায় চোখ রেখে বিশ্বরাজনীতির ময়না তদন্ত করছিলো। কেউ বলছিলো, মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুব করুণ। গণতন্ত্রের লেবাস পরে জান্তা সরকার যেভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, সভ্যতার চূড়ান্ত পর্যায়ে এমন নৃশংসতা কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। নোবেল কমিটির উচিত অং সান সুচির কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়া। কেউ বলছিলো, শুধু সুচির নয়, পুরস্কার কেড়ে নেয়া উচিত বারাক ওবামার কাছ থেকেও। সে এক আইএস অস্ত্র দিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে শেষ করে দিয়েছে। সিরিয়াকে এখন কোনো দেশ বলা যায় না। বড়োজোর ওটাকে রুশ-মার্কিনের যুদ্ধক্ষেত্র বলা যেতে পারে। তাদের কথা শুনে আব্বাস বলে, এতো কথা বলো না তো, আল্লা যা করে ভালোর জন্যই করে। বিশ্বের দরবারে মুসলমান জাতটাই খারাপ। মুসলমানরা এখন আগের জায়গায় নাই। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথ ছাইড়া তারা এখন অন্যের হাতের দিকে চায়া থাকে। শিয়া-সুন্নি-মুতাজিলাসহ নানা মত-পথে বিভক্ত হয়ে গোড়া কৃমির মতো নিজেরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করে মরে। এজন্যেই তাদের এতো সিদ্দত। আজাইরা মানুষেরে দুইষ্যা লাভ নাই। এদেরকে সাইজ করবার লাগি খোদা নিজেই আইএস পাঠাইছে।
আব্বাসের কথায় কামাল কিছুটা ক্ষ্যাপে যায়। সে বলে, ‘দুরু! বাদ দেও তো এসব। নিজেদের কথা কও। ভোটের দিন বাসায় থাকবা নাকি মহল্লা ছাইড়া পালাইবা। আমি নিয়্যত করছি, ভোটের আগের দিন থেকেই উধাও হয়ে যামু।’ তখন মুখ খুলে ক্লাবের সাবেক সম্পাদক রতন মাহমুদ। সে বলে, ‘মহল্লা ছাইড়া পালাবা ক্যান? বাসায় বইয়া বইয়া টিভি দেখবা। মটকু-মটকিদের অভিনয় দেখবা। আমাদের অভিনয় দেখবা। ক্যান আমাদের অভিনয় ভালো লাগে না?’ তারা তখন হাসে। কী যে কও মিয়া। ভাল্লাবো না ক্যান? ভাল্লাগে। সবই ভাল্লাগে। এই যে রহিম মিয়া প্রতিদিন সকালে দোকান থিকা বাইর অইয়া ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবাইস’ বলতে বলতে উন্নয়নের ফিরিস্তি লেখা সাইন বোর্ডের গোড়ায় যায়া পেশাব করতে বয়, এই দৃশ্যও তো আমাদের ভাল্লাগে।
এসব নিয়ে যখন তারা হাসাহাসি করছিলো, ঠিক তখনই কয়েকজন সহযোগিসহ এক ক্যান্ডিডেট তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং তার কর্মীরা প্রত্যেকের হাতে হ্যান্ডবিল বিলি করতে থাকে। ছবিযুক্ত হ্যান্ডবিলে এক নজর তাকিয়ে তারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার সাথে হাসি মুখে কোলাকুলি করে। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে, ‘আল্লা তোমার হায়াৎ দারাজ করুক এবং শরীর-স্বাস্থ্য ভালো রাখুক।’ কারণ তারা জানে, তার বিজয় নিশ্চিত। সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে খুনের হুমকি দিয়ে মহল্লা তো মহল্লা একেবারে শহর ছাড়া করে দিয়েছে। পুলিশ এসে দিন-রাত ঘুরে বেড়ায়। নিখোঁজ প্রার্থীর কোনো সমর্থক চোখে পড়লেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আতঙ্কে তাদের প্রচার তো দূরের কথা ছায়া পর্যন্ত তারা দেখতে পায় না। এখন সে বিজয়ী হয়েই তাদের কাছে এসেছে। এখন কেবল নির্বাচন কমিশনের মুখের ডিক্লিয়ারটা বাকি। আর সেটা শোনার বা শোনানোর জন্যে এই অভিনয়। ভোটাররাও কম যায় না। অভিনয় করে তারাও বলে, এগিয়ে যাও আমরা আছি...। খুশি হয়ে সে চলে যায়। সে চলে যেতে-না-যেতেই  রহিম মিয়া এক কাজ করে বসে। সবার হাত থেকে হ্যান্ডবিলগুলো নিয়ে চুলার ভেতর ঢুকিয়ে দেয় আর মুখে বলে, ‘হে তো পাশই এবং আগামী পাঁচ বছর তার কাছ থেকে আমরা কোনো সুবিধা পামু না। তাই হ্যান্ডবিল পুড়িয়ে লাকড়ি দুইড্যা বাঁচাইলাম আর কি। আপনেরা কী কন?’ তারাও তার সাথে দোহা টেনে বলে, ‘ভালো ভালো। একটা কাজের কাজ করেছো তুমি।’ ভাগ্যের কী খেলা। কথাটা বলে শেষ করতে পারেনি। ঠিক তখনই ক্যান্ডিডেটের এক কর্মী আবার তাদের সামনে যেয়ে উপস্থিত। ‘কী ব্যাপার কুদ্দুস! আবার কেনো?’ ভয়ে নাকি কেরামত কাকার ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে কাঠ।
চাচা, ভুলে এখানে এক বান্ডিল পোস্টার রেখে গিয়েছিলাম। নিতে এসেছি।
তারা তখন দোকানের ভেতর চোখ ঘোরায়। দেখে, বান্ডিলটা রাহিম মিয়ার চুলার ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলছে। সর্বনাশ! এ-দৃশ্য কুদ্দসের চোখে পড়লে খবর আছে। সাথে সাথে তারা কয়েকজন সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে চুলাটাকে আড়াল করে রাখে। কিন্তু কাগজ পোড়ার গন্ধ তো কোনো-মতে দূর পারে না। সে-ভয়েই তাদের হাত-পা এক প্রকার কাঁপতে ছিলো। তবে আল্লার কি মর্জি, সে তার মুখের ভদকার গন্ধের কারণে বুঝতে পারেনি। কয়েক সেকেন্ড এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে চলে যায়। তারাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এমনি নানা দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে একদিন দোর-গোড়ায় এসে কড়া নাড়ে ভোটের সকাল। যারা বেরোবার তারা বেরিয়ে পড়ে রাতেই। রাতে চলে আশ্চর্য কেনা-বেচা। বোধ-আত্মা-বেঁচে থাকা সব বিক্রি হয়ে যায় অমাবস্যার বাজারে। বিক্রি হয়ে যায় বঙ্গোপসাগরে এতোদিনের জমানো জলের ঘূর্ণিও। ব্লেডের মতো ধারালো নীল আলোর শপিং মলে বেচা-কেনা চলে লোভ-লালসা-হিংসা-জিঘাংসার মতো প্রিজর্ভেটিভমাখা পণ্যগুলিও।
আমরা তখন ঘুমোই। সে-রাতে আমরা কোনো স্বপ্ন দেখি না। কেবল মরা লাশের মতো বিছানায় শুয়ে থাকি। এটাই ছিলো অঘোষিত আদেশ। আমরা পালন করি অক্ষরে অক্ষরে। সকাল দশটা বেজে যায় তারপরও দরজা খুলি না। কারণ আমরা জানি, আমরা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও ভোটবাক্স অপূর্ণ থাকবে না। দেবতাদের দৈবিক ক্ষমতায় সকাল দশটা কি সাড়ে-দশটার ভেতরেই বাক্স পূর্ণ হয়ে যাবে। শুধু আজকের জন্যে ক্যামেরার সামনে আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দেবতাদের খাসভক্তবৃন্দের মাধ্যমেই ক্যামেরার দৃষ্টি সীমানা পরিপূর্ণ। আজকের জন্যে তাঁরাই যথেষ্ট। আমাদের কাজ শুধু গৃহবন্দি থেকে টিভিতে তাঁদের অভিনয় দেখা। টিভি ছেড়ে অভিনয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। সব চ্যানেলে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে—’, ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না—’ ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা—,’ ইত্যাদি দেশাত্মবোধক গান চলতে থাকে। দশটা-এগারোটা-বারোটা বাজে কোথাও খবর নেই।
তবে পায়ের চলার পথে সারিবদ্ধ বুটের আওয়াজ। কাঁদানি গ্যাসের ঝাঁজ। অক্ষমের বিলাপ। এসব সিম্পটম থেকেই আমরা আন্দাজ করতে পারি শহরের অলি-গলি খবরে ঠাসা। কিন্তু টিভিতে কিছুই দেখানো হচ্ছে না। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। ইন্টারনেটও বন্ধ। কোনোভাবেই খবরের জগতে ঢোকার সুযোগ নেই। তার মানে বিকেল চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিকেল চারটায় দেবতারা মর্তে আবির্ভূত হবেন। আমরা দেব-দেবী দর্শনে ধন্য হবো। তখন ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। বিজয় মিছিল করতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও মিছিলের পেছনে পেছনে হাঁটতে হবে। মিছিল যাবে শক্তির উৎস সূর্যভবনের সামনে। আমরা সেখানে গিয়ে জড়ো হবো। মহাদেব-মহাদেবী ভাষণ দেবেন। আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনবো। আবেগে চোখের জল ফেলবো। তবেই না আমাদের পরিত্রাণ।
(চলবে)



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট