আয়না

 


আয়না

হেমন্ত হাসান 


বাস থেকে নেমে আমি একটা রিক্সা নিলাম। অনেক দিন পর আজ আমি নিজের বাসায় যাচ্ছি। হ্যাঁ, অনেক দিন পর, প্রায় এক বছর। গত এই এক বছরে পরিবারের কারো সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি জানিনা বাসার সবাই কেমন আছে? তারা নিশ্চই আমার জন্য ভীষণ অপেক্ষা করে আছে। মা, ছোটবোন তুলি,  আমার পাঁচ বছরের কন্যা রুহী আর রূপা। রূপা- আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। না জানি বেচারি এই একটা বছর আমাকে কত খুঁজেছে!  না জানি কত রাত না খেয়ে থেকে থেকে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরেছে! যা কাঁদতে পারে মেয়েটা! খুব সামান্য কারনেই কেঁদে ফেলে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এই কান্নাটাই খুব ভালো লাগত আমার। রূপা একটু কাঁদলেই আমার চোখেও জল এসে টলমল করতে থাকত। তারপর রুহীর জন্মের পর থেকে রূপার কান্নাকে আমার অকারণ আদিখ্যেতা মনে হতে লাগল। একটা মেয়ে যে কিনা নিজেই একটা সন্তানের মা, সে কেন অতি তুচ্ছ কারণে ক্যাচ ক্যাচ করে কাঁদবে?

আমার মেয়ে রুহীও জন্মের পর ছয় মাস খুব কান্নাকাটি করেছে। এত বিরক্ত লাগত আমার! সারাদিন অফিস করে রাতে ঘরে এসে শান্তিতে একটু ঘুমানোর উপায় ছিল না। এই নিয়ে খুব রাগারাগি করতাম আমি। আহারে! ছয় মাসের শিশু, কথা বলতে পারেনা, কান্নাই যার সকল অনুভূতির ভাষা; কত অসহায় সে, আর আমি কিনা ওর উপরে রাগ করতাম! ভাবতেই আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি রিক্সাটাকে একটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড় করাতে বলি। রিক্সাওয়ালাটির হাতে এক কাপ লেবু চা ধরিয়ে দিয়ে আমি একটা সিগারেট ধরাই। এটা আমার পুরনো অভ্যাস। কোন কারণে বুকে একটু দুঃখ অনুভব হলেই আমি সিগারেট খাই। সিগারেট একেবারে পছন্দ নয় রূপার। 


কত বার এ নিয়ে মান-অভিমান হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে- কিছুতেই কিছু হয়নি। সিগারেটে প্রথম টানটা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার  মনে হলো, কাজটা ঠিক হলো না। আজকের দিনে অন্তত নিকোটিনের গন্ধ গায়ে মেখে রূপার কাছে না গেলেই পারতাম। কিংবা রুহী যখন আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পরবে, বাবা বলে ডেকে আমার গালে চুমু খাবে তখন সিগারেটের গন্ধটা ওর কাছে বিশ্রী লাগবে না? পরক্ষণেই আবার মনে হলো, ধুর! এতদিন পর সবার সাথে দেখা হবে- সবাই নিশ্চই আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরবে, আলাদা করে আমার গায়ের গন্ধ নিয়ে নয়। 

এই এক বছর আমি কোথায় ছিলাম, কেন ছিলাম, কেমন ছিলাম, কেন কেউ আমার কোন খোঁজ পায়নি- সেসব যখন আমি বাসায় গিয়ে সবার কাছে বলব, নিশ্চই সেসব শুনে এবং আমাকে ফিরে আবার অশেষ আনন্দে সবাই হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। দিক। আজ আমি আর রাগবো না। ঐ কান্না তো আমাকে ভালোবেসেই বাড়বে। প্রত্যেককে বুকে চেপে সেই কান্নায় আমি নিজেও বিলীন হয়ে যাব। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার আবার চোখে পানি এসে যেতে থাকে। কি আশ্চর্য! আজ আমি নিজেই কাঁদছি নাকি! 

সদর দরজায় ছিটকিনি খোলা। আমি নির্দ্বিধায় বাসার ভিতরে ঢুকে গেলাম। কোন সঙ্কোচ নেই আমার, বরং বুক ভরা উত্তেজনার বারুদ।এটা আমার নিজের বাড়ি! বাড়ি জুড়ে কোথাও কারো কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সবাইকে চমকে দেব বলে আমিও কারো নাম ধরে ডাকব না ভাবলাম। বাসার চারটা রুমের তিনটার দরজাই হা করে খোলা। একটা ঘরের দরজা শুধু অল্প করে ভেজানো। আমি সবগুলো খোলা রুম ঘুরে এলাম। নেই, কেউ নেই। মা, রুহী, রূপা সবাই গেল কোথায়! এমন হতে পারে মা আর তুলি রুহীকে নিয়ে পাশের বাসায় গেছে, কিংবা মোড়ের দোকানে। আর রূপা নিশ্চই অন্য ঘরটিতে একটু ঘুমিয়েছে দুপুরে ভাত খেয়ে। দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়া ওর পুরনো অভ্যাস। 

কী করতে হবে আমি এক মূহুর্ত ভেবে নিলাম। প্রথমে দরজাটা খুলতে হবে নিঃশব্দে যেন তার ঘুম ভেঙে না যায়। তারপর ওর কপাল ছুঁয়ে আলতো স্বরে ডেকে ওর ঘুম ভাঙাতে হবে। ঘুম ভেঙে তাকিয়েই যখন সে আমায় দেখবে, কেমন হবে তখন? নিশ্চই তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হতে চাইবে না। হুড়মুড় করে উঠে বসবে বিছানায়। তারপর হাউমাউ করে বুকে ঝাঁপিয়ে পরবে? আমি তাকে বুকে ধরে রাখব শক্ত করে। আদর করে চুমু খাব তার কপালে। উত্তেজনায় আমার ঘাম হতে থাকে! 

খুব সাবধানে আমি দরজাটা খুললাম। আমার সামনে অনন্য সুন্দর এক দৃশ্য ফুটে উঠল। ঘরের ভেতর  অল্প আলো। একটু করে খুলে রাখা জানালার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে শুয়ে আছে বিছানার মাঝামাঝি। হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে প্রায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রূপা। তবু এই অল্প আলোতেই আমি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি। রূপা ঘুমুচ্ছে। তার আঁচল খসে পড়েছে বিছানায়। নাভীতে এসে মিশেছে অপরাহ্নের আলো। সেই আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে ভালো করে আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি রূপার দিকে হাঁটি। কাছাকাছি যেয়ে রূপার মুখের দিকে তাকাতেই আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। ভয়াবহ বিষ্ময় এবং দুঃখ নিয়ে আমি দেখতে পাই রূপার গলাটা জবাই করা! আমার নিজের গলা শুকিয়ে আসতে থাকে। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে থাকে আমার। আমি রূপার পাশে বসি। তার মাথাটা কোলে তুলে নিই। তারপর হাত রাখি তার গালে এবং চিবুকে। আমার আঙ্গুলে রুপার রক্ত লেগে যায়। আমি স্পষ্টত অনুভব করি, সেটা এখনো উষ্ণ। সারা ঘরে আমি কোন আয়না দেখতে পাইনা। ঘরে কোন আয়না থাকলে, আমার ঠোঁটের কোণে কোন হাসি ফুটে উঠেছে কিনা- হয়তো আমি তা দেখতে পেতাম!                                    



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট