মানুষ নয়, সংখ্যা!

 


মানুষ নয়, সংখ্যা! 

প্রিন্স আশরাফ


কীসের শব্দ মা? গাজা উপত্যকার সুজায়ার ছোট্ট একটি ঘরে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে চার সন্তান। প্রশ্নটা সবচেয়ে ছোটজনের। মা জবাব দেন না। একমনে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকেন। আরেকটি শব্দ। আরো কাছাকাছি। আরো কানফাটানো। ছোটজনের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিতে মা এবারে ফুঁপিয়ে ওঠেন। শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন কোলে। খালি পেটে ঘুমের ভান করে থাকা অন্য তিনজন মাকে জ্বালায় না। অসহনীয় শব্দ থেকে রেহাই পেতে চোখের পাশাপাশি যেন নিঃশ্বাসটুকুও বন্ধ করে রাখে। দুদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। পানি আসছে না কলে। ঘরে একদানা খাবার নেই। কিছুক্ষনের জন্য সব শান্ত। অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট। প্রার্থনায় ফলে যাওয়ায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মার চোখ ভিজে ওঠে। আহা রে! আরেকটি দিন! আরেকটি সূর্যোদয়! সন্তানেরা দেখবে আরেকটি সকাল। হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। বাচ্চারা আবার স্কুলে যাবে। খেলা করবে বাসার সামনে। দুষ্টুমি করে মায়ের বকুনি শুনবে। ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরুর কথাও ভাবছেন মা। একটু যেন শীত শীত লাগছে। ছোট্ট বাচ্চাটার গায়ে একটা জীর্ণ কম্বল জড়িয়ে দেন মা। মা, যুদ্ধ কি শেষ? ছোটজনের প্রশ্নের উত্তর ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি। সব কটি সন্তানই চোখ মেলে চেয়ে আছে ধেয়ে আসার আলোর দিকে। আর কোন প্রশ্নে মাকে বিব্রত হতে হয় না। সব প্রশ্ন আর পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে গেছেন তিনি। জাতি সংঘের কর্মকর্তাদের মৃত্যুখাতায় আরো পাঁচটি সংখ্যা যোগ হয়। 

যুদ্ধ দু’পক্ষের ব্যাপার। এক পক্ষ জেতে। সুতরাং আরেকপক্ষকে পরাজিত হতে হয়। আসলে পরাজিত হয় মানুষ। ভূলুন্ঠিত হয় মানবতা।

    রাষ্ট্র অনেক বড় ব্যাপার। অনেক বড়। অনেক বড় তাদের স্বার্থ। অনেক বড় বড় তাদের পা। রাষ্ট্রযন্ত্রের বড় বড় পায়ের নিচে পড়ে থেতলে যায় ক্ষুদ্র মানুষ। থেতলে যায় মানবতা।

জাতিসংঘের হিসাবে হতাহত হয় সংখ্যায়। যুদ্ধে মরে সংখ্যায়। সাতশ বা হাজার মরে। নিহত নয়শ। সংখ্যা মরে। ওই সাতশ বা হাজার তো কোন বিমুর্ত সংখ্যা নয়। সাতশ বা হাজার মানুষ। শিশু, বৃদ্ধ, নর-নারী। মানুষ।

     একজন মানুষ। তার চোখ, মুখ, নাক, কান সবই আছে। আছে শরীর। আছে মন। আছে জন্মের ইতিহাস। তাদের প্রত্যেকে জন্মের সময় বাড়িতে উৎসব হয়েছে। প্রত্যেকে যখন হাটিহাটি পা পা করেছে, বাড়িতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেছে। প্রত্যেকের মনে আছে এক আকাশ স্বপ্ন।

       হামাস তাদের দিকে রকেট ছুড়ছে এই অভিযোগে তারা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছে। হামাস যুদ্ধবিরতি মেনে চললেও ইসরাইল গাজা ভুখন্ড অবরোধ অব্যহত রাখায় গত  তারা যুদ্ধবিরতি থেকে সরে আসে।  গাজায় শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার শুরু করে ইসরাইল বাহিনী। শুরু হয় তান্ডবলীলা। ঘন্টায় ঘন্টায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। নিহত হাজার ছাড়িয়েছে। আহতও পাচ সহস্যাধিক। গাজার পালামের্ন্ট ভবন মন্ত্রণালয় মসজিদ স্কুল বিশ্ববিদ্যায়লয় হাসপাতাল এমনকি হাসপাতালের এম্বুলেন্স পর্যন্ত হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে নিরীহ বেসামরিক ফিলিস্তিনি নারী শিশুদের হত্যা করছে। ইসরাইলের কথিত হামাসের ৭০টি রকেট হামলায় ইসরাইলী সরকার চারজন সেনাসদস্যের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। আর হামাসের অবকাঠামো ধ্বংসের নামে এ পর্যন্ত হাজার খানিক মৃতের খবর জানিয়েছে সরকার। তার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু। চারদিনের শিশুও বাদ যায়নি বর্বেরের হাত থেকে। পুরানো কৌতুক’ই নতুন করে মনে পড়ে যায়।

    এক বার এক মেষশাবক মানে ভেড়ার বাচ্চা ঝরনার পানি খাচ্ছিল। এলো এক নেকড়ে। নেকড়ের নজর পড়ে যায় ভেড়ার বাচ্চার দিকে। ভেড়ার বাচ্চাকে নেকড়ে খাবে। কিন্তু বিনা ভূমিকায় খায় কি করে? ‘হেই ভেড়ার বাচ্চা, তুই আমার পানি ঘোলা করেছিস কেন? তুই আমার দিকে রকেট হামলা চালিয়েছিস কেন?

      ‘হুজুর, আপনি উজানে আমি আপনার ভাটিতে, আমার পক্ষে আপনার পানি ঘোলা করা অসম্ভব। বরং সত্যি কথা বলতে কি , আপনিই আমার পানি ঘোলা করেছেন। আপনি যুদ্ধ বিরতি না মেনে আমাদের উপর হামলা চালিয়ে আসছেন।

    ‘তাহলে গত বছর তুই আমার পানি...। যুদ্ধবিরতির আগে তুই হামলা চালিয়েছিল।’

     ‘হুজুর, তখন তো আপনারাও। দুঃখিত যে এ অভিযোগও সত্যি নয়। গত বছর আমার জন্মই হয়নি।’

    ‘তাহলে গত বছরে তোর বাপ আমার পানি ঘোলা করেছিল। এখন বোঝ তার শাস্তি। আমি যখন বলেছি তোরা শান্তির বিপক্ষে। তো বিপক্ষেই। এখন আমরা শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধারের নামে তোদের ধুলোয় মিশিয়ে দেব। নাম নিশানা মুছে ফেলব।

    খলের ছলের অভাব নেই। নেই ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের ওজরের অভাব। ক্ষমতাশালী যাকে খেতে ইচ্ছে  করবে, খাবে। পিষতে ইচ্ছে করবে, পিষবে

     ফিলিস্তিনীদের উপর চলমান সংহিসতা বন্ধের ব্যাপারে প্রথমেই আসে জাতিসংঘের কথা। কিন্তু  বরাবরের মতই জাতিসংঘ ঠুটো জগন্নাথ। যদিও জাতিসংঘ ইসরাইলকে সর্তক করে দিয়েছে। বলেছে এটা মানবতার বিপর্যয়ের দিকে গড়াচ্ছে। ইসরাইল জাতিসংঘের সর্তকতা থোড়াই কেয়ার করে চালিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ। বিষ নেই তার কুলোপনা চক্কর। আমেরিকা সাথে থাকলে জাতিসংঘ ঘোড়ার ঘাস কাটবে? কবি শামছুর রহমান যথার্থই বলেছেন- 

জাতিসংঘ পরিণামহীন দেবতার মত

                   ডানা ঝাপটায়, শূন্যতায়!

গাধা যখন মোট বয়, তখনো যেমন গাধা, যখন বোঝা নামিয়ে রাখে তখনো সে গাধা। কথাটা ইসরাইলের বেলাতেই সমান সত্য। কথাটা ইসরাইলের বেলাতেও সমান সত্য। যখন যুদ্ধে নামে আর যখন শান্তির কথা বলে, তখনো তা সমান আগ্রাসী।

    খুনের অভিযোগে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একজনের কাছে বিচারক জানতে চাইলেন, সে খুন করেছে কি না?’

     অভিযুক্ত উত্তর দিলেন, ‘আমি একজন শান্তি প্রিয় মানুষ।’

     আদালত খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বীকার করলেন, খুনটি তিনি করেছেন। বিচারক বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন- তারপরও আপনি বলতে চান আপনি শান্তিপ্রিয় মানুষ। ‘খুন হওয়ার পর লোকটি আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গিয়েছিল ধর্মাবতার অভিযুক্ত উত্তর দিল।

    একটি স্কুল। বাচ্চাদের। স্কুলের লাগোয়া পার্ক। শিশুরা খেলছে। একদল খুদে খোকাখুকু। তাদের নরম গাল। মাথাভরা ঝাকড়া চুল। মায়াভরা বড় বড় চোখ। সেকি ছোটাছুটি। হৈচৈ।

    ঠিক তখনই অকম্মাৎ আকাশে একটা প্লেন দেখতে পায় তারা। হৈচৈ করে তারা প্লেন দেখতে আকাশের দিকে তাকায়। ছোট্ট একটা বোমা ছুড়ে দিয়ে প্লেনটা বিন্দুর মত মিলিয়ে যায়। চোখের পলকে। বোমাটা নিচের দিকে নামছে। শিশুদের দিকে। পার্কের দিকে। বিকট শব্দ। মুহুর্তে সব কিছু নেই হয়ে গেল। হৈচৈ নেই। ছোটাছুটি নেই। এক শিশুর আরেক শিশুর পিছনে ধাওয়াধায়ি নেই। নরম গাল নেই। মায়াভরা বড় বড় চোখ নেই। ওই পার্কের ঝাকবাধা শিশুরা নেই। পাখি পতঙ্গ পুষ্প শিশু কিছুই নেই। শুধু মৃত্যু, শুধু মৃত্যু।

     গাজায় ইসরাইলিদের হামলা নিহতদের অর্ধেক নারী ও শিশু। প্রায় তিনশতের উপর শিশু এ পর্যন্ত এই হামলায় মারা গেছে। ওরা জানে না কি ওদের অপরাধ।

     পাপড়িটা বড় বোকা

     কোৎ করে গিলে ফেলে মৃত্যু।- সুমন চট্টোপ্যাধায়ের গানের পাপড়ির মতো বড়দের বোকামিতে নিষ্পাপ শিশুগুলি কোৎ করে মৃত্যু গিলে ফেলছে।

     সদ্যজাত চারদিনের শিশুও বাদ যায়নি। মায়ের কোলে এসে বাহাত্তর ঘন্টা পেরুতে না পেরুতেই দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নিল শিশুটি। ইটালির প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি বলেন- ‘আমার ভেতরের ভ্রণটিকে আমি বলেছি, প্রিয় শিশু, জীবনটা হচ্ছে যুদ্ধ। নিরন্তর যুদ্ধ। জানতে চেয়েছি এই পৃথিবীতে সে জন্ম নিতে চায় কি না।  সে বলেছে, ‘নরকে যাও তুমি মা। আমি আর জন্ম নিচ্ছি না।’

   আমার ভাগ্নে পোকা-মাকড় নিয়ে খেলা করে। একদিন সে পায়ের তলায় একটা টিকটিকি পিষে মারছিল। আমি দেখতেই আমাকে বলল, ‘দেখ ছোটমামা, টিকটিকি কত বদমাশ, লেজ নাড়ছে।’

    যে পিষে মারে সে না জানলেও যে পিষ্ট হচ্ছে সে জানে যে লেজ নাড়ে আনন্দে নাকি বেদনায়।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট