ভ্রমণকাহিনী : পর্ব : ০৩ : মুর্শিদাবাদ- পথে প্রান্তরে ইতিহাস...

 


মুর্শিদাবাদ :
পথে প্রান্তরে ইতিহাস...

মাজরুল ইসলাম


[গত সংখ্যার পর...] 

                        মরীচা: মুঘল শাসন আমলে নদী কেন্দ্রিক প্রাচীন নগর। সভ্যতার ও নাগরিক  চেতনার বিকাশ গড়ে উঠেছিল। শিয়ালমারি, জলঙ্গি ও ভৈরব নদী কেন্দ্রিক বিকাশের অনেক প্রমান পাওয়া যায়। ভৈরব নদী নির্ভর যাতায়াত ছিল গৌড় থেকে সাতগাঁও পর্যন্ত। ভৈরব শিয়ালমারি ও জলঙ্গি নদীথথ এই নদীগুলোর উৎস মুখ পদ্মা এখনও। সুলতানি বা মুঘল শাসন আমলে সাতগাঁও শাসনের জন্য সুতি, লালগোলা, ভগবানগোলা, চুনাখালি স্থলপথে অথবা ভাগীরথী- ভৈরব জলপথে যোগাযোগ করত। সম্রাট আকবর পর্যন্ত সাতগাঁও যেতেন ভৈরব নদীর বুক বেয়ে। এছাড়া সুলতানী আমলেও এই নদীগুলোই যাতায়াতের একমাত্র প্রধান উপায় ছিল। প্রতি প্রতিক্ষার স্বার্থে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা ছাউনি গড়ে তুলেছিলেন। মরীচা সেনা ছাউনি তার মধ্যে অন্যন্য। শিয়ালমারি নদী ও পদ্মা নদীর কাছাকাছি ছিল মরীচা। প্রশাসনিক দপ্তর গড়ে ওঠার কারণেই মরীচা, মৃদাদপুর ও আমিরাবাদ বিভক্ত হয় এবং পৃথক জনপদ গড়ে ওঠে। সেনা প্রশাসকদের বসবাসে আমিরাবাদ এবং প্রাত্যহিক সেনা মহড়ার জন্য মৃদাদপুর গ্রাম দুটোর নাম স্মরণ করিয়ে দেয়। মরীচা ও মৃদাদপুরের পূর্বে শিয়ালমারি নদী। উত্তরে আলাইপুর মরীচা জলঙ্গি প্রাচীন সড়কপথ। পরিখার ধারে মসজিদ সমর বিভাগে নিযুক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের নামাজ পড়ার প্রমাণ। এই মসজিদটির নাম ছিল ‘চৌকী’ মসজিদ। মরীচা সামরিক ছাউনির কারণে ও সামরিক লোকজনের প্রয়োজনে সংলগ্ন এলাকায় হাট বাজার এবং সুপরিগোলায় একটি বানিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল। জনরব, মরীচায় কড়িয়ালদের বসবাস ছিল। প্রসঙ্গত, প্রাচীন মরীচা জনপদেই ভাষা বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আবদুল হাই জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন মরীচা পদ্মায় ভেঙে গেলে নতুন করে মোল্লাডাঙ্গা সেখপাড়া পাকা সড়কের দক্ষিণে মরীচা গ্রাম এখনও বিদ্যমান। প্রাচীন কালে নদী কেন্দ্রিক যাতায়াতের সুবিধার্থে মরীচা সেনা ছাউনি, সুপরিগোলায় শস্য ভান্ডার এবং টাঁকশাল গড়ে উঠেছিল।


                    মুর্শিদকুলী খাঁ: নবাব জাফর আলী খাঁর পূর্ব নাম ছিল করতলব খাঁ। ইতিহাস খ্যাত নাম মুর্শিদকুলী খাঁ। তিনি ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর নগর (ঢাকা) থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মুর্শিদাবাদে। তাঁর অনেক কীর্তির মধ্যে কাটরা মসজিদ। শুধু তাই নয় তিনি ঢাকা (জাহাঙ্গীর নগর) নগরীতে আরও একটি মসজিদ ও বাজার নির্মাণ করে ছিলেন। উক্ত মসজিদটি ‘জাফরী’ মসজিদ নামে খ্যাত। ইহা ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর উত্তরসূরি গুজনফার হুসেন খাঁর কন্যা হাজি বেগমের তত্ত্বাবধানে দেন। মসজিদটি আকারে বিশাল। এই মসজিদ নির্মাণ কৌশল অতি চমৎকার। মসজিদটি বেগম- বাজারের মসজিদ নামে পরিচিত।


                 মুর্শিদকুলী খাঁ ১৭০৪ সালে কাসিম বাজারে টাঁকশাল স্থাপন করেন। কাসিম বাজারে কোন স্থানে এই টাঁকশাল ছিল তা আজ চিহ্নিত করা যায় না। এক বছর পর কাসিম বাজার থেকে সরিয়ে মহিমাপুরে রাজকীয় টাঁকশাল স্থাপন করলেন। এবং এই টাঁকশালের পুরো দায়িত্বে রাখলেন মানিক চাঁদ তথা শেঠেদের উপর। এদেরই চক্রান্তে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়।


                    সম্রাট ওরঙজেব প্রধান কানুনগোর ক্ষমতা হ্রাস করে এবং সুবাদার বা নাজিম থেকে দেওয়ানকে আলাদা করে বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য হায়দ্রাবাদের দেওয়ানী দপ্তরের দক্ষ হিসাবরক্ষক মহম্মদ হাদীকে করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে মুখসুদাবাদ প্রদেশের ফৌজদার ও সুবা বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যাকে সুবা বাংলা বলা হত। তিনি প্রথমে আসেন তৎকালে সুবার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে। আজিম উসসানের বিদ্বেষ বাড়তে থাকলে  মহম্মদ হাদী মুখসুসাবাদের ভাগীরথী তীরে কুলোরিয়াতে বসবাস এবং দেওয়ানখানা গড়ে তুলেন। ভারত সম্রাট আরঙজেবের অনুমতিক্রমে তাঁর নামে রাজধানীর নাম করলেন মুর্শিদাবাদ। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ অক্টোবর মুর্শিদকুলী খাঁ হন বাংলা সুবার সুবেদার এবং তাঁর সুতামন-উল-মুলুক আলা উদ্ দৌলা, জাফর খাঁন বাহাদুর নাসির, নাসির। মহম্মদ হাদীর সঙ্গে এসেছিলেন মহিমা পুরে মানিক চাঁদ, দর্পনারায়ন ডাহাপাড়ায় এবং ভট্টবাটিত জয় নারায়ন তখন থেকে মুর্শিদাবাদ জাঁকজমক রূপ পেল। এই কুলোরিয়াতে নিজ প্রাসাদ, দরবার হল সবই ছিল। চেহেল সেতুন নাম দিয়েছিলেন। ১৭০৪-১৭২৭ পর্যন্ত চেহেল সেতুন ছিল সুবা বাংলার নবাবদের বাসস্থান।

                    চেহেল সেতুন: ভাগীরথী তীরে কুলোরিয়া নামক স্থানে চল্লিশটা স্তম্ভের উপর নির্মিত দরবারখানা। ১৭০১সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার প্রধান দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি রাজস্ব আদায়ে দক্ষ ছিলেন বলে রাজস্ব আশাতীত বেড়ে যায়। তাঁর নির্মিত চেহেল সেতুন আজ আর চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন ইতিহাসের পাতায়। এটি একটি নবাবদের বাসোপযোগী সুদৃশ্য প্রসাদ। ১৭০৪-১৭২৭ প্রায় ২৫ বছর চেহেল সেতুন ছিল সুবা বাংলার নবাবদের বাসস্থান। বাংলার রাজধানী ছিল জাহাঙ্গীরনগর। ১৭০৪ সালে সেখান থেকে মুকসুসাবাদে রাজধানী তুলে এনেছিলেন। তাঁর নামানুসারে হয় মুর্শিদাবাদ। অবশ্য মুর্শিদাবাদ নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মতের প্রচলিত আছে। মুর্শিদকুলী খাঁ  এখানে আসার পর যে বিশাল বিশাল প্রাসাদ, ইমারত, কেল্লা, দরবার গৃহ প্রভৃতি নির্মাণ করলে মুখসুসাবাদ বা মুর্শিদাবাদ অজগাঁ থেকে শহর বা রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। নবাবও নেই আর সেই জৌলুসও নেই। চেহেল সেতুনের পাশেই মুর্শিদকুলী খাঁর মহিষী নৌসেরীবানু বেগমের একটি মসজিদ ও তার মধ্যে নৌসেরীবানু বেগমের সমাধি আছে। মসজিদটি নির্মাণ করেন ১৭১৮ সালে নৌসেরীবানু বেগম। মসজিদটির নাম কেউ বলে নৌসেরী বানুর মসজিদ আবার কেউ বলে বেগম মসজিদ। মসজিদটি বিলুপ্তের পথে।


                    কাটরা মসজিদ: মুর্শিদাবাদ শহরের অন্যতম আকর্ষণ কাটরা মসজিদ। নগরীর মধ্যে একটি প্রাচীন অন্যতম মসজিদ। মুর্শিদকুলী খাঁর আরও একটি অমর কীর্তি কাটরা মসজিদ। ১৭২৩ সালে মক্কার সুপ্রসিদ্ধ মসজিদের আদলে নির্মিত কাটরা মসজিদ। মোরাদ ফরাস নামে তাঁর একজন স্থপতিকে ওই মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব অর্পণ করে ছিলেন। স্থপতি মোরাদ ফরাস মাত্র ১৭২৩-১৭২৫ সালের মধ্যে কাটরা মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ মৃত্যু বরণ করলে তাঁর পূর্ব ইচ্ছে অনুযায়ী মসজিদের সিঁড়ির নিচে কবরস্থ করা হয়। ১৭৮০ সালে হোজেস নামের পরিব্রাজকের মতে এখানে ৭০০ জন কারী এক সঙ্গে বসে কোরআন পাঠ করতেন। এবং তার ব্যয় ভার ছিল কাটরা বাজারের আয় থেকে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কাটরা মসজিদের গম্বুজ ও অন্য অংশের ক্ষতি হয়। এখানে একটি সুবিশাল শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। এবং যা দেখে সবাই অবাক হতেন।

                   মহিমা পুর ও টাঁকশাল: ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকার জাহাঙ্গীর নগর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সেই সময় জগৎ শেঠ বংশের পূর্ব পুরুষ মানিক চাঁদও মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। তিনি ছিলেন হীরা নন্দের পুত্র। হীরা নন্দের সাত ছেলে নানা স্থানে ব্যবসা করতেন। মানিক চাঁদের ব্যবসা ছিল বাংলায়। তাঁর ব্যবসা মূলত মহাজনী ও হুন্ডির। মহিমা পুর টাঁকশালের পরিচালনার দায়িত্ব পান মানিক চাঁদ। ১৭১৫ সালে দিল্লির বাদশা ফারুকশিয়ার তাঁকে শেঠ উপাধি প্রদান করেন। সুবা বাংলার উত্থান ও পতনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে এই খল নায়ক জগৎ শেঠের নাম। 

[চলবে...]



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট