৫৩তম সংখ্যার পদাবলি

মানুষের প্রকৃতি
আবু ইউসুফ সুমন


হাঁটতে গিয়ে একরাশ অসম্পূর্ণতা পথের সামনে  রাস্তা আগলে দাঁড়ায়
উপহাস করতে থাকে না মেলাতে পারা গোলমেলে গাণিতিক রাশিমালা!

ভাবনার মাঝে ভীড় করতে থাকে হাজারো সীমাবদ্ধতার কালিমা
আমি এক মুমূর্ষু রোগীর মত নিস্তব্ধতার সাড়াহীন ¯্রােতে গাঁ ভাসিয়ে দেই।

আলোকিত সভ্যতাতে আমি আমাবস্যার অন্ধকার খুঁজতে থাকি
ভুলে যেতে বসি আমার ও কিছু স্বপ্ন আছে যেগুলো উজ্জ্বল-রঙিন।

নিজের প্রতি আক্ষেপের জঞ্জাল নিজেই বহন করতে পারি না
তাই কেউ দেখা না দেখার মাঝে নির্জনে কান্নায় ফেটে পড়ি।

এমন অলক্ষুণে সময়ে নিজের মাঝে এক সংগ্রামী অনুভূতি জন্ম নেই
মনে পড়তে থাকে অসম্পূর্ণতা আর সীমাবদ্ধতাই সব মানুষের প্রকৃতি!

এখনো সময় খেলে যায়
সাদিক আল আমিন

নিরবধি জেগে জোছনা এখনও, মনভোলানো রাতে
তার শাদারঙা মুখের ওপর ফুটে আছে সতরঞ্চির চাল
গেরুয়া প্রজাপতি অবচেতনে খুঁটে খেয়ে মগজ
ঢেঁকুর তোলে কৃতজ্ঞ বাসনায়; তার হারিয়ে যাওয়া,
হলদে পাঞ্জাবির কলারে লেখে গল্প; হ্যাঙ্কারে ঝোলে সুখ
আড়ালে বসে চড়কা কাটে রসিক রহস্যের মানুষ
আমি খুঁজি তাকে অনন্ত, বলি দেখা পেলে আড়ালে
‘মিসির আলি, আপনি কোথায়? আমিও অপ্রকৃতস্থ’
তিনি অন্য ভূ-লোকে বসে হাসেন মৃদু, কখনো বলেন,
‘শোনো কবি, রহস্যের সাথে আবেগ মেশানো দুষ্কর’
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে খুঁজি সন্ধানী প্রেম
তিনি জন্ম নিলেই আমি কবিতা লিখি, উৎসর্গী তাকে
রুপার মতো নীলাদ্রিও আমাকে খামবন্দি প্রণয় পাঠায়
‘বলো কবি, যদি হিমু আরেকটু ভবঘুরে হতো, তবে
ঢাকা শহরটাতে বেশি কি একটা অনিয়ম হতো?’
আমি থাকি চেয়ে চুপ, দূরে সোনালি ফ্রেমের চশমা
আরো দূরে সোনালি বিকেল, ঝুলে আছে মেঘের সাথে
প্রত্যাশা, একদিন সে ফিরবে আমাদের সোনাঘরে ।

বিদায় পৃথিবী
সুমন আহমেদ

প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়ে আছে আমার পৃথিবী, রাত্রির কমল
বিছানায়; হাতে হাত রেখে, একটা অবয়বের মাঝে
নিজেকে বিলিন করে; দুইয়ে মিলে এক হয়ে।

পৃথিবীটার ঠিকানা বদল হয়েছে- সংসার নামের ঠিকানায়;
ধূসর স্বপ্নগুলো প্রতিনিয়ত গুমরে গুমরে কেঁদে মরে
বারবার সীমান্ত ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে অবুঝ মন,
পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণায়- বেলা অবেলায়।
চাই না আর, রাত্রির ঘুমন্ত শহরের নিদ্রাহীন প্রহরী জীবন;
আর কত, বেচেঁ থেকেও প্রতিমূহুর্ত মিথ্যের সাধ?

বিদায় পৃথিবী,
আর হবেনা দ্যাখা, হেমন্তের কুয়াশার চাদর জড়ানো ভোরে,
দূর্বাঘাস আর শিশির বিন্দুর দুইয়ে মিলে এক হওয়া 
মধুর মিলন লগ্নে; বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে নীড়হারা ছুটন্ত
পথিক- অসহায় ভেজা কাক জীবনে।

কথার কথা
নীল মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

অনর্গল কথা বলে চলে বাতাস, কি কথা কয় কি কথা গোপন করে
কথার পিঠে কথা এসে হামলে পড়ে আমার ঘরে।
আমার এখন অনেক কথাই ঠোঁটের কোণে চেপে যাই,
মৃদু হেসে চলতে কেমন পথটাকে রোজ মেপে যাই।
অনেক কথাই চোখের মধ্যে ডুবিয়ে দেই অকারণ,
অকথিত সকল কথা দু’চোখ আমার করছে ধারণ।
অনেক কথাই কথার কথা, অনেক কথাই ফসকে গেছে-
কিছু কথা খুব গোপনের, সে সব বলতে বারণ আছে।
এমন কিছু কথা আছে, যে সব কথা জীবন্ত-
কেউ না জানুক সে সব কথা, ও সব আমার একান্ত।
কিছু কথার দায় থেকে যায়, কিছু কথার ওজন ভারি-
কিছু কথা মিথ্যে ছিল, কিছু কথা বাড়াবাড়ি।
সত্য মিথ্যে কথার সুতোয় সেলাই করা নকশি কাঁথা প্রেম;
তোমার হাতেই আমার বাসর শয্যা রচেছিলেম,
চিকন হাতের দক্ষতাতে নিগূঢ় ব্যথা লুকিয়েছিলে কাঁথার ভাজে-
সেসব কথা কাঁটা হয়ে বাজে, আমার বুকের মাঝে।


আমি পারি প্রিয়তমা
নাবিল তুরাব

তোমাকে ভুলে যাওয়া কঠিন নয়, যখন আমি ঈশ্বরকেও ভুলতে পারি।
তোমাকে ঘৃণা করাও তীব্র কঠিন নয়, যখন আমি পূর্বসূরিদেরও ঘৃণা করতে পারি।
তোমাকে স্মৃতি থেকে আজন্ম ঝেড়ে ফেলাও দুঃসাধ্য নয়,
যখন পৃথিবীর ভুল মানচিত্র মুছে দিতে পারি সমূলে।

গ্রহ থেকে গ্রহে ঘুরে আমি সৃষ্টি করতে পারি যখন নতুন পৃথিবীর মানচিত্র;
পূর্বসূরিদের আবিষ্কার করতে পারি স্বর্গে, কাউকে নরকে;
সীমাহীন অনন্ত ঈশ্বরকে দেখতে পাই নিষ্ঠুর সুকোমল সহাস্যমুখÑ
আমি পারি প্রিয়তমা তোমাকে ভুলতে, ঘৃণা করতে, এমনকি মুছে দিতে।

আমিও আজ পথিক
স্বপন শর্মা

ব্যাগ ভর্তি দুঃখ নিয়ে, বাঁশের সাঁকো পার হয়ে;
নগ্ন পা’য়ে মেঠো পথে আমিও আজ পথিক
শিশির ভেজা দূর্বা ঘাস, ধানহীন ধানক্ষেত
সরিষার কচি সবুজ পাতা-
খেসারী কলাই’র এলোমেলো ডালে
আটকে থাকা পা;

সাথী হওয়ার বাহানা তোমার,
আমার কালক্ষেপণ।
অতঃপর আমি পথের খোঁজে, একলা পথিক।

সুখের পা-ুলিপি সাজাই, ছিড়ে ফেলি
আবার মগ্ন হই, গুছিয়ে রাখি বিশ্রাম নেয়ার জন্য-
শিশির কুড়িয়ে যখন তপ্ত হৃদয় শীতল হবে
কুয়াশা ভেদ করে আবার হয়ত আশা জাগবে।
ততদিনে ভৈরবী মন্দিরে, পুরোহিতের পাশে বসে
মন্ত্র জপে ঈষ্ট দেবতার সন্তুষ্টি চাব।

বিফল মনোরথে, আজ আমি পথিক
ব্যাগ ভর্তি দুঃখ নিয়ে আবার হাঁটি গাঁয়ের পথে মাগন নিতে।




বিষ গরলের নেশায়
পার্থ কর্মকার

হেমন্তে কালো মেঘের অস্তিত্বকে তুচ্ছ করে আকাশে সাদা মেঘের ছুটাছুটি...
আকাশের নীলে প্রাণ জাগিয়ে একঝাক পাখির ডানা ঝাপটানো।
ঠিক এমনি সমুদ্র মন্থনের কোন এক ক্ষণে মেঘবালিকা ঈশ্বরী তোমার জন্ম,
তুমি একা ছিলে না, তোমার সাথে ছিল বিষ গরলের একটি রুপার কৌটা;
নীলকণ্ঠের মতো দেবতাদের মৃত্যুর শংকা কাটিয়ে আমি তোমার রৌপ্য কৌটার বিষ,
কণ্ঠে ধারন করে তোমায় অমর বন্ধুত্ব দিয়েছি। আজ তুমি বন্ধুত্ব নিয়ে খুশি,
আমি তোমার বিষ-গরলের নেশায়।



বিরহ ও রাজনীতির একুশ বছর

জাহিদ আল হাসান

হৃদয়ের এমন ক্রান্তিকালে যদি
নিরপেক্ষ শান্তিকামীরা মুক্তির জন্য মিছিলে নামে
মূহুর্তে অবরোধ করে ফেলে
নিঃসঙ্গতার ২১টি অন্ধকার মহাসড়ক
‘তবে তাই হোক’ এমন সকল কর্মসূচিতে
একাত্মতা প্রকাশ করবো আমি।

যদি প্রেম পিপাসু জনতা শ্লোগানে শ্লোগানে
মুখরিত করে তোলে বুকের বামপাশ,
প্রতিবাদে গায় ভালোবাসার গান
প্রেমের ভেতরে চায় সুখ আহবান
যদি অসুখ ভুলে সুখের দাবি জানায়
আর বিষাদ ভুলে ভালোবাসার,

এবং যদি স্মারক লিপির প্রথম লাইনেই
বিলুপ্ত ঘোষণা করতে চায়, ‘একাকীত্ব’
নামের অবাঞ্চিত শব্দের কথা
তবে গণতান্তিক নিয়মে লাখো জনতার
মাঝে আমি বলতে চাই,
এই লড়াইয়ের দিনে তোমরা যাকে
বিলুপ্তির জন্য চিৎকার করো,
যার জন্য তোমাদের হৃদয়ে সুখ নাই,
পথে পথে সুখ চাই
তাকে ছাড়তে পারি না আমি,
সে আমার ছায়া হয়ে থাকে মনের ঘরে
রাত দিন যন্ত্রণা করে এ বুকের পাঁজরে।


তুমি এসেছিলে
জালাল জয়

তুমি এসেছিলে
ঝরাপাতায় লেপটে বসন্তের কালে
মর্মর শব্দে পথের ধারে পড়ে থাকা
পাতাদের কন্ঠে। মধুময় কোকিল সুরে 
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুমি এসেছিলে
শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে, জলে ভিজিয়ে
আষাঢ়ের তুমূল গানে। ঝাপটা
মেরে বৈশাখী ঝড়ে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুমি এসেছিলে
শরতের কাশফুলে হৃদয় ছুঁয়ে
নীলের মেঘে এঁকে প্রাণে শিউলি
ভোরে। অতি আদরের মেঘে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুুমি এসেছিলে
হেমন্তের শিশির হয়ে- ঘাসময় হৃদয়টাকে
কুয়াশায় ভিজিয়ে। নবান্নের উৎসবে
অগ্রহায়ণের নতুন ধানে, কৃষাণির হাসিমুখে
পিঠা পায়েসে-মধুমাখা তৃপ্ত সুরে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুমি এসেছিলে
হাড়কাঁপা শীতের কুয়াশা ভোরে
ঝিমঝিম ঘুমে পেীষ-মাঘে কিংবা
ফাগুনের শেষ প্রভাতে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে


ঈশ্বরের হৃদয়
রাহাত রাব্বানী

তোমাকে ভেবে ভেবে মধ্যরাতে আকাশ খুলে বসি।
দেখি- নক্ষত্রদের মিছিল-সমাবেশ। তোমাকে ভেবে ছুঁয়ে দেই-
মানিপ্ল্যান্টের কোমল দেহ। ঘাসফুল। অলকানন্দা।
নেতিয়ে পড়া ভাঁট ফুলের আসরে-
তোমার যুগল চোখ খেলে ভালোবাসার খেলা।
মূলত তুমি আর প্রকৃতি একই কক্ষে ঘূর্ণায়মান।
আমি যতবার তোমাকে ভাবি,ততবারই ভাবি-
ঈশ্বরের হৃদয়। দেখি, তার গুছানো পৃথিবী।




বুকপকেট নেই কবি বলে
ইকরামুল হাসান শাকিল

নন্দিতা, তুমি নদীর সামনে দাঁড়াও, রৌদ্রে ভিজে শুকাও একাকিত্বটুকু
সেতুহীন সেই ¯্রােতস্বিনী দেখো সাজসজ্জা ছেড়ে; নিজের গভীরতায়
তোমার ভিতরেই চন্দনকাঠের আলমারিতে শীতের আগমনী
কানের দুল রাখা কাচের তালার ভাস্কর্যের লাবণ্য;
নদীর নবীন জল, জলজউদ্ভিদ, হারানো রুপার নুপুর, খোলা চুলের
মাতাল ভাঁজ, জলপাইকাঠের নৌকো, যতটুকু আকাশ
অই ওড়নার সীমানায় সেই সবটুকু তুমি
নেই কোন সীমারেখা কিংবা কাঁটাতারের অসভ্য বেহায়পানা।
কাটাকুটির শহরে সেই কবেই হেঁটে গেছো শুকনো বটপাতা ভাঙার  শব্দে
পায়ের চিহ্ন মাখা শালিকের ভাঙা ডিমের খোসা তুলে রেখেছি বুকপকেটে
আজ সেই বুকপকেট  নেই কবি বলে, দারুণ অভাবে বিক্রি করেছি নিলামে
নিদারুণ মূল্যে কলম কিনেছি একটি নৌকোর জন্য কবিতার জন্ম হবে বলে।



ঘুমন্ত মানব পৃথিবী
নাফছি জাহান

ঘুমে কাতর মানব পৃথিবী- প্রাণহীন জীবিত প্রাণ নিয়ে
আধমরা হয়ে বেঁচে আছে,
তাদের অন্তদৃষ্টি চক্ষু বন্ধ করে- অবিবেচকের আবরণ
আষ্টেপৃষ্ঠে যতœ সহকারে জড়িয়ে রেখেছে।
প্রলোভনের অশ্রুতিমধুর শব্দবিন্যাস
কোমলতাকে বিতাড়িত করে, কঠোরতাকে নিত্যসঙ্গী করেছে,
সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা হয়তো তাদের বিড়ম্বনা করছে
তাইতো চক্রাকারে বিন্যস্ত, প্রাক্তন বিবেকহীন চিন্তাধারার
তাদের হৃদয়ের অন্তস্থলে পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
বিবেকের এ অন্তিম দশা প্রত্যক্ষ করে-
মানব পৃথিবী যেনো আনন্দে মেতে আছে,
হায়রে জীবন! ঘুমিয়ে থাকা মানব জীবন।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট