গল্প- চুড়ি

চুড়ি

লুৎফুন নাহার লোপা




কবির বাসের জানালা দিয়ে একটা ছোট ছেলেকে খেয়াল করছিল। ছেলেটি শসা মাথায় করে বিক্রি করতে এনেছে। এই  ছোট বয়সে তার হাব ভাব একজন বয়স্ক মানুষের মত হয়ে গিয়েছে। ছেলেটি তার ক্রেতাকে বলছে- ‘দুনিয়ার খবর কি কিছু রাখেন, আজকাল সব জিনিসের দাম বাড়তি। বাস ছেড়ে দিলো,  ছেলেটির শসা বিক্রি আর দেখা হলো না। কবির পাশে ফিরে দেখলো একটি মেয়ে তার পাশের সিটে বসেছে। মেয়েটির চেহারা তাকে আকর্ষণ করতে পারলো না কিন্তু তার দুহাত ভরতি চুড়ি মন ছুঁয়ে গেলো।
কবির তার নতুন গন্তব্য এ এসে পৌছালো। অনেকগুলো  পরিক্ষা দিয়েও সরকারি কোন চাকরি না পেয়ে তাকে পাড়াগাঁয়ে এক এন জি ও তে জয়েন করতে হলো। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও কয়েক মাসের মধ্যেই তার চাকরির প্রতি বিরক্তি এসে গেল। যদিওবা সে ম্যানেজার পদে চাকরি করে তবে অফিসে কেরানিদের কথার বাইরে সে কোন কাজ করতে পারে না। কারন এম ডি স্যারের সাথে কেরানিরই সুসম্পর্ক। কবির অফিসে ২ মিনিট লেট এ গেলেও তার কৈফিয়ত কেরানিদের দিতে হয়। সে অফিসে ঢোকামাত্রই দারোয়ান জিজ্ঞেস করল - স্যার এতো দেরি হইল কেন?
কবিরের মনে অনেক বকাঝকা এলেও সে তা প্রকাশ করল না, রাগ সংবরণ করে সে ভেতরে গিয়ে নিজের টেবিলে বসে পড়ল।
কাজের ভিরে তার সব রাগ হারিয়ে গেল সে টের পেলো না। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে সে দেখল তার মুখোমুখি টেবিল এ এক মেয়ে বসে আছে। কিন্তু লাঞ্চ করে আসার পর যখন দেখতে পেল মেয়েটি সেখানেই বসে আছে তখন সে  বুঝল মেয়েটির দীর্ঘস্থায়ী বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েটি তাকে দেখে মুচকি হাসলো এবং হাত নেড়ে হ্যালো বলতে চাইলো।  কিন্তু কবির কিছুই বলল না। তার রাগ হলো অফিসে নতুন সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অথচ আমাকে জানানো হলো না কেন ?

রুনা নতুন অফিসে গিয়ে আনন্দে কাজ করতে লাগলো।  সবার সাথে সে ভাব জমিয়ে ফেলল। শুধু মাত্র ভাব হলো না ম্যানেজার সাহেবের সাথে। ম্যানেজার সাহেবের সাথে আলাপ করার অভিপ্রায় নিয়ে সে অনেকক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তাতেও কাজ হলো না, তাই সে উঠে গিয়ে কবির কে বলল - স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?
-হ্যা, অফিসে নতুন জয়েন করেছেন
-স্যার, আমাকে মনে আছে আপনার?
-আর কিভাবে মনে থাকবে?
-ওই যে ভাইবার দিন আমাকে গান গাইতে বলেছিলেন। আমার নাম রুনা দেখে বলেছিলেন রুনা লায়লার একটা গান করতে, আর আপনার কথা শুনে বড় স্যার হেসে ফেলেছিল ।
-ওহ.. মনে পরেছে;  হাহাহা...
কবির হেসে ফেলল, তার মনে পরল এই মেয়েকে নিয়োগের ব্যাপারে তাকে একবারে যে কিছু জানানো হয়নি তা না। তবে এই মেয়ে যে কেরানির রিকোয়েস্ট এ এসেছে তা বুঝতে তার বাকি রইল না। কারন কবির নিজেই তাকে রিজেক্ট করে দিয়েছিল।  তবে এখন সে বুঝল মেয়েটির রেজাল্ট যেমনি হোক না কেন, সে অফিস টাকে হাসিখুশি রাখতে পারবে।
 ৩
আজ অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে। অফিসের ক্লান্তি দূর করতে কবির বাইরে বের হল। হেমন্তের শেষ, কদিন পরেই শীত এসে পরবে। বিকেলের হালকা কুয়াশায় হাটতে সব রাস্তাই মায়াবী মনে হয়। কবির হাটতে হাটতে তার মায়াবী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কার অভিশাপে যেন সেই মায়াবী রাস্তা দূর্গম মনে হল। নিচে তাকিয়ে সে দেখলো সে গোবরে পা দিয়ে তার নতুন জুতার বারো টা বাজিয়েছে। পাশেই একটা পুকুর দেখে সে পা ধুতে গেলো।  সাতটা সিঁড়ি মাড়িয়ে সে পা ধুয়ে উপরে উঠবে এমন সময় তার চোখ আরেক জোড়া চোখের সাথে ধাক্কা খেল। একটি মেয়ে তার দিকে গম্ভির মুখে তাকিয়ে আছে। যেন সে পা ধুয়ে অনেক অন্যায় করে ফেলেছে।  কবির কিছু না বলে তাড়াতাড়ি কেটে পরল।
 ৪
পরদিন অফিস যাওয়ার পথে মেয়েটিকে আবার দেখা গেল পুকুর ঘাটে। তার গায়ে কালো চাদর জড়ানো, খোলা চুলের অর্ধেক টা চাদরের ভেতর দিয়ে বের হয়ে আছে, বাকি অর্ধেকটা চাদরের ভেতরে। গ্রীষ্মকালে তাকে কেমন দেখায় তা আন্দাজ করা গেলো না, তবে শীতে তার সৌন্দর্য  কবিরের চোখে লেগে গেল।
কবির বিকেলে ফেরার পথে পুকুরপাড় পরিদর্শন  করতে লাগলো। কিন্তু সাহস করে মেয়েটিকে ডেকে কথা বলতে ইচ্ছা করলো না। একদিন পুকুর পাড়ে এক মহিলার শেফালি নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরে সেই চাদর পরা মেয়েটি এসে তাকে মা বলে ডাকল। তাতে বোঝা গেলো মেয়েটির নাম শেফালি।
পরের দিন মেয়েটি নিজে ডেকে তার সাথে আলাপ করল। বলল, আপনি কি পুকুর দেখতে খুব ভালোবাসেন?
-হ্যা, অনেক।
-রোজ পুকুর পাড়ে আসেন?
-হ্যা
-কাল বিকেলে আসবেন, আপনাকে বড় পুকুরঘাটে নিয়ে যাবো।

কবির অফিসে এসে ভাবল আজ আগেই বের হয়ে যাবে, বিকেলে বড় পুকুর দেখার নিমন্ত্রণ আছে। কিন্তু কাজের চাপে তার কিছুই মনে রইল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল।  রাতে বাসায় এসে মনে পড়ল সে কি ভুলে গিয়েছিল। এক অপরিচিতার পুকুর দেখার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করে সারা রাত তার অসস্তিতে কাটল।
পরদিন বিকেল বেলা সে মেয়েটিকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাছে গিয়ে বলল-আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, কাল আসতে পারিনি...।
মেয়েটি গম্ভির মুখে তাকিয়ে রইল, তারপর হেসে বলল, কাল আমিও আসতে পারি নাই। চলুন আজ দেখে আসি....
প্রায়ই তাদের পুকুর পরিদর্শন চলতে লাগলো। তাদের সখ্যতা বাড়তে লাগলো। ধীওে ধীরে শীত বাড়তে লাগলো এবং এক সময় আবার কমতে শুরু করল।
হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে ফোন আসল কবিরের সরকারি চাকরি হয়ে গেছে। তার বাড়িতে প্রতিরক্ষা  মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কবির খুশিতে অভিভূত হয়ে উঠলো।  সবাই কে জানানো হলো, শুধু পুকুর ঘাটে যাওয়া হলো না। পরের দিন পুকুর পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ল তার কথা। দেখল মেয়েটি বসে আছে। কবির কাছে গিয়ে বলল - আমার সরকারি চাকরি হয়ে গেছে,  ২ দিন পর চলে যাব।
-সত্যি চলে যাবেন?
-হ্যা
-আমাকে ভুলে যাবেন তাইনা?
-ভুলবো কেন? ছুটি পেলেই এসে পুকুরঘাট দেখে জাবো
-শুুধুই কি পুকুর ঘাট?
-আর কি দেখার আছে বলো...।
-ওহ..ঠিকাছে।  আমার একটা কথা রাখবেন?
-কি?
-আপনি চলে যাওয়ার আগে আমাকে একটা উপহার দিয়ে যাবেন?
কবির দেখল মেয়েটি চোখে জল এসে গেছে। তার চোখে মুখে অদ্ভুত ভালোবাসা ফুটে উঠেছে।  কবির এর বুকেও একটা অদ্ভুত টান অনূভুত হলো। সে আর সহ্য করতে পারল না। তাকে বলে ফেলল যদি যাই তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো। সেই আবেগ আপ্লুত বিকেলটা ভালোবাসার জন্ম দিল।

কবির সাড়া দিন ঘুরে চুড়ি কিনল। দুপুরে ভাবলো শেফালি কে সাথে নিতে হলে তার মা বাবার অনুমতির প্রয়োজন।  তাই খোজ নিয়ে শেফালিদের বাড়ী খুজে বের করল। শেফালির মা তার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল- তোমার পরিবার আমার মেয়েকে মেনে নেবে তো?
- কেন নেবেনা?
- না মানে ওর হাত দুটো অকেজো তো। জম্ন থেকেই ওর হাত পোলিও রোগীর মত বিকলাঙ্গ।
কবির কিছু বলতে পারল না। আসি বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসল। তার সকল আবেগ, সকল ভালোবাসা  এক নিমিষে শেষ হয়ে গেলো।  মনে হল কি করে আমি এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করতে পারলাম। সে আমার যোগ্য নয়। মেয়েটি চাদর দিয়ে তার সত্যি লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন। আমার মা বাবার ঘারে এই মেয়ের বোঝা আমি কিছুতেই চাপিয়ে দিতে পারিনা। রাগে দুঃখে সে অসহ্য হয়ে উঠল। ফেরার পথে সে পুকুর পাড়ে চুড়িগুলো রেখে নিরবে চলে এলো।

প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে কবিরের নতুন  চাকরির বয়স। সময়ের সাথে সব কিছু বদলে যায়। সেও আবার যান্ত্রিক মানুষে পরিনত হল।
কদিন পর তার এক কলিগ এর বাসায় তার দাওয়াত হলো।  তার সহকর্মী তাকে তার স্ত্রী এর সাথে আলাপ করিয়ে দিল। সহকর্মীর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কবির অবাক হইল..... এত তার পুকুর ঘাটের প্রিয় মুখ। কিন্তু আজ তার গায়ে চাদর নেই। তার হাত ভরা চুড়ি কবির কে বিদ্রুপ করতে লাগল। এত সেই কবিরের ফেলে আসা চুড়ি। মেয়েটি তার ভালোবাসার ভার এখনো অতি যতেœ বয়ে বেড়াচ্ছে।  কবিরের দম বন্ধ হয়ে আসলো।  বাইরে ফোন দিলো সেই আগের অফিসের দারোয়ান কে। জানতে পারলো  তার ভালোবাসার মানুষের নাম শেফালি নয়, তার বড় বোন শেফালি এবং তার হাত নেই। আর যাকে সে এতদিন ভালোবেসেছে তার নাম চামেলি। সে নিজেই বুঝলো সে ভালোবাসার কতটুকু অপমান করেছে। কবির নিজেকে শান্ত করতে চাইল কিন্তু তার বুকে বিধে রইলো চামেলির হাত ভরা চুড়ি।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট