গল্প- যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না



যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না                                        
বাসার তাসাউফ

    কোনো সুন্দর দৃশ্যের মালিক আসলেই সে-ই, যে সেটা প্রথমে দেখে। 
     ট্রেনে উঠে জানালার পাশের সিটটিতে বসেই হঠাৎ এমনটি মনে হল আমার। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণ আছে। কারণটা গল্পের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে জানা যাবে। আপাতত জানার বিষয় হল, আমি যে সিটে বসে আছি, তার থেকে ঠিক দু’টো সিট ডানে বসে আছে একজন মেয়ে। মাথায় দীঘল কালো চুল, পাখির নীড়ের মতো চোখ, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট, সাদা কালো সালোয়ার-কামিজপরা মেয়েটিকে একেবারে পরীর মতো লাগছে ইত্যাদি অদ্ভুত বিশেষণে আমি তাকে বিশেষায়িত করব না। আমি শুধু এককথায় বলে দিতে চাই, মেয়েটি সুন্দরী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে ধার করেও বলা যায়- “নির্মল বুদ্ধির চেহারা ঝকঝক করছে যেন। সুুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা, উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি ...।”
     আমার পাশের সিটটি খালি, খালি পড়ে আছে মেয়েটির পাশের সিটও। এখনো এ দু’টো সিটের টিকেটধারী ট্রেনে ওঠেনি। ট্রেন ছাড়তে বাকি দশ পনেরো মিনিট এখনো। জানালার পাশে সিট পেয়ে আমি খুশিই হয়েছি। চলন্ত ট্রেনে বসে বাইরের দৃশ্য দেখা যাবে। চোখ রাখলাম জানালার ওপারে। এ সময়ে কেউ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে আঁচ করতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে দেখি একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই আমাকে বলে, ‘এই সিট কি তোমার?’
     আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াই। 
     ‘তাহলে বাবা, তুমি আমার সিটে বসো, আমি বসব তোমার সিটে।’
     ‘কেন বলুন তো?’
     ‘আমার বমিটমির অভ্যেস আছে তো, তাই। জানালার পাশের সিটটাতে বসলে আমার একটু ভালো হয়।’
     আমি ভদ্রমহিলাকে আমার সিটটা ছেড়ে দিলাম। মহিলা বমি করে এ কারণে নয়। কারণ অন্য। আমি যদি এ সিট ছেড়ে ডান দিকের সিটটাতে বসি তাহলে মেয়েটার খুব কাছে চলে আসতে পারি। মাঝখানে শুধু একটা সিটের ব্যবধান। ভদ্রমহিলা দুুই সিটের প্রায় দেড়খানা দখল করে বসতে বসতে আবার বলে, ‘শোনো বাবা! সিট বড় কথা না, পৌঁছানোই হল আসল। নাও এবার বসে পড়ো।’
     ট্রেন ছাড়ি ছাড়ি করেও ছাড়ছে না। এদিকে ভদ্রমহিলা একে তো দেড়খানা সিট দখল করে বসে আছে, তার ওপরে অনবরত বলে চলেছে কথা, ‘এই যা! আজকাল যা গরম পড়েছে! ট্রেন কেন ছাড়ছে না? ড্রাইভার কি ঘুমাইয়া পড়েছে...? আচ্ছা বাবা! তুমি চাকরি কর না লেখা পড়া...? জানো! আমার দুই মেয়ে। বড়টার নাম ডেইজি। ওর স্বামীর সঙ্গে অষ্ট্রেলিয়া থাকে...। ছোট মেয়েটি ভার্সিটিতে পড়ে। আমার স্বামী বিজনেস করে। ঢাকা শহরে তার বিশাল বিজনেস...। আমি কখনো গ্রামে যাই নি...।’ 
     আগামী কয়েক ঘণ্টা এই মহিলা আমাকে কীরকম বিরক্ত করে ছাড়বে আমি আধখানা সিটে কোনো মতে বসে এ কথা ভাবছি যখন- তখনই ট্রেনটা ছাড়ল। ট্রেন কিছু দূর এগুতেই মহিলা পানির বোতল বের করে দু’টো   অ্যাভোমিন ট্যাবলেট হাতে নিয়ে আমাকে বলে, ‘তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’
     আমি চুপ করে আছি। ট্যাবলেট খেয়ে ফের বলে, ‘তুমি খাবে একটা?’
     ‘না, গাড়িতে আমার বমি হয় না।’
     ‘আমারও হয় না। তবে আগে থেকে একটু সতর্ক হলাম। তা তোমার নাম কী বাবা?’
     আমি রীতিমতো হতবাক। বমি হয় বলে মহিলা আমার কাছ থেকে জানালার পাশের সিটটা কেড়ে নিল। এখন বলে তার নাকি গাড়িতে বমি হয় না। বমির ট্যাবলেটও খেল দু’টো। একটু আগে আমাকে গ্রামের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে এখন বাড়ির বদলে আমার নাম জিজ্ঞেস করছে। বড় অদ্ভুত মনে হয় আমার এই মহিলা সহযাত্রীটি। আমি মহিলার মুখের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলি, ‘আমার নাম আবিদ।’ 
     ‘বাহ্! খুব সুন্দর নাম। কী করো তুমি?’
     ‘লেখাপড়া।’ 
     ‘কোথায়?’
     ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, অনার্স থার্ড ইয়ার... সাবজেক্ট বাংলা... এখন যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি, কুমিল্লায়।’
     আমি মহিলার সম্ভাব্য পরবর্তী প্রশ্নের আগাম জবাব দিয়ে দিলাম যেন সে আর কথা না বলে। কিন্তু মহিলা আরও কথা বলে যাচ্ছে, ‘আমিও তো যাচ্ছি কুমিল্লায়। অনন্তপুর নামব। প্রথমে বড় মেয়ের বাড়ি, তারপর যাব বাপের বাড়ি। তুমি অনন্তপুর নেমে মাজহার ভূঁইয়ার নাম বললেই যে কেউ আমাদের বাড়ি দেখিয়ে দেবে। আমার বাবার কয়েক’শ বিগা জমি আছে। জানো...।’
     মহিলার কথা আমি আর শুনছি না। একটু আগে বলেছে তার বড় মেয়ে অষ্ট্রেলিয়া থাকে। এখন বলে অনন্তপুর বড় মেয়ের বাড়ি যাবে। কোথায় অষ্ট্রেলিয়া, কোথায় অনন্তপুর? মহিলা কি পাগল না মিথ্যুক?
     ‘রাশিদ অ রাশিদ!’
     না, মহিলার কথা না শুনে উপায় নেই। ভুল নাম ধরে ডাকছে আমাকে। আমি শুধরে দিলাম, ‘আমার   নাম রাশিদ নয়, আবিদ।’
     ‘অ! আবিদ, তোমার কি বাবা মা দু’জনেই বেঁচে আছেন?’
     ‘হ্যাঁ, বেঁচে আছেন।’
     ‘মাশাল্লা! তোমার বাবা মা দু’জনকে আমার সালাম দিবা। আচ্ছা, বায়জিদ তুমি কি বিয়ে করেছ?’
     মহিলা আবারও নাম ভুল করল। এবার আর শুধরে দিলাম না। শুধরে দিতে ইচ্ছে হল না।
     ‘না, আমি বিয়ে করিনি।’ একটু বিরক্তমাখা গলায় বলি কথাটি।
     ‘গুড, আমার ছেলেকেও বিয়ে দিই নি। বড় মেয়েটার বিয়ে হোক আগে তারপর...।’
     ও মাই গড! মহিলা দেখি আসলেই পাগল। পাগল না বাচাল বুঝতে পাছি না। মিথ্যুক, মহা মিথ্যুক মহিলাটি! কখন কি বলে কোন ঠিক নেই। যে করেই হোক এই মহিলার কাছ থেকে আমাকে কেটে পড়তে হবে। ট্রেনে উঠেই পাশের সিটের ঐ সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে আমার মনে ভালো লাগার যে আমেজ তৈরি হয়ে ছিল, সেটি এখন এই মহিলার কারণে উধাও হয়ে যেতে উপক্রম হল। বিরক্ত হয়ে চুপচাপ বসে আছি। মহিলা বোধ হয় আমার বিরক্ত হওয়া বুঝতে পেরেছে। তাই সেও চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলে, ‘কেমন যেন লাগছে সাজিদ!’
     বলতে বলতেই হড়বড় করে বমি করে দিল। দু’টো অ্যাভোমিনেও কাজ হয়নি। বমি করবি তো কর জানালার বাইরে। তা না করে আমার দিকে অর্ধগলিত ভাত, মাংস, রুটি মুখ ভরে ঢেলে দিলি কী কারণে? গা গিনগিন করতে লাগল আমার। বমি করার পর মহিলা শান্ত হল। শুধু শান্ত নয়, একেবারে নেতিয়ে পড়ল। যাক, বাঁচা গেল।
     এর মধ্যে সেই মেয়েটির পাশের সিটটিতে একজন মাঝবয়েসী লোক উঠে বসে পড়েছে। ভীষণ ঈর্ষা হতে লাগল আমার। ...‘ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে- ঘাড় ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে, কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশপিশ করে...।’
     ট্রেন চলছে দ্রুত। ভদ্রমহিলা ঘুুমিয়ে পড়েছে শান্ত হয়ে। কিন্তু আমার মন অশান্ত এখন। মেয়েটি বসে আছে জানালার ওপাশে মুখ রেখে। পাশের লোকটি তার গা ঘেঁষে বসে আছে আরামে। আমার মনে ঈর্ষার আগুন জ্বলছে- ‘মনে ভাবি একটা কোন সংকট দেখা দেয় না কেন উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি- রাস্তা মধ্যে একটা কোনো উৎপাত, কোনো একজন গুন্ডার স্পর্ধা। এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে...।’ যতই আমি মেয়েটিকে আমার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি মেয়েটি ততই উদাসীন। ভুল করেও একবার তাকায় না আমার দিকে। কিন্তু আমি অপলক, অনিমেষ চোখে দেখছি। যেন ‘চোখে চোখ রেখে আমি দৃষ্টিবিহীন...।’ হঠাৎ আমার মনে হল, অহেতুক একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে এত হাপিত্যিস করার কী আছে? মেয়েটি আমার কে? ভেতর থেকে জবাব এল, ‘আর কোনো সম্বন্দ না থাক, ও তো আমার সহযাত্রীনী...।’


     এর মধ্যে ট্রেন কসবা স্টেশনে এসে পৌঁছে গেছে। এই স্টেশনে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হবে। এতক্ষণ আমার সব মনোযোগ মেয়েটিকে ঘিরে ছিল। এবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, পুরো প্লাটফর্মে মানুষের ভিড় জমে আছে। ট্রেন থেকে যাত্রীরা নামছে, এখান থেকেও ওঠছে। আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনে। ট্রেনে বসে একঘেয়ে ইঞ্জিনের শব্দ আর মহিলার অর্থহীন প্রলাপ শুনে শুনে বেশ ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছি। মাথা ব্যথাও হয়েছে শুরু। এখন এককাপ চা খেতে পারলে ভালো হত। ট্রেনে পানসে চা আর নোনতা বিস্কুট ছাড়া কিছুই নেই। এসব কি খাওয়া যায়? স্টেশনের কাছাকাছি একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ল। ট্রেন থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে স্টেশনের এ পাশটা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। সবুজ বৃক্ষরাজি আর আকাশ-ছোঁয়া রাঙ্গা মাটির পাহাড়ের উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বালিহাঁস উড়ে যাচ্ছে। আমি আগে কখনো এতগুলো বালিহাঁস একসঙ্গে দেখিনি।
     আমাদের অনন্তপুর স্টেশনে পৌঁছুতে আরও একঘণ্টা সময় লাগতে পারে। চা খেতে না খেতেই ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এল। বার বার বাঁশি বেজে উঠল ট্রেনে। আমি ট্রেনে উঠার জন্য ছুটলাম।
     ‘এক্সকিউজমি!’ হঠাৎ এ সময়ে পেছন থেকে একটা মেয়েলি গলা শোনে থমকে দাঁড়ালাম। অকস্মাৎ পেছনে ফিরে দেখি আমার পাশের সিটে বসা সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরা ট্রলি ব্যাগ। গভীর মায়াবী চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখে কাজল আর কপালে নীল টিপপরা। ট্রেনে বসে আমি এগুলো লক্ষ করি নি। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আমাকে বলছেন?’
     ‘জ্বি, আপনাকেই বলছি।’
      ‘বলুন...!’   
     ‘ট্রেনে আপনি যার পাশে বসেছিলেন, যে আপনাকে সারা পথে বিরক্ত করতে করতে এসেছে, সে আমার আম্মু। মানসিক ভারসাম্যহীন। তার পাশে যে বসে তাকেই এ রকম বিরক্ত করে থাকে। তাই আমি ইচ্ছে করেই তার পাশের সিটে না বসে অন্য সিটে বসেছি। আম্মু আপনাকে বিরক্ত করেছে, এ জন্য আমি মাফ চাচ্ছি, সরি।’ বলেই মেয়েটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্শার দিকে পা বাড়ালো। রিক্শায় মহিলাটি বসে আছে। আমি নিঃশব্দে দু’চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে আছি। ওদিকে ট্রেন থেকে বার বার বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেবে ট্রেনটা। মানুষের ভিড়টা এখন আর নেই। প্রায় সবাই উঠে পড়েছে ট্রেনে। এখনই আমাকে ট্রেনে গিয়ে উঠতে হবে। নইলে ট্রেন আমাকে ফেলেই চলে যাবে। মেয়েটা চলে গেছে, ট্রেনটাও চলে যাক আমি তা চাই না। আমি ট্রেনে উঠে জানালার পাশের সিটটাতে বসলাম। পুরো ট্রেনটাকে আমার কাছে শূন্য মনে হল। শুধু একজন মানুষ চলে গেছে ট্রেন থেকে, তার জন্য এমনটা মনে হবার কীর কারণ থাকতে পারে? আচ্ছা, যে চলে যায়, সে কি একেবারেই যায়?  কখনো কি ফিরে আসে না? নাকি যে চলে যায়, সে একেবারেই যায়, ফিরে আসার জন্য যায় না...?



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট