ঘরের মাঝে পরের মানুষ: বিবিধ বিম্বের সম্মিলন




ঘরের মাঝে পরের মানুষ: বিবিধ বিম্বের সম্মিলন
ইলিয়াস বাবর

ঘরের মাঝে পরের মানুষ পড়তে পড়তে আমাদের মনে হওয়া স্বাভাবিক, সাম্প্রতিকতম বিষয়াশয়ও সাহিত্যে সংযুক্ত হয়। কবিতায় তার প্রকাশ বিণীত ও আবরণে; কথাসাহিত্যে বিস্তৃত ও বহুরৈখিক। সময়ের সাথে, প্রাযুক্তিক সংশ্লেষ বাড়ে আমাদের, সুযোগ হয় নিজেকে প্রকাশ ও প্রচারের। সেইহেতু মোল্লারা প-িত সাজে, প-িতকে পড়তে হয় তৈলমর্দনে ব্যস্ত বেপথুদের খপ্পরে। কিন্তু কথাসাহিত্যিক আরমানউজ্জামান এবারকার বইমেলায় প্রকাশিত তার উপন্যাসে নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাহাকার ও রোদনমুখরতা, যাপন ও উৎসবের বর্ণাঢ্য, জীবন ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব তুলে আনবার চেষ্টা চালান। এক্ষণে, এ সত্যও গিলতে হয়, আরমানউজ্জামান এর কথাসাহিত্যিক চারিত্র একটা সমান্তরালে হাঁটে, যা তারই নিজস্ব ভূগোলের বিজ্ঞাপন দেখায়, ভাষাশৈলীর পরিচিত বয়ানে পাঠককে এগিয়ে নেয়। আবুল হোসেনÑ তিন্নী ও মিহিরের জনক; অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবির জীবন নিয়ে তার ভাবনার যত বিস্তার। ছেলে মিহিরের সেদিকে খেয়াল নেই, স্ত্রীর কাছে পাত্তা পাওয়া যায় না তেমন, গালগল্প কি চা বানানোটা তিন্নির সাথেই হয়। কাজ না থাকলে যা হয়Ñ দুর্ভাবনা ভর করে আবুল হোসেনের মনে এবং এ ভাবনা-সংক্রান্ত বিস্তারে ক্রমান্বয়ে হাজিরা দেয় হুজুর, বিদায় স্টোরের মালিক মতিন মিয়াও। চলতে থাকে সাংসারিক ব্যস্ততা, ছেলেমেয়েদের ক্যারিয়ার, প্রযুক্তি-আসক্তি ও স্ত্রীর প্যানপ্যানানির ভেতরেই তিনি হাঁটেন, হাঁটতে তাকে বাধ্য করে নি¤œমধ্যবিত্তের মানস ও প্রেস্টিজ।

যার যা পেশাÑ মতিন মিয়ার মানুষ মরলেই লাভÑ ব্যবসা ভালো হয়, পেট চলে। ওদিকে মোবাইল অপারেটর কোম্পানীগুলোর নানাবিধ চটকদার অফারে রাতজেগে ফেসবুকিং, চ্যাটিং আছেই; তিন্নি হাজার কথা বলে এসবের ধারাবাহিকতায়, তার প্রেমিক ওরফে বর রাশেদের সাথে। ঘটনা পরম্পরায় আরমানউজ্জামান যে গতি চালু রাখে তা কিন্তু ভাষার গতরে পূর্ণতা দিতে পারেনি বলেই সচেতন পাঠকের মনে হয়। যেখানে সৃষ্টির সেরা মানুষকে শরীরের আকার ঠিক রাখতে জিমে ঘাম ঝরাতে দেখা যায়, একজন কথাসাহিত্যিক কেন তার ভাষাকে মেদবহুল রাখবেন তবে? কিংবা যে মিহিরকে উপন্যাসের নায়ক হিসেবেই লেখক উপাস্থাপন করেন, সে কেন পীরের দরবারে ছুটতে যাবে? হোক না পারিবারিক প্রচেষ্টাÑ যেহেতু মিহির আউটসোর্সিং-এ ভালো রকমের ইনকাম করে বলে আমরা জানতে পারি। তার আয়েই প্রায় বেউপায় আবুল হোসেন পথ দেখেন মাঝদরিয়ায়। মেয়েকে বিয়ে দেয় আধুুনিক ও কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার অবস্থান থেকে। সে-ই কি তবে পরের মানুষ? পর-মানুষ হলেই বুঝি আরো স্বস্তি লাগতো! এ সীমাবদ্ধতার  ভেতরে, উপন্যাসে চাষ দিলে, সীমাহীন সম্ভাবনা আপ্লুত করে আমাদের। একজন কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার হাহাকার, সংসারে বাতিল হয়ে যাওয়া ছেলেটির সগৌরবে ফিরে আসা, রাশেদ ওরফে তিন্নির বরের বিয়ে সংক্রান্ত বাজেটে ব্যাংকের লোন নেয়া ইত্যাদিকে আরমানউজ্জামান দৃশ্যমান করেন সফলভাবেই। এমনকি ঔপন্যাসিকের নজর থেকে বাদ যায় না শরবত বিক্রেতার কা-, পুলিশবন্ধুর সন্দেহ, মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলার দিকটাও বাদ যায় না দেখার প্রয়াস থেকে। এখানে বলে রাখা ভালো, আলোচ্য কথাকার পেশায় একজন ব্যাংকার। ফলে, ব্যাংকিং জগতের ব্যবহারিক জ্ঞান ঘরের মাঝে পরের মানুষ’কে সমৃদ্ধ করেছে। উপরন্তু আরমানউজ্জামান এর কথাসাহিত্য বিশেষ উপভোগের দিক তার কথোপকথন দক্ষতা। রাশেদকে ভদ্রোচিতও হয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা যেভাবে আলাপের ছলে সতকর্তা দেয় তা প্রাগুক্ত উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়।

হতে পারে মানসিক রোগ, দুঃচিন্তা ও অবসাদÑ আবুল হোসেন প্রায় রাতেই অন্যরকম স্বপ্ন দেখেন, তিন্নি বাপেরবাড়ি আসায়, মেয়েকে পেয়ে বাপ খানিক স্বস্তি পান বটে তবুও স্বপ্নের ঘোরে তিনি থাকেন আক্রান্ত এবং একটা তাবিরে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে পিতাকে। মিহির ও তিন্নির দুই রকম ব্যাখ্যা, মতিন মিয়াকে খোঁজ করা; রমিজ পাগলার কাছে গিয়ে পরামর্শ নেয়া সবটাই যেন বাস্তবতার নিরিখে করতে চান আলোচ্য কথাকার। কাহিনির বিন্যাসে তা খুব যুৎসই-ই হয়। আরো মজার বিষয় এই, অস্থির ও ভুল বোঝাবুঝির এই দুঃসময়ে স্বামী-স্ত্রীতে অমিল হতে পারে, বিশেষত অর্থনৈতিক টানাপড়েনে। মিহিরের কথামালা আমাদের সহজ করে দেয় মিলমিশ থাকতে। একরোখা সিদ্ধান্তকে বেশ বদলে দিতে পারে মিহির। এক্ষেত্রে মিহিরের ভূমিকা আমাদের সমাজে খুব প্রয়োজন। সাহিত্য সমাজ বদলায় এমন কথা জোর দিয়ে না বললেও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানের আর্শীবাদকে সীমাহীন পৃথিবীর মানবিক কল্যাণে পরিপূর্ণভাবে লাগাতে পারলে মন্দ হয় না। একজন সচেতন কথাসাহিত্যিক, যেকোন শিল্পীই তার সমাজকে নিরীক্ষণ করে এগিয়ে যেতে চায়, তাকেও রাখতে হয় দৃষ্টির প্রখরতা। আমি বিজ্ঞানের দান নেব হাত পেতে আবার মাজারেও যেতে চাইবো, তা কেমনে হয়! প্রত্যেক ঘটনার নিশ্চয়ই দুদিকের ব্যাখ্যা থাকতে পারে তবুও এদেশ কিংবা উপমহাদেশের ধর্মীয় সাধক-পির-আউলিয়াদের অবদানে বিস্মৃত নই আমরা। লোকাচারের বিশ্বাসে শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, চিন্তাকে একমুখি রাখতে হয়, অগ্রগামী চিন্তার সাথে কখনোই পশ্চাদপদতা যায় না; লেখার জগতে তো নয়ই।

আমাদের আবেগ সর্বস্ব ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন আরমানউজ্জামান। চলতি-পার্থিবতাকেও ছাড় দেন না বিনা বাক্যব্যয়ে। আমরা মনে করি, একজন কথাকারের ভূমিকা নিশ্চয়ই অনুসন্ধিস্যু হওয়া উচিত। তার মানে এই নয়, রমিজ পাগলার কিশোরীর সাথে মিহিরের ভালো লাগিয়ে দিতে হবে! নাটুকেপনা সিনেমার সাথে যায় ভালো, বাস্তবতার সাথে স্ক্রিপটের জীবন প্রায় সময়ই যায় না। জীবন তো আসলে সিনেমার সমান্তরালে চলে না, চলে না কথাকারের জীবন না-বোঝা কথার সংলাপে। তাছাড়া পড়ার শুরুতেই এবং প্রায়ই যদি বানান বিভ্রাট নজরে আসে পাঠকের বিরক্তি আসারই কথা।  র ও ড় এর ব্যবহার ঘরের মাঝে পরের মানুষ-এ একটা বিশ্রি কান্ড ঘটিয়ে দেয় কিন্তু। যৌথশব্দ ব্যবহারেও গ্রন্থকারকে আরো সচেতন হওয়ার দরকার ছিল। কখনোসখনো যুক্তির প্রেক্ষিতে প্রতিযুক্তি চমকিত করে পাঠকদের। জীবনবাদী কথাসাহিত্যে আমাদের অভাব, তরুণেরাই পূরণ করবে; এ পথে আরমানউজ্জামান ভরসার এক নাম হবে বলেই বিশ্বাস রাখতে চাই।

ঘরের মাঝে পরের মানুষ
আরমানউজ্জামান
গ্রন্থকুটির প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ১৫০
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১৮





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পদাবলি