অপবাদ
মোহাম্মদ অংকন
একটা সময় ছিল, যখন প্রতিদিন বিকালে নদীর তীরে গিয়ে জামগাছের নিচে বসতাম। এখন আর নদীর তীরে যাওয়া হয়না। কেন যাওয়া হয়না সে কথাই আজ বলব।
নদীর তীরে বসে যা যা লক্ষ্য করতাম তা আগে বলা যাক। এক মধ্যবয়সী সুন্দরী নারী প্রতিদিন নদীর ঘাটে আসত। কখনও সে হাড়ি পাতিল পরিষ্কার করত, কখনও সে মাছ, তরি-তরকারি ধুতে আসত কিংবা দুপুরের গোসলের কাপড় ধুতে আসত। আমি কিন্তু এসব মোটেও লক্ষ্য করতাম না। মোটের ওপর আমি জানতামই না যে নদীর ঘাটে কোনো মেয়ে আসে। যা জানার তা জেনেছি বিষাদময় ঘটনাটি ঘটার পর।
আমি নদীর তীরে রোজ আসি, একাকী বসে থাকি। কখনও সূর্য ডোবা দেখি, কখনও পাখিদেও নীড়ে ফেরা দেখি কিংবা দেখি কাজ শেষে বাড়ির দিকে ধেয়ে চলা পরিশ্রমী মানুষগুলোকে। নদীতে নৌকা খুব একটা চোখে পড়ত না। শুধু চোখে পড়ত দু একজন ছোট নৌকার জেলেকে। আমি নদীর তীরে যাই দেখিনা কেন, মানুষ জন আমাকে দেখত যে আমি নদীর তীরে বসে থাকি। কেউ হয়তো ভাল মনে করে, কেউ হয়তো ঠাট্টা কওে বলে, কবি বসে আছে কবিতা লিখছে। কারও কথাই ওভাবে আমি বিচার করতে যাইনা। কেননা, নেতিবাচক তা আমার একদম অপছন্দ।
কিন্তু এমন নেতিবাচক তা আমি কখনো আশা করিনি। কেউ একজন আবিষ্কার করে বসল, আমি ঐ মধ্যবয়সী নারীকে দেখার জন্য রোজ নদীর তীরে আসি, বসে থাকি। সে আরও আবিষ্কার করল, আমার আর ঐ নারীর মধ্যে নাকি অবৈধ প্রেমের দূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এসব আবিষ্কার করেও ক্ষান্ত থাকেনি। সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে একটি গল্প বানিয়ে বলে দিয়েছে ঐ নারীর পরিবার ও স্বামীকে। সামাজিক নিয়মে তারপর যা হবার তাই হওয়ার কথা। প্রথমত নারীটিকে তার স্বামী ডিভোর্স দেয়। অতঃপর নারীটি আত্মহত্যার মত কঠিন পথ বেছে নেয়।
জানতে চাইবেন না, এত বড় দূর্ঘটনা ঘটে গেল আর আমার ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া এল না? বলছি তাহলে পরের কথা। নারীটিও আসলে জানত না যে আমি নদীর তীরে এসে বসতাম। তার কাজ সে করত আর আমার কাজ আমি করতাম। কখনও কোনো দিন চোখে চোখওপড়েনি। কিন্তু লোকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে স্বামীর ঘরের সাথে জগৎস্বামীরও ঘর ত্যাগ করতে বাধ্য করল। এ অপবাদে হয়তো তার অনেক আক্ষেপ ছিল। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে তার সত্য কথাগুলো যেমন কেউ কানে নেয়নি, তেমনি আক্ষেপের অবসান ঘটাতে পারেনি।
প্রতিটি আত্মহত্যামুলক ঘটনায় কোনো না কোনো ইঙ্গিত বা চিরকুট রেখে যায় আতœহননকারী। এ ঘটনায় তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পাওয়া যায় একটি চিরকুট। তাতে লেখা থাকে, ‘তোমরা আমাকে অপবাদ দিয়েছ। বেশ ভাল করেছ। আমি তা মাথা পেতে নিয়েছি। কিন্তু নির্দোষ ঐ যুবক যেন মিথ্যা অপবাদে পড়ে আমার মত আত্মহত্যার মত জঘন্য পথ বেছেনা নেয়। চিরবিদায় পৃথিবী।’
মৃত্যুর সময় কেউ মিথ্যা কথা বলেনা বা বলতেপারেনা। তাই এই ধ্রুব সত্যগুলো সকলকে কষ্ট কওে হলেও মেনে নিতে হয়। সকলে ভুল বুঝতে পারে। ঘটনাগুলো আমি যখন অনুধাবন করতে পারি, তখন নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকি, আমি কি ঐ মধ্যবয়সী নারীর উপযুক্ত ছিলাম? আসলে এগুলো আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কিছু ভ্রান্তধারণা। কিভাবে একটি সংসারকে ভেঙ্গে দিল? একটি অপবাদই যথেষ্ট। তারপর আমি ভাবতে থাকি, না আমার একার পক্ষে এসব কুসংস্কার দূর করা সম্ভবপর নয়। অতঃএব এ নদীর তীরে আমার আর না আসাই যুক্তিগ্রাহ্য। তাই আর এক যুগ ধরে নদীর তীরে যাওয়া হয়না এই ভেবে যে আবার যদি কারও হৃদয়ে অপবাদের কলঙ্ক লেপন হয়!