ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা : পাঠ ও পর্যালোচনা
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
ছোটবেলায় একটি গল্প পড়েছিলাম। নাম ‘পটু’। একটি দুর্বল ও মৃত্যুপথযাত্রী ছাগশিশুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল গল্পের পটভূমি। বাড়ির কর্তীর ধারণা ছিল ছাগীর চার নম্বর বাচ্চার আর বাঁচার আশা নেই। কিন্তু ছেলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আগ্রহে পটু ধীরে ধীরে সুস্থ-সবল হয়ে ওঠে। এক সময় সেই ছোট্ট ছাগশিশুটি খাশি ছাগলে পরিণত হয়। এ পর্যন্ত বলা যায় গল্পের কাহিনি সরল পথেই ছিল। কিন্তু ঘটনার বাঁক শুরু হয় কুরবানীর জন্য পটুকে বলীদানের সিদ্ধান্তে। তখন পটু কেবল একটি খাশি ছাগল থাকে নাÑ এই প্রাণীটি হয়ে ওঠে মানবতার মূর্ত প্রতীক।
‘পটু’ গল্পটি লিখেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। তখন অবশ্য ইবরাহীম খাঁ’র প্রতিভা ও সাহিত্য সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। সময় পরিক্রমায় এখন উপলব্ধি করি খাঁ সাহেব কত বড় একজন মনীষী ছিলেন! বাংলা কথাসাহিত্যকে অঙ্কুর থেকে মহীরুহ পর্যায় নিয়ে আসতে যে সকল সাহিত্যিক বিশেষ অবদান রেখেছেন ইবরাহীম খাঁ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সমকালীন লেখক ও বিদগ্ধ গবেষক ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান তাঁর ‘ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা’ গ্রন্থে ইবরাহীম খাঁ’র ব্যক্তিজীবন, সাহিত্যকর্ম, চিন্তা, দেশপ্রেম, রাজনীতিসহÑ সকল বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলা ভাষার উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক। সাড়ে ছত্রিশ ফর্মার বিশাল কলেবরে এই গ্রন্থটি ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নানের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। এই গবেষণাকর্মটি ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ থেকে বই আকারে মুদ্রিত হয়েছে।
ইবরাহীম খাঁ পেশায় ছিলেন অধ্যক্ষ। লোকে তাঁকে সম্মান করে ‘প্রিন্সিপাল’ সাহেব বলে ডাকতেন। পরবর্তীতে এই প্রিন্সিপাল শব্দটি তাঁর উপাধি হিসেবে নামের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। ইবরাহীম খাঁ ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সংগঠক, সংস্কারক, সাহিত্যিক ও চিন্তক। সমাজ সেবা ও সাহিত্যকর্ম ছিল তাঁর প্রিয় কাজ। তিনি সমকালীন রাজনীতির সাথেও ঘনিষ্ট ছিলেন। পশ্চাৎপদ সমাজকে উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করার মাধ্যমে গণমানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। ইবরাহীম খাঁ ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সাািহত্য সাধক। দেশ ও দেশের মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তাই জাতির দুর্দিনে, সময়ের ডাকে তিনি ঘরে খিল এঁকে রুদ্ধ হয়ে বসে থাকেন নি। তৎকালীন খেলাফত আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বদেশি আন্দোলন, ভারত বিভাগ আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখ করার মত।
সাহিত্যিক ইবরাহীম খাঁ’র প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮২ টি। অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির সংখ্যা ২৪ টি। এছাড়া বাঁধাই করা খাতায় বিপুল পরিমাণ রচনা অপ্রকাশিত রয়েছে। ইবরাহীম খাঁ’কে বোঝার জন্য গবেষক পুরো গ্রন্থটিকে ছয়টি অধ্যায় ও কয়েকটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন। বলা যায়, কালের গর্ভে বিলীনপ্রায় ইবরাহীম খাঁর সাহিত্যকর্মকে এ গ্রন্থের মাধ্যমে নতুন করে তুলে ধরার প্রয়াস। ইবরাহীম খাঁর সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিকে জানার জন্য লেখক প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইবরাহীম খাঁর জীবন ও মানস যেমন : জন্ম, পরিচয়, লেখাপড়া, চাকরি ও চিন্তারস্বরূপ আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক ইবরাহীম খাঁর কথাসাহিত্য: উপন্যাস ও ছোটগল্প নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যে মুসলমানেরা নিজেদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন। ফলে পূর্ব বাংলার বেশিরভাগ বিত্তবান মুসলমান সামাজিকভাবে হেয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়িষ্ণুতার ভেতর পড়ে যান। মুসলমানদের সেই বিক্ষুব্ধ সময়ে ইবরাহীম খাঁয়ের আবির্ভাব যেন আলোকবর্তিকার মতো। মীর মোশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকের রচনার প্রভাবে গড়ে উঠেছে ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য মানস। গবেষক ইয়াহ্ইয়া মান্নান গ্রন্থটির চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে ইবরাহীম খাঁর নাটক, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরবর্তী গবেষকদের জন্য উপসংহার, পরিশিষ্ট, গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট সংযোজন করে বইটির গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছেন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ইবরাহীম খাঁর চিন্তা ও কর্মে সর্বদা খেলা করত মানুষের মঙ্গল। তিনি যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসা-বিদ্বেষ একদম পছন্দ করতেন না। তাই যুদ্ধ, হানাহানি, হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা বন্ধের জন্য তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বলেছিলেন :
“আমাদের আজ কর্তব্য সর্বপ্রকার উপায়ে অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের অলঙ্ঘনীয় দেয়াল গড়ে তোলা। মানুষের সমাজ হতে যুদ্ধকে যে দিন নির্বাসনে দেওয়া সম্ভব হবে, মানবীয় সাধনার চরম সাফল্যের শুভক্ষণ বলে সেদিন মানুষের কীর্তির ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা পড়বে।”
উপরিউক্ত মন্তব্য থেকে উপলব্ধি করতে পারি যে, ইবরাহীম খাঁ কেবল দেশে নয়, তাঁর গুরুত্ব ছিল বিশ্বজনীন।
গ্রন্থ : ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা * লেখক : ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান * প্রচ্ছদ : সোহেল আনাম * প্রকাশনী : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ * মূল্য : ৮০০ টাকা।