সৃষ্টিশীল উন্মাদ : সালভাদর দালি



সৃষ্টিশীল উন্মাদ 
সালভাদর দালি

লুফাইয়্যা শাম্মী

পরাবাস্তববাদী চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি স্যুরিয়ালিস্টিক এবং এবস্ট্রাক্ট পেইন্টিংয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন চিত্রশিল্পের জগৎ এ। কিউবিজম, ফিউচারিজম ও মেটাফিজিক্যাল পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে তিনি তার চিত্রশিল্পে স্বপ্ন, কল্পনা, নির্মোহ বাস্তবতা ও মানুষের মনোজগৎকে এমন ভাবে রূপ দিয়েছেন যার কারনে দালি আজও জগদ্বিখ্যাত। পাশ্চাত্য চিত্রকলায় শিল্প আন্দোলনের ইতিহাস সাজিয়ে তুলেন তিনি নিজের স্যুরিয়ালিস্টিক চিত্রকলার মাধ্যমে।

১৯০৪ সালের ১১ মে স্পেনের ক্যাটালোনিয়ার ফিগুয়েরেস শহরে জন্ম গ্রহন করেন বিস্ময়কর এই চিত্রশিল্পী। ছোট থেকেই অদ্ভুত গড়নার এই মানুষ চিত্রশিল্পের জগতে প্রবেশ করলে সৃষ্টি হয়  অদ্ভুত এক বিপ্লবের। অসচেতনতার কল্পনা কিংবা আবেগকে একটি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার প্রবণতা থেকে দালি পৃথিবীকে দেয় শ্রেষ্ঠ কিছু চিত্রশিল্প, চিত্রকলায় যুক্ত করে নতুন এক অধ্যায়। দালির চিত্রকলা এতো বেশি বিখ্যাত যে শুধু মাত্র তার জন্যই দুইটি মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে। তিনি যে শুধু প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীই ছিলেন তা নয়। তার নিজের প্রতি এতোটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি নিজেকে নিয়ে লিখেন-‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি’। দালীকে বুঝতে হলে জানতে হলে তার চিত্রকর্মের দিকে নজর দিতে হবে।

দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি  (১৯৩১) :


সালভাদর দালির বিখ্যাত কিছু চিত্রকলার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’। বহুল আলোচিত এই ছবির অন্যতম মূল আকর্ষণ ঘড়ি। পটভূমিতে দেখা যায় সমুদ্রের তীর ঘেষে পাহাড় স্থির অনড় দাঁড়িয়ে। একটা টেবিলে গাছের কান্ডে ঝুলন্ত ঘড়ি। কিছু আকৃতি, কিছু ছোট অবজেক্ট। তবে সবচেয়ে চোখে পড়ে ৪টা পকেট ঘড়ি যা বিচিত্র ভাবে পরে আছে চার জায়গায়। তিনটি ঘড়ি যেন গলে গলে পড়ছে। বাকী একটি ঘড়ি অন্য তিনটি ঘড়ি থেকে ভিন্ন। কমলা রঙের ঘড়ি, এবং তার কেন্দ্রের দিকে মুখ করা অনেক গুলো পিঁপড়ে, যেন কোনো কিছু আকর্ষণে ছুটে চলছে কেন্দ্র অভিমুখে। দালীর সমস্ত কাজ’ই যেন মনের সচেতন এবং অবচেতন ভাবকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। গলে যাওয়া ঘড়ি গলে পড়া সময় হতে পারে, হতে পারে অসতর্ক মনের প্রতিবিম্ব। অবচেতন মনের নিরবিচ্ছিন্ন ভাবনা, যা হারিয়ে যাওয়ার দিকে এগুচ্ছে ক্রমাগত। আর কমলা রঙের ঘড়ি তার সচেতন মনের অবস্থা, যা গলে যাচ্ছেনা কিন্তু পিঁপড়ের দল জেঁকে ধরেছে। যা সচেতন মনের ধ্বংস কিংবা ক্ষতির সম্মুখীন এক দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থা ও হতে পারে, হতে পারে নিজেই কিভাবে সময়কে ক্ষতিগ্রস্থ করে চলেছি কিংবা সময় কিভাবে ধীরে নষ্ট হচ্ছে চোখের সম্মুখে। সমুদ্রের জায়গায় সমুদ্র, পাহাড়ের জায়গায় পাহাড় দাঁড়িয়ে শুধু সময় গলে গলে পড়ছে অবচেতন ভাবে। হতে পারে দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি শুধু মাত্রই সচেতন ও অবচেতন মনের একটা অবস্থা বুঝাতে চেয়েছেন সালভাদর দালি।

দ্য ফেইস অভ ওয়ার (১৯৪০) :


দালির অন্য একটি বিখ্যাত চিত্র হচ্ছে  ‘দ্য ফেইস অভ ওয়ার’। নিজ মাতৃভূমি থেকে ক্যালিফোর্নিয়াতে নির্বাসিত দালী যুদ্ধের ভয়াবহতার এক অনন্য চিত্র ফুটিয়ে তুলেন তার দ্য ফেইস অব ওয়ারে। এই ছবিটির সময় স্পেনের গৃহযুদ্ধের শেষ এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কাল। এই ছবির কেন্দ্রে এক ভীত আতঙ্কিত নারী মুখ কিংবা বলা হোক যুদ্ধের মুখ। যার চোখের ভেতর কঙ্কাল, তার ভেতরেও কঙ্কাল, এভাবেই কঙ্কালের পুনঃপুনিক একটা অবস্থা যেন, চলছেই। অর্থাৎ এটার এক অর্থ করলে বলা যেতে পারে নারীর চোখ শুধু মৃত্যু দেখেছে, মৃত লাশ বয়ে বেড়ানো চোখে মানুষের কঙ্কাল ব্যতীত আর কিছু নেই। তেমনি নারীটির মুখেও কঙ্কাল, ঠিক চোখের মতো, পুনঃপুনিক ভাবে চলছেই। অর্থাৎ নারীর মুখ ও শুধু মৃত্যুর কথাই বলছে, অগণিত মৃত্যুতে ভরে আছে চোখ, মুখ। যুদ্ধের এক ভয়াবহ অবস্থা নিজের চোখে দেখে আতঙ্কিত ভীত এক নারীর রূপ। নারী মুখের পিছনে এক ভয়াবহ শূন্যতা, কিছুই নেই, এ হতে পারে যুদ্ধের ধ্বংসের কারনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সেটা বুঝানো হয়েছে। নারীমুখের এক পাশে একটি হাতের ছাপে হয়তো দালী তার নিজের অবস্থাটাই বুঝাতে চেয়েছেন। জন্মস্থান স্পেনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের প্রতিফলন দালীর এই চিত্রকর্ম। যাতে তিনি দেখিয়েছেন, মৃত্যু, শূন্যতা, মৃত্যু এবং মৃত্যুর সাক্ষ্য এক মৃত্যুর দলিল।

দ্য গ্রেট মাস্টারবেটর (১৯২৯) :

দালীর অন্যতম আলোচিত এক সৃষ্টি। ধারনা করা হয় এটি দালীর শেলফ পোর্টেট। এই ছবিতে যৌনতা, বিতৃষ্ণা কিংবা তারচেয়েও বেশি কিছু বুঝানো হয়েছে। অনেক গুলো অবজেক্ট দেখানো হয়েছে, যা ধরে ধরে আলোচনা করা সম্ভব নয়, কারন শিল্পীর মনের অবস্থা বুঝে এই ছবি আলোচনা করা অন্তত আমার পক্ষে তো সম্ভব ই নয়। এই ছবিতে তবুও যা বুঝা যায় একটি শান্ত মুখ, বন্ধ চোখ-পরিশ্রান্ত!  ক্লান্ত হতে পারে। নাকের কাছে ঘাসফড়িং। দালী ছোট বেলায় ঘাসফড়িং প্রচ- ভয় পেতেন। হয়তো এই ছবিতে তিনি ঘাসফড়িং দিয়ে তার ভয়টা ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার পেটে কিছু পিঁপড়ে দেখিয়েছেন। এর মাধ্যমেও ভয়, ধ্বংস, কিংবা আতঙ্কের কিছু বুঝিয়েছেন হয়তো। হাটু ফেঁটে রক্ত বের হওয়া দুটো পা ঠিক কি বুঝানো হয়েছে বলা ঝামেলা, হতে পারে রক্তক্ষরণ,  কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝাতে চেয়েছেন তিনি। একটা নারী মুখ যা পুরুষাঙ্গের কাছে থেমে আছে, সঙ্গমের আনন্দ, উত্তেজনা ফ্যান্টাসি বুঝাতে এটা এঁকে থাকতে পারেন। এই ছবিতে  পাথর, গাছের ডাল, মানুষের অবয়ব, সিংহের মুখ এবং আরো কিছু অবজেক্ট রয়েছে যা ছবিকে করে তুলেছে দুর্বোধ্য। এই ছবিতে দালী সঙ্গমের প্রতি ভয়, বিতৃষ্ণা আবার ফ্যান্টাসি সবকিছু একই সাথে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, যার কারনেই এই ছবি হয়ে উঠেছে অধিক আলোচিত।

দ্য বার্নিং জিরাফ (১৯৩৭) :


ধারনা করা হয় এই ছবিটি দালীর নিজের ক্ষোভ আর দুঃখ থেকে সৃষ্টি। এই ছবির সময়কালে স্পেনে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছিলো। যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ, অস্তিত্ব হীনতা বুঝাতে চেয়েছেন তিনি অনেকাংশে। এই ছবিটিতে গভীর নীল আকাশ দেখানো হয়েছে, যার ফোরগ্রাউন্ডে রয়েছে দুইটি নারী প্রতিকৃতি। ছবির নাম বার্নিং জিরাফ হলেও জিরাফের প্রতিকৃতি আছে ছোট করে পিছনের দিকে যা দুই নারীর তুলনায় ছোট করে দেখানো হয়েছে। নারী প্রতিকৃতিকেই যেন ছবিটাতে ফোকাস করা হয়েছে বেশি। মূল নীল দেহ নারীর শরীরের থোরাক্স থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি বড় খোলা ড্রয়ার, আর বাম পা থেকে বেরিয়ে এসেছে ক্রমান্বয়ে বড় থেকে ছোট হয়ে আসা আরো সাতটি খোলা ড্রয়ার।নারীর হাত এমন ভাবে রেখেছে যেন কিছু থেকে ভয় পাচ্ছে, সরে যেতে চাচ্ছে কিংবা কিছু ঠেকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। পিছনে অন্য নারী প্রতিকৃতির এক হাতে একটা মাংসের টুকরো ঝুলছে। দুই নারীর প্রতিকৃতিই কিছু ক্রাচের মতো অবজেক্ট দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ভূমির সাথে, বলা যায় নারী প্রতিকৃতিকে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে দালী সতকে বুঝাতে নারীর প্রতিকৃতি এঁকেছেন। নারী অন্যের ইচ্চাধীন, নারীকে দমন করা যায়, নারীর ভেতরে গোপন থাকে অনেক কিছু। সমাজের অবস্থাকে নারী আকৃতি দিয়ে দালী বুঝাতে চেয়েছেন অন্যায় আর নৃশংসতা। খোলা ড্রয়ার গুলো দিয়ে ভেতরের গোপন সত্য কিংবা গোপনীয় কিছু বুঝাতে চেয়েছেন তিনি। আবার প্রতিকৃতিকে ভূমির সাথে আটকে রাখাকে তিনি দমন করাও বুঝাতে পারেন। এই নারী প্রতিকৃতির পিছনে একটা জিরাফের গায়ে আগুন লেগেছে, ধোয়া উড়ছে। জিরাফ তাকিয়ে আছে দূরের পাহারের দিকে। যুদ্ধ এই সমাজ ব্যবস্থার সবকিছু পুড়ে ফেলছে, কিংবা সবকিছুই ধ্বংসের পথে দালীর অবচেতন মনে তা উঁকি দিয়েছে আর সৃষ্টি হয়েছে এই অনন্য চিত্রকলা।


শিল্পকলার ইতিহাসে তিনি যে পরাবাস্তবিক আবহ ফুটিয়ে তুলেছিলেন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তা অত্যন্ত বিস্ময়কর। বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার জগৎ এ দালি এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। স্যুরিয়ালিস্টিক আবহের মাধ্যমে চিত্রশিল্পের জগতে দালী যে বিপ্লব এনেছিলেন তাতে তিনি অমর হয়ে আছেন- শিল্প জগৎ, শিল্পমনে তার বিস্ময়কর সব চিত্রকর্মের মধ্যে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট