দিনটি ভুলে যাওয়ার নয়



দিনটি ভুলে যাওয়ার নয়
আশিক আহমেদ

আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের ও বেদনাদায়ক একটি দিন। এমন একটি দিন আমার জীবনে আসবে কখনো ভাবিনি।
সেদিনের দিনটি ছিলো একেবারেই ভিন্ন বলা যায় প্রত্যেক দিনের মতো স্বাবাভিক কোন দিন  নয়।  সেদিন হঠাৎ সকালবেলায় চাচাতো ভাই মাসুমের ডাকে ঘুম ভাঙল আমার। কাকার দোকানে থাকার জন্য রাতে তেমনটা  বাড়িতে থাকা হতো নাহ...
তাই সাঝ সকালে দোকানে গিয়েই ডাকতে শুরু করে মাসুম। তবে হটাৎ ঢাকার কারণটা বুঝে উঠতে পারছিলাম নাহ। তবে ঢাকার কারন টা ছিলো একটু  ভিন্ন।
-তর মায়ে তোদের বাড়ির বাথরুমের পাশে অঙ্গান অবস্থায় পড়ে আছে। রুবেল ভাই, একা একা কিছু করতে পারছে নাহ, তুই বাড়ি চল তাড়াতাড়ি।
দোকানের সাটার খুলতে নাহ খুলতেই মাসুমের মুখের কথা।
কথাটা শুনার পর থেকেই ভেতর টা জানি কেমন  শুরু করতে লাগল। কারন আমি আমার জীবনের থেকে বেশী ভালোবাসি মাকে। তাই আর দেরি নয় জ্বলদি বাড়িতে ছুটে গেলাম। আর রুবেল হচ্ছে আমার বড় ভাই।
বাড়িতে এসে  দেখলাম আমার মা কোনো কথা বলতে পারছে না; অঙ্গান হয়ে পড়ে আছে মুখ দিয়ে একটু একটু ফ্যানার মতো বেরোচ্ছে । মার এমন অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই দেরি না করে।
রুবেল ভাই, আর মাসুমকে রেখে দৌড়ে গেলাম ফারমিসি ডাক্তার শফিক ভাইকে ডাকতে সম্পর্কে উনি আমাদের ভাই।
উনি এসে মার এই অবস্থা দেখে বলল হাসপাতালে নিতে হবে। আর এরকম একটা অবস্থায় বাবা ছিলো না বাড়িতে। বাবার খোঁজ আর গাড়ি আনার জন্য দৌড়ে গেলাম সলিং মোড় বাজারে।
কোনোটাই না পেয়ে আবার বাড়িতে ফেরা। এই দিকে মার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।
ওই সময় হঠাৎ বড় ভাই ইজাজ আহমেদ মিলন ভাইয়ের গাড়িটি পেয়ে গেলাম।  বিউটি ভাবি তার দুই ছেলে প্রান্তর আর রাহীকে ইস্কুলে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের ঘরের পেছন দিয়েই যাবার পথ। সেই সময় বিউটি ভাবি মার এরকম অবস্থা দেখে বিউটি ভাবি জ্বলদি মাকে গাড়িতে তুলতে বলল। পরে ওই গাড়ি করেই  নিয়ে যাওয়া হলো; মাওনা চৌরাস্তা আলহেরা হাসপাতালে । মার অবস্থা ভালো নাহ দেখে ঐ খানের ডাক্তার রা বলল ঢাকা নয়ত ময়মনসিং মেডিকেল এ নিয়ে যেতে।
আর ততক্ষণে মার এমন অবস্থার খবর চলে গেছে তার বাপের বাড়ি । খবর শুনার পর তার ভাই, বোনেরা  কিছুক্ষণ পর ভির জমাতে শুরু করে হাসপাতালে।
ঢাকার দিকে জ্যাম থাকায় ময়মনসিং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য রওনা হলাম। যাত্রা পথে আমার সাথে ছিলো; আমাদের সাইদুল কাকা, আমার এক মামা, মামানি ও খালা।

বাকী সব ইতিহাস...
আজও সেইদিনটি ভুলতে পারনি। জানি পারবনা কখনো ভুলতে।
সতিই দিনটি ভোলার নয় আজো মনে আছে, মনে আছে সেদিনের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ  হাসপাতালের ৩য় তলা ভবনের  মেঝোতে শুয়ে থাকা অবস্থার তোমার করুন সেই  বিবৎস্য দৃশ্য। আজো ঘোর অন্ধকারে আমার চোখে জ্বল জ্বল করে ভেঁসে উঠে তোমার গোলাকার মুখ, হাড্ডিশার শরীর।
সেইদিন বুঝি; অভিমান করেছিলে আমার সাথে। অভিমান নয়তো- কী? অভিমান না- করলে হয়তো, একটি কথাও হলে বলতে আমাকে একবারের জন্য।  আমি চাতকের মতো তাকিয়ে ছিলাম তোমার মুখের দিকে। যদি তোমার কন্ঠসর দিয়ে কোন শব্দ বের হয়। যদি একবার তুমি আমার নামটি ধরে ডাকো।
আমি তোমার পাশেই থাকতে চেয়েছিলাম শেষ মুহর্ত পর্যন্ত । কিন্তু ভাগ্যর পরিহাসে থাকতে পারিনি। বড় ভাই, ইজাজ আহমেদ মিলন, মোশারফ হোসাই তযু ও রাজীব ভাইকে, আনতে গিয়ে ছিলাম হাসপাতলের নিচ তলা থেকে।
ফিরে এসে দেখি তোমার হাড্ডিশার শরীরের চারপাশে মানুষের ভিড় জমে গেছে। কারো কন্ঠনালী থেকে আস্তে আস্তে কান্নার শব্দ ভেঁসে আসছে আমার কানে। আমি তখন আর স্থির হয়ে থাকতে পারলাম না। দৌড়ে ছুটে গেলাম তোমার কাছে। গিয়ে দেখলাম তুমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছো না।
কিন্তু আমি তখনো বুঝে উঠতে পারিনি তুমি যে তখন মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছো।
আমি নিস্তেজ আর নিস্তদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তখন। কিছুক্ষণ পর আমার কান্নার আহাজারি, আর বিকট শব্দে অসার হয়েছিলো পুরো হাসপাতাল। আমার মুখ থেকে শুধু তখন এ কথাটা বের হচ্ছিল
‘আমার মায়ে আমার লগে একটা কথাও কইলনা...
মনে আছে, আমি  শুধু চিৎকার করে এই কথাটাই বলেছিলাম বার বার। মা, তুমি হয়তো শুনোনি কিন্তু হাসপাতালের ভবন আর প্রতিটি দেয়াল কান পেতে শুনেছে  আমার কথা আর আমার  কান্নার বিকট শব্দ।
খুব কী- বেশী অভিমান-ছিলো আমার প্রতি । যে রাগ ঢাক আর অভিমান নিয়েই পারি জমাতে হলো না-ফেরার দেশে।
আজ দু’বছর হয়ে গেলো আমিতো  কাউকে মা বলে ডাকতে পারিছিনা। মা, ডাকটি শুনলে আমার বুকের বাম পাঁজর মৌন বাথ্যায় ভরে উঠে। খুউব খুব বেশী কষ্ট, হয় তখন। তোমার কত শত আদর আর বকুনি ছাড়াই কেটে গেলো কতদিন।
এভাবেই হয়তো কেটে যাবে বাকী দিন। আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে মা,  তুমি কেমন কবি, হেলাল হাফিজের কবিতার  দু’টি লাইন ধার করে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘কষ্ট নেবে কষ্ট, হরেক রকম কষ্ট আছে’।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট