ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১৩


(গত সংখ্যার পর)
দীপু ভাই অবুঝ কণ্ঠে বলে, ‘দেবী, জনম জনম কাঁদিব।’
সন্ধেবেলা জাকির সাহেব আসে বাবাকে নিয়ে। শুভপুর থেকে বাবা এসেছে পত্রিকায় বেবী আপাকে জড়িয়ে ধরা ছবি দেখে। পত্রিকায় যেভাবে লিখেছে তাতে উর্মির জীবন বিপন্ন। বসন্ত পাল অতি সাধারণ মানুষ। কন্যার সংবাদে ছুটে এসেছেন।
বাবাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে উর্মিলা। স্যালাইনের হাত দিয়ে বাবাকে ধরতে যায়।
জাকির সাহেব বলে, ‘অস্থির হইও না। উনি বয়স্ক মানুষ কষ্ট পাবেন।’
কে শোনে কার কথা। বাপ-বেটির ক্রন্দনে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
বাবা বলল, ‘উর্মি তুই ছাড়া আমার তো কেউ নেই।’ উর্মিলা কাঁদতে থাকে। এক সময় কান্না থামিয়ে বলে, ‘তুমি কেঁদো না বাবা। উর্মির মতো কত ছেলেমেয়ে তুমি জন্ম দিয়েছ। তারা তোমার কেউ না?’
‘না না আমি সে কথা বলি নাই।’
উর্মিলা জাকির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার বাবা রাতে থাকবেন কোথায়?
‘কেন? তোমার বেডে। আমি কেয়ারটেকার, রুবীকে সেই ভাবে ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছি।’
‘ও। রুবী খুব ভালো মেয়ে বাবা।’
বাবা উর্মিলার  মাথায় হাত বোলাতে থাকে।

১৪.

পরদিন ড্রেসিংয়ের পর ডাক্তার বলল, ‘দু-একদিনের মধ্যেই বাসায় চলে যেতে পারবেন। ওষুধগুলো চলবে। ঘুমের প্রয়োজন।’
উর্মিলার বিচিত্র রকম ছবি নিয়ে পত্রিকাগুলো স্টোরি ছেপেছে। যেন সব গল্পের কেন্দ্রবিন্দু শুভপুর গ্রামের একজন অতি সাধারণ শিক্ষক কন্যা। যার রয়েছে অমিত তেজ আর সুদৃঢ় দেশপ্রেম। সারল্যে গড়া উর্মিলা পাল হয়ে উঠেছে জাতির এক অনন্য বিস্ময়। রাতারাতি গ্রাম, গঞ্জ-লোকালয় থেকে দেশান্তরে পৌঁছে গেছে উর্মিলা বলে একটি মেয়ের নাম। গার্ডিয়ান লিখেছে ‘সি ইজ ব্রিলিয়ান্ট লেডি এন্ড পেট্রিট।
ফ্রন্টলাইন লিখেছে, পেট্রিয়েট এন্ড গ্লামারার্স গার্ল।’
মিতালী সিকদার বারবার বলতে থাকে ‘উর্মি, আমি কিন্তু হিংসে করতে শুরু করেছি।
 শিমু দিদি বলেন, ‘জাকির সাহেব যেভাবে উর্মিলার বেডে এসে দাঁড়িয়ে থাকে তাতে মনে হয় উর্মির বাধ্য প্রেমিক। শুধু হুকুমের অপেক্ষায়।’
নাজনীন আপা বলেন, ‘উর্মি, তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে।’ এ সময় হাসপাতাল জুড়ে কলবর। তাড়াহুড়ো। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আহতদের দেখতে আসছেন। প্রথমে শহীদ জননীসহ নেতানেত্রীদের দেখে তারপর উর্মিলার ওয়ার্ডে আসবেন। ওয়ার্ডবয় থেকে প্রশাসন পর্যন্ত  ক্যামন তটস্থ। নার্স-ডাক্তারদের ব্যস্ততার সীমা নেই। হঠাৎ করে সবকিছুতেই যেন ক্যামন সুনসান  নীরবতা।
ইতোমধ্যে শিমু দিদিরা চলে গেছেন। তন্দ্রাচ্ছন্নতায় ডুবে যেতে থাকে উর্মিলা। দীপু ভাইয়ের ডাকে ঘুম-মগ্নতা কেটে যায়। চোখ মেলে তাকাতে দেখে দীপু ভাই দাঁড়িয়ে। পাশে জননেত্রী শেখ হাসিনা। দীপু ভাইয়ের হাতে ফুলের তোড়া। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শেখ হাসিনা বললেন, ‘তুমিতো অসাধারণ মেয়ে হে।’
হতবিহ্বল উর্মিলা কী বলবে? আকস্মিক মনে হলো তার এই কথাটি, ‘বাবা আপনাকে হাসু বলে ডাকে।’
শেখ হাসিনা মৃদু হেসে সরল ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমার নামতো হাসুই। উনি তো তাই ডাকবেন।’
‘ও।’
‘তোমার বাবা কোথায়?’
‘শুভপুরে থাকেন। রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার।’
‘উনাকে আমার প্রণাম পৌঁছে দিও। বলো, উর্মিলার মতো হাসুও মাতৃভূমির জন্য কোনো আপস করে না।’
শেখ হাসিনা উর্মিলার মাথায় হাত বোলাতে থাকেন। আর ঠিক তখন ওর দু’চোখ ভরে জলের ধারা নামে।
প্রেসম্যানরা পটাপট ফটো তুলছে। আহতদের দেখে শেখ হাসিনা যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, উর্মিলা দেখে দীপু তেমনি ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে।
‘দেবী, তোড়া কোথায় রাখব? ভাবছেন শেখ হাসিনা দিয়েছেন। না না।  পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনেছি।  ভাবছিলাম, তোড়া দেবার ছবি পত্রিকায় উঠবে আর আমি অমর হয়ে থাকব।’ দীপু ভাই ফুলের তোড়া পাশের  ডেক্সে সাজিয়ে রাখলেন।
উর্মিলা স্মিত হেসে বলে, ‘কী যে বলেন দীপু ভাই! অসুস্থ মানুষকে কষ্ট দেয়া কি ঠিক?’
‘আমিও অসুস্থ। সুলতানা রাজিয়ার জন্য কাতর হৃদয় মুচড়ে গেছে। কেউ দেখেনি!’
‘দীপু ভাই, চুপ করবেন না আমি উচ্চস্বরে কাঁদব। তখন নার্স এসে আপনাকে ওয়ার্ড থেকে বের করে দেবে!’
‘তখন রামের মতো বনবাসে যাব। অযোদ্ধা ছেড়ে পঞ্চবটি বনে। নিঃসঙ্গ, একাকী। শুধু দেবী সীতা থাকবে না।’
উর্মিলা অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কথা বলে না।
‘এ দু’দিন ঘুমুতে পারিনি। চোখের তারায় দেবী ভেনাস হৃদয়বিদ্ধ কায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই থেকে আমাকে কেউ উদ্ধার করেনি আহারে।’
‘দীপু ভাই, আপনি এভাবে কথা বলবেন না।’
‘অবশ্যই বলব। দেবীরা অদৃশ্য। পুরাণের নায়িকা। যুগ-যুগান্তরের উপকথা। আমি তাদের দেখিনি। কেউ দেখেনি। আমার দেবযানী রক্ত-মাংসে মানুষ। তার মানুষ জন্মের জন্য গর্বিত। আমি কষ্টে প্রেমে তাকে দেখতে পাই। তাকে নিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে। মিছিলের রাজপথে দিগন্ত কাঁপানো প্রতিবাদে ফেটে পড়তে  ইচ্ছে করে। আমি কি বেশি বলছি, দেবী?’
মাথার পাশে রাখা সংবাদপত্রে চোখ রাখতে যে সংবাদে দৃষ্টি আটকে যায় তার নাম মেরী মমতাজ। জেনারেল এরশাদের প্রেমিকা। লম্পটের  অংশীদার।
সংবাদটা এমনভাবে পরিবেশন করেছে যেন জগতের তাবৎ মানুষের ঘৃণার উদ্রেক হয়। উর্মিলার গা রি রি করতে থাকে।
‘দেবী, আপনাকে তো বলা হয়নি। মা আর আসমাকে ঢাকা নিয়ে আসব।’
উর্মিলা মৃদু স্বরে বলে, ‘অবশ্যই নিয়ে আসবেন! তাদের তো আপনি ছাড়া কেউ নেই।’
‘ওদেরকে আপনার কথা বলেছি। ওরা জানে না আপনি জগৎ জুড়ে থাকা এক নারী।’
‘আপনি বেশি বলেন।’
‘সত্য বলছি।’
‘শহীদ জননী, বেবী আপা কেমন আছে।’
‘শহীদ জননী চলে গেছেন। বেবী আপাকে আজ রিলিজ দিতে পারে। তিনি তো আপনাকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। না করতে পারতাম। না করিনি।’
উর্মিলা মৃদু হাসে। দীপু ভাইয়ের মুখের দিকে স্থির চোখ রেখে বলে, ‘দীপু ভাই, আপনি তো আমার লোকাল গার্জিয়ান। সমস্যা কোথায়?’
‘না না কোনো সমস্যা নেই। তবে দেবী বলে কথা। আপনার আহত ছবি নিয়ে পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো ঢাকা শহর। দেয়ালে দেয়ালে আপনি সেঁটিয়ে আছেন। আহ কী আনন্দ ঘরে ঘরে।’
উর্মিলার কোনো ভাবান্তর হয় না। শুধু শুভপুরের কথা মনে হয়। অনেক পরিচিত মুখ স্মৃতিতে ছায়াপাত করে যায়।
বাঁশিওয়ালা রফিক ভাই কি জানে উর্মিলা মেডিকেল বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। স্কুল গেটের নীরব প্রেমিক মনসুর। কী করুণ তার চোখ! উর্মিলা, লিলুয়া বাতাস অনুভব করে। মিহিন শব্দের ফ্রেমে আটকে থাকে করুণ রাখালিয়া অথবা বংশাইয়ের  জলের করুণ ক্রন্দন। ভাটি গাঙ বেয়ে কেউ কি চলে যায়। উর্মিলা অনুভব করে খোল-করতালের দ্রিমিকি-দ্রিমিকি উন্মাতাল কোলাহল।
‘দেবী, প্রেসের সঙ্গে কথা বলতে হবে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে। মনে রাখতে হবে আমরা ডিক্টেটরহীন সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। যার মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন আছে।’
‘আমি কি পারব, দীপু ভাই?’
‘পারবেন। অসাধারণেরা সব পারে।’
‘ফাজলামো করবেন না।’
‘আমি এর বাইরে কিছু জানি না। তবে দিব্যদৃষ্টি বলে, ‘যে পথরেখায় হাঁটতে চেয়েছি, তা আর এখন দুর্লঙ্ঘনীয় নয়। সামনের পথচারী পেয়েছি, দুঃখ-কষ্ট হলেও মেনে নেব।’
‘দীপু ভাই।’ উর্মিলা আত্মচিৎকার করে ওঠে।

পরদিন হাসপাতাল থেকে রিলিজ পায় উর্মিলা। জাকির সাহেবের ওপর দায়িত্ব হাসপাতাল থেকে উর্মিলাকে নাখালপাড়া নারীমুক্তি কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়া।
দশটার মধ্যে মাইক্রো নিয়ে জাকির সাহেব হাজির।
ট্রলি থেকে নেমে উর্মিলা গাড়িতে ওঠে। জাকির সাহেব বসে সামনের সিটে। এই ক’দিনের বেড রেস্টে উর্মিলাকে অসম্ভব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। শুধু মাথার ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ।
টিএসসির মোড়ে আসতেই জাকির সাহেব বললেন, ‘গতকাল ডিবি অফিস থেকে লোক এসেছিল। তোমার আদ্যোপান্ত জানতে চাইল।’ উর্মিলা কথা বলে না।
‘উর্মিলা কি ভয় পেলে?’
‘না! ভয় শুভপুরে রেখে এসেছি।’
জাকির সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে আবার বলেন, ‘গুড! আমি তোমার কাছ থেকে এরকম কথাই আশা করেছি।’
‘ধন্যবাদ।’
‘উর্মিলা, তোমার নিকট আমি কৃতজ্ঞ। কেন, কী কারণে! তা বলা হবে না।’
‘আমি জানি।’
‘জানো! হ্যাঁ-হ্যাঁ জানতেই পারো। কিছু কিছু মানুষ নাড়ি-নক্ষত্রের সংবাদ জানে।’
‘আমি তেমন নই। সাধারণ। শুভপুরের উর্মিলা নগরে এসেছি।’
‘আমি সাধারণের কাছে পরাজিত হয়েছি। এ পরাজয়ে গ্লানি নেই।’
জাকির সাহেবকে অতি আপনজন মনে হয়। মানবসন্তান হিসেবে এটা তার আজন্ম অধিকার।
(চলবে)


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট