ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৭




জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]

বাবা বলল, তোমার কি ভালো লাগছে হাসান?
হাসান কিছু বলল না। হাসানের ছোট ভাই নিলয় বলল, আমার খুব ভাল লাগছে স্যার। এই জীবনে এতটা ভাল কখনো লাগেনি।
তোমার জীবন তো খুব ছোট। এখনই ‘এই জীবনে’ এভাবে কথা বলার সময় হয়নি। সামনে তোমার অনেক কিছুই দেখার সুযোগ রয়ে গেছে।
জি স্যার।
তুমি আমাকে ‘স্যার’ বলছো কেন? আমি কি তোমাদের স্কুলের মাস্টার? তুমি আমাকে দাদা বলবে, আর হাসান বলবে ভাই। আবার যদি ‘স্যার’ ডাকো তো থাপ্পর দিয়ে তোমার তিনটা দাঁত ফেলে দেব। তুমি কি তিনটা দাঁত হারাতে চাও?
জি না স্যার।
তাহলে আর ‘স্যার’ ডাকবে না।
ঠিক আছে দাদা।
আমার বুকের কাছে আসো, তোমাকে আদোর করি।
নিলয়কে বুকে জড়িয়ে বাবা বললেন, দ্যাখো ঐ চাঁদটা! ঐ হিজল ডালের ফাঁক দিয়ে। কোথায় যেন পড়েছিলাম-হিজলের ডাল কেমন হিজিবিজি রেখা এঁকে দিয়েছে চাঁদটার মুখে।
অন্তর বলল, বাবা, আমরা কিন্তু চাঁদ দেখতে আসিনি, এসেছি চাঁদের জ্যোৎস্না অবগাহন করতে।
তা ঠিক, তাই বলে চঁদের প্রশংসা করব না? যে চাঁদ এমন নিঃস্বার্থ আলো ঢেলে দিচ্ছে......। তাই তো নজরুল বলেছেন-চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে/ গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধুলি মাঝে।
হাসান বলল, স্যার, এটা কিন্তু তর্কের সময় না। তর্ক করে একটা মুহূর্ত অতিবাহিত করা ভুল হবে। প্রতি মুহূর্তে চাঁদটা একটু সরে যাচ্ছে। রাত এগিয়ে যাচ্ছে ভোরের দিকে। প্রতি মুহূর্তে বনের ইফেক্ট চেঞ্জ হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তের চেঞ্জ অবশ্য আমরা ধরতে পারব না। তবে প্রতি ঘন্টার চেঞ্জ ধরার চেষ্টা করতে হবে।
তুমি ঠিক বলেছো। তবে আবৃত্তি বা গান তো হতে পারে।
তা হতে পারে। সব সুন্দরের অনুসঙ্গই হল গান আর কবিতা।
তোমার আবৃত্তি শুনেছি, এবার না হয় গান শুনি।
আপনাকে তো সেবারই বলেছি, আমার বাথরুমেও গান গাওয়া হয় না অনেক দিন।
তাহলে আমিই গান গাইবো।
বাবা এ কথা বলতেই অন্তর চট করে বাবার মুখে তাকাল। অস্ফূট স্বরে বলল, বাবা!
বাবা অন্তরের মুখে তাকিয়ে দেখল, ওর মুখের ওপর এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে। শিশুদের মুখে চাঁদের আলো পড়লে এত সুন্দর লাগে! বাবা বলল, কোনো সমস্যা?
তুমি না একবার কলেজ জীবনে গান গাইতে গিয়েছিলে। এক লাইন গাইতেই দর্শক-শ্রোতা চিৎকার শুরু করে দেয়-গান থামাও-গান থামাও। শেষে তুমি মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হও।
ঘটনা সত্য। তখন হয়তো কোনো সমস্যা ছিল। নার্ভাসনেস বা শারীরিক অসুস্থতা। তবে আমি গান জানি এবং আমার প্রিয় গানগুলো আমি ভালই গাই। এটাই আমার বিশ্বাস।
তাহলে গাও।
গানটা চাঁদ দিয়ে শুরু।
তাতো হতেই হবে। এখন চাঁদ, চাঁদের আলো এসব ছাড়া অন্য কোনো গান কি মানাবে?
আমার ওস্তার ফিরোজ খান বলতেন, এই গানটা আমার কন্ঠে খুব মানায়। তিনি প্রায়ই আমাকে অনুরোধ করে এই গানটা শুনতেন।
তাহলে মানতেই হবে, তুমি গানটা ভাল গাও।
আমি এক টানা বারো বছর ওস্তাদ ফিরোজ খানের কাছে গান শিখেছি। তাঁর সুরের ওপর যেমন দক্ষতা ছিল তেমন ছিল গান শেখানোতে। প্রচার বিমূখ মানুষ হওয়ায় তিনি খ্যাতি পাননি। সংগীতে তাঁর ধারে-কাছে নেই এমন অনেকে তখন স্টার ছিল, এখনও আছে। এখন তো যা হয়....। কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে হাজার বিশেক টাকার এসএমএস খরচ করলেই সার্টিফিকেট। সংগীতে সার্টিপিকেট হয়? কি যে সময়ে আমরা.......।
বাবা! গাড়ি লাইনচ্যুত হয়ে যাচ্ছে।
ও হ্যাঁ, ওস্তাদের মৃতুর পর আমি আর কারও কাছে গান শিখিনি, গাইওনি কোথাও।
তাঁকে তুমি খুব ভালোবাসতে নিশ্চয়?
হ্যাঁ, তাঁকে আমি তেমন ভালোবাসি যেমন ভালোবাসি আমার বাবাকে। এমন নিখাদ ও পবিত্র মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। তাঁর মুখটা মনে এলেই আমার চোখে জল জমে ওঠে।
বাবা বাম হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলেন। নিলয় যেন একটু ঘাবড়ে গেল। এরকমটি তার কাছে অনাকাঙ্খিত।
বাবা বললেন, ওস্তাদ তখন খুবই অসুস্থ। সন্ধ্যায় আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে এমন মায়া হল! আমি বসে রইলাম তাঁর মাথার কাছে। রাত নেমে এল। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগল। আমি বসেই আছি ওস্তাদের মুখে চেয়ে। ওস্তাদ ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, তুমি বাড়ি যাও, রাত হচ্ছে সবাই চিন্তা করবে। আমার তখন ওস্তাদকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হল না। আমি বসে রইলাম ঠায়। সে রাতও ছিল এমনই ভরা পূর্ণিমার রাত। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে লুটিয়ে পড়ছিল ওস্তাদের মুখে। রাত তখন প্রায় বারোটা। ওস্তাদ বললেন-সেই গানটা গাও তো বাবা। আমি গাইলাম। ওস্তাদ অপলকে তাকিয়ে থেকে শুনলেন গানটা। আমার গান শেষ হল। ওস্তাদের চোখে আর পলক পড়ে না। আমার গান শুনতে শুনতে ওস্তাদ চলে গেলেন জীবনের অন্য প্রান্তে। আমি আলতো হাতে ওস্তাদের চোখ বন্ধ করে দিলাম।  
সবাই নিশ্চুপ। বাবা আচানক পরিবেশটা কেমন করুন করে দিল। কিন্তু দুঃখটাকে ধরে থাকা ঠিক হবে না। কারণ, এটা দুঃখের সময় না। হাসান বলল, স্যার, গানটা শোনাবেন না?
বাবা গাইল-
চাঁদের এত আলো তবু সে আমারে ডাকে
উতলা মাধবী রাতে মাঙ্গিছে হে মোর আঁখি।।
ফুলের সুরভী আছে, তাহারে ছাড়িয়া যাচে
মনের সুরভী মম শুনি রেনু তাতে থাকে।।
বনের লতার কোলে কত না বিহগ জানি
গানের লহর তোলে কহে গো কতনা বাণী।।
মোর কথা মোর গানে শুনিয়া অবাক পানে
আমার কন্ঠ যাচে মহুয়া বনের পাখি।।
গানটা শেষ হলে কেউ কিছু বলল না। বিস্ময় ও মুগ্ধতা সবার    চোখে-মুখে। অতিরিক্ত মুগ্ধতা, অতিরিক্ত বিস্বয়ে কথা আসে না মুখে।
ওরা যেখানে বসেছে সেখানে জ্যোৎস্না ততটা উজ্জ্বল নয়। সম্মুখটা আবছা অন্ধকারে ঢাকা। কারণ নিবীড় গাছের ছায়া। দূরে বন যেখানে শেষ সেখানের জ্যোৎস্না উজ্জ্বল। আবছা অন্ধকারের মাঝে বসে ওরা উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার দিকে চেয়ে রইল। হয়তো ওরা সারা রাতই এভাবে বসে থাকতো। হঠাৎ অন্তর ডাকল, বাবা!
কন্ঠটা কেমন কাঁপা। একটু ভয় জড়ানো। সবার ধ্যান ভাঙল। বাবা বলল, কী হল?
ঐ দ্যাখো!
কী?
তিনজন লোক আসছে।
আসুক।
এত রাতে তারা বনের ধারে কেন?
আমরা কেন?
তুমি কি মনে করো, তারাও জ্যোৎস্নায় প্রকৃতি উপভোগ দেখতে এসেছে?
হয়তো আশেপাশেই তাদের বাড়ি। কাজ থেকে বাড়ি ফিরছে।
নিলয় বলল, গ্রামে বেশ রাত করেও অনেকে বাড়ি ফেরে। গ্রামের মানুষ রাতের বেলা বন-জঙ্গলে হাঁটতে ভয় পায় না।
বাবা নিলয়ের পিঠ চাপড়ে বলল, বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছেলে।
তিনজন লোক আসতে আসতে ওদের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। তিনজনই বয়সে যুবক। পোশাক-আশাক গ্রাম্য নয়। পরনে জিন্সের প্যান্ট, গায়ে টি-শার্ট, পায়ে বুট জুতা, চোখে সানগ্লাস। রাতের বেলা চোখে সান গ্লাস কেন? নাকি সেটা মুন গ্লাস? মুন গ্লাস বলে কি কোনো গ্লাস আছে? নাইট ভিসন গ্লাস আছে বলে অন্তর জানে। সেনাবাহিনীর লোকরা সে গ্লাস ব্যবহার করে। সে গ্লাস পরে নাকি অন্ধকারেও দেখতে পাওয়া যায়। তাহলে কি তাদের চোখে নাইট ভিসন গ্লাস?
দুইজন লোক দাঁড়াল ওদের দুই পাশে। আর একজন সামনে। পাশের দুইজন দু’টি পিস্তল বের করল। সামনের লোক বলল, যা আছে বার কর-ঝটপট, একটু এদিক-ওদিক হইলেই ফুটা....।
সামনের লোকটা বোধহয় দলের নেতা। ওরা কেউ কোনো কথা বলছিল না। কেমন স্তব্দ হয়ে ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। সামনের লোকটা বলল, পিস্তল দেইখা ডরের কিছু নাই। আমাগো কথা শুনলে আমরা ওগুলা ব্যবহার করি না। যা আছে ভদ্রভাবে বাইর কইরা দে’।
বাবা বলল, আমাদের কাছে দুইটা সেলফোন, কিছু টাকা, আর কিছু খাবার আছে। খাবার গুলোও কি দিতে হবে?
মোবাইল আর টাকা দিলেই হইবো।
হাসান তার সেলফোন আর মানিব্যাগ বের করে বাবার হাতে দিল। বাবা নিজের সেলফোন আর মানিব্যাগ বের করে লোকটার হাতে দিল। লোকটা বলল, এই পিচকিরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না? এই দুই পিচকি, তোগো মোবাইল ফোন নাই?
লোকটা আঙুল তুলে অন্তর আর নিলয়কে নির্দেশ করল। অন্তর কিছু বলতে পারল না। সে শুধু ভাবতে লাগল, শেষ পর্যন্ত মায়ের আশঙ্কাই সত্যি হল। মায়ের কথা অমান্য করে এভাবে রতের বেলা আসা ঠিক হয়নি।
নিলয় বলল, শিশুদের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে হয়।
আব্বারা, তোমাগো মোবাইল নাই?
জ্বি না, আমি গ্রামের দরিদ্র ঘরের ছেলে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারি না। ও শহরের ছেলে হলেও সেরকম বড়লোকের ছেলে না। ওর বাবা ওকে মোবাইল ফোন দেননি।
আজকাল তো দুধের শিশুরাও মোবাইল ব্যবহার করে।
করে, তবে সবাই না। আমাদের কোনো মোবাইল ফোন নেই।
লোকটার ইশারায় দুই পাশের দুইজন পিস্তল পকেটে ঢোকাল। লোকটা মানিব্যাগ থেকে টাকাগুলো নিয়ে একটা মানিব্যগ হাসানের দিকে, আরেকটা বাবার দিকে ছুড়ে দিল। তারপর বলল, সিম খুলে দিলে কি ভাল হয়?
বাবা বলল, সিম তত জরুরি না। দুই/তিনশ’ টাকা ফেরত দিলে ভাল হয়। ঢাকায় ফিরে যাব, পকেটে একেবারে খালি থাকলে.....বলা তো যায় না কখন কী দরকার পরে।
ঢাকায় ফিরে যাব মানে কী?
আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।
ঢাকা থেকে আইসা রাইতের বেলা এই জঙ্গলের মধ্যি বইসা আছোস যে?
হাসান ভাঙা কন্ঠে বলল, দয়া করে তাকে তুই তুই বলবেন না। তিনি একজন সম্মানিত লোক। সরকারি অফিসের সেকেন্ড ক্লাশ অফিসার।
লোকটা হাসানের দিকে কঠিন চোখে তাকাল। বলল, তুই মনে হয় জানোস না যে, গুন্ডা-পান্ডার সাথে ফাও কথা বলতে হয় না। কত ফার্স্ট ক্লাশের গালে থাপরাইলাম তার হিসাব নাই, তুই আইছোস সেকেন্ড ক্লাশ নিয়া। আর একটা ফাও কথা কইবি তো দিমু ভুড়ি ফুটা কইরা। [ক্রমশ...]


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট