হৃদয়পুরে ঘুঘুর বাসা
রবীন বসু
ঘুঘু খুব সুন্দর আর শান্ত পাখি। কী মিষ্টি মায়াবী ডাক। দুপুরের অবসরে সে ডাক আমাদের আকুল করে। তবু কেন লোক যে বলে, ঘুঘুর বাসা! ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখনি! এই নেগেটিভ চিন্তা থেকে একটা সূত্র খুঁজে পাই। তাহলে কি আপাত শান্ত নিরীহ সরল দেখতে কোনও মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে গোপন সত্তা। যা রহস্যময় অচেনা। যেমন আমার মধ্যে। আমার মাঝেই তো লুকিয়ে আছে অন্য এক রজত। দায়িত্ববান গোবেচারা স্বামী নয়, এক ঘাঘু গোপন দুর্বার পরকীয়া প্রেমিক। অনেক বার সংযত হবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।
মেধাকে ভালবেসে বিয়ে করি, কিন্তু মেধার বন্ধু তৃষার শরীর আমাকে টানে। মেধার শরীরে যদি লাবণ্য থাকে, স্নিগ্ধতা থাকে, তবে তৃষার শরীর যেন মোহময় আগুন। সে আগুনে পুড়ে মরতে ইচ্ছে করে। তৃষা সেটা বোঝে। আর বোঝে বলেই আমাকে খেলায়। দুই চোখের অপাঙ্গে, উন্মুক্ত ক্লিভেজে সে উদ্দাম ইশারা ধরে রাখে। আমি অস্থির হই, পতঙ্গের মতো পুড়ে মরতে চাই। সেদিন অফিস ফেরতা স্টেশনে হঠাৎ তৃষার সঙ্গে দেখা। সে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছিল। ডাকল, এ্যাই জামাইবাবু, আসুন না, এক রিক্সায় যাই।
আমার পরকীয়া দ্বিতীয় সত্তা তড়াক করে লাফ দিল। তৃষা আমাকে মজা করে জামাইবাবু ডাকে। আবার জাম্বোও বলে।
-অবশ্যই যাব, এ সুযোগ কি ছাড়া যায়! তবে তুমি আমাকে জামাইবাবু বলবে না। রজত বলে ডাকবে।
-সে না হয় হল। কিন্তু যদি মেধা জানতে পারে, আপনি আর আমি এক রিক্সায়
-কেন জানবে। তুমি না বললেই হল।
-আপনি বলবেন না!
-মাথা খারাপ! আমি বলি আর ঝাড়– খাই। একদম না।
-যদি চেনা কেউ দেখে ফেলে, আর মেধাকে বলে দেয়!
-সে দেখা যাবে! তুমি এসো তো। রিক্সার হুড তুলে দিচ্ছি। কেউ দেখতে পাবে না।
-আমি রিক্সায় উঠে বসি। তৃষা উঠতে রিক্সা চলতে শুরু করল। হুড অবশ্য তুলি না। এই পায়ে চালানো রিক্সাগুলোর সিট বেশ ছোট হয়। আমি তৃষার শরীরের সঙ্গে লেপটে আছি। ওর মেদহীন পেটের উষ্ণ ছোঁয়ায় যেন আগুন। পুড়ে যাচ্ছি। নিজেকে শান্ত করতে বাঁ-হাতটা তুলে তৃষার কাঁধের উপর রাখি। তাতে আরও ছ্যাঁকা খাই। ঘাম আসে শরীরে। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়। তৃষা আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। ব্যাঙ্ক মোড় পেরিয়ে ভাঙা বটতলায় আসতেই সে চেঁচিয়ে ওঠে, এ্যাই রিক্সা দাঁড়াও।
রিক্সা দাঁড়াতে বলে, রজতদা, একটা উপকার করবেন? ওই সামনের দোকান থেকে এই বডি লোশনটা এনে দেবেন। শেষ হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে একটা খালি কৌটো বের করে আমার হাতে দেয়। আমি বুঝতে পারি রিক্সা ভাড়ার সঙ্গে এটার দামও মাশুল হিসেবে দিতে হবে এই সামান্য উষ্ণ সঙ্গ লাভের জন্য। তবু হাসিমুখে নেমে যাই। নিস্তরঙ্গ বদ্ধ জীবনে একটু পরকীয়ার চনমনে ভাব। বেঁচে থাকার রসদ।
নিজের পাড়ার মোড়ে এসে রিক্সা থেকে নামি। তৃষা আর একটু এগিয়ে সামনের মোড়ে নামবে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে এগোতে যাব, কানে আসে তৃষার গলা।
-সামনে সতেরো তারিখে আপনার জন্মদিন। মেধা আর আমাকে কিন্তু ট্রিট দিতে হবে।
ট্রিট দেবার কথা কানে আসতেই মনে পড়ে গেল অফিসের অদিতির কথা। তার টেবিলের দুটো টেবিল পরে ও বসে। বছর খানেক বিয়ে হয়েছে। তবু কারণে অকারণে সে আমার টেবিলে আসে। অন্য কলিগরা একটু বাঁকা ভাবে তাকায়। তাতে অবশ্য অদিতির কিচ্ছু যায় আসে না। বেশি ঝুঁকে কথা বলে। স্মিøমফিট জিন্সে ওকে দারুণ মোহময়ী লাগে। আমি পলকহীন ভাবে ওকে দেখি। তাতে অদিতি রাগ করে না, বরং উপভোগ করে। একবার বলেছিল, আপনার কোন জিনিসটা আমার ভাল লাগে জানেন?
-জানি না, বল।
আপনি ডাইরেক্ট আমাকে দেখেন। মানে আমার শরীরকে। লুকিয়ে বা ভনিতা না করে। এতে আমি খুশি হই। আনন্দ পাই। ভাবি, তাহলে আমি বেশ সুন্দরী।
একবার ক্যান্টিনে কফি খেতে খেতে আচমকা জানতে চেয়েছিল, আপনি আমাকে পছন্দ করেন? ভালবাসেন?
আমার মতো ঘোড়েল থতমত খেয়ে গেল। ঘেমেনেয়ে একশা। কী উত্তর দেব! জিভ জড়িয়ে আসছে। তোতলাতে তোতলাতে বলি, পছন্দ করি বটে, তবে ভালবাসা- সেটা কী করে সম্ভব! তুমি না বিবাহিত!
কেন? বিবাহিত হলে কি ভালবাসতে নেই! ভালবাসার কি কোন নির্দিষ্ট বয়স আছে বা সীমা! ভাল আমি যে কাউকে বাসতে পারি। ভালবাসা আর সেক্স কিন্তু আলাদা।
অদিতির কথার কী উত্তর দেব! আমি তো ভালবাসার সঙ্গে সেক্স গুলিয়ে ফেলি। মনে হয় দুটোই টাকার এপিঠ -ওপিঠ। কিন্তু অদিতি আমার সে ভুল ভাঙিয়ে দেয়। বলে, এই দেখুন রজতদা, আমি আমার স্বামী অয়নের সঙ্গে সেক্স করি, কিন্তু আপনাকে ভালবাসি মনে মনে। আপনার মধ্যে একটা সরল উদাস বালককে আমি দেখতে পাই। তাকেই ভালবাসি। আপনার সঙ্গ আমার ভাল লাগে। কথা বলে আনন্দ পাই।
আমি মনে মনে লজ্জায় পড়ে যাই। অদিতির এই ব্যাখ্যা আমার মনে ঘুঘুর বাসাকে ভেঙে দিল। আমি উদাস দুপুরে নীড়হারা হয়ে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে কোনোক্রমে এসে চেয়ারে বসেছি। আমাকে জব্দ করে কিংবা নীড়হারা করে ও খুব মজা পেয়েছে। হাসছে ঠোঁট টিপে। আমি লজ্জায় ওর হাসিমুখ থেকে চোখ সরিয়ে রাখি।
অদিতিও গতকাল বলেছিল, রজতদা সতেরোয় তো আপনার জন্মদিন। আমি সন্ধেবেলা আপনার আর বৌদিকে ট্রিট দেব। জন্মদিনে সবাই খেতে চায়, অদিতি খাওয়াতে চাইছে -এটা আমার খুব ভাল লাগে। উৎসাহ নিয়ে বলি, বেশ বেশ। তুমি সত্যি-ই আমাকে ভালবাস।
বাড়ি ঢুকতেই আকাশ মেঘলা। মেধার মুখ কালো। আশঙ্কার মেঘ। ও জিজ্ঞেস করে, আমার মলমটা এনেছ?
সর্বনাশ। গতকাল বাথরুমে পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল মেধা। গোড়ালিতে বেশ লেগেছে। আজ সকালে বার বার বলে দিয়েছিল, আমি আজ স্কুলে যাব না। পায়ে ব্যথা। তুমি আসার সময় অবশ্যই মনে করে একটা ব্যথার মলম নিয়ে আসবে।
উত্তেজনায় বেমালুম ভুলে গেছি। অথচ তৃষার বডি লোশন কিনে দিলাম, ওই দোকানেই তো মুভ মলমটা ছিল। অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এবার ঝড়ের ঝাপটা মুখের উপর। -আননি তো! বলবে ভুলে গেছি! তা রিক্সা চেপে বেশ তো রাসলীলা করছিলে। ওষুধটা আনতে ভুলে গেলে! কাল স্কুলে যাব কীভাবে!
-আমি কেঁপে উঠি। সত্যি ভুল হয়ে গেছে। আমতা আমতা করে বলি, সরি। আমি এখনই এনে দিচ্ছি।
-থাক্ আর যেতে হবে না। আমি পলাশকে দিয়ে আনিয়েছি। আর ওই তো দেখে এসে বলল-
-পলাশ আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। কলেজে পড়ে। ও দরকারে বৌদি মেধার অনেক কাজ করে দেয়। এখন বুঝতে পারলুম, আমার আর তৃষার রিক্সা বিলাস ওই মলম কিনতে গিয়ে দেখে ফেলেছে আর বৌদিকে রিপোর্ট করেছে।
-না মানে, তৃষা বলল-
-আর মানে বোঝাতে হবে না। তোমার এই ছুঁক ছুঁক হ্যাংলাপনা আমি ভাল বুঝি। বয়স হচ্ছে, ওয়েট বাড়ছে, সুগার তো উপরে- বলেছি না, স্টেশনে নেমে হেঁটে আসবে -শরীর ভাল থাকবে।
-আচ্ছা, আর ভুল হবে না। হেঁটেই আসব।
-মনে থাকে যেন।
ঝড় থামে। আমি ঘরে ঢুকি। রাতে খাওয়ার পর সিগারেট টানতে টানতে ভাবি, আজ তো পনেরো তারিখ। একদিন পরেই তো সতেরো। তৃষাকে ট্রিট দিতে হবে, আবার ওই একই দিনে সন্ধ্যায় অদিতি তাদের ট্রিট দেবে বলেছে। মেধা বাড়িতে যদি কোনও অনুষ্ঠান করে! ব্যাপারটা ম্যানেজ করব কীভাবে!
-মেধা ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকাল। -খুব চিন্তায় পড়েছ দেখছি। কী ব্যাপার?
পরশু তো আমার জন্মদিন, তাই ভাবছি। আমার অফিস কলিগ অদিতি বলেছে সন্ধ্যায় আমাদের ট্রিট দেবে। আবার তোমার বন্ধু তৃষা ট্রিট চেয়েছে। কী করে ম্যানেজ করি বল তো!
বিছানায় বসতে বসতে মেধা বলে, ওঃ! এই ব্যাপার! কোন্ কূল রাখবে! তাইতো?
-আমি মাথা নিচু করি। মেধা আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, ভাবার কিছু নেই। তোমার জন্মদিন এবার আমি আমার মতো পালন করব। আমার এই বাড়িতে । তোমার দুই নর্মসহচরীকে নিমন্ত্রণ করব। আমরা চার জনে মিলে সলিব্রেট করব।
-আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যায় অদিতি তৃষা আর মেধা মিলে আমার জন্মদিনের পার্টি জমিয়ে দিল। অদিতি মেধাকে রিকোয়েস্ট করল, একটু বিয়ার খেতে। কী মনে করে মেধা হাতে পেগের গ্লাস তুলে নেয় এই প্রথম। তৃষা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। তারপর আমরা চারজন গেলাসে গেলাস ঠেকিয়ে ‘চিয়ার্স’ বলি। অদিতি আমার কাছে সরে এসে বলে, দেখলেন তো রজতদা, ভালবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে। তারপর মেধার দিকে তাকিয়ে বলে, ম্যাডাম স্বামীকে একটু স্পেস দিলে দেখবেন ভালবাসা বাড়ে।
তৃষা এগিয়ে আসে। বলে, মেধা, আমি এখনও বেকার। তাই জাম্বোকে একটু ঝাড়ি। রাগ করিস না।
মেধা হাসে। নির্মল তার হাসি। সে হাসিতে সব মালিন্য সব ভয় উড়ে যায়। আর আমার হৃদয়পুরে বাস করত যে ঘোড়েল ঘুঘু, সে তার বাসা নিজ হাতে ভেঙে দিল। এখন তার অবাধ মুক্তির উড়ান!