তালাক

 


তালাক 

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ 


১ 

কলমি সারাদিন গতর খেটে খায়। কেউ কেউ আবার এই গতর খেটে খাওয়ার অন্যরকম মানে খুঁজতে যাবেন না যেন। এই গতর খেটে খাওয়ার মানে হল, কায়িক পরিশ্রম করে খাওয়া। সম্রাট নাসিরুদ্দিন হোজ্জা সহ অনেক রাজা বাদশাগণই রাজকোষ থেকে কোন অর্থ গ্রহণ না করে নিজেরা কায়িক পরিশ্রম করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। রাজা কিংবা বাদশা হয়েও যখন কোনো ব্যক্তি টুপি অথবা মানুষের জুতো সেলাই করেন, তখন বিষয়টি আর সাধারণ থাকে না। আর এই অসাধারণ মানুষেরাই মরে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকেন, বেঁচে থাকবেন। অবশ্য আমাদের কলমি তেমনি অসাধারণ কেউ নন। সে একজন অতি সাধারণ গাঁও-গেরামের গরীরের ঘরের মেয়ে। অবশ্য এখন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল, এখন সে ছক্কু মিয়ার বউ। এখানেও কেউ ভুল বুঝবেন না। ছক্কু মিয়া এমন কোনো বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ব্যক্তি না যে, নাম নেয়া মাত্রই তাকে সারা বাংলাদেশ চিনতে পারবে! আচ্ছা যাক। সে বৃত্তান্তে আমরা পরে আসব। আপাতত কলমির গন্ধভরা জলের ইতিবৃত্ত কিছুটা অন্তত জেনে নেওয়া যাক। 


কলমিকে সারাদিন কেবল ঘানি টানার মধ্যেই থাকতে হয়। এই যেমনি স্বামীর সংসারের ঘানি তেমনি পাড়া প্রতিবেশিদের ঘানি। আরও উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে চাইলে বলতে হবে মরা ঘাটের পানি। যদিও এই ঘানি টানার দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। সুতরাং সংগত কারণেই আমাদের এই প্রজন্ম ঘানি কি জিনিস হাতি না বলদ তা জানে না। তাদের জানার কথাও নও। অবশ্য তারাও মাঝে মধ্যে হয়ত বাপ-চাচাদের মুখে কুলুর বদলের নাম শুনে থাকবে। কারণ আজকাল অনেক পুরুষ মানুষকেই সংসারের প্রতি বেজায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলতে দেখা যায়, সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি রে ভাই। অনেকটা ‘মনমাঝি তো বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারছি না.... এই টাইপ কথাবার্তা। কলমির যাপিত জীবনও এইরকমই। তারও হররোজ একই রুটিন। রোজই নাকের জল আর চোখের জল সামনাসামনি হয়। কাপড় কাছো, ঘর-দোর মোছো, বাটনা বাটো, সবজি কাটো, উনুনে হাড়ি চাপাও, চাল, তেল-জল, মশলা, লবণ দাও...! শুধু এখানেই শেষ নয়; গোছগাছ কর, দোকান থেকে এইটা সেইটা কিনে দিয়ে যাও ইত্যাদি ইত্যাদি। অতঃপর স্বামী সন্তানের সেবায় লেগে যাও। আবার রাঁধ, আবার বাড়, সবাইকে খাওয়াও। অত:পর পাতিলের নিচে অবশিষ্ট কিছু পড়ে থাকলে নিজে খাও। আর না থাকলে না খাও। শুধু এইটুকুতে শেষ অইলে কলমি অখুশি অইতো না। এইসবের সাথে যখন যুক্ত হয় সাহেবদের বউ-ঝিদের বকুনি খাও, সাহেবের কামুক চোখের চাহনি খাও, পথে-ঘাটে হাজারো মানুষের দুই চক্ষের বিজলি খাও, স্বামীর মন জুগাও; তিন তিনটা সাওয়াল-পাওয়াল সামলাও, ইভ টিজিং সামলাও, বাচ্চাদের ইস্কুলে নিয়ে যাও, নিয়ে আসো... আরও কত্ত কী! এসব কেচ্ছা কাহিনি একদিন প্রাগৈতিহাসিক ছিলো, এখন প্রতিদিনই নগদা-নগদি হয়। কানের লতি ঘেঁষে সবেগে তেরছা বুলেট যেভাবে ক্ষিপ্র গতিতে সাঁই করে চলে যায়, কলমিরও সেভাবেই দিনলিপি লেখা হয়। কলমির অসুখ-বিমুখ কেবল নামেই হয়। বাস্তবে সুস্থ থাকুক আর অসুস্থ থাকুক- কাজ করেই যেতে হয়। কাজ করেই খেতে হয়। অবশ্য তার অভ্যস্ত শরীর কোনোদিন না করে না। যেমন পেটানো লোহা কামারকে না বলতে জানে না তেমন।


একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, আমরা বাঙালিরা সাধারণত সবকিছুই সাদৃশ্যপূর্ণ এবং মিলঝিল পর্যায়ের আশা করে থাকি। এই যেমন আমরা বলি, যেমনে তেমন মিলে শুটকি মাছ আর বেগুনে মিলে। এই ধরনের আরও অনেক কথা আমাদের সামাজিক জীবনে প্রচলিত আছে এবং আমরা এইসবের বাইরে যেতেও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করিনা। এর একটি বড় উদাহরণ হল, কলমি এবং ছক্কু মিয়ার বিবাহ। পাড়ার লোকজন এই বিবাহ কোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি। কারণ এই বিবাহ নাকি শুটকি মাছ আর বেগুনের মত মানানসই হয় নাই। পাড়ার ছেলেছোকরা তো এই বিবাহ আটকানোর জন্য রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত নামিয়েছিল। কিন্তু মিয়া বিবি রাজি তো কিয়া করবে কাজি? কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত ছক্কু মিয়ার গলাতেই কলমির মত নগদ মুক্তার মালা উঠল। কিন্তু কী এমন কারণ যার জন্য এতো কা--কারখানা? আসল কথা হল, সবাই মনে করে আধা ল্যাংড়া ছক্কু মিয়া কলমির সোয়ামি হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। কলমি হইল আসমানের একটা পূর্ণিমা চান। এই চান কি যার-তার ঘরে মানায়? কোনোদিন না। কলমির রূপ মাধুরীর বর্ণনা করতে গিয়ে কতজন যে কতরূপে তাকে প্রকাশ করেছে; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গণমানুষের মতামত অইল ছক্কুর ঘরে কলমি যেন শুধুই কলমি না। সরোবরে পদ্মফুল ফুটে থাকলে এই দৃশ্য যেমন মনোহর লাগে কলমিকেও ঠিক ঠিক তেমনি মনোরমা লাগে। সরাসরি বললে কলমি একটা  ফুটন্ত গোলাপ। গাঢ় উজ্জ্বল গায়ের রঙ। সাড়ে পাঁচ ফিটের একটু বেশি  উচ্চতা। তার নাক-মুখ-চোখের উপর কে যেন লাবণ্যের পর লাবণ্য  মাখিয়ে  দিয়েছে। গোল-গাল মুখখানি যেনো কোনো শিল্পীর হাতে তৈরি পুতুলের চেয়ে কোনোঅংশে কম নয়। তাই সবার ধারণা হল, কলমির মত অপরুপা সুন্দরী মেয়ে কোনো রাজা-বাদশাহর ঘরেই কেবল মানায়। এই ল্যাংড়া ছক্কু মিয়ার ঘরে কোনোমতেই কলমি রে মানায় না। কিন্তু মানুষের চাওয়া আর না চাওয়ায় কি সবকিছু হয়? হয় না। আসল কথা হইল, ভাগ্য। আমরা চাই বা না চাই একটা পর্যায়ে ভাগ্য আমাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। আমরা মূলত ভাগ্যের হাতের পুতুল। 


এই ভাগ্যের নির্মম রসিকতায় কলমি নিজেই তার নিজের শত্রু। বলতে পারেন, এইটা আবার কেমন কথা বাপু? কিন্তু এইটাই আসল কথা। কলমির এই বেপরোয়া রূপ-যৌবনই তার আসল প্রতিপক্ষ। কলমি যদি আরেকটু কম সুন্দরী অইত... তাইলে কিন্তু এইসব কোনো ঝামেলাই তাকে মোকাবেলা করতে হতো না। এজন্যই জ্ঞানী মানুষেরা বলে থাকেন, কলমির এই বেসামাল রুপটাই হয়েছে তার সাক্ষাৎ কালপুরুষ। এখানে কালপুরুষ মানে কাল জয়ী মহাপুরুষ নন।  কাল কেউটের মতোন পুরুষ। কলমি রাস্তাঘাটে হাঁটতে পারে না...ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে তাকে যেন ঢক ঢক কইরা  গিইল্যা খায়। গিইল্যা খাইতে চায়। কৈশোর কাল থেকে এইসব অত্যাচার সহ্য করতে করতে কলমির একেবারে অসহ্য হয়ে গেছে। তার আর এসব ভাল্লাগে না। রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় শরীর ঘিন ঘিন লাগে। মাঝে মধ্যে অজপাড়া গাঁয়ের কলমিও বিদ্রোহী অইতে চায়। সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। তার কেবলই ফুলন দেবী অইতে মন চায়। কেউ তাকালেই চোখ দুটি খুইল্লা নিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে সে কিছুই পারে না। মাথা নিঁচু করে রাস্তার একধার ঘেঁষে নীরবে- নিভৃতে হেঁটে যায়। আর মনে মনে বলে, ছক্কু আর তার বাপ ছাড়া পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষেরা যদি কানা অইয়া যাইতো!


ছক্কু মিয়া আধা ল্যাংড়া হলেও মানুষ হিসাবে তেমন একটা খারাপ না। সারাদিন একপায়ে রিকশা চালায়। বিয়ের পর পর এই বিষয়টা কলমিকে খুব কষ্ট দিত। তাই একদিন রাইতে স্বামীর বুকের উপর আধশোয়া অবস্থায় কলমি ছক্কু মিয়াকে বলল, একখান কথা কইলে রাখবেন? 

ছক্কু মিয়া বলল, কি কথা ক হে কলমি...

আপনের কিন্তু আমার কথা রাখতেই হবে। আমার কথা কিন্তু ফেলাইয়া দেওয়া যাব না। 

ঠিক আছে তুই ক দেহি। রাখবার মত কথা অইলে তো রাখবই

কলমি স্বামীর আরও ঘনিষ্ঠ হল। তার বুকে পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনি আর রিকশা চালাইতে পারবেন না কইলাম। আপনার শরীরের যে অবস্থা তাতে রিকশা চালানোর কাজ আপনার জন্য না। 

কলমির কথা শোনে ছক্কু মিয়ার এক ফালে আসমানে উইঠা  যাওয়ার উপক্রম অইল। তার প্রতি কলমির এই যে ভালোবাসার প্রকাশ ছক্কু মিয়া নিজের কানে শুনলো, নিজের চক্ষে দেখলো... তার ঋণ সে কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবে না। তবুও যদি কিছু টা শোধ হয়, সেই আশায় কলমিকে বুকের সাথে সাথে পিষতে পিষতে বলল, আমি রিকশা না চালাইলে কি খাবি রে কলমি?

কলমি বলল, সে চিন্তা আপনার করতে হবে না। আমি আগে থাইক্যাই সেই ভাবনা কইরা রাখছি। 

ছক্কু মিয়া বলল, কী ভাবনা?

কলমি বলল, আমি মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করমু। 

কাজ কইরা যে টাকা পাইমু সেখান থাইক্যা সংসার খরচের পরে কিছু কিছু জমাবো। সেই জমানো টাকা দিয়া আপনে একটা দোকান দিবেন। তাইলে আপনার আর রিকশা চালাইতে অইব না। 

কলমির পরিকল্পনা শোনে ছক্কু মিয়ার পরানডা খুশিতে ভইরা গেল। আধা ল্যাংড়া সোমামির প্রতি কলমির এই যে ভালোবাসা তা কম বড় কথা নয়। অন্তত ছক্কুর কাছে তো এর দাম সমগ্র দুনিয়ার চাইতেও বেশি। মনে মনে সে নিজেকে বড় ভাগ্যবান ভাবতে ভাবতে কলমি কে আরও জোরে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর বুদ্ধিটা অনেক সুন্দর কলমি। কিন্তু মাননের উপায় নেই। সারাদিন দোকানে বইসা থাকলে আমার যে ডায়াবেটিস হইয়া যাইব। তাছাড়া লোকে আমারে এমনিতেই ল্যাংড়া বলে ডাকে, তখন বাদাইম্যা বলেও ডাকবে। 

কলমি বলল, লোকের কথায় আমাদের কিছু আসব-যাব না। মানুষে আমাদেরকে না খাওয়াবে আর না পরাবে। আমার কথা আপনাকে রাখতেই হবে বইল্যা দিলাম কিন্তু! 

কলমির এই আলটিমেটাম শুনে ছক্কুর মন আরও অনেক অনেক বড় হয়ে গেল। কিন্তু নিজের বউ মানুষের বাসায় কাজ করে খাবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিবে না। যত গরীবই হোক না কেন; সে তার আত্মমর্যাদা কখনও বিসর্জন দিতে পারবে না। তবে মুখে বলল, ভিন্ন কথা। আচ্ছা, তুই যখন এত কইরা কইতাছিস তাহলে তোর কথাটা ভেবে দেখব নে। 

ছক্কুর মিয়ার কথা শোনে কলমি নিজেকে বিজয়ী ভাবতে লাগলো আর বিড়ালের মতো ছক্কুর শরীরে নিজের মুখ ঘষতে লাগলো। 


এভাবেই ছক্কু মিয়া আর কলমির সংসারে ডালপালা গজাইতে লাগলো। অসুখের কারণে ছক্কু মিয়া তার আত্মমর্যাদা হাওড়ের পানিতে বিসর্জন দিতে বাধ্য অইল। আর যা-ই হোক নিজেরা না হয় দুই, একবেলা না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তো আর উপোস রাখা যায় না। তার উপর রোগ-শোকের ব্যাপার আছে। এইসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে কলমি এখন মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে। যদিও ছক্কু এখনো রিকশা চালানো বাদ দেয় নাই। দুইজনের সম্মিলিত ইনকামে এখন আর তাদের কপোত- কপোতীর সংসারে কোনো দু:খ নাই। অবশ্য এমনিতেও কলমি খুব শক্ত নার্ভের মানুষ। তার গোটা জীবনে খুব বেশি দু:খ নেই। সব মিলিয়ে মাত্র একটা দু:খ আছে। আর তা হল, তার দিকে পুরুষ লোকদের চোখ মারা। 


অবশ্য এখন এইসব দু:খও একপ্রকার গা সওয়ার মত হয়ে গেছে। কলমির সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে এইজন্য যে, প্রায় সব পুরুষ মানুষই কোনো না কোনোভাবে লুইচ্চা। কেউ মুখ লুইচ্চা, কেউ চোখ লুইচ্চা, কেউ হাত লুইচ্চা, আবার কেউ কেউ আছে যে একেবারে আপাদমস্তক লুইচ্চা। তবে দুই একটা যে ভালো নাই ব্যাপারটা এমনও নয়। যেমন ছক্কুর কথা ধরা যাইতে পারে। সে একজন কমপ্লিট ভদ্র এবং ভালো মানুষ।  তার মধ্যে লুইচ্চামি তো দুরের কথা; এর লেশ মাত্রও নাই। সে সারাদিন গতর খাটে। রাইত- বিরাইতে বাসায় ফিরে আসে। ফিরেই একটা হাঁক দেয়, আমার পরী কইরে..। পরী হল কলমির ছোটমেয়ের নাম। যেমন বুদ্ধিমতী তেমন  মায়ের মতন রুপবতী। এই একরত্তি বয়সেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পকেট  হাতড়ায়। খাবার খুঁজে। খেলনা খুঁজে। ছক্কু কিছুক্ষণ বাচ্চাদের সময় দেয়। তারপর সবাই মিলে একত্রে খায়। তারপর চলে বাচ্চাদের ঘুমানোর জন্য অপেক্ষার পালা। কলমি ঘুম পাড়ানি গান গায়। এই ফাঁকে ছক্কু মিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি টানে। কিছুদিন ধরে বিড়ি টানলে ছক্কুর কাশি হয়। তবুও বিড়ি টানা ছাড়ে না। ছাড়তে পারে না। কলমি তারে রোজ রাইতে শপথ করায়। কিন্তু কাজের কাজ হয় না। আজ বিড়ি টানতে টানতে ছক্কু হঠাৎ আকাশের দিকে তাকায়। কী সুন্দর আর নির্মল! বিড়ি টানা শেষ করে ছক্কু ঘরের ভেতরে ঢুকে। কলমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাধ্য চুলে বিনুনি দিচ্ছে। কলমিকে যেন রুপকথার রাজকন্যার মতন দেখতে লাগছে। ছক্কু মিয়ার আর সহ্য হয় না। রোজকার মতন কলমির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্য আদরে আদরে কলমি প্রতিদিনই স্বর্গের সুখ পায়।  অতঃপর কোথা থেকে ক্লান্তি আর অবসাদ আসে।   দু’চোখের সুড়ঙ্গে রাজ্যের ঘুম ঢেলে দিয়ে যায়।


যদিও ছক্কু মিয়া রিকশা চালায়; তবুও একটি পুরনো  জরাজীর্ণ ভবনের দোতলায় থাকে। যদিও মাথার উপর ছাদ নেই। টিনের শেড দেওয়া। দুটি ছোট ছোট রুম। পাঁচ ফিট বাই দেড় ফিটের একটি মিনি বারান্দাও আছে। একটি টয়লেট। রান্না ঘর নেই। গ্যাস, কারেন্টও নেই। নিচতলা থেকে রান্না করে উপরে আনতে হয়। চরম বিরক্তিকর ব্যাপার। তবুও ভাড়া অনেক কম বলে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। সবকিছু ছাপিয়ে বারান্দাটি অসাধারণ। যেখান থেকে আকাশ ছোঁয়া যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশের মতন বিশাল বড় স্বপ্ন দেখা  যায়।  রাতের আকাশের নক্ষত্রের সাথে কথা বলা যায়। তারা খসা  কিংবা  উল্কা পতনের দৃশ্যও দেখা যায়। এখানেই কলমি আর ছক্কু মিয়ার স্বপ্নেরা বড় হচ্ছে। এই স্বপ্নদের  নাম পরী, তিতলি আর জোহরা। এরাই একদিন বড় হবে। পুরুষ শাসিত সমাজের ঘাড় থেকে ধর আলাদা করবে। এসব ভাবতেই তাদের ভাঙা নৌকোর পালে হাওয়া লাগে। জোড়া শালিক পতপত করে উড়ে। ভালোবাসারা আরও মজবুত হয়ে তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। আর এই ভালোবাসা নিয়েই কলমির যত ভয়। কলমি জানে, ভালোবাসা যত বেশি, তার জ্বালাও তত বেশি। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে থাকবে না। সন্দেহের  বিষবৃক্ষ সমস্ত জগত সংসার পুড়ে ছাইপাঁশ করে দিবে। 

 

খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলমি এসব ভাবতে ভাবতে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেও ঘামছে। কলমি জানে, তার এই একরত্তি মনে কোনো পাপ নেই। তার হৃদয়াকাশে ছক্কু মিয়া ছাড়া আর কারো কোনো স্থান নেই। লুলা হোক, ল্যাংড়া হোক...ছক্কুই তার প্রাণপতি। ছক্কুতেই বাঁচা, ছক্কুতেই মরা। ছোটবেলায় কলমি দাদীর মুখে শোনেছিল, লজ্জাস্থান মানুষ কয়জনকে দেখায়!! এইটুকু পর্যন্ত ভাবতে না ভাবতেই দরজায় ঠকঠক করে  তিনবার শব্দ হয়। ছক্কু এসেছে ভেবে কলমি দৌড়ে যায়। সাথে সাথে আবার এটাও মনে হয় এখন তো ছক্কুর আসার কথা নয়। সে তো গ্রামের বাড়িতে যাবে বলে গিয়েছে। একটা সন্দেহের বীজ কলমির মনে দলা পাকে। তাহলে সেই খসরু কুত্তাটা নাতো? আজ সকালে তার বাসায় কাজ করার সময় কী জানি একটা বিড় বিড় করে বলেছিল! কলমি একেবারেই পাত্তা দেয়নি। তবুও একটা বাক্য তার কানের ছিদ্রের ভেতর বিষ ঢেলে দিয়েছিল-আজ রাইতে তোর বাসায় আসব কলমি। তোর দুখের দিন শেষ। আমি তরে রাণী করে রাখব। আল্লাহর কসম দিলাম, আমার কথা মিথ্যা না। 

কলমি কোনো জবাব দেয়নি। রাগে, দু:খে, ঘৃণায় হাতের কাজ শেষ না করেই হনহন করে চলে এসেছিলো। আসতে আসতে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল, এই শুয়োরটার বাসায় আর কাজ করবে না। এখন দেখি সত্যি সত্যি সে এসে হাজির! এতোকিছুর পরেও কলমিও বুকে সাহস সঞ্চার করে। হাতে একটি পুরনো বটি। দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে?

সাথে সাথে জবাব পাওয়া গেলো, কলমি দরজা খুল। আমি খসরু চৌধুরী। 

কলমির মাথায় খুন চড়ে বসলো। তড়াক করে দরজা খুলে দিয়ে বলল, হাতের বটিটা দেখতে পাচ্ছিস তো শুয়োরের বাচ্চা... এক কোপে ধর থেকে মাথা আলাদা কইরা দিমু। 

কলমির এহেন রুদ্র মূর্তি দেখে খসরু আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। এমন সময় ছক্কু মিয়া বাসায় ঢুকলো। সিঁড়িতে খসরু চৌধুরীর সাথে তার দেখা। একটা সন্দেহের ঘুর্ণিঝড় তার আপাদমস্তকে তীরের মত বিদ্ধ হল। কিন্তু খসরুকে কিছুই বলল না। যা বলার কলমিকেই বলবে ভেবে দরজায় কড়া নাড়ল। কলমি জিজ্ঞেস করলো, কে?

ছক্কু মিয়া বলল, দরজা খুল মাগি। আমি তোর যম। 


কলমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। হাত থেকে বটিটি নিচে পড়ে গেল। কলমিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছক্কু মিয়া রেগে-মেগে বলল, তোর সতীপনার প্রমাণ আজ আমি হাতে-নাতে পাইলাম কালনাগিনী। আমার খাস, আমার পড়স.... আর চৌধুরীর সাথে পরকিয়া করছ! তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যা মাগি। আমি তোরে তালাক দিলাম... এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক... বাইন তালাক। 

এ যেন ভোজবাজির খেলা! কোথা থেকে বিজলির মতোন কী ঘটে গেল! কলমির আত্মপক্ষ সমর্থন করে অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলা হলো না।  হঠাৎ এক ঝড় এসে কলমির সমস্ত আকাশ-বাতাস  চুরমার করে দিয়ে গেল। ইতোমধ্যে পরী, তিতলি, জোহরা এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। কী ঘটেছে... ওরা কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ওদের এতটুকু বয়স হয়নি। ছক্কু মিয়া আবারও হুংকার ছাড়লো, বের হয়ে যা হারামজাদী। তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা...তোর মত ছেনালি মাগি যেন আল্লাহ আর কারো কপালে না দেয়-- ! 


৫ 

কলমি যেন একখ- পাথর। কিছুক্ষণ মাথানত করে নখ খুঁটল। এরপর একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় কলমি দরজার দিকে পা বাড়ায়। পরী এসে  মাকে জড়িয়ে ধরে। কলমি পরীকে কোলে নিতে চাইতেই ছক্কু মিয়া জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, তুই বের হয়ে যা নষ্টা মেয়েমানুষ কোথাকার...পরী আমার মেয়ে, সে আমার সাথেই থাকবে। 

কলমির অনেক কিছুই বলার ছিলো। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বলেনি। বলা চলে বলতে  পারেনি। কেবল দুচোখের কোণে আলোড়িত জলোচ্ছ্বাস নিয়ে  নিরবে-নিভৃতে বের হয়ে গেলো। 


পাদটীকা: প্রিয় পাঠক, আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, ঘটনার কয়েকদিন পরেই ছক্কু মিয়ার ভুল ভাঙে। কলমি কে আবার নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করে। কাকুতি মিনতি করে। এমন কি হাতে পায়েও ধরে। কিন্তু  কলমির আর মন গলেনি। তার এক কথা, যে থুতু একবার মাটিতে পড়ে গেছে; সেই থুতু আর মুখ নেবো না।। 


পরিচিতিঃ সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট