মায়ের জন্য লেখা পঙ্ক্তিমালা



মায়ের জন্য লেখা 
পঙ্ক্তিমালা
বাসার তাসাউফ

আজকাল প্রকৃতি বড় বেয়াড়া। শুকনো, ঠন্ঠনে। চারপাশটা মরুভূমির মতো লাগছে। কী সকাল, কী দুপুর কিংবা মধ্যারাতের নির্জনতাÑ সারাক্ষণই গরমে বুকের ভেতরের থাকা কলজেটা ফেটে যাবার উপক্রম হয়ে থাকে। তার ওপর আছে নিসঙ্গতা নামক এক অনিরাময়ী ব্যাধির যন্ত্রণা। কিছুতে মন বসে না। খালি সব কিছু শূন্য শূন্য লাগে। জানি না অন্যদের কেমন লাগছে আজকালের শুষ্ক, গুমোট প্রকৃতি। আমার মতো বেকার ও অকর্মণ্য যারা তাদের কাছেই বোধহয় এমন অনুভূতি হচ্ছে। সকাল থেকে কোথাও বের হই নি। শুধু ফযরের সময় মসজিদ থেকে নামায আদায় শেষে বাসায় ফেরার পথে বাবার কবর জিয়ারত করার সময়টা ছাড়া। বাগানে যাইনি, ফুলগাছে পানি ঢালিনি। বিরস লেগেছে জেলি ও পাউরুটি। কফির মগে চুমুক দিয়ে তেতোয় জিভ বেঁকে গিয়েছে। ড্রয়িংরুমে বসে রিমোটের বাটন টিপে টিপে চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টে গেছি, কোনো চ্যানেলই দেখতে ইচ্ছে হল না। অগত্যা বসা থেকে উঠে স্টাডি রুমে এসে বুকসেলফ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ নামিয়ে আনলাম। দুই লাইন পড়ার পর আর পড়তে ইচ্ছে হল না। বইটি আগের জায়গা রেখে নিচের তাক থেকে আমার লেখার ডায়েরিটা বের করলাম। কয়েকটি পাতা উল্টাতেই ‘আমার মা’ শিরোনামের বহুদিন আগে লেখা আমার একটি কবিতাচোখে পড়ল।
শৈশবে আমি না-কি খুব বেশি অস্থির রেখেছি
আমার মাকে,
কারণে অকারণে অর্থহীন চিৎকারে
তাঁকে ডেকে উঠেছি কান্নার ভাষায়।
মা আমাকে কোলে তোলে নিয়ে
আদর করে বুকে জড়িয়ে রাখত
আমি সুখ পেতাম।
এ সুখ তখন বুঝিনি।
হোক না মাঘ-নিশিতেই
তবু কেমন মায়া আমার মায়ের!
শুভ্র মখমলের ওম বিছানায়
শুয়ে আছি মায়ের পাশে
মা আমার দু’চোখে এঁকে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ, স্বপ্নিল আল্পনা
অনাগত আগামীর মানচিত্র।
হঠাৎ কখন ভিজিয়ে দিয়েছি মখমলের সেই বিছানা
উষ্ণতার ওমে, শিশির বিন্দু
মা ভেজা বিছানায় গা এলিয়ে
উষ্ণতায় রাখে আমায় সযতনে
কী মমত্ব মায়ের!
কৈশোরের কথা বলি: একদা রাত্রি বেলায়
আমার শোবার ঘরে
আলনা কিংবা শো’কেসের আড়ালে
কী যেন এক প্রাণীর অদ্ভুত ডাক শুনতে পাই
মা দৌড়ে ছুটে এসে বলে, ‘খোকা! ওদিকে যাসনে,
দেখছি আমি কোন সে প্রাণী লুকিয়ে ওখানে
সাপ কিংবা বিষাক্ত কিছু হয় যদি!’
সাপ-কি মায়েদের ছোবল দেয় না?
কী মায়া মায়ের!
মাকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম কবিতা এটি। লিখেছি আজ থেকে ঠিক দশ বছল আগে। ৯ মে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক দুপুরবেলা। ভাতঘুম না দিয়ে আমি কবিতাটি লেখার চেষ্টা করেছিলাম। জানি না, এটি কোনো কবিতা হয়েছে কি না। কবিতা হোক আর না হোক মাকে নিয়ে সেই আমার প্রথম অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর অনুভূতিরা দলে দলে মগজে, মননে, অন্তরে ভিড় করলেও আমি আর একটি চরণও লেখতে পারিনি মাকে নিয়ে। অথচ মাকে নিয়ে আমার একটা গল্প অথবা কবিতা লেখার কথা ছিল। কিন্তু লিখতে পারি নি। লিখতে বসলেই মনে হয়, আমি আমার মাকে নিয়ে ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র চেয়ে বড় একটা কাব্য লিখতে পারি। কিন্তু কখনও লেখা হয় নি। মা আমার পৃথিবীর সবচেয়ে আপন ও প্রাণের চেয়ে প্রিয়। আমি না লিখলে কী হবে? মাকে নিয়ে অনেকে কবি-সাহিত্যিক লিখে গেছেন তাঁদের নিজেদের মতো করে। কাজী নজরুল ইসলাম ‘মা’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘যেখানেতে দেখি যাহা/ মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,/মায়ের মতন এত/ আদর সোহাগ সে তো/ আর/কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!/হেরিলে মায়ের মুখ/দূরে যায় সব দুখ,/মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,/মায়ের শীতল কোলে/সকল যাতনা ভোলে/কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেনÑ ‘আমি যদি দুষ্টুমি করে/চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,/ভোরের বেলা, মা গো,/ডালের ’পরে/কচি পাতায় করি লুটোপুটি-/তবে তুমি আমার কাছে হারো-/তখন কি, মা, চিনতে আমায় পারো?/তুমি ডাকো ‘খোকা কোথায় ওরে’/আমি শুধু হাসি চুপটি করে।’
‘বীরপুরুষ’ কবিতায় লিখেছেনÑ‘মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।/তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে/দরজা দু’টো একটুকু ফাঁক ক’রে,/আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে/টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।’
জসীম উদ্দীন তার পল্লী-জননী কবিতায় লিখেছেনÑ‘রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার, /নিশ্বাস ফেলি, তাও/শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার। /রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা, /করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা। /শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে, /তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে। /ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান, /এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?/ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু, /শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।’
কবি কামিনী রায় লিখেছেনÑ ‘জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-/‘মা, তোমারে কত ভালোবাসি!’/কত ভালবাস ধন?’ জননী শুধায়।/‘এ-ত।’ বলি দুই হাত প্রসারি দেখায়।/‘তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?’/মা বলেন ‘মাপ তার আমি নাহি জানি।/‘তবু কতখানি, বল।’/‘যতখানি ধরে/তোমার মায়ের বুকে।’
কবি শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি পড়ে আমরা আবেগাপ্লুত হয়েছি। ‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি/সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে/আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’
‘আমাদের মা’ কবিতাটি পড়লে হুমায়ুন আজাদের মা যেন হয়ে উঠে আমাদের মাÑ ‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।/আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,/কথা বলতে গিয়ে কখনোই/কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না।/আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে/মাকে আপনি/বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।/আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।’
কবি কালিদাস তাঁর বিখ্যাত ‘মাক্তৃভক্তি’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘বায়েজিদ বোস্তামী- /শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী। /দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, ‘বাছাধন, /বড়ই পিয়াস পানি দাও’ বলি মুদিলেন দু’নয়ন। /দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি, /বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।
কবি সুভাষ মখোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ‘আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মাকে/কখনও মুখ ফুটে বলি নি।/টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে/কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু/শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত/আমার ভালাবাসার কথা/মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।’
কবি আল মাহমুদ লিখেছেনÑ ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে /হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।’
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছেনÑ ‘মাগো, ওরা বলে,/সবার কথা কেড়ে নেবে/‘তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো মা, তাই কি হয়?’
মাকে নিয়ে লেখা আরও লিখেছেন, আম্মা- আবদুল মান্নান সৈয়দ, মায়ের চোখে- দাউদ হায়দার, ¯মৃতি- আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আমার হারানো মাকে-পুর্ণেন্দু পত্রী, একটি গ্রাম্য দৃশ্য- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আমার মায়ের চোখ- রফিক আজাদ, তোমার মা- হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মা- দিলওয়ার, স্বপ্ন- সঞ্জয় ভট্টাচার্য
মা থাকো- দেবারতি মিত্র, তাদের মাতা, জগৎমাতা- জাহিদ হায়দার, মা-র কাছে ফেরা- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, একটি সবুজ তারা- শিহাব সরকার, উনুন- ত্রিদিব দস্তিদার, জীবন দেবতা- স্বপন বন্দোপাধ্যায়, মা- জাহাঙ্গীর ফিরোজ, মাকে নিয়ে- আশিস স্যানাল, জন্মবৃত্তান্ত- দিব্যেন্দু পালিত, মাও যেন কবিতা লেখেন- জয় গোস্বাম, একটি সজল ছায়ামূর্তি- ইকবাল আজিজ, মা- সুজিত সরকার, আলোর ভাসান- সুনীলকুমার নন্দ, মা আমাকে ফিরিয়ে নাও- মাহমুদ শফিক, সোনালী চুলের স্মৃতি- ভাস্কর চক্রবর্তী, মা- পঙ্কজ সাহ, আমার মা-মাকিদ হায়দার, মাকে- আবদুল গনি হাজারী, বাঁচবো কি- আবুল হোসেন, মা- অসীম সাহা, আমার মা- শ্যামলকান্তি দা, মা- সুমিত্রা দত্তচৌধুরী, ঠিক কোনখানে- প্রমোদ বসু, মা আমার- বৃন্দাবন দাস, গল্প লেখার মাকে- নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, এক পৌরাণিক দেবীর গল্প- দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায়, মা, তোমাকে- বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, মা- মল্লিকা সেনগুপ্ত।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট