নিকষ




নিকষ
আহাদ আদনান

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের বারান্দাজুড়ে ছিল ফুলের গাছ। মা নিজের হাতে লাগিয়ে ছিলেন গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া আর হাসনাহেনা চারা। বসন্তের সেই সন্ধ্যাগুলোতে আমরা বারান্দায় বসতাম বাবার রেডিওটা নিয়ে। বাবা বলতেন, ‘দেখো, এইবার আমরা স্বাধীন হবোই। শেখ মুজিব কি বলছে শুনো নাই, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মা হয়ত তখন অনুকে দুধ খাওয়াচ্ছেন বসে। আর আমি খেলছি বিড়ালটার সাথে।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। বিকেলে বাবার কিছু ছাত্র আসে দেখা করতে। ‘স্যার, কিছু আঁচ করতে পারছেন দেশের অবস্থা? আমরা কোন পথে যাচ্ছি এখন’? বাবা তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে মুছে নিচ্ছেন। আমি এখনও মনে করতে পারি বাবার মুখ। জ্বলজ্বলে চোখ, হালকা হাসি আর প্রচ- রাশভারি লোকটা অভয় দেন ছাত্রদের, ‘তোমরা প্রস্তুত থাকবে। রক্ত আরও দিতে হতে পারে। দেশ হচ্ছে মায়ের মতন। মা’কে বাঁচাতে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সংগ্রাম করতে হয়। মুক্তির সংগ্রাম’। আশ্চর্য, বাবাকে কেন যেন হুবুহু মনে হচ্ছে পত্রিকায় দেখা আর রেডিওতে শোনা সেই মহাপুরুষের মত।
আমি তখন পড়ি ষষ্ঠ শ্রেণীতে। স্কুলে আবার কবে যাব, জানি না। দেড় বছরের অনু, আমার এই ছোট বোনটার সাথে খেলা করতে করতে কেটে যায় আমার প্রতিটাদিন। সন্ধ্যারাতেই মা রাতের খাবার সাজিয়ে দেন। আমরা সবাই টেবিলে। খাবার নামছে না কারও গলা দিয়ে। কিসের যেন উৎকণ্ঠা, ভয়। ‘এই অনু’র কিন্তু আজ বুকটা ধড়ফড় করছে খুব। কাল একবার নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে’? আমার এই বোনটা জন্ম থেকেই হৃৎপি-ে ছিদ্র নিয়ে বড় হচ্ছে। অল্পতেই ঘেমে যায়, বুক ধড়ফড় করে, শ্বাসকষ্ট হয়। নিয়মিত একজন ডাক্তার দেখেন ওকে। ২৫ তারিখের সেই সন্ধ্যারাতে কেন জানি আমরা কেওই ভাত খেতে পারিনি।
রাত তখন কয়টা জানি না। রাস্তায় বড় বড় গাড়ির বিকট হর্নের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার। ঘরের বাতি নেভানো। বসার ঘরে বাবা একলা পায়চারি করছেন। হাতে সিগারেট। মা অনুকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছেন। অনেক দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, বুকের খাঁচা ভেঙে যাচ্ছে, আর এতটা নীল ঠোঁট আমি আজও দেখিনি কোন মানুষের।
‘শুনছ, অনু’র প্রচ- শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কি করি বলোতো’?
এত অসহায় দৃষ্টিতে বাবাকে তাকাতে দেখিনি কখনো। মোমবাতির আবছা আলোয় দেখি, বাবা কপালের ঘাম মুছছেন, ‘একটু কষ্ট কর। বাইরে কারফিউ। সকাল হলেই...’।
চারদিক হঠাৎ বিক্ষিপ্ত শব্দে আন্দোলিত হয়ে পড়ে। মিলিটারির বুটের শব্দ, দরজায় লাথির শব্দ, উর্দু গালিগালাজ, গুলি’র শব্দে জাহান্নাম নেমে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের কোয়ার্টারে। মা কী আঁচ করেছিলেন জানি না। আমাকে শুধু একবার বললেন, ‘বাবারে, তোর বোনটাকে কোলে নে। এই আলনাটার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবি। কেও আসলে, তোর বাবাকে ডাকলে, নিয়ে গেলেও চুপ করে থাকবি। একটা টুঁ শব্দ করবি না। পারবি না, বাবা’?
একটার পর একটা বুটের লাথির শব্দ আমাদের দরজায় আঘাত করে। বাবা গর্জে উঠেন, ‘কে? হু ইজ দেয়ার’? দরজা খুলে দিতেই কয়েকটা পশু ঢুকে পড়ে ঘরে। একজন বাবার গলা চেপে ধরে। মা চিৎকার করে ছুটে আসেন। প্রথম গুলিটাও লাগে মায়ের কপালে। লুটিয়ে পড়েন নতুন কেনা কার্পেটটার উপর মা। আমাদের শো-কেইস, টিভি, আসবাব ভেঙে তছনছ হয়ে পড়ে। কে একজন চিৎকার করে বলে, ‘এ প্রফেসরকো মার ডালো’।
অনু’র শ্বাস আরও বেড়ে গেছে। আমি ওর মুখ চেপে আছি। মায়ের আদেশ একটা শব্দও জেনো না হয়। আমার হাত ঘেমে যাচ্ছে, অনু’র ঘামে। বুকের ঘড়ঘড়টা আমি যেন এখনও শুনতে পাই। আলনার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার চোখের সামনে রক্তাক্ত পড়ে আছে বাবা আর মায়ের নিথর দেহ। আমি চিৎকার করতে ভুলে গেছি। নড়াচড়ার শক্তিটুকু হারিয়ে যায় আমার ।
যখন সম্বিৎ ফিরে আসে হাতের দিকে চেয়ে দেখি অনু খুব শান্তিতে আছে। কোন শ্বাসকষ্ট নেই, বুকে ঘড়ঘড় নেই, বুক ভাঙা নেই। বোনটা আমার কখন যেন চুপ করে চলে গেছে মায়ের সাথে, না ফেরার দেশে।

মাতুয়াইল, ঢাকা। 




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট