ম্যালেরিয়া বিজয়

 



ম্যালেরিয়া বিজয়

মূল :  টমাস চার্লস ব্রিজস এবং হেজেল টিল্টম্যান 

অনুবাদ : আহাদ আদনান 


গ্রীষ্মম-লের দেশগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এসব দেশের হাসপাতালে রোগীদের এক তৃতীয়াংশ এই রোগ নিয়ে আসে। এমনকি উষ্ণ দেশগুলোর জনসংখ্যারও এক তৃতীয়াংশ বছরে ম্যালেরিয়ায় ভোগে। যদিও কয়েক হাজার রোগীদের মধ্যে একজন শুধু এই রোগে মারা যায়, এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কথা চিন্তা করলে সামষ্টিক মৃত্যুর অঙ্কটা কিন্তু বিশাল হয়েই দাঁড়ায়। সরকারি হিসেব মতে ভারতে প্রতি বছর গড়ে তেরো লক্ষ প্রাণ ম্যালেরিয়ায় ঝরে যায়। এটি ইউরোপেও হানা দিয়েছে। দূর উত্তরে হল্যান্ড (নেদারল্যান্ড) এবং ইংল্যান্ডও এর শিকার। এই কিছুদিন আগেও গ্রীস এবং রোমের আশেপাশে এটি ছিল মূর্ত অভিশাপ। বিশ্বের একটি বিশাল অংশে ম্যালেরিয়া মানেই  প্লেগের মত মহামারি। অধিবাসীদের জন্য সাক্ষাৎ আতঙ্ক। 

বছরের পর বছর বিজ্ঞানি, চিকিৎসক এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। রাতের বাতাস এর জন্য দায়ী? নাকি দূষিত জল? এই দুটি ভাবনাই অবশ্য পরিত্যাক্ত হয়েছে। ম্যানসন এবং রস আজ এই উড়ন্ত ক্ষুদ্র জীবাণুটিকে পরাজিত করেছেন, যেটি বিংশ শতাব্দীর শুরু অব্দি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে চোখ রাঙিয়েছে। যার কাছে সেনা, নৌ-বহর এমনকি চিকিৎসকরাও ছিলেন অসহায়। তারা দেখিয়েছেন ম্যালেরিয়া কিভাবে ছড়ায় আর কিভাবে একে জয় করা যায়।

স্কটিশ চিকিৎসক স্যার প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৬৬ সালে ফরমোসা এলাকার চীনা হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি ‘গোদরোগ’, অর্থাৎ যে রোগে হাত, পা হাতির মত ফুলে যায়, নিয়ে অধ্যায়ন করেন। সেখানেই তার পরিচয় ঘটে ম্যালেরিয়ার সাথে। দুটোই গ্রীষ্মম-লীয় এলাকার অসুখ। দুটোই কি জলাভূমির রাতের বাতাসের জন্য হয়? এমনই ছিল তখনকার ভাবনা।

ম্যানসন শুরু করলেন অনুসন্ধান। তিনি এই নতিজায় পৌঁছলেন যে, মানুষের রক্তে ‘ফাইলেরিয়া’ নামের একটি পরজীবী’র এই অসুখের (গোদরোগ) সাথে কোন না কোন সম্পর্ক আছে। সমস্যা তাতে বাড়ল বৈ কমলো না। ‘ফাইলেরিয়া’ রক্তে গেলো কিভাবে, এবার বলুন দেখি। এতো হাঁটেও না, উড়েও না। একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। ধরুন; একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিয়ে কোন পতঙ্গ তার রক্ত চুষে খেল, সে আবার আরেকজন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ে তার রক্তে এই জীবাণু ছেড়ে দিল। এমন হতেই পারে, নাকি? 

সন্দেহ গিয়ে পড়ল মশা’র উপর। এর গতিবিধি’র সাথে জীবাণু ছড়ানোর সূত্র যে মিলে যাচ্ছে। হাতেকলমে পরীক্ষার জন্য ম্যানসন একটি ফন্দি আঁটলেন। তার অধীনস্থ দেশীয় কয়েকজনের রক্ত পরীক্ষা করে ভারি মাত্রায় জীবাণু আক্রান্ত একটি ছেলেকে বাছাই করলেন। মশা’য় ভরা একটি কামরায় তাকে রাত যাপন করতে দিলেন। উদ্দেশ্য, মশা যাতে তাকে প্রচ- কামড়ায়। পরেরদিন রক্ত খাওয়া মশাগুলোকে ধরে ব্যবচ্ছেদ করে দেখলেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পরকলা (লেন্স) দেখাচ্ছে রক্তে ‘ফাইলেরিয়া’ জীবাণু! আবিষ্কার হয়ে গেলো, গোদরোগের জীবাণুর বাহক আসলে মশা।

ম্যানসনের এই আবিষ্কার বিজ্ঞানিদের চিন্তার অনেকগুলো দ্বার’কে নাড়া দিল। এই মশা যেভাবে গোদরোগ করছে, একই ভাবে ম্যালেরিয়া করতে পারে না? ল্যাভেরান নামের একজন ফরাসি চিকিৎসক, যিনি কাজ করছিলেন আলজেরিয়াতে, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ম্যালেরিয়ায় জন্যও মশা দায়ি। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া তার দাবি পাত্তা দিবে কেন বিজ্ঞানি সমাজ? তাদের যেন কোন তাড়াও নেই। এর মধ্যে ম্যানসন চীন থেকে অবসর নিয়ে চলে আসেন ইংল্যান্ড। সবকিছু থমকে গেল কয়েক বছরের জন্য। 

লন্ডন, ১৮৯৪ সাল। ম্যানসনের কাছে একটি চিঠি এলো। লিখেছেন চিকিৎসক মেজর রোনাল্ড রস। অনেকদিন তিনি কাজ করেছেন ভারতীয় চিকিৎসা বিভাগে। ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন। ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য গ্রীষ্মম-লীয় ব্যাধি নিয়ে তার বিপুল আগ্রহ। একজন আরেকজনের সাথে দেখা করলেন। ভাবনার আদান প্রদান হলো। উপাত্তের বিনিময় হলো। জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রচ- আঘাতের এই ছিল মাহেন্দ্রক্ষণ।      

যৌথ গবেষণার ইতিহাসে অন্যতম প্রসিদ্ধ অনুসন্ধান। মানবতার দুই পরম দরদি চিকিৎসক। একজন বিলেতে, আরেকজন আবার ভারতে। একজন আরেকজনকে সহায়তা, উৎসাহ আর পরামর্শ দেওয়া চালিয়ে গেলেন। রস তার পূর্বসূরি ম্যানসনের বাতলানো পথ ধরলেন। অর্থাৎ, ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর রক্ত খাবে মশা, আর তিনি তিনি সেই মশাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে। আশ্চর্য, পরকলা যে কোন আশানুরূপ ফল দেখাচ্ছে না। কয়েকশ’ মশা বিচ্ছিন্ন হয়ে এলো যন্ত্রের নিচে। উঁহু, কিছুই হচ্ছে না। এখন কি হবে?

মাসের পর মাসের চলে যায়, পরীক্ষা আর সফল হয় না। রস কি ভুল পথে এগুচ্ছেন? এদিকে ম্যানসন বিশ্বাস করে বসে আছেন, আক্রান্ত মশা পানীয় জল দূষিত করছে, আর সেই জল পান করেই ম্যালেরিয়া ছড়াচ্ছে। রস কিন্তু এই মত মোটেও গ্রহণ করলেন না। কিন্তু আরেকজন বিজ্ঞানির মত এত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায়?

তিনি বেছে নিলেন চারটি মশা, একজন ম্যালেরিয়া রোগী আর দুই বোতল জল। কাজ খুব পরিষ্কার। মশা রোগীর রক্ত খেয়ে বসবে, ডিম দিবে সেই জলে। এক সপ্তাহ শীতল পরিবেশে রাখা হবে সেই জলাধার। তারপর দেখা গেল মশাগুলো মরে পড়ে আছে। ডিম ফেটে মশা’র লার্ভা বা কীট সাঁতরে বেড়াচ্ছে। রস শুধু মৃত মশাগুলো সরালেন। থেকে গেলো কিছু ডিম আর কীট। এবার সুস্থ ব্যক্তিকে এই জল পান করাতে হবে। কে পান করবে এই দূষিত জল? অধীন ভারতীয়রা আছে না (অনুমতি সাপেক্ষে অবশ্য) পরীক্ষার ফল এল অদ্ভুত!


দুইজন স্বেচ্ছাকর্মী দিব্যি সুস্থ হেঁটে বেড়াচ্ছে। একজনের এসেছে জ্বর। ম্যালেরিয়া নয়তো? লক্ষণতো সেরকমই? রক্ত পরীক্ষা বলল ম্যালেরিয়া নয়। আসলে এটা ছিল স্রেফ কাকতাল। এখন তাহলে ম্যানসনের তত্ত্ব বাতিল করতেই হয়। এই কথাগুলো লিখে রাখলেন রস তার ‘মেমোরিজ’ বইয়ের খসড়ায়। তিনি ফিরে এলেন তার মশা’র রক্তপানের এবং কামড়ের সূত্রে। 

একদিন সকালের কথা। তিনজন লোক রস’কে মশা ধরে দিত। তাদের একজন কিছু লার্ভা নিয়ে এসেছে। এই লার্ভাগুলোর থেকে যে মশা বেড়ে উঠলো তাদের পাখায় ছোপ ছোপ বর্ণালি। রসে’র আগের পরীক্ষায় মশাগুলোর পাখায় ছিল তিনটি করে কালো দাগ। রস বিস্মিত হলেন। এ যে নতুন, এ যে অপূর্ব! ঠিক আগের পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি হলো। সিকান্দারবাদ, ষোলই আগস্ট ১৮৯৭। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে রস তাকালেন পরকলা’য়। না, কিছুই পাওয়া গেলো না। হাল ছাড়লেন না তিনি। বর্ণালি ছোপের আরও কিছু মশা’র প্রজাতি জোগাড় করা হলো। 

চার দিন পরের কথা। অর্থাৎ, আগস্টের কুড়ি তারিখ। রসে’র ভাষায় ‘মশক দিবস’। প্রথম কয়েকটি মশা কেটে কিছুই পাওয়া গেলো না। শেষ কয়েকটি মশা আছে শুধু। এরা ষোল তারিখে ম্যালেরিয়া রোগীর রক্ত খেয়ে ফুলে আছে। একটি মশাকে ব্যবচ্ছেদ করা হলো। শরীরে কিছুই পাওয়া গেলো না। রসে’র চোখ ক্লান্তিতে ঢুলুঢুলু করছে। মশার পাকস্থলীতো এখনও দেখা হয়নি। পাক্কা আধ ঘণ্টা লাগবে। শরীর যে আর সায় দিচ্ছে না। এর আগেওতো কয়েক সহস্র পাকস্থলী দেখে বসে আছেন। এটা কি দেখতেই হবে? ‘বিনা রণে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’। এই মন্ত্রে দীক্ষিত রসে’র জবানিতেই আসুন দেখে নিই কী হয়েছিল সেদিন।     

‘কষ্ট হলেও আমি অনুসন্ধান অব্যহত রাখলাম।  হঠাৎ আমি স্পষ্ট গোলাকার একটি রেখা দেখতে পেলাম। প্রায় বারো মাইক্রন হবে ব্যাসার্ধে। আকারটি বেশ ক্ষুদ্র আর বাইরের আবরণ এত তীক্ষè। এটাতো শুধুই মশা’র পাকস্থলী’র কোষ নয়। আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক। এইতো, ঠিক একইরকম আরেকটি কোষ। আরও কয়েকটি। এদের একটিকে আমি আরও সূক্ষ্মভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। কিছু দানাদার বস্তু পেলাম যেগুলো অবিকল ম্যালেরিয়া’র পরজীবী’র সাথে মিলে যাচ্ছে। মোট বারোটি এমন গোলক পর্যবেক্ষণ করে ফেললাম। আমার শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। এত বড় আবিষ্কারের মাঝপথে বিশ্রামের জন্য বাসায় আসলাম। এক ঘণ্টা ঘুমিয়েছি কি ঘুমাইনি, আমি যে গেলাম। আমি কি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি? জেগে উঠে এটাই ছিল আমার প্রথম ভাবনা’।

চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসের অন্যতম বড় আবিষ্কার, যা কোটি কোটি জীবন বাঁচাতে কাজে লেগেছে, সেটা উপলব্ধি করতে ক্লান্ত, বিধ্বস্থ আর বারংবার ব্যর্থ রসে’র ঘুমটি জরুরি ছিল! পরের সকালে শেষ মশা’টি ব্যবচ্ছেদ করে সেই গোলাকার বস্তু পাওয়া গেল পাকস্থলীতে। তিনি বুঝে গেলেন কত বড় জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছে। তার ভাষাতেই আসুন দেখি তিনি কি ভাবছিলেন।

‘আমাদের একই সাথে দুটি বিষয় বের করতে হয়েছিল। কোন ধরণের মশা জীবাণু বয়ে বেড়াচ্ছে এবং এর ভেতরে জীবাণুটির আকার, অবস্থান। আমি প্রচ- ভাগ্যবান, দুটো পাখিই আমি এক ঢিলে শিকার করে ফেলেছি। শুধুমাত্র “এনোফিলিস” মশা’ই ম্যালেরিয়া’র জীবাণু বহন করে বেড়ায়। এই জীবাণু বাসা বাঁধে মশা’র পাকস্থলী’র দেওয়ালে। এদের চেনা যায় এই বিশেষ বর্ণ দেখে। গত ত্রিশ বছর আমি এবং আমার মত আরও বিজ্ঞানি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছি, এখন তা ছেলেখেলা মনে হচ্ছে। এই সুত্র ধরে এগুলে যে কেও এখন থেকে এটা পারবে’। 

নিন্দুকের দল বসে ছিল সেদিনও। তারা বলল, মশা আসলে বাসা বেঁধেছে রস’দের মাথাতেই। এগুলো গুজব। আবার অনেকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। নিন্দা বা প্রশংসা, রস গায়ে মাখেননি কোনটিই। পাখিদের শরীরে আক্রান্ত মশার কামড় দিয়ে জীবাণু ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি আবার তার আবিষ্কার প্রমাণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঠিক পথেই আছেন। এটাই যথেষ্ট। মৃত্যু আর অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের চেয়ে আর কি বড় হতে পারে? 

এই আবিষ্কার তাকে খ্যাতি এনে দিলেও অর্থযোগ ঘটাতে পারেনি। এ যেন অন্য হাজারও গবেষকদের গল্প। রস’কে দরিদ্র’ই বলতে হবে। পরবর্তীতে ১৯০২ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে তাকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। পাটনা’য় তার নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রীষ্মম-লীয় অসুখের একটি ইন্সটিটিউটে তিনি ছিলেন প্রধান পরিচালক। আমৃত্যু, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাজ করে গেছেন। 

তরুণ রস ভারতে এসে দেখেছিলেন প্রতিষ্ঠিত, মেধাবি চিকিৎসকরা একটি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়া অসুখ মোকাবিলা করতে হিমসিম খাচ্ছেন। হ্যা, তারা কুইনিন দিয়ে রোগ সারাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রতিরোধের উপায় কোথায়? শত্রুর ডেরার খোঁজ কে দিবে? চার বছরের সাধনার পর রস শত্রুকে খুঁজে বের করে দেখালেন কিভাবে একে জয় করা যায়। কিভাবে ম্যালেরিয়া বিজয় সম্ভব। অনাগত প্রজন্ম এমনি করে জীবন এবং মৃত্যুর অসংখ্য রহস্য উন্মোচনের জন্য লড়াই করবে। কোন এক মুহূর্তে হতোদ্যম, হতাশ হয়ে পড়বে। তখন সেই পাথর সময়গুলোতে স্যার রোনাল্ড রসে’র গল্প হয়ত ওদের মনে পড়বে। অনুপ্রেরণা জোগাবে যুগে যুগে। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট