ক্ষত !

 




ক্ষত

নেহাল অর্ক 


শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে আজ অনেক ভিড়। দিনের শেষাংশ একটা লাল আভার সাথে মিশে বিদায়ের করুণ রাগীনির নিথর অবয়ব গড়ে তুলেছে পশ্চিম আকাশে। কিছু পরেই আঁধারের কালো হাত পরিচিত মুখগুলোকে বর্ণহীন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করে দিবে। এমন সময় ট্রেন থেকে নেমে এলো এক যুবক। ছিমছাম গড়নের মাথায় ঝাকড়া চুল, ভাসা ভাসা চোখের উপর যেনো গভীর একটা মায়া। নেমেই রিক্সার খোঁজে চঞ্চল হয়ে উঠে যুবকের মন। একটি রিকশা এলে যুবক তাতে উঠে বসে। খানিকটা আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে আঁধার। রিকশায় উঠে যুবক সোজা চলে যায় চা বাগানের  বাংলোর দিকে; আগেই বাংলো বুকিং করা ছিলো তার। রিক্সা থামতেই কাজল দৌড়ে এসে যুবককে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে। কাজল বাংলোর কেয়ারটেকার হিসেবে আছে বছর দশেক হবে। স্যার, আমি কাজল এই বাংলোর কেয়ারটেকার। 

ভালো আছো? ম্যানেজার সাহেব আছেন বাগানে? ইত্যাদি কিছু প্রশ্নের আসা-যাওয়ার মাঝেই যুবক পৌঁছে যায় বাংলোতে। রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই যুবকের মোবাইলে একটা কল এলো,  কার কল তা বুঝতে পারলোনা কাজল ! 


হ্যাঁ ভাই,  আমিই অনির্বাণ,  এশিয়া ব্যংকের ব্যবস্থাপক। আপনি কোথায় আছেন? এসব কথোপকথনের আবেশের মাঝে কাজল যুবকের নামটি রপ্ত করে নেয়। স্যার অনেক দূর হতে এসেছেন বোধহয় ! একটু ফ্রেশ হয়ে নেন। বাথরুমে সবকিছু গুছিয়ে রাখা আছে, বলেই কাজল বের হয়ে যায়। অনির্বাণ ফ্রেশ হয়ে চেয়ারে বসে আজকের পত্রিকা পড়ছে। হঠাৎ বাগানের ম্যানেজার সফিক সাহেব ও তার স্ত্রী জাইফা এসে দরজায় নক করতেই অনির্বাণ দরজা খুলে তাদের অভ্যর্থনা জানালো।

কেমন আছেন? প্রথমে সফিক সাহেব জানতে চাইলো। পিছনে সফিক সাহেবের স্ত্রী জাইফা তখনও দাঁড়ানো। কালো দুটি চোখে অনেক গভীরতা লুকানো, চুলগুলো পড়ে আছে পিঠের পরে যেনো স্ফীত নিতম্বকে ছুঁই ছুঁই করছে। মরাল গ্রীবার তলদেশে ছোট একটা কালো প্রায় তিল হলুদের উজ্জ্বলতাকে আরও কমনীয় করে তুলেছে। জলপাই রঙের শাড়িতে আবৃত জাইফার দেহ অতি দীর্ঘ নয় আবার খর্বও নয়; এক অপূর্ব পুলক দীপ্তি তার চোখে-মুখে ফোঁটে আছে। স্মিতহাস্য চেহারায় জাইফা চোখ দুটি তুলে একফাঁকে দেখে নেয় আগন্তুককে।


সফিক সাহেব তার স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয় অনির্বাণের সাথে।  সকলে মিলে আড্ডা চলে কিছু সময়, তারপর রাতের খাবার নিয়ে আসে কাজল। সফিক সাহেব ও জাইফাকে অনির্বাণ অনুরোধ করলে তারাও এখানে ডিনার করে। ডিনারের ফাঁকে অনির্বাণ এখানে কেনো আসলো, ক’দিন থাকবে ইত্যাদি বলে নেয়। পারস্পরিক কথপোকথনে সবাই তাদের জানা-অজানা অনেক গাল-গল্প শেষ করে বের হয়। সফিক সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় চলে যায়। তবে রেখে যায় কিছু সময়ের প্রবাহ; যার ঢেউ জাইফার গোছানো মনের বাগানটাকে তছনছ করে ফেলে। বাগানের বাংলোতে এর আগেও অনেক অগন্তুক এসেছে, আবার চলে গেছে। সবার সাথেই জাইফার দেখা হয়, কথা হয়। এটা তাদের একটা স্বাভাবিক সৌজন্যতা বলা যায়। কিন্তু এমন করে কেউ জাইফাকে নাড়িয়ে দেয়নি এর আগে কখনো। 


সফিক সাহেব চলে যাবার পর অনির্বাণ দরজা খুলে বসে থাকে কিছু সময়। বাহিরে শীতের কনকনে হাওয়া এসে ঘরটাকে শীতল করছে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বিছানায় হেলান দিলেই ঘুম চলে আসবে; সেটা বুঝতে পেরে দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিবে এমন সময় কাজল এসে ডাকলো।

স্যার, ঘুমিয়ে গেলেন নাকি? অনির্বাণ দরজা খুলে দিলো।  কাজল ভেতরে প্রবেশ করে বললো, স্যার আপনার কোনোকিছু লাগলে আমাকে বলবেন। আমি আপনার পাশেই আছি,  ম্যানেজার স্যারের বাংলোতে থাকি। এটা আমার মোবাইল নম্বর, যে কোনো দরকারে আমাকে ডাকলেই আমি আসবো। অনির্বাণ কিছু বলেনা, কেবল কাজলের আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। তুমি কোনো চিন্তা করোনা, আমার কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই তোমাকে ডাকবো, বলে কাজলকে বিদায় দেয়। তারপর দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে থাকে। বাগানের এই নির্জনতায় রাতের আঁধারও মনের আনন্দে হাহাকার করতে থাকে।




ঘুম আসছে না জাইফার চোখে। পাশের ঘরে সফিক সাহেব ঘুমে কাতর। ঘুম আসছেনা বলে জাইফা স্বামীর ঘরে যায়। বেশকছু দিন হয় সফিক সাহেব আলাদা ঘরে রাতে থাকে। যদিও প্রয়োজন অপ্রয়োজনে দেখা করতে কোনো বাঁধা নেই। কোনো কোনো সম্পর্কের গভীরতা দূর হতে রঙিন কাগজে মোড়ানো বর্ণিল মনে হলেও তার ভেতরের গভীরে যে খরস্রোতা নদীর প্রবাহ থাকে সেটা দেখা যায়না। সফিক সাহেবের এমন ঘুমে জাইফার বেশ মায়া হয়, মনে হয় মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। রাতের এই আঁধার জাইফাকে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, সে নিজেকে সামলাতে পারছেনা যেনো। তারপরও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়। কী যেনো এক অদেখা দুরত্বে দু’জন বাস করছে প্রতিনিয়ত। সংঙ্গাহীন এই দুরত্বের কোনো সীমানা নির্ধারণ করা যায়না কেবল অসীম দূরত্বে চেয়ে থাকাটাই স্বান্তনা।


শীতের কনকনে ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য বাহিরের কুয়াশায় যেনো প্রকৃতি কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। বাগানের গাছগুলোর ফাঁকে চাঁদের আলো আঁধারকে খানিকটা পথ দেখাতে ব্যস্ত। জাইফা বারান্দায় এসে  চেয়ারে বসে। মনের ভিতরে যেনো তোলপাড় চলছে, মনে হচ্ছে এই জীবনটাকে সে ছিটকে ফেলে দেয়। বছর দশ হলো বিবাহিত জীবনে তাদের কোনো সন্তান আসেনি, আর আসবে বলেও সম্ভাবনা নেই। স্বামী রাত হলেই অতিথিশালায় আমোদ ফুর্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে।  রাতের গভীরতায় জাইফার বেদনাসিক্ত হৃদয়ের হাহাকার আরো বাড়তে থাকে। শূন্য বুকের উঠোনে খেঁকশিয়াল রাতের আঁধারে সঙ্গ দেয়। অতিথিরা বাগানে আসলে বাংলোতে এই আসর জমে প্রায়ই কিন্তু নতুন এই আগন্তুকের কথা ভেবে জাইফার মনে অনেক কৌতুহল সৃষ্টি হয়। আগের অতিথিদের মধ্যে একটা নেশার ভাব লক্ষ্য করতো জাইফা কিন্তু তার মধ্যে এটা সে খুঁজে পায়নাই।


রাত গভীরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় অনির্বাণের। আর ঘুম আসছেনা তাই বিছানা ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। একটা সিগারেট শুঁকতে শুঁকতে নেমে আসে রাস্তায়। এই রাস্তাটি আরেকটি বাংলোর সাথে সংযোগ করা আছে। রাতের চাঁদ অনির্বাণকে পথ দেখায়। কিছুটা এগোতেই ম্যানেজারের বাংলোর বারান্দায় চোখ পড়লো অনির্বাণের। থমকে দাঁড়িয়ে খানিকটা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। একটা মুখ ও সেই শাড়ির রঙটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা। চুলগুলো ঠিক আগের মতোই ছেড়ে চলে গেছে নিতম্ব অবধি। এটা কাল্পনিক অস্তিত্ব নাকি মনের ভুল সেটা বুঝতে পারছেনা অনির্বাণ। একটু এগোতেই চেনা গেল। এতো রাতে জাইফা বারান্দায় কেনো দাঁড়িয়ে আছে তার হিসেবে মেলাতে পারছেনা অনির্বাণ । সফিক সাহেবের সাথে জাইফাকে দেখে এক অসম্ভব সুখী দম্পতি মনেয়েছিলো অনির্বাণের। অথচ জাইফা গভীর রাতে এখানে কী যেনো হারায়ে বসে আছে। সন্ধ্যা রাতের সেই জাইফা আর এখানে বসে থাকা জাইফার মাঝে কোনো মিল খুজে পাচ্ছেনা অনির্বাণ। 


সময় বহে চলছে আপন গতিতে।  শিশিরের পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। একটু পরেই হয়তো আঁধারকে পেছনে ফেলে আলো এসে হাজির হবে। ততক্ষণে অনির্বাণের মনের ভিতর যে ঝড় বইছে তা শান্ত করবে কে? জাইফাকে অনির্বাণ  প্রথম দেখেছে সফিক সাহেবের সাথে। তখনই কোনো এক ফাঁকে তাকে আপাদমস্তক কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুক্তিবোধহীন চাহনিতে দেখে নেয় অনির্বাণ। কিছু চাহনি কেবল চোখ দিয়ে হয়না এতে মনের একটা তীব্র সংযোগ থাকে বলেই সেটা দেখায় রূপ নেয়। একটা সুন্দরের মোহে ডুব দিয়েছিলো অনির্বাণ এখন সেটা বড্ড মায়ায় রূপ নিয়েছে। অনির্বাণের বারবার মনে হচ্ছে একটু এগিয়ে জাইফার সাথে একটু কথা বলে, তার বরান্দায় বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করে। এমন হাজারো ইচ্ছা অনিচ্ছার ভাবনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে তার ভিতর। আকাশে চাঁদের মায়ার সাথে মিতালি করে অনির্বাণ  এগিয়ে চলছে সামনে। ঠোঁটের সিগারেট আগুনের তীব্রতায় ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। 


সারাটা রাত বারান্দায় কাটিয়ে ভোরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছে জাইফা। সফিক সাহেব সকাল বেলা উঠে দেখে জাইফা ঘুমাচ্ছে। সকালের নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে পড়েছে সফিক সাহেব ; আজ তার দুপুরের ট্রেন ধরে ঢাকায় যাবার কথা। ঢাকায় কাল এবং পরশু দু’দিন চা বিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগদান শেষে আবার ফিরবে শ্রীমঙ্গল। জাইফাকে গতরাতেই বাসায় ফেরার সময় বলেছিলো ব্যপারটা; তাই জাইফাকে ঘুমে রেখেই বেরিয়ে পড়ে সফিক সাহেব। জীবনের চলার বাঁকে দৈনন্দিন ঘাত-প্রতিঘাতে মনের অজান্তে’ই  মানুষ মাঝে মাঝে রোমান্টিকতায় আচ্ছাদিত  স্বাভাবিক সৌজন্যতাটুকুও হারিয়ে ফেলে।


ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই করছে। জাইফা ঘুম থেকে উঠে সোজা বাথরুমে চলে যায়। সকালের স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দেয়। হালকা গোলাপি শাড়িতে তাকে আলাদা লাগছিলো নিজের কাছে। জাইফা বারবার সামনে রাখা আয়নায় নিজের অবয়ব দেখে নিজেকে সে হিংসা করছে। প্রতিবিম্বিত জাইফাকে সে অবাক হয়ে দেখে চুলগুলো সামনে এনে বারবার তাকায়। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনের আয়নায় আওয়াজ তুলে অনির্বাণের মায়াবী চোখের কথা বলার অনুরণন। ধীরে ধীরে আয়নার সামন থেকে সরে জানালার পাশে দাঁড়াবার একটা প্রয়াস চালায় সে। শীতের সকালের রোদ জাইফার  চুলগুলো থেকে চুমুকে চুমুকে সমস্ত পানি শুষে নেয়। অনাহুত স্বাধীনতা পেয়ে চুল এবং মন দুটোই উড়তে থাকে মোর ঘোড়ানো জীবনের অজ্ঞাতনামা গন্তব্যে। হঠাৎ মনে হলো কাজলকে ডেকে পাঠানোর কথা। তাই ফোনটা হাতে নিয়ে কাজলকে ডেকে আনে জাইফা।

কাজল, বাংলোর সাহেব সকালে নাস্তা খেয়েছে তো! তুমি উনার দেখভাল করো ঠিকমতো; যেহেতু তোমার স্যার ওখানে নেই তাই তুমি নিজ উদ্যোগে খোঁজ-খবর রেখো। আমাকে সময় সময় আপডেট জানিও, কেমন। কথাগুলো বলে জাইফা একহাজার টাকার একটি নোট কাজলকে দেয়। কিছু মাছ-মাংস সহ আরো কিছু আনতে বলে তাকে। কাজল টাকা নিয়ে বের হবে এমন সময় জাইফা কাজলকে ডাক দেয়।

আচ্ছা কাজল, তুমি একটা কাজ করো।

জী মেম বলেন, কী করতে হবে আমাকে? কাজল জানতে চায়।

দুপুরের খাবার বাংলোর সাহেব এখানে খাবে। তুমি তার ব্যবস্থা করো এবং ওনাকে আমার নিমন্ত্রণ পৌঁছে দিও, বলেই জাইফা কাজলের নিকট হতে বিদায় নেয়।


অনির্বাণ চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছে। সকালের নাস্তা শেষ করে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। ভাবনার সাথে চোখের দৃষ্টি একাকার হয়ে মিশে গেছে পত্রিকার পাতায়। দরজা খুলে রেখেছিলো যাতে সূর্যের আলো এসে ঘরের সমস্ত অবসন্নতা কাটিয়ে দিয়ে যায়। কাজল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কিছু বলছে না। হঠাৎ অনির্বাণ কাজলকে দেখে ভিতরে আসতে বলে। কী জন্য এসছো? অনির্বাণ জানতে চায়। দুপুরে স্যারের বাংলোতে আপনার লাঞ্চ হবে, মেম আপনাকে বলতে বলেছে। বলেই কাজল চলে যায়। পত্রিকা আর পড়া হলোনা অনির্বাণের ; কেবল কালো কালো অক্ষরের উপর প্রাণহীন চোখের চাহনি রাতের আঁধারের অপরিচিত কিছু ঘটনার স্মৃতি খুঁজে বেড়ায়। 


মাঝে মাঝে জাইফা রান্না করে সফিকের জন্য।  আজ সে নিজেই রেঁধে সব তৈরি করেছে।  ঘড়িতে একটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে কিছু আগেই, জাইফা কাজলের জন্য অপেক্ষা করছে। হালকা নীলাভ রঙের একটা শাড়ি পরে চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে। খানিকটা এলোমেলো চুলের খর্বিত অংশ গ্রীবাদেশ স্পর্শ করে আছে, তার মাঝে কালো একটা তিলের অবস্থান যেনো সুন্দরকে আলাদা একটা কাব্যিক অলংকার দান করেছে।  অলংকারের বাহুল্য বর্জিত জাইফা সাধাসিধা থাকতেই পছন্দ করে। হঠাৎ কাজল এসে হাজির হয়। কাজলকে কিছু বলার চেষ্টা করতেই চোখে ধরা দেয় ঝাকড়া চুলের ছিমছাম গড়নের রাতের সেই মানুষটি, যাকে অনির্বাণ বলেই জাইফা ডাকবে বলে স্থির করে রেখেছে। পরস্পরের কুশল বিনিময় শেষে খাবার টেবিলে বসে অনির্বাণ। আগেই সব প্রস্তুত করে রাখা ছিলো; অনির্বাণ একা খাবেনা বলে পীড়াপীড়ি করলে জাইফাও এক টেবিলে খেতে বসে। খেতে খেতে দুজনের গাল গল্পে কিছু আসে, কিছু যায় আবার তার রেশ টেনে নতুন গল্পের জন্ম হয়। পাশেই মৃদুস্বরে বাজতে থাকে একটি রবীন্দ্র সংগীত;.....জগতের আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’


ভাবী কেমন আছেন?  খাবার পর জাইফা জানতে চায় অনির্বাণের কাছে । কিছু সময় নিরব থেকে অনির্বাণ বলে, এখনও তেমন কিছু হয়ে উঠেনি। কথাটা শুনে জাইফা ভাবছে ভদ্রলোককে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিলাম বোধহয়।  তাই  সে নিজেই পরিস্থিতিকে দুজনের অনুকূলে আনার জন্য আরো অনেক কথা বললো। দীর্ঘ আলাপচারিতায় দুজনের কাছেই পরিবেশটা খুব উপযোগী মনে হচ্ছিলো সময়কে আরো দূরে টেনে নেওয়ার। শীতকালে সচরাচর বৃষ্টি হয়না। কিন্তু মাঘ মাসের বৃষ্টি ফসলের জন্য খুবই উপকারী। গল্প ও আড্ডার শেষ না-হতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। একটা অলসভাব এসে গেছে তাই উঠতেও মন চাইছেনা অনির্বাণের। তারপর জাইফার নিকট থেকে চলে যাওয়াটাও বেশ খারাপ  লাগছে মনে। দুজনেই সময়টাকে খুব উপভোগ করছে।


বৃষ্টির ফোঁটা টিনের চালে ভীষণ তাল সৃষ্টি করছে। মাঘের কনকনে শীত জাইফার শরীর যেনো উষ্ণতার চাদরে ঢেকে রাখার জন্য হাহাকার করছে। শীতের মাঝে বৃষ্টির এই নগ্নতার কথা ভেবে অনির্বাণকে শুয়ে থাকতে বলে বিছানা প্রকস্তুত করে দেয় জাইফা। এলায়িত চুলের ফাঁকে হলুদে রাঙানো মুখের প্রতিচ্ছবি একবার দেখে নেয় অনির্বাণ। জাইফাও চলে যায় তার কক্ষে। বিছানায় হেলান দিয়ে জাইফা মোবাইল থেকে একটি কল দেয় সফিক সাহেবকে।  কুশল বিনিময়ের পর আরও কিছু কথা বলে রেখে দেয় ফোন। কখন আসবে তুমি?  জাইফা সফিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করে। তীব্র হাহাকারের প্রতিধ্বনি অবিরত জাইফার ভিতর বাহিরে আওয়াজ তোলে। জীবনের এই বাঁকে না পেলো মাতৃত্বের স্বাদ না পেলো শারীরিক সুখ। কতোজন জাইফার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। সেদিকে ফিরেও তাকায়নি সে। দিন দিন হতাশার ক্রমবর্ধমান চাপ আর সইতে পরছেনা জাইফা। কাজল একবার ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় সামগ্রিক অবস্থার। জাইফা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা যেনো। উঠে যায় বিছানা থেকে; ঘরময় কেবল পায়চারি করে।


সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বৃষ্টি তখনো থামছে না। বিদ্যুৎ মশাই চলে গেছে বেশ আগে। একটা অন্ধকার নেমে এসেছে বাগানের সারটা বুক জুড়ে। অনির্বাণকেও যেনো এই আঁধার ক্রমশঃ গ্রাস করছে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অনির্বাণ। এই আঁধার কী সব ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যাবে ! অনির্বাণ বুঝতে পারছেনা কিছুতেই। মরাল গ্রীবাদেশে কোমল চুলের নৃত্য অনির্বাণ যেনো প্রথম দেখলো জাইফার মাঝে। অন্ধকার সমগ্র ঘরে যেনো এক বেদনার হাহাকারকে আমন্ত্রণ জানাতে ব্যস্ত। জাইফা আলো জ্বেলে দিবে ভেবে অনির্বাণের ঘরে আসে।

কোথায় আছেন এই অন্ধকারে? আলো জ্বালাননি কেনো?  বলতে বলতে জাইফা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অনির্বাণকে দেখা যাচ্ছিলোনা; খুব কাছাকাছি আসতেই দুজন সতর্কভাবে দাঁড়ায়। অন্ধকারে কেউ কাউকে চিনতে পারছেনা যেনো। জাইফার চুলের একটা নেশা জাগানো গন্ধ অনির্বাণের নাক দিয়ে প্রাণের ভিতরে প্রবেশ করে নোঙর ফেলে। নিজকে এইপর্যায় সমলাতে না পেরে আগ্রাসী কঠিন হাত বাড়িয়ে দেয় জাইফার দিকে। জাইফার এলোমেলো কোমল চুলের নৃত্য অনির্বাণের মুষ্টিবদ্ধ আঙুলের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। জাইফাও নিজেকে বাঁধা দেয়না জগতের এই প্রাচীনতম খেলায় সংযুক্ত হতে। ক্রমেই বাড়তে থাকে খেলার তাল, লয় আর গুঞ্জন। দুজনেই উপভোগ করতে থাকে হৃদয় উপচিয়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন।


আঁধারের কালো হাত সমগ্র বাগানের সবুজকে যেনো দুমড়েমুচড়ে দিয়ে গেছে কিছু সময়ের মধ্যে। বড় ঝড় হয়তো বেশি সময় থাকেনা কিন্তু স্বল্প সময়ে তার তান্ডব রেখে যায় বিশাল ক্ষত। ভবিষ্যৎ হয়তো তার গতিপথ নির্ধারণ করে দিবে সময়ের আপন নিয়মে কিন্তু যে ক্ষতের সৃষ্টি হলো তার ভার উভয়েরই বয়ে যেতে হবে সারাজীবন। ক্রমেই রাত বাড়তে থাকে; কিছু না বলেই অনির্বাণ চলে আসে নিজের বাংলোয়। জাইফার ক্ষত-বিক্ষত অন্তর ছাঁচ হীন বিছানায় পড়ে থাকে। রাতের আঁধারের তীব্রতা ভোরের আলোর পথকে সুগম করে দেয়। খসে যাওয়া প্রকৃতির আস্তরণ সযতনে লাগাতে থাকে দুজনে। সকালবেলা সফিক সাহেবের ফোনে ঘুম ভাঙে জাইফার। সকালের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে স্নান করে নেয়। মরে যাওয়া গাছের ডালে যেনো সবুজ কঁচি পাতা উঁকি মারে। সফিক সাহেব আজ সন্ধ্যা নাগাদ আসবে বলে জাইফাকে জানায়। একটা তীব্র ক্ষত দগদগে ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছে জাইফার মনে। গভীর চোখের সর্বনাশা মায়া কাজের গতিপথ পাল্টে দেয় মাঝে মাঝে।


দুপুরের খাবারের আগে অনির্বাণ জাইফাকে ফোন দেয়। গতরাতে ঘটে যাওয়া অনির্ধারিত ঘটনার রেশ কাটাতে পারেনি কেউ। লাঞ্চ করা হয়েছে? অনির্বাণ জানতে চায়। জাইফা না সূচক জবাব দেয়। আরো অনেক কথা হয় ; একটি অনাহুত রাতের পরিবেশ দুজনকে এমনভাবে পরিচয় করে দিয়েছে যেনো বহু জনমের আগে তাদের একবার দেখা হয়েছিলো। কী যেনো এক গভীর আকর্ষণ দুজনকে চুম্বকের মতো টানে। অল্পসময়ের পরিচয়ে যে সম্পর্কের ভিত রচিত হয়েছে তার উপর দাঁড়িয়ে অনির্বাণ একবার জাইফাকে বিয়েরও প্রস্তাব দেয়। অসীম আকাশের নীচে যে বেদনার ঘর বাঁধা  হয়েছে তা ভাঙবে কী দিয়ে জাইফা। কোনো উত্তর দেয়না,  নিরবতার একটা গভীর ভাষা থাকে। মানুষের অসহায়ত্ব  এই নীরব ভাষায় ব্যক্ত হয়। সফিক সাহেব বাংলোতে ফিরে আসে। প্রকৃতি সন্ধ্যা পূজার আয়োজন সাজাতে ব্যস্ত। জাইফাকে অনির্বাণ বলেছিলো কাল পর্যন্ত ছুটি আছে, তাকে ফিরতে হবে কর্মস্থলে। বিষন্নতা সন্ধ্যার  আয়োজনকে জোর করে অতীতের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। জাইফা গত রাতের কথা ভাবতে থাকে। অনির্বাণের মায়াবী চোখ আর আগ্রাসী হাত যে ক্ষতের তৈরি করেছে তা সারাবে কী দিয়ে জাইফা। ধীরে ধীরে তা মন থেকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। সফিক সাহেবের  সব কথার উত্তর দেয়না জাইফা কেবল এক অজানা অস্থিরতা চলছে মনের উঠোনে । ভাবনার ফাঁকে অনির্বাণের প্রস্তাবটার কথা মনে উঁকি দেয়। সময়ের ¯্রােত ভাবনাগুলোকে আগ্রাসী করে তুলে। বিবর্ণ ভবিষ্যৎ বর্তমানের ভাঙা কাঁচের টুকরোতে হেঁটে হেঁটে রক্তাক্ত হতে থাকে ।


হবিগঞ্জ।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট