আয়না-আদল !

 



আয়না-আদল 

আহাদ আদনান


‘বউ-ঝি’রা কুটুম আসলে আলমারি খুলে শাড়ি দেখায়। থাকে থাকে সাজানো শাড়ি। আমার আছে তোয়ালে। সাদা সাদা দামি তোয়ালে। মখমলের মত নরম। কাল রাতেও গুনে রাখছি। ঊনচল্লিশটা তোয়ালে’।

‘তোয়ালে জমানো আপনার শখ বুঝি’?

আহসান মঞ্জিলের দক্ষিণ দিকের গেটের বিখ্যাত পান’টা মুখে দিয়ে, চিবিয়ে লাল করে, আড়চোখে চেয়ে তৃপ্তির হাসি দেন আবদুল বাতেন হাওলাদার। শরীয়তপুরের সড়ক বিভাগের অফিসের কেরানী হাওলাদার বাবু।

‘শখ না, এইটা আমার ধ্যান-জ্ঞান। ল্যাঙটার মাজারে যেমন পাগলেরা তবারক খাবলে নেয়, এই তোয়ালে আমার তবারক, প্রসাদ, মেওয়া যা কন। তাবিজের মতন আমি যতন কইরা রাখি আলমারিতে’।

আড্ডা জমে উঠে ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানে। হাওলাদার মেলে ধরেন তার গল্পের ঝাঁপি।

‘হাইস্কুলে আমার হেডমাস্টার ছিলেন প্রদীপ স্যার। লুকিয়ে বিড়ি খেয়ে ধরা পড়ি। ডাক পড়ল স্যারের কামরায়। বেত খেতে খেতে পিঠের চামড়া উঠে গিয়েছিল। ব্যথার মাঝেও চোখ গিয়েছিল স্যারের চেয়ারে। কাঠের নকশা করা হাতলওয়ালা কেদারা। পিঠ বেয়ে ঝুলছে ধবধবে সাদা একটা তোয়ালে। কয়েকবছর পর পারিবারিক একটা মামলায় গিয়েছিলাম কোর্টে। জজ সাহেব বসে আছেন এক মসনদে। পিছনে ঝুলছে তোয়ালে। বুঝে গেলাম এই তোয়ালে সম্মানের, আভিজাত্যের প্রতীক। জীবনে প্রথম মাসের বেতনের টাকায় মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য জায়নামাজ আর একটা তোয়ালে কিনেছিলাম। অফিসের বড় সাহেবের হাতে তুলে দিতে পিঠ চাপড়ে আদর করেছিলেন বয়স্ক অফিসার। আর চেয়ে নিয়েছিলাম পুরনো তোয়ালেটা। সেই থেকে নেশা শুরু হয়ে গেলো। বদলি আমার হোক কিংবা বড় সাহেবদের, তোয়ালে হতে হবে দেখার মত। এভাবেই পরিচয় নেকবর ভাইয়ের সাথে’।

দোকানের মহাজন নেকবর আলী মৃদু হাসেন। ইসলামপুরের সবচেয়ে সেরা তোয়ালে পাবেন তার দোকানেই। হাওলাদারের অনেক স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, বিকিকিনি আর ছোটখাটো দুর্নীতির সাক্ষী তিনি। অবশ্য পাঁচ হাজার টাকার তোয়ালের দশ হাজার টাকা ম্যামো করার চেয়ে আর কোন বড় চুরির হদিস জানা নেই তার। তবে শিকারি বেড়াল গোঁফে (কিংবা তোয়ালে দিয়ে) চেনা যায়। 

‘হাওলাদার বাবু, কোনো বসের সাথে তোয়ালে নিয়ে ঝামেলা হয় নাই? এই যে বেশি বিল ধরছেন, কিংবা তোয়ালে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন। সবাই তো আর এক রকম না’।

মুখে লালা জমে গেছে। পিক করে কিছুটা লাল তরল ফেলে হাওলাদার।

‘বিসিএস কি জিনিস বুঝেন? এইটা হচ্ছে আধুনিক সামন্তবাদ। একেকটা ক্যাডার নিজেরে মনে করে জমিদার। অহংকারে পা পড়ে না মাটিতে। কোন জমিদার তেল খায় না, কন? আমার সাথে ঝামেলা কইরা লাভ আছে? আমি হইলাম ঝানু কেরানী’।

এই ঝানু লোকটাই আবার হেরে যান নিজের ছেলের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করা ছেলেটা ছাড়ে না কথা শুনিয়ে দিতে।

‘তুমি একটা ব্যাকডেটেড লোক। ঔপনিবেশিক আমলের দাসত্বের প্রতীক তুমি সাজিয়ে রেখেছো ঘরে। তুমি জানো, এই তোয়ালের ইতিহাস? ব্রিটিশ বাস্টার্ডগুলো দেখলো বাঙাল খেতগুলো মাথা-ভরতি করে তেল মেখে আসে। সেই তেলে নোংরা হয় চেয়ার। হাতের তেলে নষ্ট হয় জরুরী দাপ্তরিক কাগজ। তারা ব্যবস্থা করলেন গেঁয়োর দল তোমরা চেয়ারে তোয়ালে রাখবে, ময়লা হাত শুকনো রাখবে। সেই তোয়ালে কেন এখনও ব্যবহার করব আমরা’?

‘গর্দভ, এটা আভিজাত্যের প্রতীক। ব্রিটিশ ছিল বলেই সভ্য হতে পেরেছিস। আর তোয়ালে যদি এত খারাপ হয়, ব্রিটিশদের অন্য নিয়মগুলো কেন বাদ যাবে? সমাবর্তনে কেন পাশ্চাত্যের গাউন আর টুপি পরিস? বিচারপতিরা কেন আজও মাথায় পরচুলা লাগিয়ে শপথ করায়? এই তোয়ালে আমার অহংকার, বুঝেছিস’?

‘এত তেল মারো বলেই তেল থেকে তোয়ালে হয়েছে’।

গর্দভটাকে আর বলা হয়না ‘টাওয়েল’ একটা ইংরেজি শব্দ। 

আজ বিশেষ একটা দিন। অন্য সময়ের চেয়ে একঘণ্টা আগেই অফিসে হাজির হাওলাদার। নতুন বস যোগদান করবেন। তার চাকরি জীবনের শেষ বস হয়তো। দেড় মাস পরেই তার অবসর। নতুন কেনা তোয়ালেটা সাজিয়ে রেখেছেন বড় সিংহাসনের মত চেয়ারটায়। বসের বয়স খুব কম মনে হচ্ছে। পাঁচ ফুট দশ-এগারো হবেন। শ্যাম্পু করা তেলমুক্ত চুল। রুচির পরিচয় মাথা থেকে পা পর্যন্ত। গলার আওয়াজ মখমলের মত মিহি। শান্তিনিকেতনি উচ্চারণ। হাওলাদারের মত ঝানু লোক কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে নতুন ‘ডিজিটাল প্রজন্মের’ সামনে।

‘চেয়ারে তোয়ালে রেখেছে কে? এটা সরিয়ে ফেলুন। দরজার পর্দাগুলোর রঙতো এমন হওয়া উচিত নয়। ভাবমূর্তি একটি বিশাল ব্যাপার। সমস্যা মনে হচ্ছে। অফিসের খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে’।

এই ব্যক্তিত্বের সামনে হাওলাদারের ভোকাল কর্ড অবশ অবশ লাগে। চাকরি জীবনের শেষ দেড় মাস তার মনে হয় দেড় যুগের মত দীর্ঘ। দেওয়ালের রঙ বদলে যায়, রোমের পর্দা আসে, রাজস্থানের নকশা করা চেয়ার আমদানি হয়। তেহরানের সবচেয়ে সেরা তোয়ালে শোভাবর্ধন করে সেই চেয়ারে। জেলা শহরের সড়ক বিভাগের অফিসটা যেন তাজমহলের সাথে পাল্লা দিতে চায়।

পার হয় আরও ছয়টি মাস। হাওলাদারের তোয়ালের নেশা কিংবা প্রেম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন সেই বড় সাহেব। জমে থাকা তোয়ালে এখন আর নেড়ে চেড়ে দেখা হয় না। রোদ পায়না তারা আর। ন্যাপথলিনগুলো ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে যায়। তেলাপোকা আর ছারপোকাদের প্রজননের অভয়ারণ্য হয় তোয়ালের স্তুপ। পুরনো অফিস থেকে ফোন আসছে সপ্তাহদুয়েক ধরে। হাওলাদার পেট এখন ফার্মেসি। উচ্চরক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, অনিদ্রা জাঁকিয়ে ধরে তাকে। ছেলেমেয়েরা দেখে দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে বাবা। জিজ্ঞেস করলে একই কথা, ‘আরে কিছু না। আমি ঠিক আছি। ভালো আছি’।

দৈনিক পত্রিকার খবরটাই সব ফাঁস করে দেয়। ‘সড়ক বিভাগে তোয়ালে কেলেঙ্কারি। দেড় লাখ টাকায় কেনা হয়েছে একেকটি তোয়ালে’।

হাওলাদার বাবু প্রমাদ গুনেন। ‘ডিজিটাল’ বস খুব সুন্দর করে অর্থ কেলেঙ্কারি চাপিয়ে দিয়েছেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কেরানীর ঘাড়ে। এলাকায় তার মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে যায়। মামলা চলছে। গ্রেফতার হতে পারেন যেকোনো দিন। 

আলমারি থেকে একটা তোয়ালে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ান তিনি। চেহারাটা মনে হয় কালো, কুচকুচে কালো। কে যেন এক খাবলা কালি মেখে দিয়েছে আয়না-আদলে। তোয়ালে নিয়ে ঘষতে থাকেন মুখ। কালি উঠে না। এই কালি কলঙ্কের চেয়ে কালো।       


মাতুয়াইল, ঢাকা। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট