জীবনটা দাবার গুটি !

 



জীবনটা দাবার গুটি

সাহেদ বিপ্লব


মাহবুব সাহেব একটি সরকারি ব্যাংক থেকে সহকারী পরিচালক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন প্রায় দশ বছর হলো। এখন তিনি গ্রামে থাকেন। বাবার রেখে যাওয়া জমি এবং তিনি চাকরির সুবাদে বেশ কিছু কিনেছেন এই সবের উপর ভর করে ভালো ভাবেই সংসার চলে যাচ্ছে তার। 

মাঝে মাঝে অতিতের কথা মনে পড়ে, আজ একটু বেশি মনে পড়ছে। কি বিলাসিতার জীবন। সরকারি বাড়ি, কাজের লোক, সরকারি গাড়ি। আলিশান অফিস। কি নেই সেখানে। বলা চলে হাত বাড়িয়ে দিলেই হাতের কাছে সব কিছু। জীবনকে যেভাবে আনন্দময় করতে চাই, সেই ভাবে আনন্দময় করা যায় এখানে। বিদেশ ভ্রমণ। সেরাটোনে শিল্পপতিদের আমন্ত্রণ সহ অনেক কিছু।

অবসর নেওয়ার পর মাঝে মাঝে অফিস থেকে ডাক আসতো। স্যার একটু অফিসে আসতেন তাহলে ভালো হতো। এই কাজটা ভালো করে বুঝতে পারছি না। বলেই গাড়ি পাঠিয়ে দিতো এখন আর তা হয় না।

ছেলেমেয়ে সবাই বিদেশে। তাই ভাড়া বাসায় না থেকে এক সময় সিদ্ধান্ত নিলো আর ঢাকাতে নয় গ্রামে চলে যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। একদিন সকল কিছু গুছিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসলেন মাহবুব সাহেব।

এখন তিনি গ্রামে থাকেন। প্রথম প্রথম একটু কেমন লাগতো। এস,এস.সি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকাতে পা রেখেছেন। বলা চলে লেখাপড়া চাকরি সব কিছু ঢাকাতে। যাকে বলে জীবনের সোনালী দিনগুলো ঢাকাতে কাটিয়েছেন।

এক সময় মনে হলো অনেক বছর ঢাকাতে যাওয়া না। একবার ঘুরে আসি কবে পৃথিবী থেকে চলে যাই, তা তো আর বলা যায় না। সেই ইচ্ছা নিয়ে মাহবুব সাহেব ঢাকাতে আসলেন। অনেক স্থানে ঘুরলেন। যেখানে সোনালী দিনগুলো কেটেছে। দেখছেন আর ভাবছেন দশ বছরে ঢাকা শহর কতো পরিবর্তন হয়েছে। যেখানে ছিলো শুধু ধানের খেত সেখানে আজ আলিশান বাড়ি বলেই একটা দীঘশ^াস ছাড়লেন।

অনেক ঘুরে ফিরে এক সময় গিয়ে হাজির হলেন তার সেই ব্যাংকে। যেখান থেকে তিনি সহকারী পরিচালক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। ব্যাংকের ভিতরে গিয়ে পরিচিত তেমন কাউকে পেলেন না। সকলে তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাকে দেখে কেউ একবার উঠে সালাম দিলো না। একদিন এই অফিসে আসতেই সালামের উপর সালাম। স্যার কেমন আছেন, শরীর ভালো আছে কি-না ইত্যাদি ইত্যাদি আজ তার কিছুই নেই।

অনেক ঘুরে ফিরে বর্তমান সহকারি পরিচালক এর রুমে গিয়ে ঢুকলেন মাহবুব সাহেব।

এটা সেটা নিয়ে কথা হলো কিন্তু বর্তমান সহকারি পরিচালক তাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। এক সময় মাহবুব সাহেব বললেন, আপনি কতো দিন এই চেয়ারে বসেছেন?

এই তো দুই বছর হলো।

ও আচ্ছা।

অনেক দিন কাটিয়ে দিলেন।

তা বলতে পারেন বলেই বর্তমান সহকারি পরিচালক বললেন, আপনি আগে কি করতেন?

এবার মাহবুব সাহেব বলার সুযোগ পেয়ে বললেন, আপনার এই চেয়ার এমন কি এই অফিস থেকে দশ বছর আগে অবসর নিয়েছি। আপনার পিছনের বোর্ডে পাঁচ নাম্বারে যে নামটা দেখছেন মোঃ মাহবুবুর রহমান আমি সেই লোক।

এবার বর্তমান সহকারি পরিচালক একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, তাই নাকি স্যার।

মাহবুব সাহেব একটু মাথা নাড়ালেন।

বর্তমান সহকারি পরিচালক বেল বাজিয়ে চায়ের অর্ডার দিলেন। তারপর বললেন, এখন অবসর জীবন কেমন লাগছে স্যার?

একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললেন, প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। এতো বড় চেয়ার, চারিদিকে রাজকীয় জীবনযাপন তা থেকে হঠাৎ করে ছিটকে পরলে কি আর ভালো লাগে?

মাহবুব সাহেবের এমন কথা শুনে একটু ভাবনা এলো মনে।

তিনি আবার বললেন, জীবন কি অদ্ভত। ঠিক দাবা খেলার মতো। যখন গুটিকে কোটের উপর সাজানো হয় তখন রাজার কতো দাম। উজির, সেনাপতি, সৈনিক কিন্তু খেলা শেষে যখন সবাইকে এক কৌটার ভিতর রাখা হয় তখন সবাই সমান। আপনি যখন অবসরে যাবেন তখন আমি আপনি সবাই সমান। একটু থেমে আবার মাহবুব সাহেব বললেন, এই চেয়ার ধরে রাখার জন্য জীবনে কতো কিছু করেছি কিন্তু একদিন সব কিছু ছাড়তে হয়। যাদের জন্য আয় করেছি তারা এখন অনেক দূরে, কেউ আমেরিকায়, কেউ কানাডায় আমার খবর রাখার সময় তাদের নেই। আজ ভাবি কাদের জন্য এতো কিছু করলাম?

কথাটা শুনে বর্তমান সহকারি পরিচালক একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়লেন।

আজ আসি। অন্য একদিন আসবো বলেই মাহবুব সাহেব উঠে চলে গেলেন। বর্তমান পরিচালক অবাক হয়ে মাহবুব সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং তার জীবনের উত্তর খুঁজতে লাগলেন।



প্রকাশক

টইটই প্রকাশন

বাংলাবাজার মাদ্রাসা মার্কেট,ঢাকা-১১০০




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট