ডোরবেল

 


ডোরবেল

রোমেনা আফরোজ


লিয়া বারান্দায় বসে আছে। তার চারপাশে ঠাঁসা বুনোনের ঘন অন্ধকার। আজ কোথাও কোন শব্দ নেই। বাতাস নেই। এ কারণেই বুঝি তার কান্নার মৃদু শব্দও বোধগম্য হয়ে উঠে। কান্নার নিজস্ব একটা ভাষা আছে। কেবল অনুভূতিসম্পন্ন মানুষরাই এই ভাষা বুঝতে সক্ষম।


-লিয়া, তুমি কি তোমার সিদ্ধান্তে অটল?

- অতীতে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো এ কথা সত্যি। সেই কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেও পারিনি। কিন্তু আজ আমি সন্দেহমুক্ত।

-তবে কাঁদছ কেন? তোমার কান্নাই বলে দিচ্ছে তুমি অটল কিংবা স্থির নও। 

-হয়তো তাই। কিন্তু তাতে আমার সিদ্ধান্তের কোনও পরিবর্তন হবে না।

-তুমি আরেকবার ভেবে দেখো।

-প্রভু, এখানে ভাবার কিছু নেই। আপনি তো সবই জানেন। এও জানেন আমার কোন বসন্ত নেই।

-সত্যিই কি বসন্ত নেই? এই যে তুমি মনেপ্রাণে তোমার প্রভুকে স্মরণ করছো, তোমার অন্তরে উজ্জ্বল আলোর আভাস, একাকীত্বকে বশীভূত করে তোমার হৃদয়জুড়ে শিশুরা বিচরণ করছে এগুলো কি বসন্তের ফুলগুলোর চেয়েও সুবাসিত নয়?

-সে তো আপনারই করুণা। কিন্তু আঠারো বছরকে ভুলতে পারার মতো শক্তিশালী আমি নই।

-এই ভুলতে না পারা তোমার দুর্বলতা নয় লিয়া। অতীত মানুষের জীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে অতীত শুধু ছায়াসঙ্গী। তুমি যদি অতীতকে বর্তমানের পথে দেয়াল তৈরি করতে দাও তবে বর্তমান ধসে পড়বে।

-আমি জানি, এই চার দেয়াল, একাকীত্ব আমার দুর্বলতারই সাক্ষ্য বহন করছে। হয়তো এজন্য আমিই দায়ী। কিন্তু বারো বছর আগে আমাকে যে দু দু’বার ভ্রুণ হত্যা করতে হয়েছিল এবং আজকের এই মাতৃত্বহীনতা এর দায় কি শুধুই আমার? এই দায় থেকে আমার স্বামীও মুক্তি পেতে পারে না...

-লিয়া, একজন নারী হিসেবে তুমি তোমার মধ্যকার অপার শক্তিকে জাগাতে পারোনি।  এর দায় কেবল তোমার। অন্য কারো নয়। কণ্ঠের দৃঢ়তা টের পেয়ে ঘাবড়ে যায় লিয়া। বিশাল দীর্ঘশ্বাস অবমুক্ত করে অতীতের ভুলগুলো নতুন করে ভাবতে থাকে। একসময় স্বীকার করে, উর্বরতার দিনগুলোতে সে যদি আর একটু কৌশলী হতো তবে হয়তো আজ নিরবতার পরিবর্তে সন্তানদের কোলাহলে চারদিক মুখরিত হত। তবে এও ঠিক, স্বামীর মদ্যশালায় ডুবে থাকার বিষয়টি তার মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিলো। সেজন্য নতুন প্রাণের কথা ভাবতে পারেনি। তখন প্রচ- ভয় পেতো। যখন প্রভু একটু একটু  করে পরম মমতায় দখল করে নিচ্ছিলো তার আত্মা এবং শরীর, সে সময় প্রথমবারের মত তার মধ্যে মাতৃত্ব জেগে উঠে। এরপর অনেক চেষ্টা করেছিল। প্রথমদিকে ডাক্তাররা আশাও দিয়েছিল। সেই আশা আর স্বপ্নের দিনগুলো ছিল সত্যিই সুন্দর। কিন্তু গতকাল তার ডাক্তার জানিয়েছে সে আর কখনোই মা হতে পারবে না। 


-লিয়া আর একবার ভেবে বল, তুমি কি সত্যিই তোমার স্বামীর মৃত্যু কামনা কর? তুমি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারো।

-না প্রভু, আমি ক্ষমা করতে পারি না। স্ত্রী হিসেবে ক্ষমা করতে পারলেও একজন মা হিসেবে আমি ক্ষমাহীন। বিয়ের পর থেকে দেখছি মানুষটা প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে পানশালায় যায়। আড্ডায় সে এতই অভ্যন্ত যে মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার পথটাও ভুলে যায়। আমাদের বিবাহবার্ষিকী, আত্মীয়-স্বজনের বিয়ে কিংবা অন্য কোন অনুষ্ঠানে আমি নিতান্ত একা ছিলাম। একাকীত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অনেকদিন ধরে নিরবতাই আমার সঙ্গী। এখন স্বামীর আগমন, চলাফেরা, তার কথাবার্তা আমাকে রক্তাক্ত করে। তারপর ডোরবেল... কথাটি বলে মৃদু হেসে ওঠে লিয়া। নিজেকে উপহাস করার এ ভঙ্গিমা তার নতুন নয়।


-যে ডোরবেলের জন্য আমি এতো বছর অপেক্ষা করছি সেই শব্দে এখন বিভীষিকা জাগে। মনে হয় তার আগমনে গৃহের ভেতর একজন পাপাত্মার প্রবেশ ঘটেছে, যে কিনা নিজ হাতে আমার প্রাণপ্রিয় সঙ্গী নীরবতাকে খুন করতে চায়। এই মৃত্যুকে আমি কোনমতেই মেনে নিতে পারি না প্রভু। 


চারপাশে এতো ঘন অন্ধকার যে লিয়াকে দেখা যায় না। তবে কণ্ঠস্বরে বেশ বোঝা যায় তার চোখে, মুখে অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। কোন কথা নেই। অনেকক্ষণ নিরব থেকে পুনরায় নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে চলে, প্রভু আমার এই অশ্রুপাত তাকে হারানো কিংবা অনুশোচনার জন্য নয়। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অনেকটা সময় আমি অপচয় করে ফেলেছি। সে কারণেই এই কান্না।   


এমন সময় একদল কুকুর কাছাকাছি কোথাও ডেকে উঠে। ডাক শুনে লিয়া উত্তেজিত হয়। সে উন্মাদের মতো ছুটতে থাকে বিশাল বারান্দায়। একসময় স্থির হয়। একবার গ্রিলের বাইরে উঁকি মেরে কী যেন দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অনেকক্ষণ ধরে ইলেক্ট্রিসিটিও নেই। কিছু দেখতে না পেয়ে লিয়া মৃদু স্বরে ডাকে, প্রভু। আপনি কি আছেন? অপর প্রান্ত থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সে পুনরায় অস্থির হয়ে উঠে। বিমর্ষ। হতাশার সুর তুলে বলে, প্রভু আপনিও কি সবার মতো প্রিয় বৎসকে পরিত্যাগ করলেন? ঐ যে কুকুরগুলো এগিয়ে আসছে। এখনি ডোরবেল বেজে উঠবে। একজন মাতালের প্রলাপবাক্য থেকে আমাকে রক্ষা করুন প্রভু।


হঠাৎ কোন কারণে লিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রথমে সে বুঝতে ব্যর্থ হয় কোথায় আছে।  কিছু সময় অতিবাহিত হলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে তার অবস্থান। প্রতিদিন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে সোফার ওপর। আধোঘুমের পর তার খুব এলোমেলো লাগে। মাঝে মধ্যে দুঃস্বপ্নও দেখে। তখন সদর দরজার উপর প্রচ- রাগ হয়। মনে হয় খ- খ- করে খুলে ফেলে দরজা।   


প্রতিদিনের এই দাসত্ব থেকে সে মুক্তি চায়। চিরকালীন মুক্তি।


রাত প্রায় দুটো বাজে। সে বোধহয় আধঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। এতোক্ষণে তার মনে পড়ে একটু আগের স্বপ্নের কথা, যেখানে প্রভু তার সাথে কথা বলছিলেন। সেই স্বপ্নের রেশ এখন তার মন জুড়ে বিস্তৃত হয়। শরীরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। এমন সময় অনেকগুলো কুকুর পানশালার কাছাকাছি কোথাও ডেকে উঠে। সম্ভবত এই ডাকের জন্যই তার ঘুম ভেঙেছে। সে জানে আর মাত্র কয়েক  মুহূর্ত। তারপর ডোরবেলের তীক্ষè ধ্বনি কেড়ে নেবে তার শান্তি। জ্বলে উঠবে বাতি। উফ! বাতিগুলোকে তার অসহ্য লাগে। গ্রহে প্রবেশের পর মাতাল মানুষটি সারাদিনের সব কথাবার্তা উগড়ে দিতে চায় কিন্তু ঐ সব অপলাপের চেয়ে তার কাছে ঘুম খুব প্রিয়।   


লিয়া সোফায় উঠে বসে। নিজেকে প্রস্তুত করে দরজা খোলার জন্য।


আজ কুকুরগুলো বিরামহীন ডেকে যাচ্ছে। কী এক অশুভ ইঙ্গিতে তারা বুঝি মধ্যরাতের নীরবতা ছিঁড়ে ফেলতে চায়! সাধারণত ওরা এমনভাবে ডাকে না। অনেক রাতে কোন লোকজন দেখলে এক কি দু’বার ডেকে উঠে। একসময় থেমেও যায়। নতুবা কলোনীর দারোয়ান ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় ওদের। আজ দাড়োয়ানদের কোন খবর নেই। মধ্যরাতের পর ওরাও কোন কোনদিন ঘুমিয়ে যায়। একমাত্র তাকেই জেগে থাকতে হয়। সারাবছর। ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, শীত কোন ঋতুতেই তার ছুটি নেই।


আজ কুকুরগুলো থামছে না। সেই কখন থেকে একটানা করুণ সুরে বিলাপ করে তার কান এবং হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। এতোক্ষণে ডোরবেলও বেজে উঠার কথা। প্রতি রাতে অদৃশ্য বুলেটের মতো যে ডোরবেলের শব্দ তাকে আহত করে সেই ডোরবেল আজ বেজে উঠছে না। কিন্তু কেন? স্বামীর আসার সময় ক্রমেই পার হয়ে যাচ্ছে। সে কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকায়। তার কান উৎকীর্ণ হয়ে আছে। কিন্ত ডোরবেল মধ্যরাতের মত নিশ্চুপ। শুধু দূর থেকে কিছু মুক্ত বাতাস এসে তার কানে কী যেন বলে যায় ফিস ফিস করে! 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট