ছায়া

 

    গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ



ছায়া

শিশির খান


আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। ইট বিছানো রাস্তা ধরে তিন চাকার পায়ে প্যাডেল করা একটি ভ্যান যাত্রী নিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভ্যানের যাত্রীরা বেশ শান্ত শুধু বুদু মিঞার কপালে বেশ চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বেলা যে গড়িয়ে এলো, সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। বুদু মিঞা শহরের ননী মজুমদারের গোডাউনে কাজ করে। প্রতিদিন আরও সকাল সকালই সে বাড়ি ফেরে কিন্তু আজ হঠাৎই দুপুর বেলায় চার ট্রাক মাল আসায় আনলোড করতে তার দেরি হয়ে গেলো। এখনও প্রায় নয় মাইল পথ গেলে ত্রিমোহনীর ঘাট। ঘাটে নেমে নদী পাড় হয়ে আরও পাঁচ মাইল পথ পাঁয়ে হেঁটে তার বাড়িতে যেতে হবে। বুদু মিঞা ভ্যান চালককে তারা দিয়ে বললো : 

“হ্যারে নজু, একটু তাড়াতাড়ি পা চালানা ভাই! এখুনি মাগরিবের আজান পড়বে যে! সন্ধ্যে হয়ে এলো”। 

নজু একটু বিরক্তির স্বরে বললো : 

“পারবো নে, এর চেয়ে জোরে পারবো নে।

এতই যখন তারা ছিল, তখন বিমানে চরে গিলেই পারতি। ভ্যানে উঠিছিস কিজন্যি ? ”

পাশাপাশি গাঁয়ের মানুষরা একে অপরকে চেনে, আর সমবয়সিদের মধ্যে তুই-তুকারি চলে।

নজুর এমন কথা শুনে বুদু মিঞা চুপ করে গেল ঠিকই কিন্তু তার মনের বিচলিত অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটলো না। একটু পরেই মাগরিবের আজান পড়ে গেলো। পশ্চিম আকাশে গোধুলীর রক্তিম সূর্য অস্ত যেতেই সন্ধ্যা নামলো। 

ভ্যানটি তখনও হারিকেনের আলোয় মন্থর গতিতে এগিয়ে  চলেছে। ভ্যানটি যখন ত্রিমোহনীর ঘাটে এসে পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমেছে। বুদু মিয়াকে ঘাটে নামিয়ে ভ্যানটি অন্য দুই যাত্রীকে নিয়ে নদীর পাড় ঘেষে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। জনমানব শূণ্য ঘাটে দাঁড়িয়ে বুদু মিঞা নদী পারাপারের উপায় খুঁজতে লাগলো। সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। গ্রামের নৌকাগুলো তাদের শেষ যাত্রীদের নিয়ে সন্ধ্যা নামতেই ওপারে পাড়ি দিয়েছে। নদীর এপারে অর্থাৎ বুদু মিয়া যেপারে দাঁড়িয়ে আছে সে পারে একটি ডিঙ্গি যদিও বাঁধা আছে কিন্তু তার মাঝি নেই। মাঝিকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষীণ আশায় বুদু মিয়া চারিদিকে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগলো। হঠাৎই তার চোখে পড়লো নদীর পারের ওপরে একটি বুনো ঝোঁপের আড়ালে একজন লোকের মাথা বেড়িয়ে আছে। বুদু মিয়া বুঝতে পারলো, লোকটি সেখানে বসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। টর্চের আলো পড়তেই লোকটি বিরক্তির স্বরে বলে উঠলো : 

“ওই মিঞা টর্চ মারো কেন ? খারাও আসতাছি।”

লোকটি আসলে এই ডিঙ্গিটার মাঝি। সে বুদু মিঞাকে একা নদী পাড় করতে পারবে না, সাফ জানিয়ে দিল। 

“না না বাপু আমি একজন নিয়ে নাও ভাসাতে পারব নে, আমার তাতে পোষাবি নে।”

বুদু মিঞা কণ্ঠে হতাশা নিয়ে বললো, “বুঝেছি তোমার বেশি ভাড়া চাই। তা কতো হলি নৌকা ভাসাবে বলো দিকিনি ? ”

মাঝি বুদু মিয়ার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে একটুও কার্পণ্য করলো না। বললো : 

“বিশ টাকা দিতি হবি, এক পয়সাও কম হলি আমি পারবো নানি।”

“দু’ টাকার ভাড়া বিশ টাকা” বলেই চমকে উঠলো বুদু মিঞা। অসহায় বুদু মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অগত্যা রাজি হয়ে গেল। রাতের শান্ত নদীর অন্ধকার জলের বুক চিরে বৈঠার আঘাত করতে করতে ডিঙিটা বুদু মিঞাকে নিয়ে এগিয়ে চললো নদীর ওপারের দিকে। কিছুক্ষণ পর নৌকাটি বুদু মিঞাকে নদী পাড় করে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেল। বুদু মিঞা নদীর পাড় বেয়ে উঠে ফসলের মাঠের মাঝের কাঁচা রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললো। এই যে চোখের সীমানা পেরিয়ে বিস্তির্ণ ফসলের মাঠ সে হেঁটে চলেছে একে স্থানীয়রা চিতলবেরীর বিল বলে। মস্ত এ চিতলবেরীর বিলের দু’ধার ঘেষে বয়ে গেছে বাড়নই নদী আর তার জন্য দুইপাশে ছোট ছোট তিনটি গ্রাম এর মধ্যে উত্তরের পারবিশা গ্রামে বুদু মিঞার বাড়ি। বুদু মিঞা টর্চের আলো ফেলে দ্রুত বেগে চিতলবেরীর মাঠের কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে চললো । এখনও প্রায় পাঁচ মাইল পথ তাকে হেঁটেই অতিক্রম করতে হবে, এই নির্জন চিতলবেরীর বুক চিরে। 

এখন হেমন্তকাল, আকাশে মেঘ নেই। তার পরিবর্তে চাঁদ ও তারাদের হাট বসেছে। মাঠের চারিদিকে ধান ও গমখেত। জ্যো¯œার আলো চুঁইয়ে পড়ছে। সে আলোতে চিতলবেরীর বিলের প্রান্তর বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শুধু জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো একটু অন্ধকারের আড়াল তৈরী করেছে। মাঝে মাঝে দক্ষিণা হাওয়া এসে শরীর শিরশিরে অনুভূতি জাগাচ্ছে। এ সময় ধান পাকতে শুরু করে। অনেক সময় শক্রর হাত থেকে ধান রক্ষার জন্য কৃষকের দল রাত জেগে ধান পাহারা দেয়। বুদু মিঞার অনুসন্ধিতসু চোখ সেরকম কোন কৃষকের দলকে আশে-পাশে খুঁজতে লাগলো। কিন্ত না, কোথাও কেউ নেই। হয়তো আর কয়েকদিন পর থেকে তারা পাহারায় বসবে। কেমনজানি একটু ভয় করতে লাগলো। বুদু মিঞার থেকে পাহারায় বসবে। এই চিতলবেরী বিলের অনেক গল্পই সে শুনেছে তার গ্রামবাসীর কাছ থেকে। সেসব কথা তার মনে পড়ে যেতে লাগলো। ভয়ে তার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই নির্জন রাতে এই মেঠো পথে যদি কোন অশরীরী তার সঙ্গী হয়। 


এইকথা ভাবতেই তার গলা শুকিয়ে এলো। সে কোনমতে ঢোক গিলে আরও দ্রুতবেগে পা বাড়াতে লাগলো। তিন ব্যাটারীর টর্চের জোরালো আলো তার সামনের পথকে একদম পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই আলোতে পথে পড়ে থাকা সামান্য ঘাসের শুকনো টুকরোটাও নজর এড়াচ্ছে না। তাই পথ চলতে তার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। এভাবে সে প্রায় দুই মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে, সে কথা পথের ধারে বা’দিকে দাঁড়িয়ে থাকা পর পর তিনটি তালগাছ দেখেই সে বুুঝতে পারলো। এই তিনটি তালগাছের সমষ্টিগত স্থানকে লোকে তালপট্টি বলে। ত্রিমোহনী ঘাটের এপাড় থেকে এই তালপট্টির দূরত্ব যে দুই মাইল সেটা তার জানা ছিল। সেই সাথে বহুদিনের পুরোনো আরেকটি কথাও তার মনে পড়ে গেলো। বহুবছর আগে তখন বুদু মিঞা যুবক ছিল, এখন সে মাঝবয়সী। সেসময় বুদু মিঞা তার এক প্রতিবেশী বন্ধুর কাছে এই তালপট্টির এক ভয়ংকর ঘটনা শুনেছিল। বহুদিন পর আজ সে ঘটনাটি মনে পড়তেই ভয়ে তার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতলস্রোত বয়ে গেল। গলা শুকিয়ে এলো পথ চলার ক্লান্তিতে নয় বরং ভয়ে ¯œায়ুবিক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার ফলে। ঘটনাটি শোনা থাকলে আর এই নির্জন রাতে এই নি:সঙ্গ একা এই রহস্যময় তালপট্টিতে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো প্রায় সবারই এই এ অবস্থা হবে। ঘটনাটি হলো এই : 

বুদু মিঞার এক বন্ধু মানিক একবার তার বাড়ির গাছের ল্যাংড়া আম শহরের আঁড়তে বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা হাতে পেলো। টাকা হাতে পেয়ে তার সখ হলো সিনেমা দেখবে। শহরের ছাঁয়াবিথী সিনেমা হলের ইভিনিং-শো যখন ভাংলো তখন রাত নয়টা। ত্রিমোহনীর ঘাটে এসে নৌকা না পেয়ে উদ্দ্যমী সাহসী যুবক মানিক সাঁতরে নদী পাড় করে এপারে পৌঁছে আবার হাঁটতে শুরু করলো চিতলবেরীর সেই মেঠোপথ ধরেই। রাত তখন প্রায় ২টা হাঁটতে হাঁটতে সে যখন এই তালপট্টিতে পৌঁছালো, তখন ক্লান্ত হয়ে মাটির দিকে তাঁকিয়ে অবনতমস্তকে হাঁটছিলো সে। হঠাৎই তার বা’পাশ থেকে কে যেনো তার নাম ধরে ডাক দিল : 

“ওরে মানিক একটু দাঁড়া”।

কণ্ঠস্বরটি মানিকের পরিচিত নয়। অত্যন্ত ভারি মোটা বজ্রের মতো কণ্ঠস্বর। মানিক সে ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলো। কে তাকে ডাকছে, তা দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই যে দশ্য সে দেখলো তাতে তার চোখ এতো বড় হলো যেনো গোলাকার চোখ দুটি কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে। ভয়ে শিহরীত হয়ে তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ভয়ার্ত চিৎকার। আর তৎক্ষনাৎ সে পিছে একধাপ দিতে গিয়েই বসে পড়লো। সে দেখলো দুটি তাল গাছের কান্ডে দুই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রকান্ড এক জি¦ন। তার প্রকান্ড লোমশ দেহটা চাঁদের আবছা আলোতে কালো ঘন ত্রিমাত্রিক ছাঁয়ার মতো দেখাচ্ছে। তার প্রকন্ড দেহের ভারে তাল গাছ দুটি দুদিকে কিছুটা বেঁকে গেছে। 

সে জি¦নটি তার বজ্রকণ্ঠে আবার বলে উঠলো : 

“এ সময় আমার আহার শেষে বিশ্রামের সময়। এতো রাতে তুই কেনো আমাকে বিরক্ত করতে এপথে যাচ্ছিস ? ”

মানিক হাওমাও করে কেঁদে উঠে বললো : 

“মাফ করে দেন, এবারের মতো মাফ করে দেন।”

আমি আর কখনও রাইতে এ রাস্তায় আসবো নে। 

“আল্লাহর দোহায় আমাকে মাফ করে দেন!”

জি¦নটি এবার বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বললো : 

আহ্ যখন উনার দোহায় দিলি তখন যা, এবারের মত তোকে ছেড়ে দিলাম।

কিন্তু আর কখনো............

তার কথা শেষ না হতেই মানিক উঠে দাঁড়িয়ে 

“আর আসপোনে আর আসপোনে”

বলতে বলতে হাত করজোড়ে মিনতি করতে করতে এগিয়ে চলল। তারপর বাঁকিটা পথ দৌঁড়ে পরে কি মরে এই অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিল। পরদিন সকালে এ ঘটনা গ্রামশুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আর মানিকের কাছেই বুদু মিঞা নিজ কানে শুনেছিল। তার স্মৃতিচারণ শেষে হঠাৎই চমকে উঠে সে তালপট্টির চারিদিকে দ্রুত দেখে নিল। না, আজ কোথাও কেউ নেই। বুদু মিঞা দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে তালপট্টিটি পেরিয়ে গেল। কিছুদুর যাবার পর সে মনে মনে বললো “যাক বাবা, খারাপ জাগাতো পার হয়ে আইসি। আর ভয় নাই।” এবার সে শান্ত মনে স্বাভাবিক গতিতে তার পা বাড়াতে লাগলো। কিছুদুর যাওয়ার পর পথটাকে তার বড় চেনা মনে হলো। হ্যাঁ, সে প্রতিদিনই এ পথ ধরেই শহরে যাতায়াত করে। তাই পথটা তার চেনা হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এ চেনা সেই চেনা নয় বরং তার মনে হলো এই একটু আগেই তো সে এ পথ অতিক্রম করে এসেছে। টর্চের আলোতে ভাল করে লক্ষ্য করতে করতে সে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে গেলো। হঠাৎই তার মনে হলো এটা সে কোথায় এসে পৌঁছেছে! এটাতো সেই তালপট্টি! ঐতো ঐ..... যে সেই তালগাছ তিনটি  দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু এবার তারা বুদু মিঞার বামে নয় ডানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তেমনিভাবে যেমনটি গ্রাম থেকে ত্রিমোহনী ঘাটের দিকে যেতে গেলে দেখা যায়। কি আশ্চর্য, সে আবার কেনো ফিরে এলো এখানে ? সেতো কখনো ফিরে দাঁড়ায়নি। সেতো সোজা হেঁটে চলছিল গ্রামের দিকে। তবে সে উল্টো এখানে কিভাবে ঘুরে এসে পৌঁছালো। এবারও সে চারদিকে তাঁকিয়ে দেখলো। না, কোথাও কেউ নেই। আর কিছু না ভেবে সে দ্রুতপায়ে তালপট্টিকে পিছনে ফেলে গ্রামের দিকে পা বাড়ালো কিন্তু একি ? কিছুদূর যাওয়ার পর আবার সে ঐ তাল পট্টিতেই ফিরে এলো। কি আশ্চর্য! সে বার বার কেন সেই তালপট্টিতেই ফিরে আসছে ? 

তবে কি সে এক অলৌকিক অদৃশ্য জ¦ালে আটকা পড়েছে ? এবারও বুদু মিঞা ভয়ার্ত চোখে চারদিকে দেখলো, নাহ্ কোথাও তো কেউ নেই তবে এমন কেন হচ্ছে ? সে আবার জোর কদমে তার গাঁয়ের দিকে এগিয়ে চললো। কিছুদুর যেতেই সে লক্ষ্য করলো তার সামনে একটি ছাঁয়া পড়েছে। সে ভাবলো, হয়তো কোন মানুষ তারই মতো টর্চের আলো ফেলে তার পিছনে হেঁটে আসছে। আর সেই  টর্চের আলোতে তার নিজের ছাঁয়া তার সামনে পড়েছে। বুদু মিঞা আনন্দিত হয়ে তাকে দেখার উদ্দেশ্যে পিছনে ফিরে তাঁকিয়ে দেখলো, না তার পিছনেতো কেউ নেই! হঠাৎ বুকটা ধরাক করে উঠলো, সে এবার সামনে ফিরে আবার তাকিয়ে দেখলো ছাঁয়াটা তার সামনে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। বড় অদ্ভুত ব্যাপার, এই নিশুতি রাতে অন্ধকার পথে তার এমন জোড়ালো ছাঁয়া পড়লো কেমন করে ? টর্চের আলোতে সেই ছাঁয়া আরও তীব্র কালো বর্ণের দেখা যাচ্ছে। আমরা সকলেই জানি যে উজ্জ্বল আলোকরশ্মি কোন বস্তুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছাঁয়ার সৃষ্টি করে কিন্তু বুদু মিঞার পেছনে বা উপরে তো কোন আলো পড়েনি তবে, ছাঁয়া এলো কোথা থেকে ? বুদু মিঞা এবার টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। জ্যোৎ¯œার মৃদু আলোতেও সে দেখলো সেই ছাঁয়াটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে আবার টর্চের আলো জ¦ালালো। ভাল করে লক্ষ্য করলো, একি, যে যাকে তার ছাঁয়া ভাবছিল আসলে সেটি তার নিজের ছাঁয়া নয়! কারণ নিজের ছাঁয়া হলে ছাঁয়ায় পা আর তার পা একত্রে মিলে যেতো। কিন্তু এই ছাঁয়া তার থেকে দূরে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে ভয়ে বুদু মিঞার সমস্ত শরীর বেয়ে ঘর্ম¯্রােত বয়ে গেলো। হেমন্তের দক্ষিণা শীতল প্রবাহিত বায়ু তার এই ঘর্ম¯্রােতকে আটকাতে অক্ষম। সে টর্চের আলো সামনে ফেলে উর্দ্ধশ^াসে ছুটতে লাগলো তার গাঁয়ের দিকে। কিন্তু একি ? সেই ছাঁয়া মুর্তিটাও তার সামনে সামনে তার সাথেই চলতে লাগলো। বুদু মিঞা ভয় পেয়ে আরও জোরে ছুটতে লাগলো। তবুও সে ছাঁয়া মুর্তিটাকে পেছনে ফেলা সম্ভব হলো না। বুদু মিঞা এবার দাঁড়িয়ে পড়লো, ছাঁয়া মূর্তিটাও দাঁড়িয়ে পড়লো। বুদু মিঞার শরীর থর থর করে কাঁপছে, তার শ^াস ফুলতে শুরু করেছে। সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এবার সে লক্ষ্য করলো এতক্ষণ যে ছাঁয়া মূর্তিটা তার দিকে পিঠ করে তার আগে আগে চলছিলো, সেই ছাঁয়া মূর্তি এবার আস্তে আস্তে তার দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়ালো। সেই সঙ্গে সে ছাঁয়াটি আর মাটিতে পড়ে নেই। সে এখন পুরোপুরি একটা পুরুষ অবয়ব নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার চেহারায় প্রবল হিং¯্রতা স্পষ্ট। তার চোখ দুটি আগুনের শিখা প্রজ্জ্বলিত করে জ¦লে উঠলো। ছাঁয়া মূর্তিটি বড় হতে প্রকান্ড আকার ধারণ করলো। এমন ভয়ানক ও রক্তহীন দৃশ্য দেখে বুদু মিঞা “আ.........আ.......” আত্মচিৎকার করে উল্টো দিকে দৌঁড়ে পালাতে লাগলো। কিছুটা দৌঁড়েই সে হোঁচট খেয়ে পড়লো মাটিতে। প্রচন্ড শব্দে ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠলো সে। 


সে চিৎকার ছিল ভয়ংকর আর্তনাদের বহি:প্রকাশ। তার সেই গগনবিদারী আর্তনাদ চিতলবেরির প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়লো। ভেসে ভেসে প্রান্তর শেষে নি:শেষ হয়ে গেলো। 

তারপর ভয়ংকর সে রাতের পরিসমাপ্তি ঘটলো। ভোরের আলো ফুটলো, কৃষকেরা একে একে তাদের জমিতে কাজ করতে মাঠে আসতে শুরু করলো। হঠাৎ কিছু কৃষক লক্ষ্য করলো  তারপট্টির মেঠোপথে একজন লোক উপুর হয়ে পড়ে আছে। কাছে এসে লক্ষ্য করে দেখলো তার ঘাড় ঘুরে পেছন দিকে মুখ করে পড়ে আছে। মুখ হা করা আর চোখ দুটো কোটর থেকে বেড়িয়ে আছে এবং সে মৃত। কৃষকদের সবাই এমন ভয়ানক চেহারার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো। তাদের একজন বলে উঠলো “আরে এরে তো আমি চিনি, ওযে উত্তরের পাড় বিশার বুদু মিঞা”। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট