শাহেন শাহ

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


শাহেন শাহ

নন্দি আরজু রুবি


ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো শাহেন শাহর চোখে

পড়ছে। বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে পাশ ফিরলো। অনেক রাত অবধি ঘুম হয়নি, খিদেয় ছটফট করেছে। কাজ নাই, কাল দুপুর থেকে শুধু পানি খেয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কিন্তু       উঠতে ইচ্ছে করছে না, পিপাসা পেয়েছে খুব  ইস্টিশনের কলটাও নষ্ট,শূন্য বোতল পানি আনতে যেতে হবে দূরে। পেটের ভিতরে ক্ষুধার জ্বালায় চো-চো করছে। 

ঠিক সেই সময় আকালীর ডাক, ‘‘গুরু ওঠো বেলা বেড়েছে, আর কত ঘুমাবে।’’

চোখ কোচলে উঠে বসলো শাহেন শাহ তার আধ ছেঁড়া প্যান্টের দড়ির গিঁটটা আর একটু কষে বেঁধে নিলো। পেটে খাবার নাই ঢিলে হয়ে গেছে। 

আকালী বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল ‘‘কও তো গুরু, কী খবর আছে?”

জানিনে, ‘‘তুই বল।”

ওই যে মাঠের ওপাশের গ্রামে আজ বিয়ের মেজবানি, যাবে? 

শুনেই শাহেন শাহর খিদে বেড়ে উঠলো, দোনোমোনো করে বললো ‘‘হ্যাঁ যাবো, চল যাই দুজনে।”


এটা রাজশাহীর সীমান্তবর্তী ছোট একটা ইস্টিশন ‘‘বীরকুৎসা” ভিড় নাই চারিদিকে খোলা, মাঠের পর মাঠ ধানের আবাদ। কিছুদুর গেলেই দেখা যায় বিশাল পরিত্যক্ত হাজারদুয়ারি বীরকুৎসা রাজবাড়ী। এরপরে আর একটা ইস্টিশন আছে তার পরেই ভারতের সীমান্ত। 

প্রতিদিন একটা ট্রেন যাতায়াত করে। এখানে রুটির দোকানে কাজ করে শাহেন শাহ। দোকানের মালিক আকবর আলি গরীব মানুষ দোকানের যৎসামান্য আয় দিয়ে কোন মতে সংসার চলে।শাহেন শাহ নাম তার দেওয়া। 

আকালী চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খাটে। 

সকালে ট্রেন যাওয়ার সময় যাত্রীরা রুটি সিঙাড়া চা খায় তাতেই কোনমতে এখানকার দোকান চলে। মাত্র তিনটে দোকান দুটো চা আর এটাতে রুটি সিঙাড়া বিক্রি হয়। 

বেশ কিছুদিন ট্রেন বন্ধ তাই দোকানও বন্ধ। খাবারের খুব কষ্ট। 

শাহেন শাহ শূন্য দোকানে রাতে ঘুমায়। দুদিন খাবারের কোন জোগাড় নাই। কদিন আকবর আলি খাবার দিয়েছে, এখন আর পারছে না। 

তার অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নাই, এখানে ছোট্ট  ইস্টিশনে মায়াপড়ে গেছে। নিজের ঘর বাড়ি বাবা-মা কোন ঠিকানা জানা নাই।

সুবোধ শান্ত চেহারা মায়াবী মুখ শাহেন শার, বড় বড় চোখে সারল্য গলায় মাশাল্লাহ দারুণ সুর। আগে ট্রেনে গান গাইতো যাত্রিরা খুশি হয়ে যা দিতো তাতেই চলে যেতো। এই ইস্টিশনে এসে একেবারে থেকে গেছে, ভেসে বেড়াতে আর ইচ্ছে করে না।  আকালীও শাহেন শাহর মতো তারও কেউ নেই। ইস্টিশনে অন্ধ এক ভিক্ষুকের সাথে ভিক্ষে করতো। সে মারা যাওয়ার পরে চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছে। দুজন প্রায় সমবয়সি সবে কৈশরে পা দিয়েছে। 


সাতপাঁচ ভাবার সময় নাই, রংচটা গেঞ্জি তালি দেওয়া প্যান্ট আর খালি পায়ে দুজনে হাঁটা শুরু করলো, আজ খুব গরম, রোদের তেজ চড়চড় করে বেড়ে উঠছে। তাতে আবার দুদিন দুজনের পেটে দানাপানি কিচ্ছু জোটেনি।

চারিদিকে সবুজ চারা ধানে মাঠ ভরে আছে। কোনো গাছ নাই ছায়াহীন খেতের সরু আলপথ ধরে হেঁটে চললো সটকাট। রোদে কাদামাটি থেকে ভাপ উঠছে ভ্যপসা গরম। পেটের খিদে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চললো। মনে আশা গেলে কিছু খাবার জুটবে। 

মাঠ পেরিয়ে ঘামে ক্লান্ত শ্রান্ত দুই কিশোর মেজবান বাড়ির প্রায় কাছে এসে পৌঁছালো। দূর থেকেই ভাত আর মাংসের ঘ্রাণ নাকে ঝাপটা দিলো। পেটের ভিতর রাক্ষুসে ক্ষুধাটা নড়েচড়ে জাকিয়ে বসলো। শাহেন শাহ প্যান্টের দড়ি আর একপ্রস্ টাইট করে নিলো। দুজনের চলার গতি শ্লথ হয়ে গেছিলো। খাবারের ঘ্রাণ তাদের শক্তি এনে দিলো। ক্ষুধার্ত  দুজনের চোখাচোখী হতেই হাসি উপচে পড়ছে খুশিতে। এই খুশি আনন্দ একমুঠ ভাত খেতে পাওয়ার আশা। 

হায়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্দশা মানুষকে কত অসহায় করে দেয় সে শুধু ক্ষুধার্ত কর্মহীন মানুষ জানে।

ক্ষুন্নিবৃত্তির তাড়না মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। ক্ষুদ্র কাজ অন্যায় অনৈতিক কাজ করতে দ্বীধা বোধ করে না। 

বড় প্যান্ডেল ভদ্র সুবেশী লোকজন খাওয়া দাওয়া করছে। হতদরিদ্র দুই কিশোর ধীর পায়ে প্যান্ডেলের গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন খেকিয়ে উঠলো এই যা ভাগ কোথা থেকে সব ভিক্ষিরি এসে জুটেছে। যা ওদিকে... 

দুজন দূরে এসে গাছের নীচে বসে রইলো। দেখছে মানুষ খাচ্ছে তাদের হাক ডাক ভাত আনো মাংস, ডাল, মাছভাজা, দই.. 

ক্ষুধা আর পিপাসায় কাতর হয়ে দুজন প্রতীক্ষায় বসে রইলো। তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকালো না। 

উচ্ছিষ্ট এঁটোকাঁটা একজন ডালায় করে এনে ঢেলে দিয়ে গেলো পথের কুকুর গুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। শুকনো মুখে শাহেন শাহ বললো চল আকালী ফিরে যাই। এখানে খাবার দেবে না কেউ। এতোটা পথ ফিরে যেতে হবে তৃষ্ণায় কাতর আকালী বললো আর একটু দেখিনা অপেক্ষা করে! বেলা প্রায় গড়িয়ে এলো... 

একটা দীর্ঘছায়া পড়লো দুই কিশোরের গায়ে, কেউ এসেছে ওদের পেছনে। খাবারের গন্ধ ছাপিয়ে একটা অন্য মা মা গন্ধ তাদের নাড়িয়ে দিলো। পিছনে তাকিয়ে দেখলো একজন মাঝবয়সি মহিলা, পরনে পুরাতন ছেঁড়া শাড়ি। আঁচলের তলে থালায় ভাত তরকারি। হয়তো এই বাড়িতে কাজ করে। মহিলা ভাতের থালা বের করে দুজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাও বাবা আহা মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।”

এই স্নেহের পরশ টুকু পেয়ে অন্য এক তৃষ্ণা জেগে উঠলো মমতা দরদ এই যে অচেনা তবুও মাতৃত্বের স্নেহময় ভালোবাসা দুজনের চোখে জল চলে এলো। শাহেন শাহ বলল, মা তুমি খাবে না।”

তোমরা দুজনে ভাগ করে খাও। আমি খাবো না বাবা। 

আকালী আর শাহেন শাহ পেট পুরে খেলো। মাগো গেলাম বিদায় নিয়ে দুই কিশোর ক্ষেতের আল দিয়ে ফিরে চললো। অপরিচিত মা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো...

হঠাৎ দূরে ট্রেনের হুইশেলের শব্দ শোনা গেলো, ট্রেন চলাচল আবার শুরু হয়েছে.. 

দুই কিশোর খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, বাতাসে তার উল্লাস খেতের আল পথে দৌড়াচ্ছে দুহাত ছড়িয়ে একরাশ সবুজের ভিতর যেন উড়ছে..।






শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট