অন্ধকারে মিশে আছে পাপের হাবিয়া...

 



অন্ধকারে মিশে আছে পাপের হাবিয়া

অনার্য আমিন


রাত তিনটে বাজে। শ্যামল আজকে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে। স্থির দাঁড়াতে পারছে না। মদ পানের অভ্যাস শ্যামলের নতুন নয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে অনিয়মিত মদ গ্রহনে নিজেকে ন্যাস্ত রেখেছে। সিগারেটের স্বাদ নিয়েছিলো কলেজ জীবনে ক্যাম্পাস আড্ডায়, ওটা এখনো নিয়মিত। আর মদের নেশায় অভ্যাস্ত হয়েছে চাকুরীরত কলীগদের বদৌলতে। তবে আড্ডাবাজ কলীগদের মাঝে শ্যামল আলাদা, বিশেষ করে নেশার ক্ষেত্রে। মদ পানে সবাই মাতলামি করলেও শ্যামল শান্ত ও স্বাভাবিক আচরণ করে। তবে আজকে বেশ মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখের সামনে ধোঁয়াশা উপস্থিত। মস্ত রাস্তাটা এবড়ো থেবড়ো দেখছে। গাঢ় রাতের অপুষ্টিকর আলো ছড়ানো ল্যাম্পপোস্টের ঘুটি ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। নেড়ি কুকুরগুলো ময়লা স্তুপে মুখ ঢুকাচ্ছে। কতৃত্ব দখলে ঘেউ ঘেউ চিৎকারে এক দল আরেকদলকে তাড়া দিলো।  নড়বড়ে মেরুদন্ডতে শক্তি জুগিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো শ্যামল। নিয়ন্ত্রণহীন পা দুটো কিছু দূর যেতেই থেমে গেল। ঘোর লাগা চোখদুটো স্থির হলো মুহূর্তেই। হাত দিয়ে চোখদুটো কচলে আবারো দৃষ্টিপানে স্থির করলো। শ্যাম বর্ণের একটা মেয়ে সীমানা প্রাচির ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স উনিশ কুড়ি হবে। সময়ের যৌবন জোয়ারে পূর্ণতা তার মানব নদীতে। বয়স্ক রাতের আলো আধাঁরীতে দৃষ্টির বিরতি দিয়ে শ্যামল আবার তাকালে। এ তো নার্গিস! নার্গিসের একমাত্র আশ্রয় ভিক্ষুক মা কিছুদিন আগে মারা গেছে। রাস্তার ওপারে পাহাড়ের গায়ে তার কবর। শ্যামল আগে থেকেই মেয়েটিকে চেনে। কালো রঙের হলেও গঠন অববয়ে যে কারো দৃষ্টি কাড়ে নার্গিস। শ্যামল ভাবনার খেয়ালে মেয়েটিকে পছন্দ করলেও অবস্থানের ভিন্নতায় কাছে আসে না। দূর থেকে দেখে কামনা জাগে শ্যামলের। ছোট্ট খুপরি ঘরটা ভেঙে গেছে। আসবাব-জিনিস বলতে কিছুই নেই ঘরে। ছন্নছাড়া নার্গিস মা মরার পর কই যেন চলে গেছিলো। শ্যামল ওকে মিস করতো ভালোবেসে নয়, কামনায়। নেশায় ছেয়ে যাওয়া দেহটা হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠে। নার্গিসের সামনে এসে দাঁড়ায় শ্যামল। পুরনো ছেড়া কামিজের ভেতর থেকে নার্গিসের যৌবন উঁকি দেয় শ্যামলের চোখে। শ্যামল হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। নেশা আর বাসনার বিষ ফলায় বিদ্ধ শ্যামল নার্গিসকে ঝাপটে ধরে। নার্গিস শ্যামলকে চিনতে পেরেছে কিনা কে জানে, কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া করলো না। নিরব চতুর্দিক। সুনশান ঘুমন্ত পরিবেশ। জনমানবহীন রাস্তা। পাহাড় থেকে ভেসে আসা দু একটা অপরিচিত পাখির ছোট ডাক ছাড়া কোন শব্দ নেই কোথাও। ছোট বড় দালানগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে যে যার মতো। রাস্তার মাথায় একটা দালান এখনো জেগে আছে আপদমস্তক আলোকসজ্জা নিয়ে। হয়তো বিয়ে বাড়ি হবে, কে জানে!  শ্যামল নার্গিসকে পাশের  স্কুল মাঠে নিয়ে যায়। মাঠের কোনে কিছু পরিত্যক্ত চেয়ার টেবিল পড়ে আছে। শ্যামল নার্গিসকে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। পাশের দালান থেকে ঘুলঘুলির মতো একটা আলো এসে নার্গিসের মুখে পড়লো। ক্ষুধার্ত মলিন মুখটা দেখে শ্যামল মায়ার বিপরীতে কামনায় জ্বলে উঠলো। একটু পরেই ঘুলঘুলিটা নিভে গেল। আঁধারে নেশাগ্রস্থ শ্যামল এখন ক্ষুধার্ত, হিংস্র বাঘ। নরম জমিন থেকে পান করে গোবলেটে যৌবনের মদিরা। শ্যামল হারাতে থাকে নার্গিসের অন্তঃপুরে, গভীরে। ওর পুরো দেহ প্রকম্পিত, শিরা উপশিরা, কোষে কোষান্তরে ছড়িয়ে গেছে অনাস্বাদিত আনন্দ। ধীরে ধীরে শ্যামলের নেশা কাটতে থাকে। আর যতক্ষণে নেশা কেটে যায় তখন ওর শরীরটা ক্লান্ত হয়ে আসে। ক্লান্ত দেহটায় বিবেক জেগে ওঠে। মাথা ঝিম ধরে যায় নিজের অবস্থান ও কর্ম দেখে। শ্যামল উঠে দাঁড়ায়। চারদিকে কালো কালো অন্ধকার ঝিম মেরে আছে। শ্যামল নার্গিসের দিকে ঝুকেছে আসে। কেঁপে কেঁপে ওঠা দেহটা নির্বাক লেপ্টে আছে বেঞ্চে। চোখদুটো বন্ধ। মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় শ্যামল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না! অন্ধকারে মিশে আছে পাপের হাবিয়া। কালো সে পাপ ছোপ ছোপ দাগ এটে দেয় শ্যমলের যৌবনে, সভ্যতার মগজে।

নার্গিস এখনো শুয়ে আছে নিথর হয়ে। কোন তাড়া নেই, উৎকন্ঠা নেই। এটাই বুঝি নার্গিসদের জাগতিক জীবনের পাথেয়। 

শ্যামল পকেট থেকে টাকা বের করে নার্গিসকে ধাক্কা দেয়। নার্গিস উঠে বসে। শ্যামল ওর হাতে টাকাগুলো গুজে দিয়ে দ্রুত হেঁটে যায়। স্কুলের খোলা গেটে এসে পিছনে ফিরে তাকায়। আবছা অন্ধকারে দেখে নার্গিস এখনো বসে আছে। শ্যামল নার্গিস থেকে দৃষ্টি এনে নিজের দিকে তাকায়। যাপিত জীবনের অর্জিত শিক্ষা নেশার ঘোরে, রাতের আধাঁরে অজ্ঞতার সনদ দিলো। পাহাড়ী বুনো হুতুমের ডাকে সামনে পা বাড়ায় শ্যামল। নার্গিস তখনো বসে আছে বেঞ্চে।


ঘাসের ডগায় ভর করে সকাল আসে, নেতিয়ে পড়া দুপুরটা সন্ধ্যায় মিশে যায় রাতের আহ্বানে। রাতের আদিম চেহারায় উৎকন্ঠা জেগে সকালে রূপ নেয়। এভাবে কেটে যায় দিন, রাত। চার দিন পর। শ্যামলের স্বপ্নের পর্দায় হাজির হয় নার্গিস। প্রতিটি মুহূর্ত নিজের কৃতকর্মের চিন্তা ও নেশা না করার পাথর শপথে বেশামাল উদ্বেগ শ্যামল। নিজের প্রতি নিজের ঘৃনা বেড়ে যায়। বর্ণহীন হাজারো জিজ্ঞাসায় নিজের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসে হঠাৎ হঠাৎ। পাপের নদীতে ডুব দেয়া দেহটা পাপমোচনে যারপরনাই হতাশ। ভাবনায় ঘুম যাওয়া শ্যামল স্বপ্নে নার্গিসকে দেখে ভয়ে আৎকে ওঠে। অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর থেকে নার্গিস শ্যামলের দিকে আসছে। নার্গিসের সামনে সামনে দৌড়ে আসছে ছোট্ট একটা বাচ্চা। কী মিষ্টি বাচ্চা! বাবা, বাবা, ডাকে শ্যামলের কাছে আসতেই বাচ্চাটা বিভীষিকাময় এক আগুন কুন্ডে শ্যামলকে ঝাপটে ধরে। লেলিহান তাপে শ্যামলের বুকটা অঙ্গার হয়ে যায়। নিজের দৃষ্টে নিজেই ভস্ব হচ্ছে।  হন্তদন্ত হয়ে শ্যামলের ঘুম ভাঙে। ঘামের স্নানে ভিজে আছে পুরো শরীর!  ভয়ের আঁধারে আলো খুঁজে পায় না শ্যামল। মগজে হাতুড়ি পেটানো আঘাত। অন্ধকার ঘরে এই বুজি পুড়ে যায় শ্যামল। পাপের হাবিয়া তাকে ঘিরে ধরেছে। স্বপ্নের সেই আগুন শ্যামলের পাপের ফসল। ভাবতেই অশান্ত হয়ে ওঠে শ্যামল। বিছানা, ঘর ছেড়ে বাইরে আসে শ্যামল। ভুতুড়ে অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো পরিবেশ। শ্যামল দ্রুতগতিতে হাঁটতে লাগলো রাস্তা মাড়িয়ে। নার্গিসকে খুজঁতে লাগলো। ওর কাছে ক্ষমা চাইবে শ্যামল, আর ক্ষমা না করলে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিশেবে নার্গিসকে ঘরে নিয়ে আসবে। স্কুল গেটে আজও নার্গিসকে পাওয়া গেলো তবে সেদিনের সেই অবস্থায় নয়। প্রকাশ্যে দেয়ালের গায়ে ভর করে জড়িয়ে রেখেছে অন্য পুরুষকে! আজ নার্গিস বেশ পরিনত। খুব কৌশলেই জীবনের লাগাম টেনে চলছে। এগুলো কি সেদিনের পর থেকে না আগেও ছিলো ভাবনায় আসছে না শ্যামলের। যে অপরাধের দায় নিয়ে এত রাতে শ্যামল নার্গিসকে খুঁজতে এসেছে সে অপরাধের জন্য এতটুকুও পেরেশানি নেই নার্গিসের। নার্গিস আঁধারকে ভালোবাসলেও শ্যামলের কাছে তা পাপ, কালো পাপ। এ পাপ থেকে নার্গিসকে সরানো সম্ভব নয়। দূরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো শ্যামল। কি করবে ভাবছে। ভাবনার মাঝেই নার্গিস রিক্সা চেপে অন্যত্র চলে গেল। না বলা কথা আর হতাশা নিয়ে বাসায় চলে এলো শ্যামল।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট