ঝড়

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


ঝড়

মুহাম্মদ বরকত আলী


মোরগ ডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে মিতু। বাড়িতে অনেকগুলো মুরগির মধ্যে বেশ মোটা তাজা একটা লাল মোরগ আছে। প্রতিদিন ভোরে কুকরুকুউউ করে ডেকে ওঠে। সেই ডাকে জেগে ওঠে খুশিদা খাতুন। গোয়ালঘর পরিষ্কার করে। গরুকে খেতে দেয়। এরই মধ্যে ঘুম ভাঙ্গে হাসেমর। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে। পান্তা ভাত খায়। দুটো মরিচ, পেয়াজ আর একটু লবন দিয়ে গবাগব পান্তা ভাত খেয়ে লাঙ্গল জোঁয়াল কাঁধে ফেলে গরু দুটো তাড়িয়ে ছোটে মাঠের দিকে। এই হল নিত্যদিনের রুটিন। মিতু ওঠে সকালে। কিন্তু আজ সে ভোরেই উঠেছে। মনে হয় রাতে ঘুম হয়নি। খুশিদা খাতুন চুলার কাছে ভিড়েছে। হাত শেমায় রান্না করা হয়েছে। মা মেয়ে এই কদিন ধরে হাতে দিয়েই তৈরি করেছে সেমাই। ময়দা ভিজিয়ে হাড়ি বা ঘটি উপুড় করে এক ধরনের বিশেষ কায়দায় হাতের সাহায্যে এই সেমাই তৈরি করা হয়। এরপর দু একদিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। গায়ের সকলেই এই সেমাই তৈরি করেছে। পহেলা বৈশাখে এই সেমাই তৈরি করার একটা রেওয়াজ আছে। 

আজ পহেলা বৈশাখ। তাই বাড়িতে এত আয়োজন। শুধু মিতুদের বাড়িতেই না, সারা গায়ে, সারা শহরে, সারা দেশেই কত্ত আয়োজন। 

মিতু ঢাকঢোল মার্কা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরেছে। একটা ছোট কলসি নিয়েছে কাখে। কলসিতে আলপনা এঁকেছে মিতু নিজেই। হাতে পায়ে আলতা দিয়েছে। কিছুক্ষণপর বের হবে মঙ্গল সোভাযাত্রা। গ্রামের স্কুল থেকে একটা র‌্যালি বের হবে। শহরের বড় র‌্যালির সাথে একত্রিত হবে। 

সকালের সূর্য উঠেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে সেই আলো এসে পড়ছে মিতুদের উঠোনে। হাসেম উঠানে বসে বাঁশ কাটছে। দঁড়ি পাকাচ্ছে। ঘরটা একটু মেরামত করতে হবে। আজ মাঠে যাবে না। আজকের দিনটার জন্য কাজ আপাতত বন্ধ। আগে ঘর এরপর মাঠ। খুশিদা খাতুন রান্না ঘর থেকে হাক ছাড়ে, ‘মিতু, মা মিতু, একটু সেমাই মুুখে দিয়ে এরপর যাস মা।’

মিতু সাজগোজ করে বাইরে আসে। রান্না ঘরে যায়। মায়ের কাছে গিয়ে বসে। আবদার করে, ‘ওমা, চুলটা একটু বেধে দাও না। দেরি হয়ে যাচ্ছেতো’

খুশিদা চুলোয় লাকড়ি ঠেলে দিয়ে বলে, ‘ইমা, আমার মেয়েকে কত্ত সুন্দর লাগছে গো।’ মেয়ের সাজ দেখে খুশিদার ভালো লাগে। আনন্দ হয়। 

মেয়েকে কাছে বসিয়ে চুল বেধে দেয়। শাড়ির কুচি ঠিক করে দেয়। এরপর গরম সেমাই কিছুটা মুখে দিয়ে বের হয় মিতু।

খুশিদা তাকিয়ে থাকে মেয়ের চলে যাওয়ার পথে। একমাত্র মেয়ে। ছোট সংসার। খুশিদার মনেপড়ে যায় এই শাড়ির জন্য গতবছর মেয়েটা কতই না কান্নাকাটি করল। কিনে দিতে পারেনি। গত বৈশাখে মেয়ের আবদার ছিল একটা মাত্র বৈশাখী শাড়ি চায়। ঢাকঢোল ছাপানো শাড়ি। কিনে দেওয়ার সামর্থ্য হয়নি সেবার। সারাদিন কিচ্ছুটি মুখে করেনি। খুশিদা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেছিল, ‘পরের বার কিনে দেবো। কথা দিচ্ছি। তোর বাপ না দিলেও আমি কিনে দেবো।’ 

খুশিদা কথা রেখেছে। মুরগির ডিম বিক্রি করে টাকা জমিয়েছে। কথা সে রেখেছে। এসব কথা মনে হতেই চোখের কোনে এক ফোটা জল এসে হাজির হয়। আচঁল দিয়ে চোখ মুছে।

মিতুর বাড়ি ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। বাড়ি এসে মাকে গল্প শোনায়। মঙ্গল সোভাযাত্রার গল্প। কত্ত মানুষ লাইল ধরে রাস্তায় বের হয়েছে। নানা রকম পোশাক পরা। কেউ কৃষক সেজে হাতে হুকা নিয়ে বের হয়েছে। আবার কেউ নতুন বর বৌ সেঁজেছে। কত্ত রকমের সাজ। ঢাকঢোল বাজিয়ে গায়ছে বৈশাখী গান। শহরের বড় বড় কর্তরা পান্তা ভাতের আয়োজন করেছে। পান্তাভাত, পেয়াজ, মরিচ, আলু ভর্তা যে যার মত নিয়ে খাচ্ছে। মিতু তার স্কুলের সহপাঠিদের সাথে পান্তা খেয়ে এসেছে। 

বিকেলের শেষ ভাগ। হাসেম সারাটাদিন বাড়িঘর মেরামত করেছে। নতুন বাঁশ দিয়ে শক্ত করে বেঁধেছে চালা। তার দিয়ে টানা দেওয়া হয়েছে চালা। 

খুশিদা খাতুন বলল, ‘কি গো, মুদির দোকানে হালখাতা করতে যাবা না? সন্ধ্যে যে হয়ে এল।’

হাসেম কাজ গোছাতে গোছাতে বলে, ‘না গিয়ে উপায় আছে। যেতেত হবেই। এজন্যইত ঘরের খড়টা বদলাতে পারলাম না। দেখি ভালোই ভালোই কয়েক মাস গেলে তো হয়।’ 

মাঝ রাত। আকাশে গুড়–ম গুড়–ম মেঘের আওয়াজ। হাসেম ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তার মনে আগেই সন্দেহ হয়েছিল এমন কিছু একটা হবে। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা তার। পূর্বে এমন পরিস্থিতির মধ্যে অনেকবার পড়তে হয়েছে তাকে। কিছুই করার নেই। গরিব মানুুষের খেটে খেয়ে দিন চলে। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারে না। চাওয়া যায় না। গতবছর পহেলা বৈশাখের রাতে প্রচুর ঝড় হয়েছিল। হাসেমের ঘরের একদিকে চালা উড়ে গিয়ে পড়েছিল মাঠে। সেজন্যই আজ তার এত সতর্কতা। এবার যেন একই ঘটনা না ঘটে। প্রস্তুতি হিসেবে আজ সে সকাল থেকেই ঘরের মেরামত করেছে। নিজে যতটুকু পেরেছে করেছে। গুড়–ম করে মেঘ ডেকে উঠল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।  

খুশিদা ঘুমাচ্ছে। মিতু ঘুমে বেভর। শহরে গিয়ে অনেকটা পথ হাটাহাটি করেছে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম হয় বেশি। 

হাসেম ঘর থেকে নেমে আসে উঠানে। আকাশ অন্ধকার। মেঘের গর্জন। গোয়াল ঘরের দিকে গিয়ে দেখে গরু দুটো জাবর কাটছে। পশুরা কি বুঝতে পারে প্রকৃতির কথা? ওরা ঘুমায়নি। নাকি ওরা ঘুমায় না। 

হঠাৎ বাতাস শুরু হল। হাসেম ঘরে উঠল। বাতাসের বেগ বাড়ছে। খুশিদাকে না ডেকে পারল না হাসেম। এরি মধ্যে শুরু হল তান্ডব। শনশন বাতাস শুরু হল। অল্প সময়ের মধ্যে গতি বাড়িয়ে ঝড় শুরু হল। এক ঝাপটায় বাইরের যতধুলা ঘরের ভিতরে ঢুকে সব অন্ধকার করে দিলো। কিছুক্ষণপর বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির মধ্যে ধুলা ওড়া বন্ধ হয়েছে। মেঘের প্রচুর গর্জন। কাল বৈশাখী ঝড়। ঝড় বৃষ্টি পাল্লা দিয়ে শুরু চলছে। বাইরে মড় মড় শব্দে গাছ ভাঙ্গার শব্দ ভেসে আসছে বাতাসে। হাসেম আর খুশিদা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝ ঝাপটা আসছে। সেই ঝড়ের ঝাপটায় চালা উঠে পড়ছে। এবার মনে হয় ঘরের চালা উড়ে যায় যায়। ভরসা পায় না। খুশিদা আর দায়িড়ে থাকতে পারে না। ঘরের চালা ধরে ঝুল খায়। গরু দুইটা হামবা হামবা ডাক ছাড়ে। বাতাসে সেই ডাক ভেসে আসে হাসেমের কানে। হাসেম চিন্তা করে গরু দুইটার জন্য। অবলা পশু। দুটো রুটি রোজগার হয় ওদের থেকে। ঝড় থামে না। কালবৈশাখী তার নিজের গতিতে চলতে থাকে। হাসেম পশ্চিম দিকে মুখ করে। দুই কানের কাছে হাত নিয়ে যায়। শুরু করে আজান। আজান দিলে ঝড় থেমে যায়। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শিখেছে সে। মিতু ঘুম থেকে জেগে ওঠে। বাবা আজান দিচ্ছেন। মা ঘরের চালা ধরে ঝুলে আছে। বাইরে ঝড় বৃষ্টি। মিতু কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা বলেন, ‘মিতু মা, ঘরের মাচানের তলে গিয়ে বসে থাক। ভয় নেই কো আমি আছি। যা মা যা।’

মিতু মায়ের কথা শোনে। মাচানের নিচে বসে থাকে গুটিশুটি মেরে। ঝড় থামার অপেক্ষায় থাকে মিতু।


অন্যদিনের মত আজও ভোরে মোরগ ডাকে। খুশিদা ঘুম থেকে ওঠে, গোয়ালঘরে যায়, পরিষ্কার করে। গরু দুটোকে খেতে দেয়। হাসেম বাসি পান্তা খায়। খাবার খেয়ে লাঙ্গল জোয়াল কাধে ফেলে গরু দুটোকে তাড়িয়ে মাঠের দিকে ছোটে। মিতু ঘুমিয়ে থাকে। বৈশাখের নতুন শাড়ির স্বপ্ন দেখে। সকালের সূর্য ওঠে। নতুন সূর্য। এভাবেই চলে বছরের পর বছর।  



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট