গঙ্গাজলে পূণ্য স্নান

 


গঙ্গাজলে পূণ্য স্নান

এম ইব্রাহীম মিজি


পীর সাহেব তার সাগরেদ রমজানকে ডেকে বলে- আমার জায়নামাজ এবং বিছানা-পত্র গুছিয়ে নাও। কাপড় গোছ করতে করতে রমজান পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, পীর সাহেব কোথাও যাবেন না-কি? তখন তাকে একটা ধমক দিয়ে বলে। চুপ কর বেয়াকুফ। আমার সাথে এতো বছর হলো রয়েছিস এখনো আমার মতিগতি ধরতে পারিসনি। আমি হলাম ইসলামের ধারক-বাহক, দ্বীনের খেদমতে আমাকে পৃথিবীর কত প্রান্তে যেতে হয়। তারপর এই বলে পীর সাহেব কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকেন। মনে মনে হাতের কড় গুনলেন। তারপর বলেন, গুনে গুনে আঠারোটা ডিলে কুলুপ নাও। ঐখানে তিন দিন অবস্থান করবেন। তাই প্রতিদিন তিনবার করে এক নম্বর (এক নম্বর বলতে প্রস্রাব করা) করবে। আর প্রতিদিন একবার করে দুই নম্বর (অথাৎ টয়লেট) করতে লাগবে তিনটি ডিলে কুলুপ। তাহলে তিনদিনে তিনটি করে মোট নয়টা ডিলে কুলুপ লাগবে দুই নম্বর করতে আর প্রতিদিন তিনবার করে এক নম্বর করতে তিনদিনে লাগবে মোট নয়টা ডিলে কুলুপ। এক নম্বর এবং দুই নম্বর হলো সাংকেতিক ভাষা। 

পীর সাহেব একটা চেয়ারের উপর বসে আছেন। বসে বসে তার কাজগুলো হলফ করছেন। রমজান বিছানা-পত্র গুছিয়ে নিয়ে চটকরে ঘরের বাহির হয়ে যায়। ঘরের অদূরে ছিল একখন্ড জমি। কয়েক দিন হলো জমিতে হাল চাষ দিয়েছে। এখন শীতকাল তাই শুকনো মাটির কোন অভাব নেই। সেখান থেকে কয়েকটি বড় বড় মাটির টুকরো নিয়ে আসে। তারপর মাটির টুকরোগুলোকে একটা দা নিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে নেয়। যখনি একটা নেকড়ার মধ্যে বেঁধে দিবে। ঠিক তখনি পীর সাহেব রমজানকে নির্দেশ করলেন। ডিলে কুলুপগুলো এদিকে নিয়ে এসো আর একটা একটা করে আমার হাতে দাও। রমজান একটা একটা করে পীর সাহেব হাতে দেয় আর পীর সাহেব প্রতিটি ডিলে কুলুপের গায়ে তিনটি টোকা মারে তারপর চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে কি সব দোয়া কালাম পড়ে ফুঁ দেয়। এভাবে আঠারোটায় ফুঁ দেওয়ার পরে রমজান যখন আরেকটা ডিলে কুলুপ দেয় তখন পীর সাহেব বলে আঠারোটা হইছে ত। আরেকটা কেন? তখন রমজান বলে আমার জন্য। 

পীর সাহেব মুখটাকে একটু বিকৃত করলো। তারপর বলল,

পীর আমি, না তুমি?

আর কখনো পীর সাহেব হতে চেষ্টা করো না। কারণ এটার অনেক ওজন। সইতে পারবে না। রমজান একেবারে কোনঠাসা হয়ে যায়। কি বলবে সে কোন কথা খুঁজে পায় না। রমজান ছিলো পথ শিশু। একটু সহজ-সরল ধরণের। গ্রামের মধ্যে হকারের ব্যবসা করতো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কাছে বিভিন্ন খাবার বিক্রি করতো। তার বিনিময়ে ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত বোতল বিভিন্ন ভাঙ্গাচোরা জিনিস নিতো। একদিন পীর সাহেবের সাথে তার দেখা হয়। তাকে দেখে পীর সাহেব হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। হাত উঁচু করে পীর সাহেব তাকে ডাকলেন। 

এই...ছেলে। এদিকে আসো।

ছেলেটি তার কাছে এলো। কাঁধে ঝুলানো হকারি জিনিসগুলো নামিয়ে রেখে তার সামনে খুব বিনয়ী হয়ে দাঁড়াল- তারপর হুজুর জিজ্ঞাস করলো। 

তোমার নাম কী?

আমার নাম রাকেশ মিয়া।

তুমি কি হিন্দুর বাচ্চা? রাগতঃস্বরে পীর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। 

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি প্রতিবাদ করলো। না, না, আমি মুসলমান। আমার বাবার নাম সুমন বেপারি আর মায়ের নাম জোলেখা বেগম । 

তাহলে তোমার নাম কেন রাকেশ মিয়া রাখলেন। রাকেশ হল হিন্দুধর্মের ছেলেদের নাম। এটা কোন মুসলমানদের নাম হতে পারে না। 

তাহলে হুজুর  কি নাম রাখবো। 

কেন, কত নামই ত আছে। রমজান, আশ্রাফ, শরিফ আরো কত কি।

তখন ছেলেটা বলে, তাহলে হুজুর আপনি আমার একটা নাম রেখে দেন। 

আজ থেকে তোমার নাম রমজান রাখলাম। বারো চান্দের মধ্যে সবচে ফজিলতের মাস রমজান, তাই আজ থেকে তোমার নাম রমজান বলে সবাই ডাকবে। বাড়িতে গিয়ে তোমার বাবা-মাকে বলবে। তারা যেন আজ থেকে তোমাকে রমজান নামে ডাকে। 

তখন ছেলেটা বলে হুজুর আমার কেউ নেই এ জগতে। এ জগতে আমার বলতে শুধু আমি। মাকে হারিয়েছি সেই জন্মলগ্নে। ছিল বাবা, সে-ও চলে গেছে আমাকে রেখে। আজ পর্যন্ত তার আর কোন খোঁজ -খবর পাইনি। আমিও কখনো খোঁজার চেষ্টা করি নাই। 

ত, তোমাকে লালন-পালন করেছে কে? 

আমার নানি। নানির কাছে বড় হয়েছি। নানি অনেক কষ্টে অনেকের কথাঘাত সহ্য করে আমাকে বার বছর পর্যন্ত লালন-পালন করেন। তারপর একদিন নানিও মারা যায়। আর কি থাকা যায়। ব্যস নেমে পড়লাম এ ব্যবসায়। 

তাহলে ত ভালোই হল। মনে মনে পীর সাহেব বলে আমার ষোলকলা পূর্ণ হল। আমি ত এমন একটি ছেলে খোঁজ করছিলাম এতদিন। 

হঠাৎ পীর সাহেব উঁচু গলায় বলে উঠলো। 

আলহামদুলিল্লাহ...তোমাকে তো আমি খোয়াবে দেখেছিলাম গত রাতে! তোমার সাথে দেখা হবে। কথা হবে। তুমি আমার কাছে বায়াত গ্রহণ করছ। আমার মুরিদ হয়েছ। ছেলেটা হা করে শুধু পীর সাহেবের দিকে চেয়ে রয়। সে কিছুই বুঝতে পারে না। কি বায়াত, কি মুরিদ। 

পরে ছেলেটা বলে, হুজুর আপনি এগুলো কি বলেন। আমি কিছুই বুঝি না।

তোমার কিছুই বুঝতে হবে না। তুমি শুধু আমার সাথে চলো। ছেলেটা রাজি হয় না। পরে তাকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখায়। আমার অনেক জ্বিন মুরিদ আছে তারা তোমার ক্ষতি করবে। এরপূর্বে অনেকের, অনেক ক্ষতি হয়েছিল। যারাই আমার কথা অমান্য করেছিল। আমার সাথে বেয়াদবি করাকে তারা মেনে নিতে পারে না। তখন ছেলেটা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। এখন যা জিজ্ঞেস করে সে হ্যাঁ বলে না, আবার না-ও বলে না। একটু একটু নিম রাজি জ্বিনের ভয়ে। সেই থেকে রমজান পীর সাহেবের সাথে আছে। 

পথে আসতে আসতে তাকে সব শিখে দেয়া হয়। আমাকে শুধু হুজুর ডাকবে না। পীর সাব হুজুর বলে ডাকবে। আর আমার গুণকীর্তন করবে। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করে, 

রমজান, ও রমজান। তার কোন সাড়া নাই। 

তখন পীর সাহেব ফিরে দাঁড়ায়। এ..ছেলে তোমাকে ডাকতেছি না?

তখন সে বলে, কইন, পীর সাহেব হুজুর।

কেন। আজ থেকে না তোমার নাম রাখা হলো রমজান । 

ও..হ্যাঁ। আমি ভুলে গেছিলাম, তো ক্যান ডাকছেন? ছেলেটা জিজ্ঞেস করে। 

তুমি কি আরবি পড়তে পার?

না।

নাউজুবিল্লাহ! পীর সাহেব বলে উঠে। তার পরের দিন হতে তাকে আরবি পড়াতে থাকে ।

বল “আলিফ”

বা’...(এক আলিফ টানিয়া পড়িবে) 

পির সাহেব, এইভাবে রমজানকে শরিয়তের ছবক নিয়মিত দিতে লাগল...


গ্রামে পৌঁছার আগেই সূূর্যটা নেমে যায় নদীর ঐ পাড়ে। যেন কূূল ছুঁই ছুঁই। সারা দিনের ক্লান্ত সূূর্যটা কেমন  লালচে হয়ে গেছে। এখুনি আঁঁধার নামবে গ্রামের বুকে। চারিদিকে  আজান পড়ছে। পিছন হইতে রমজান হাঁক ছাড়ে- পীর সাহেব নামাজের উক্ত চলে যাচ্ছে। নদীর পাড়ে নামাজ পড়ে নিই। তখন পীর সাহেব জিজ্ঞেস করে এ নদীর নাম কি?

পিছন হইতে রমজান বলে এ নদীর নাম হল ‘গঙ্গা’। এ নদীর জলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পাক-পবিত্র হওয়ার জন্য গঙ্গা স্নান করে। তাৎক্ষণিক পীর সাহেব হাঁটু সমান পানি থেকে এক লাফে কূলে উঠতে উঠতে বলে তওবা! তওবা!। যেমন শীতকালে ঠান্ডা পানি ছুঁইলে শরীর আঁতকে উঠে। ঠিক তেমনি। তাহলে ত এখানে অজু করা যাবে না। এটা নাপাক পানি। যেখানে বিধর্মীরা স্নান করে। তখন রমজান বলে তাহলে কি নামাজ পরে পড়বেন। 

হু...। গ্রামে পৌঁছে তারপর নামাজ পড়ব।

তাহলে ত কাযা হয়ে যাবে? রমজান বলে। 

হোক। এক-দুই ওয়াক্ত নামাজ কাযা হলে কিছু হবে না। পীর সাহেব বললেন। 


গ্রামে পৌঁছে সে তার কামরাতে অবস্থান করে। সেখানে সে তিন দিন, তিন রাত থাকবে। কিন্তু পরে এখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। এটা ছিলো এক সময় একজন হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি। হিন্দু ব্যক্তিটি ছিলো এ অঞ্চলের প্রধান। এ বাড়িতে হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা -অর্চনা অনুষ্ঠিত হতো। একদিন বাড়ির পীর সাহেবের চোখে পড়ে। তার খুব পছন্দ হয়। বাড়িটি প্রায় নয়/দশ একর জমির উপর অবস্থিত। এছাড়াও বাড়ির আশেপাশে আরো কয়েক একর জমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একদিন যখন আসর বসে। আসর শেষ করে তারপর পীর সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বলে। আজকে আপনাদেরকে বহু বছরের একটা পুরনো কথা বলবো। আজ হইতে বহু বছর আগে আমার দাদাজান পীর সাহেব হুজুর যখন এখানে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসছিলো তখন এ বাড়ির হিন্দু প্রধান উনাকে বেদমভাবে মেরে তাড়িয়ে দেয়। তখন এ অঞ্চলে নওমুসলিমদের সংখ্যাধিক্য ছিল। এখান থেকে যাওয়ার পরে উনি আর বেশি দিন টিকে নাই। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কথাটা বলতে গিয়ে পীর সাহেব হাউমাউ করে কান্না জুড়িয়ে দেয়, উপস্থিত মুরিদগণ তার কান্না সহ্য করতে পারে না। সবার মাঝখান হতে একজন হঠাৎ স্লোগান দিয়ে উঠে। ‘না’রে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’ দাদা হুজুরের অপমান সইবো না, সইবো না। স্লোগান দিয়ে সবাই লাঠিসোটা নিয়ে হিন্দু প্রধানের বাড়িতে হামলা করে। 

হামলায় আহত হয়ে হিন্দু প্রধান তার পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে চলে যায়। এদিকে পীর সাহেব তার মুরিদদেরকে নিয়ে বাড়িটির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে যায়। সে আজ আনন্দে বিমোহিত। সকল আকাক্সক্ষা যেন আপনা হইতে ধরা দিয়েছে। সে যখন কাজ করতে যায় তখন তার মুরিদরা তা করতে দেয় না।


পরে পীর সাহেব এখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। তার আপনজনেরা জিজ্ঞেস করলে বলত- এখানকার মুরিদদের অনুরোধে থাকতে হয়েছে। তারা এত করে অনুরোধ করলো। তাদের কোন মুরুব্বি নেই। 

তারা আমাকেই মুরুব্বি হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাছাড়া এ অঞ্চল ছিলো ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। আল্লাহ-রসুল সম্পর্কে তাদের লেশমাত্র জ্ঞান ছিল না। পুরুষ-নারীতে কোন বেদ-বিচার ছিল না। পরে বেপর্দাকে এনেছি পর্দায়। বে-জাতকে করেছি জাত। এভাবে আস্তে আস্তে এ অঞ্চলটি আলোকিত হয়ে ওঠে।

একদিন পীর সাহেব মাগরিবের নামাজ শেষ করে তার খাস কামরায় মোরাকাবায় বসে আছেন। এমন সময় একজন আসে পানি পড়া নিতে। তার স্ত্রীর পেটের পীড়া। দরজা খুলবে খুলবে এমন সময় তার মুরীদ রমজান পিছন থেকে লোকটিকে টেনে ধরে।

অ্যা...অ্যা তুমি কি করছ।

ভাই আমার গিন্নির পেটে ভীষণ ব্যথা উঠেছে। এখন একটু পানি পড়া লাগবে। লোকটির চোখে-মুখে খুবই কাতরতা। না, এখন হবে না। পীর সাহেব এখন ধ্যান মগ্নে আছেন। খোদার সাথে কথালাপ করছেন। পীর সাহেব ভেতর থেকে সব শুনে হঠাৎ করে বোল পাল্টিয়ে প্রলাপ করতে থাকেন। দাদাজান আপনাকে যারা একদিন এ অঞ্চল থেকে অপমাণ করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। খোদাতায়ালা আজ তাদেরকে দেশ ছাড়া করেছে।  

কিছুক্ষণ পর পীর সাহেব তার খাস কামরা ছেড়ে বের হয়ে আসেন। বাহির হয়ে শাগরেদ রমজানকে ডাক দেন। তাকে ডেকে কালীগঞ্জে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তার আরেক জন মুরিদ আছে। তাকে গিয়ে বলবে তার মৃত বাবা গত রাতে স্বপ্নযোগে আমার কাছে কিছু খেতে চেয়েছে। এখন সে যেন একটা কাঙালি ভোজের আয়োজন করে। আরো বলবে, আয়োজনে যেন কোন কার্পণ্য না করে। উল্লেখ্য এসব আয়োজনে পীর সাহেবই প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত পেয়ে থাকেন!

আর এখন এক পেয়ালা পানি নিয়ে এসো। রমজান দ্রুত পানি নিয়ে আসে। পীর সাহেব পানি পেয়ালাটা হাতে নিয়ে ফিসফিস করে কি কি পড়ে কয়েকবার পানিতে ফুঁ দেয়। তারপর লোকটার হাতে দিয়ে বলে, আপনার স্ত্রীর না পেটের পীড়া? পানিপড়া নিয়ে তাকে খাইয়ে দিবেন। ইনশাল্লাহ আরোগ্য লাভ করবে।

আগন্তুক লোকটা ত অবাক হয়ে যায়! মনে মনে কথোপকথন করে আমি কিছুই বললাম না, তবু পীর সাহেব কিভাবে বুঝলেন। কত বড় পরহেজগার লোক হলে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। 

লোকটা ভয়ে ভয়ে বলে- পীরসাব, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? 

হ্যাঁ। পীর সাহেব বলেন। 

তখন সে বলে। আমি ত আপনাকে কিছুই বলিনি। তবু কিভাবে বুঝলেন? 

পীর সাহেব একটু মুচকি হাসলেন। তারপরে বলতে থাকেন, আমাদের ‘রুহানি’ শক্তির বলে আমরা তা বুঝতে পারি। জগতের সব অদৃশ্য বস্তু দেখতে পাই। কার কি সমস্যা সব কিছুই উপরওয়ালা আমাকে বলে দেন। লোকটার মুখে কোন কথা নেই, লা জবাব!


শীতের সকাল, কুয়াশার জাল ছিঁড়ে আস্তে-আস্তে সূর্যের কিরণ এসে আছড়ে পড়ে পুকুরের নরম ঘাসের উপর। স্নেহের পরশে সূর্যটা উঁকি দিল পূর্বাকাশে।

পীর সাহেব খদ্দরের চাদরটি গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। হাতে একটা হাদিসের বই। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রমজান দৌড়ে গিয়ে একটা চেয়ার দিয়ে আসে। পীর সাহেব চেয়ারে বসে বসে রোদ পোহায় আর বই পড়ে। কিছুক্ষণ একাগ্রচিত্তে বইটি পড়ার পর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পীর সাহেব মাথা তুললেন। মাথা তুলতে দেখলেন রমজান বাড়ির সামনে পরিত্যক্ত জমিতে কোদাল দিয়ে কোপাচ্ছে। সেখানে সে এবার রবি শস্যের চাষ করবে। এখনো গায়ের গরম কাপড়-চোপড়গুলো খুলেনি। সে যখন কোন কাজ শুরু করে তখন তার আর কোন পূর্ব-পশ্চিম ঠিক থাকে না। সেখান থেকে পীর সাহেব তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, রমজান ফরজের দিকে খেয়াল রেখো। ফরজ তরককারি কোন লোকের হাতে আমি কিছু খাই না। তুমি জানো। রমজান সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। না শোনার কারণে পীর সাহেব তাকে আবার ডেকে বলে- 

রমজান, ও... রমজান। 

কয়েকবার ডাকার পর রমজান মাথা তুলে তাকায়। তখন সে বলে, হাঁটুর কাপড় ঠিক করো। রমজান জীভে কামড় দিয়ে তড়িঘড়ি করে হাঁটু ঢেকে দেয়। কখন যে হাঁটুর কাপড় খসে পড়ল সেদিকে তার খেয়ালই ছিল না।

তারপর তার দিকে পীর সাহেব কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই কিশোর ছেলেটি আজ কত বড় হয়ে গেছে। আজ সে এক পরিপক্ক যুবক। পীর সাহেব ঐ অবস্থায় মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন এবার তাকে বিয়ে করিয়ে দিবেন। 

পীর সাহেবের ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একটা লোক আসে তার কাছে। একটা স্বপ্নের বর্ণনা নিয়ে। বলো, কি স্বপ্ন তোমার? পীর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। তখন লোকটা বলে, হুজুর আমি গতরাতে ঘুমের মধ্যে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। পীর সাহেব লোকটার কাছে স্বপ্নের ধরণ জানতে চান? তখন লোকটা বলে- 

হুজুর আমি দেখলাম, তিন বর্ণের তিনটা কুকুর। কালো, লাল আর সাদা। আমাকে খুব দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। এটা দেখার পরে হুজুর আমি আর সারারাত ঘুমাতে পারিনি। এখন হুজুর আমি এটার ব্যাখ্যা জানতে চাই। 

তখন পীর সাহেব বলে, তাহলে শোনো। তোমার পিছনে অনেক শত্রু। তারা একেকজন একেক ক্ষতি করতে চায় তোমার। তুমি একটু সাবধানে থেকো। এটাই হল স্বপ্নের মর্মকথা। 


তারপর একদিন, মহা ধুমধামে রমজানের বিয়ে হয়। পীর সাহেবের এক ভক্ত-অনুসারী মেয়ের সঙ্গে। তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই থাকেন পীর সাহেবের বাড়িতে। কারণ পীর সাহেব ছাড়া এ দুনিয়াতে রমজানের আর কেহ নাই। দেখতে দেখতে রমজানের বিয়ের ছয় মাস পার হয়েছে। কিন্তু পীর সাহেব এখনো তার বৌকে দেখে নাই। যদিও মাঝে মধ্যে কিছু নিয়ে আসতো, তখন একেবারে হাতে পায়ে মোজা পরে পর্দা করে আসতো। একদিন পীর সাহেব তাকে বলে তুমি রমজানের বৌ। আর রমজান হলো আমার পালিত ছেলে। সেই হিসাবে তুমি আমার ছেলের বৌ’য়ের মতো। আমার সামনে আসতে এতো পর্দা কেন করো? আর পর্দা করা লাগবে না।

তারপর থেকে সে আর পীর সাহেবের সামনে আসতে পর্দা করতো না। এবার প্রথম পর্দা ছাড়া পীর সাহেবের সামনে আসে। তাকে দেখে ত পীর সাহেব থমকে যায়। এত সুন্দরী একটি মেয়ে রমজানের স্ত্রী! আবার সে আমার বাড়িতেই থাকে। তারপর থেকে পীর সাহেব আর তার মনকে এক মুহূর্তের জন্য স্থির করতে পারে না। আল্লাহ -রাসূলের নাম ভুলে গিয়ে সে রমজানের স্ত্রী’কে নিয়েই ভাবে। সর্বক্ষণ পীর সাহেব বিভিন্ন কূটকৌশলী ভাবনার জাল বুনে চলে। কিভাবে রমজানের স্ত্রীকে নিজের করে কাছে পাবে? দিবানিশি এই ভাবনা।

হুজুরের প্রথম কৌশল হলো, তাদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি করবে। তাই একদিন রমজানকে ডেকে বলে, তোমার বৌ কেন পর্দা করে না? আমার সামনে খোলামেলা আসে। আমার আমল নষ্ট হয়। তাছাড়া চলা-ফেরায় অনেক ত্রুটি পরিলক্ষিত হইতেছে। জোরে আওয়াজ করে কথা বলে। খিল খিল করে বেটা ছেলের মত হাসে, রমজান এমন বউকে নিয়ে তুমি ঘর সংসার করতে পারবে না। যত দ্রুত পারো তাকে তাড়ানোর একটা পদক্ষেপ নাও।

পীর সাহেব কি বুঝাতে চেয়েছিলেন রমজান না বুঝার কোন অবকাশ রইলো না। বড় শক্ত কথা। কথাগুলো শোনার পরে সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার শরীর যেন উত্তাপে ফেটে যাবে। সারা শরীর জুড়ে ঘামের ঢল নামে। গলায় মোড়ানো রুমাল দিয়ে হাত ও মুখের ঘাম মুছে নেয়। তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, পীর সাহেবকে সালাম দিয়ে হন্ হন্ করে বেরিয়ে যায়।


রমজান সারাদিন অন্যরকম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে পার করে। কোন কিছুতে মিল খুঁজে পায় না। পীর সাহেব তার বৌ’য়ের ব্যাপারে যা বলল, বাস্তবে তার কোন মিল খুঁজে পায় না। রমজান ভাবে, পীর সাহেব কি কখন মিথ্যে বলতে পারে! নিজের সাথে নিজের কথপোকথন। এদিকে ততদিনে রমজান আর তার স্ত্রীর মাঝে স্বগসর্ম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। 

অনেক দিন হয়ে গেছে পীর সাহেব তাদের দুই জনের মধ্যে দূরত্ব হওয়ার কোন আলামত দেখতে পায় না। তাই মনে মনে  নতুন আরেকটা ফন্দি আঁটে। কীভাবে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। দিনরাত শুধু ভাবে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে একদিন মনের মাঝে একটা কুটচালের উদয় হয়।

একদিন পীর সাহেব খুব বিমর্ষচিত্তে ঘরের দরজা বসে আছেন। এত ধ্যানমগ্ন যেন কাউকে দেখতে পায় না। তার সামনে দিয়ে রমজান কয়েকবার হেঁটে যায়। প্রতিদিন দেখলে ত একবার না একবার রমজানকে ডাকতো। কিন্তু আজ একবারও ডাকল না। রমজান ভাবলো, আজ পীর সাহেবের কি হলো। সে ভয়ে ভয়ে পীর সাহেবকে ডাক দিল।

হঠাৎ ডাক শুনে পীর সাহেব চমকিত হয়ে উঠে। রমজান বলে, পীর সাহেব কি কোন কিছু নিয়ে ভাবছেন? 

-হ্যাঁ, আমি ত তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। তুমি যেভাবে ঘর-ঘরণি নিয়ে মত্ত আছো। জাহান্নাম খুব আজাবের স্থান। রমজান শুনছে, কিন্তু কিছু বলার সাহস নেই তার। 

সে যখন পীর সাহেবের কাছে এলো। তখন পীর সাহেব চেয়ার থেকে উঠে তার কাঁধের উপর হাত রেখে বলে। আজ যে আমি মর্যাদার শিখরে এলাম, তা এমনিতে হাঁচিল হয়নি। অনেক সাধনা করতে হয়েছে। রাত-দিন খোদার কদমে পড়ে ছিলাম। তারপর উনার দিদার পেয়েছি। এটা বলতে বলতে পীর সাহেব আবার চেয়ারে বসল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে- দুনিয়াটা হল ইমানদার এর জন্য পরীক্ষাখানা। এখানে আমরা উপভোগ করতে আসি নাই, এসেছি যুদ্ধ করতে। কারণ আমরা হলাম ধর্ম প্রচারক বলতে পারো খেদমতগার। দ্বীন প্রচারের জন্য আমাদেরকে দূর হইতে দূরে চলে যেতে হয়। গৃহের প্রতি টান থাকতে নাই। পরে জগতে আরো সুন্দর সুন্দর হুর (নারী) পাবে। আর এখন তোমার যৌবন কাল। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপযুক্ত সময়। 

তাছাড়া তুমি আমার কাছে থাকো। তোমাকে যদি আমি দ্বীনের কাজে ব্যবহার না করি। তার জন্য আমাকে পরে কালে জবাবদিহি করতে হবে। এ কঠিন পরীক্ষা হইতে আমাকে উদ্ধার করো। পীর সাহেব অত্যন্ত কাতরস্বরে বলে। তারপর কৌশলে রমজানকে এক বছরের জন্য দ্বীনের কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কয়েক দিন পর পীর সাহেব রমজানের স্ত্রীকে ডেকে পাঠায়। আসার পরে তাকে আরবি লেখা একটা কাগজ দেখায়, এটা হল তোমার তালাকনামা। রমজান যাওয়ার আগে আমার হাতে দিয়ে গেছে। সে আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দা হতে চায়। তুমি হয়তো জানো না, সে বিয়ের আগেও এমন ছিল। বছরে পর বছর নিরুদ্দেশে চলে যেতো। এবার বোধ হয় আর ফিরবে না। কথাটা শোনার পর মেয়েটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বারবার মূর্চ্ছা যায়। বেশ কিছুদিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়, রমজান আর ফিরে আসেনা।

তারপর সুযোগ বুঝে পীর সাহেব একদিন তার জন্য তার বাপের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। পীর সাহেবের প্রস্তাব, না করার সাহস গ্রামের কারো নেই। কারণ, না করলে পীর সাহেবের বদদোয়া লাগতে পারে। 

একবার কলিমউদ্দিনের স্ত্রী গর্ভাবস্থা তার পড়া তাবিজ হাতে দে নাই বলে তার গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ হয়েছিল। গ্রামের মধ্যে এনিয়ে হই চই পড়ে যায়। কথাটা পীর সাহেবের কানে গেলে তখন সে তার পীরত্ব জাহেল করার জন্য বলে আমি তো ক্ষমা করে দিয়েছি। আল্লাহ বোধ হয় তাকে ক্ষমা করতে পারে নাই। তার এ অধম বান্দাকে অপমাণ করা আল্লাহ পছন্দ করেনি... 





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট