কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য


কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য
অলাত এহ্সান

‘জাতির জীবনের শিল্পশিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। শিল্পশিক্ষার অভাবে আমাদের রুচি গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি দেশপ্রেম। যে শিক্ষা উৎসের দিকে মুখ ফেরাতে সাহায্য করে, যে শিক্ষা মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে শেখায়, যে শিক্ষা মেরুদণ্ড সোজা করে পৃথিবীর পানে তাকাতে শেখায়, সেই শিক্ষার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পেরে আমি সত্যি গর্বিত।’
আজকের দিনে মুদ্রণশিল্পের প্রসার কিংবা গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধির কল্যাণেই হোক, চারুকলা বাণিজ্য যখন বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে লেখা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ওই কথাটুকুর মতো কতজন শিল্পী ভেবেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশেও চারুকলার বিপুল উল্ফনের পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য।
ঢাকায় এখন চলছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে পাঁচ দিনব্যাপী ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। গত বছর ঠিক এই সময়ে, এই উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে বক্তৃতারত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। গতকাল বেঙ্গলের ধ্রুপদী মিউজিক্যাল উৎসবে বসে আমার বারবারই মনে হয়েছে, আগত দর্শককে জিজ্ঞেস করি, তাদের এই সংগীত শুনতে শুনতে কাইয়ুম চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে কি না? আমরা এতটাই বিস্মৃতিপ্রবণ, অনেক ক্ষেত্রে অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্নও বৈকি যে এই গুণী মানুষকে ভুলে যাওয়া বিচিত্র কিছু মনে হয় না।
এ বছরের ৯ মার্চ, যখন প্রথম কাইয়ুম চৌধুরী মৃত্যুর পরবর্তী জন্মদিন উপলক্ষে দৈনিকের সাময়িকীর আয়োজনে তাকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন বা লেখাগুলো হলো, তখন আমার মনে হয়েছে, তার অধিকাংশই স্মৃতির চাদরে ঢাকা। এটা হতেই পরে, ৮২ বছর বয়সে একজন গুণী মানুষের প্রয়াণ হলে, চারপাশে তার স্মৃতি গুঞ্জরন তৈরি হবেই। অনেক সময় এই ধরনের লেখায় কাইয়ুম চৌধুরীর আলোয় নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা, কিংবা সময়ের রেখায় তার পায়ের ছাপ খোঁজার দোষে দুষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, অনেক আরো গুণী মানুষের মতোই, এই দীর্ঘ জীবনে তাকে ঘিরে যতটা ঘ্যাঙর নৃত্য হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আবার তাকে ঘরানা বা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণও হয়েছে, বাস্তবিক অর্থে তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন হয়নি। আমার এই লেখা সেই শুষ্ক নদীতে স্রোত বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো নয়ই, এত স্বল্প পরিসরে ও সাধ্যে আমার তা সম্ভবও নয়, কিন্তু সূচনা সূত্র খোঁজা মাত্র।
ফ্রান্সপ্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, কিংবা তাকে নিয়ে লেখা থেকে জানতে পারি, বিশ্বে আলোচিত শিল্পীদের মধ্যে তিনি বিশেষভাবে সম্মানীয় এ কারণে যে, তিনিই সম্ভবত একমাত্র শিল্পী যিনি দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং শিল্পকলাও সফল হয়েছে। বিষয়টা দারুণভাবে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। প্রসঙ্গত মনে করা যায়, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় গঠিত চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি তুলে এনেছেন ক্যানভাসে, মুক্তিযুদ্ধের ধারা করেছেন সম্প্রসারিত। মাথায় গামছা বেঁধে গেরিলা যোদ্ধাদের বলিষ্ঠ এগিয়ে যাওয়া তার মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকৃতি। আবার তার আঁকা কৃষকের দৃশ্যের সঙ্গেও এর মিল পাওয়া যাবে। আসলে এর একটা গূঢ় দিক হলো, আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ যতটা দলীয়করণ হয়েছে, সেই অর্থে সাধারণ মানুষের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের কথা হারিয়ে গেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে অন্তত তার বলিষ্ঠ স্বীকৃতি সব সময়ই দেখা যায়। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং তার চিত্রকর্ম মূল্যায়নের জন্য তাকে কি আমরা বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপনে যথাযথ সচেষ্ট হয়েছি?
এখানে প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, ’৫২-র সেই উত্তাল দিনগুলোতে তার সহপাঠী আমিনুল ইসলাম,  মুর্তজা বশীরসহ অনেকেই ছিলেন প্রতিবাদী আয়োজনের নিরলস কর্মী এবং সকল মিছিলের পুরোভাগে। স্বভাবে অন্তর্মুখী হলেও কাইয়ুম চৌধুরীও সম্পৃক্ত ছিলেন তাতে। ষাটের গণ-অভ্যুত্থানে মুখরিত সংগ্রামের শক্তিতে তার চিত্রকলা হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়। কোনো প্রতিরোধই তাকে অবরুদ্ধ করেনি। যেখানে যে প্রয়োজনটুকু আবশ্যক, তা করতে এতটুকু পিছপা হননি। যে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে শিল্পী-সাহিত্যিকরা যখন নিজেদের বিভিন্ন দলভুক্ত করে বিভিন্ন সুবিধা নিতে উৎসাহী হয়েছেন, সেখানেও তিনি নিজেকে বাইরে রেখেছেন। সে কারণে হয়তো, আমার কাছে মনে হয়, আমরা কাইয়ুম চৌধুরীকে বিশ্বে তুলে ধরিনি। আবার এ কথা ভাবাও নিশ্চয়ই অবাস্তব হবে না যে, যে অর্থে তার চিত্রকর্মকে আমাদের দেশে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা অনেক সময় জাতীয়তাবাদী ও স্থূল। ফলে চিত্রকলার আবিষ্কৃত নতুন নতুন ফর্ম ও ধারণা নিয়ে তার যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল তা অনেক সময় হয়ে ওঠেনি। যে কারণে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান নিজের অনগ্রসরতার ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই কাইয়ুম চোধুরীকে বাংলাদেশের শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিনিধি করার চেয়ে, জাতীয়তাবাদের ঘানিই বেশি বহন করিয়েছে।
বাংলাদেশে চিত্রকলা এবং সাহিত্যে একই সঙ্গে যে দুজন দারুণ সক্রিয়, তারা হলেন মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরী।  ব্যাপারটা ঠিক বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বে এর উদাহরণ বেশি নেই। মুর্তজা বশীরের ছোটগল্প ও প্রবন্ধগুলোর সাহিত্য মান এবং  প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দুই-ই আছে। আর কাইয়ুম চৌধুরীর কবিতাগুলো, একটা বিশেষ ধরন তো বটেই, সাহিত্যেরও মার্গ বহন করে। দৈনিকের পাতায় প্রচলিত কবিতার উন্মাদনার চেয়ে অনেক বেশি সেগুলো সমৃদ্ধ। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই দুজনকে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার বাইরে দাঁড়িয়ে যথার্থ মূল্যায়ন জরুরি। প্রচ্ছদশিল্পে দুজনের অবদান অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীর উৎকর্ষ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তুল্য ও স্বতন্ত্র।
আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন কাইয়ুম চৌধুরী। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানকে। তার চিত্রকালায় এই দুই মহান শিল্পীর প্রভাব সুস্পষ্ট। ১৯৫৭ সালে তিনি নিজেও ঢাকা গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে প্রফেসর হিসেবে অবসর গ্রহণের পরও ২০০২ সাল পর্যন্ত চারুকলা ইনস্টিটিউটে পাঠদান কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি শিল্পচর্চায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন (১৯৬১-৬২)। ওই বছর লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিল্পকলা প্রদর্শনীতে ‘বটম’ শীর্ষক চিত্রকলার জন্য প্রথম পুরস্কার পান। তিনি আরো সম্মানিত হন এর চার বছর পরে পঞ্চম তেহরান বিয়েনালে রাজকীয় দরবার পুরস্কার লাভ করে (১৯৬৬)। স্বীকৃতি অর্জনের এই ধারায় তিনি লাভ করেন শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৮৬), ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা। ২০১৪ সালে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদকে ভূষিত হয়েছেন।

আমার খুব বিস্ময় লাগে, কাইয়ুম চৌধুরী ও কামরুল হাসান সম্পর্ক। শুধু শিল্পকর্ম নয়, ব্যক্তিজীবনেও কাইয়ুম চৌধুরীর ওপর পটুয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য। মনে করা যেতে পারে, কামরুল হাসান কিশোর সংগঠন মুকুল ফৌজ-এর কর্মী ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি এর প্রধান হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কাইয়ুম চৌধুরীও মুকুল ফৌজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শৈশবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তত দিনে এ দুজন সহকর্মী ও সুহৃদ হয়ে উঠেছেন। যে কারণে আমরা দেখি স্বাধীনতার পরে কামরুল হাসান যখন বাংলাদেশের বুটিকস শিল্পের দায়িত্ব নেন, তার আহ্বানে কাইয়ুম চৌধুরী কিছুদিনের জন্য যোগ দিয়েছিলেন সেখানে। আশির দশকের আগে ও পরে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারিপনার বিরুদ্ধে দুজনেই সক্রিয় ছিলেন। কি বিস্ময়কর! কামরুল হাসান মারা গেলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে। কাইয়ুম চৌধুরীও মারা গেলেন সংগীত উৎসবে বক্তৃতা দেওয়ার সময়। দুজনের মৃত্যুর মিল কাকতালীয় হলেও বন্ধুত্ব ও সংগ্রামের মিল ছিল একই মূল থেকে উৎসরিত। সেই মিল দর্শনের।
কামরুল হাসান বরাবরই কমিউনিজনের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। সরাসরি পার্টির কর্মী ছিলেন। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া কাইয়ুম চৌধুরীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রজীবন থেকে। তার চিত্রে লোকশিল্প তুলে আনার প্রেরণা এই কামরুল হাসান। তার হাতেই কালো রং দাপুটে শিল্পে ঘুরে বেড়ায় ক্যানভাসে। সেই কালোও চারপাশের ঔজ্জ্বল্য আরো বাড়িয়ে দেয়। এও ঠিক, দর্শনগত দৃঢ়তা না থাকলে কাইয়ুম চৌধুরীর মতো দৃঢ়ভাবে কেউ এ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আগলে রাখতে পারেন না।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আজকের দিনে আমাদের দেশে শিল্পী নিজেও যেমন, তাকে নিয়ে লেখালেখি ও মূল্যায়নেও তেমন, তার চিন্তা-দর্শন একপ্রকার নেই করে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়। যা শুধু লেখাই নয়, ওই ব্যক্তি সম্পর্কের বোধের জায়গাটাও ধোঁয়াশাপূর্ণ হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাইয়ুম চৌধুরীকে বুঝতে গেলে, মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের তার দর্শনও বুঝতে হবে।  কিন্তু এ ধরনের মূল্যায়ন আমাদের দেশে খুব বেশি নেই।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট