গল্পটি শুনতে চেয়ো না- কিস্তি ০৭

  
গল্পটি শুনতে চেয়ো না
 সোহেল নওরোজ

এই পর্যায়ে এসে বেশ নির্ভার বোধ করেন হাফিজুল হক। অনেকটা গাড়ি রানওয়ের ওপর তুলে দেওয়ার মতো অবস্থায় আছেন। তিনি স্টার্ট চালু করে লাইনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য খুব বেশি তাড়া নেই। স্টেয়ারিংটা নিজের হাতে রেখে কমান্ড ঠিকঠাকমতো দিলেই হলো। গাড়ি নিজের মতো চলবে। শর্ত একটাই, কেবল নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে হবে। তিনি কি কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কায় আছেন? কখনোই যা বোধ করেননি, না চাইলেও অজানা সেই শঙ্কাটাই ঘুরেফিরে তার আশপাশে ঘুরঘুর করছে। তবে তিনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো মামুলি কেউ না। শুরু যখন করেছেন, শেষও করবেন এক হাতে। হাতের প্রসঙ্গ এলেই আরেকটা হাতের ব্যাপারটা তার মাথায় আসে। কেন জানি হাতটাকে তিনি অনুভব করছেন কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পেলে একটা সুবিধা হতো, তিনি হাতটার একটা চিত্র আঁকতে পারতেন। তাতে কি খুব লাভ হতো? মানুষকে চেনার জন্য তার একটা হাত কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না। একবার হলেও তাকে দেখতে হয়। তিনি কি কখনো অনুভূত হাতের মানুষটাকে দেখেছেন?

নাহিদ নিজের মতো চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার সিদ্ধান্তে প্রভাবক হয়ে আসেনি কেউ। না কবিতা, না তাহিয়া। নিজের চাওয়াকে মজবুত করতে কখনো কখনো দূরত্ব খুব কাজে দেয়। এই দূরত্বের ব্যাপারটা হাফিজুল হকের ক্ষেত্রেও অনেকবার ঘটেছে। তিনি নিজে যেমন দূরত্ব তৈরি করেছেন, তেমনি আবার অন্যের সৃষ্ট দূরত্বের কারণে তাকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। নাহিদের বড় সুবিধা হলো, তার ওপর কেউ এটা চাপিয়ে দেয়নি। বরং অন্যের চাওয়ার বিপরীতে হেঁটেই তাকে এটা বেছে নিতে হয়েছে। তাতে হয়তো মন খারাপের মতো অনুসঙ্গ এসে পড়ে কিন্তু জীবনের হিসেবের কাছে ধরা দেওয়া সহজ হয়। মত আর অমতের দ্বন্দ্বের পরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব পুষে না রেখে হীনমন্যতা পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলার আরেক নাম জীবনÑতা কে না জানে!

হাফিজুল হকের হাতে নাহিদের দুই নম্বর ছবি। আগেরটা শৈশবের, এটা যুবক বয়সের। বয়সের তারতম্য খুব বেশি না হলেও কিছু বদল সহজেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তিনি দুটি ছবি পাশাপাশি রাখেন। কী কী পরিবর্তন এসেছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অর্পা অবশ্য এ কাজটা সহজ করে দিয়েছে। ঝানু শিক্ষকের মতো পয়েন্ট আউট করে দেখিয়ে দিয়েছে ছবি দুটোর মিল-অমিল। সেগুলো একত্র করলে এমন একটা অনুসিদ্ধান্ত দাঁড় করানো যায়।
আগের ছবির সারল্যের ত্রিশ শতাংশ এ ছবিটাতে নেই। তার মানে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাহিদের ভেতর থেকে সারল্যের উপাদানগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
চেহারার মায়াবী ভাবও অনেকটা কমেছে। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই মায়ার ওপর কাঠিন্যের একটা পাতলা আবরণ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
নিষ্পাপ হাসির স্থলে দৃঢ় একটা সংকল্প প্রতিভাত হচ্ছে। এটা বোধ হয় কাহিনির কারণেই আনতে হয়েছে। পরের অংশ হয়তো তার ভেতর মমতার চেয়ে সংকল্প বেশি দাবি করে। হাফিজুল হক তেমনটাই করতে চেয়েছেন।

কলেজের প্রথম দিনগুলো নাহিদের দুঃসহ লেগেছে। বারবার মনে হয়েছে জীবনের এ পর্যায়ে এসে সে বড় একা এবং নিঃসঙ্গ। অনিকেতের মতো কেউ পাশে থাকলে তার পথচলায় এমন নিঃসঙ্গতা জুড়ে বসত না। অনিকেত একাাই তাকে আগলে রাখত। অনিকেত না হয়ে কবিতা এবং তাহিয়া বা তাদের দুজনের যে কেউ থাকলেও এই অনুভূতির হেরফের হতে পারত। তারাও মায়ার অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রাখত। অনিকেতকে পাশে পাওয়া সম্ভব নয়, কিংবা সে হয়তো পাশে না থেকেও প্রবলভাবেই আছে! কিন্তু কবিতা? আর তাহিয়া! তারা যে পাশে থেকেও নেই! জীবনের কিছু পথ একাই চলতে হয়। বোধ করি নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যই একাকীত্বের পথ ধরে চলতে হয় কিছু দূর, বেশ কিছু দূর! কতদূর তা এ মুহূর্তে নাহিদের জানা নেই।

শুরুর অস্বস্তি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠে নাহিদ। পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য কয়েকটা টিউশনি আর একটা কোচিংয়ে ক্লাস নেয়। তার পরিশ্রম হয়, তাল মেলাতে কষ্ট হয়ে যায়, তবু দিনশেষে এক ধরনের মানসিক স্বস্তি সঙ্গী হয়। এটাই তাকে বেশ কিছুটা প্রশান্তি দেয়।
যে মেসে থাকে সেখানে নাহিদ সবার ছোট। এ বিষয়টা তার পক্ষে গেছে। সবার ¯েœহের ভাগ যেমন পেয়েছে তেমনি বাড়তি কিছু দায়িত্ব থেকেও তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। প্রথম তিন মাসে তাকে একদিনও বাজারে যেতে হয়নি। খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নেয় সবাই। তার পড়ার টেবিল ছোট হলেও আলাদা। পড়ার সময় অন্যরা পারতপক্ষে তার রুমে আসে না। রুমমেট মমিন ভাই তাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখে। কিছুদিন আগে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছে। সময়ের মূল্য সবচেয়ে বেশি। এই ঘড়িটা সে কথায় তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে বলে মমিন ভাইয়ের বিশ^াস। পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি তাকে সম্পৃক্ত করেন। সামনে তার ছোট বোন মোহনার বিয়ে। মমিনের কিছু দায়িত্ব নাহিদের ওপরেও এসে বর্তেছে। সে এতে যারপরনাই খুশি হয়েছে। ভেতরে এখন থেকেই একধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

কয়েকদিন যাবৎ একটা বিষয় লক্ষ করছে নাহিদ। কলেজের কিছু বড় ভাই তাকে বেশ সমাদর করে। সেটা বিশেষ কারণে। তারা প্রত্যেকেই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একেকজন একেক দলে। তাকে নিজেদের দলে ভেড়াতেই তারা নানা কৌশল অবলম্বন করেছে। দু-একজন ইতিমধ্যেই নানা প্রলোভন দেখিয়েছে। নির্বাচিত হলে ভালো পদ দেওয়ার কথা বলেছে। স্যারদের বেশি নম্বর দিতে বাধ্য করার কৌশলের কথা জানিয়েছে। অবিশ^াস হলেও সে বিশ^াসের ভঙ্গিতে সব কথা শুনেছে। হ্যাঁ-না কিছু বলেনি। ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগে কাউকে কথা দেওয়া উচিৎ নয়। মমিন ভাইকে কথাগুলো বলেছে। তিনি তাদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। পড়াশোনায় ক্ষতি করতে পারে এমন কিছু না করাই শ্রেয়। সে সেটা বোঝেও। তবে নাহিদের চিন্তা অন্যখানে। চাইলেই কি সে তাদের থেকে দূরে থাকতে পারবে? একবারে ‘না’ বলতে পারবে? তারাও কি তাকে এমনিতেই ছেড়ে দেবে? ভালো ছাত্রের তকমা লেগে যাওয়ার কিছু সুবিধা যেমন আছে, তেমনি মারাত্মক কিছু সমস্যাও রয়েছে। সে তেমন একটা অসুবিধার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট