গল্প- মাকাল ভ্রমর





মাকাল ভ্রমর
বিবিকা দেব

নূর খালেক ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে । খুশিতে গদ গদ হয়ে বাঁশ ঝাড়ে একটা সোমত্ত বাঁশ কাটতে গেলেন । সামনে যাকে পাচ্ছে খুশির সংবাদ মুখে মুখে প্রচার করছে । নিকষ কালো রাত শেষে নতুন ভোরের মতো তার একখানা পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে । তার আগের বার একটা মেয়ে জন্মে ছিল । মেয়ের নাম রেখে ছিল জুঁই ফুল ।  নূর খালেক ফুল বড় ভালোবাসে । যদিও পৃথিবীতে কোথাও পাওয়া যাবে না , এমন ব্যক্তি যেই ফুল ভালোবাসে না । ছোট বড় সকলেই ফুল খুব ভালোবাসে । ছেলে জন্মেছে বলে আনন্দে আহল্লাদে আটখানা । মেয়ে জন্মেছে শুনলে মনে হয় মেয়ের মুখ দর্শন করতো না । এই গ্রাম থেকে আশে পাশে প্রায় পাঁচ গ্রামে চাউর হয়ে গেছে । গোদা নূর খালেকের ঘরে পুত্র সন্তান জন্মেছে । এই গোদা নামটা নিয়ে নূর খালেকের ভারী আপত্তি । কে যে এই নামটা প্রচার করেছে । আজো নূর খালেকের অজানা । যাক ! এই নাম নিয়ে আপাতত কোন মাথা ব্যথা নেই ।
নূর খালেক এখন বেজায় খুশি । বাপ দাদার পর বংশ পরম্পরায় সেই সহায় সম্পত্তি পেল । তাতে খেয়ে পরে দিব্যি বেঁচে থাকা যাবে । কোন ধরনের অভাব থাকবে না । তবু নূর খালেক কৃপন ! ছেলে হয়েছে বলে পাড়ার সবাই ছেলের বাপকে উদ্দেশ্য করে বললো কি মিয়া, পয়লাবার মেয়ে ছিল কিছুই খাওয়ালে না । এই বার ছেলে আসলো । মিষ্টিমুখ করাও । নূর খালেক হ্যাঁ সূচক উত্তরে বললো । তা বাদ থাকবে কেন , নিশ্চয় মিষ্টিমুখ হবে । তবে দোয়া করেন চাচা ছেলে যেন আমার বীর হয় । বিকাল বেলা বাজার থেকে ফেরার পথে হিসাব কষতে থাকে ।  রসগোল্লা খাওয়ালে কত খরচ পড়বে । হাঁটার গতির প্রতি কদমের তালে তালে হিসাব করে । যদি রসগোল্লা খাওয়াই তাহলে পকেট থেকে নতুন কড়কড়ে হাজার টাকা বেড়িয়ে যাবে । আর জিলাপি, কচরি খাওয়াই তাতে খরচ কম পড়বে । কিছু অর্থ নিজের সঞ্চয়ে থাকবে । বাড়ী ফিরে উঠোন থেকে হাঁক ডাক শুরু করে । কইগো আমার মা, আমার জুঁইফুল কোথায় ?
বদনা করে পানি দিয়ে গেল শেফালী । শেফালী নূর খালেকের শ্যালিকা । বউয়ের নাম শিউলী । দুটো ফুলের নাম পছন্দের তালিকায় আছে । বউটা সুন্দরী বটে , বাচ্ছা দুটো জন্মানোর পর রুপের ভাটা পড়েছে । আগে ছিল বাঁধানো শরীর । সারাদিন খাটা খাটুনির পর রোদে গায়ের ঘাম পিছলে পড়তো । দেহখানা খাঁটি সোনার মতো চকচক করতো । এখন সেই সৌন্দর্য নেই । তবু শিউলীর মুখটা ভরাট ও মায়াতে পরিপূর্ণ ।
হাত মুখ ধুয়ে বেশ পুরানো গামছা দিয়ে মুখ মুছে বউয়ের পাশে মোড়া পেতে বসে । শিউলী তখন পরম মমতায় বুকের অমৃত পানে ব্যস্ত । ছেলের বাপ আসাতে শাড়ীর আঁচলটা সরিয়ে কচি মুখটা দেখিয়ে বলল, দেখো তোমার ঘরের মানিক , তোমার সন্তান এবং বংশধর । খুশিতে আত্মহারা নূর খালেক বলে হ... আমার বাপজান আইছে আমাকে শাসন করবার লাইগা । আমার বংশের বাতি । এই সময়ে শেফালী চা নিয়ে হাজির । মৃদু হেসে হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে পরম তৃপ্তিতে চা পান করে । দেখ শেফালী, আমার বাপজানের মুখ চান্দের লাহান । যেন চান্দের আলো ফকফকা হইয়া মাটিতে পড়ছে । এবার যাই গ্রামের সকলের জন্য একটু মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা করি । আমার অনেক কাজ পড়ে আছে । নূর খালেক আঁতুড় ঘর থেকে বের হয়ে গেল । শেফালী বড়ো বোনের জর‌্য গরম ভাতের সাথে কচি লাউয়ের তরকারি খেতে দিল এবং বললো বেশী করে খেতে হবে । তুমি খেলে বাচ্চার শরীর ঠিক থাকবে । উত্তরে শিউলী বললো পাকা বুড়ি হয়েছিস না । এই সব কথা কোথা থেকে শিখলি । কেন আপু মা বলেছে এই সব কথা ।


জুঁই মায়ের কাছে আর ঘেষে বসে না । কিছুটা দূরত্বে বাঁশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে । একবার মাকে দেখে , আরেক বার মায়ের খোলে ভাইটাকে দেখে । শিউলী বললো জুঁই এসো । দেহো তোমার ভাই তোমার দিকে চাইয়া আছে । জুঁই কিছু বলে না । অনড় হয়ে আছে । মায়ের ডাকাডাকিতে চুপটি করে বসে । এক হাতে ছেলে ঘুমাচ্ছে, অন্য হাতে শিউলী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পরম ¯েœহ মমতায় । অনেক দিন হয়ে গেছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে না ।
জুঁই ছোট খালা শেফালীর সাথে ঘুমায় । শেফালী রাতের খাবার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত । এমন সময় নূর খালেক এসে জিলাপি ও কচরি  এনে বলে শেফা... ও ...শেফা... এই গুলান ধরোত । হাত আমার বেদনা হয়ে গেল । নূর খালেক কয়েক দিন ধরে শেফালীকে শেফা বলে ডাকে । শেফা নাম স্বামীর মুখে এই প্রথম শুনলো । মনে মনে ভাবলো নিজের কোন ছোড বইন নাই । তাই বোধয় আদর করে শেফা বলে ডাকে । সে স্বামীকে কিছুই বললো না । শেফালী প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে বলে এই গুলো আমি কি করবো ? কি করবা মানে ! গ্রামে সকলের ঘরে ঘরে পাঠায়া দিবা । আর লগে বলবা যেন আমার ছেলের জন্য দোয়া করে । বুঝছো , নাকি আবার বলতে হবে । শেফালী হ্যাঁ সূচক বললো জি বুঝেছি আর বলতে হবে না ।
আমি এক্ষুণি যাচ্ছি । তয় এত রাতে আমি একা যামু । আপনিও সঙ্গে চলেন । আপনি সাথে থাকলে আমার ভয় ডর কিছুই লাগবো না ।
কি বলো শেফা দেহো বাইরে দুধ শাদা চাঁদ উঠছে । চারদিকে ফকফকা আলোর নাচন । আর তুমি কিনা ভয় পাও ।
হেইডা ঠিক আছে তয় আপনি আমার লগে যাবেন । না হয় আমি একা একা যাইতে পারুম না ।
ঠিক আছে । লয় এহন যাই । হাতে জিলাপি ও কচরির প্যাকেট সমেত দুজনেই রওনা দেয় । যাওয়ার সময় শেফালী বোনকে খাবার দিয়ে যায় এবং আরো বললো বুবু তুমি তাড়াতাড়ি খাইয়া ঘুমাইয়া পড় । রাত জাইগো না । শরীর খারাপ হবে । আমি আর দুলাভাই যাচ্ছি মিষ্টি বিলি করতে । আমরা জলদি ফিরা আমু । উত্তরে শিউলী বলে যা তাড়াতাড়ি আইসো ।
শেফালী ও নূর খালেক একসাথে বের হয় । যথা শীঘ্রই মিষ্টি বিলি করে বাড়ীতে ফিরে । আসার সময় নূর খালেক বলে আচ্ছা শেফা আমি মানুষটা কি বদ ?
এই কথা কইলেন ক্যান ?
না এমনি কইতাছি। শেফা তুমি খুব সোন্দর ।
হ দুলাভাই । সকলে এই কথা কয় আমি নাকি সোন্দর আছি ।
ক্যান শেফা তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো না ।
করি তো । আপনি হইলেন গিয়া এক নম্বরে খাঁটি মানুষ । চাঁন্দের আলোয় শেফার মুখখান দুধের সরের মতো জমে আছে । আরো বেশি মায়াবী দেখাচ্ছে । কারো মুখে কোন বাক্যর ব্যবহার নেই । নিস্তব্ধ নির্বাক্ তাকিয়ে আছে ।
একসময় মৌনতা ভেঙে দুজনেই বাড়ী ফিরে আসে । শেফালী রাতের ভাত খেয়ে চটজলদী ঘুমিয়ে পড়ে । এপাশ ওপাশ করে কিন্তু চোখের পাতায় ঘুম আসে না । অনেক চেষ্টা করে কিছুতেই ঘুম আসে না । পাশে জুঁই ঘুমিয়ে আছে । গভীর ঘুমে জুঁইকে আরো বেশী সুন্দর দেখাচ্ছে । মনে হচ্ছে চাঁন্দের দেশের রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছে আমার পাশে । জুঁইয়ের ঘুমের মৃদু মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দে শেফালী অনেক দূরে নিজেকে নিঃশ্বাসের পতঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । শেফালী গ্রামের আর দশ জন সুন্দরী মেয়েদের একজন ।
প্রথম যৌবনে শাহীন নামে প্রতিবেশীর মন কেড়ে নেয় । নিতান্তই চোখে চোখে এক পলক দেখা তার বেশী কিছুই নয়। মনের মধ্যে জমিয়ে রাখে একান্ত আত্মকথা । শাহীন ও কোন উদ্যোগ নেয় নি । ভাটা পড়ে এক তুবড়ি প্রেমের । আরো বিগত কিছু দিন পরে বড়ো বোনের বাড়ীতে রওনা দেয় । বড়োবোন গর্ভবতী তার দেখাশুনা  করার জন্য অস্থায়ী  ভাবে আছে । কয় মাস থাকতে হয় জানি না । অনেক দিন থাকাতে ঘরবাড়ী, গাছপালা, পুকুর, গরুবাছুর, মানুষজন সবাইকে আপন করে নিয়েছে । দিন কাটতে থাকে হাসিতে খুশিতে । বড়ো বোনের ছেলে হয়েছে । তাই আরো বেশী আনন্দে আছি । আত্মীয় স্বজন দুলাভাই সবাই খুশি । তবুও কোথাও শূন্যতা বিরাজমান !
চৈত্রের খাঁ খাঁ করা রোদ্দুর প্রভাব পড়েছে হৃদয়ে । যেন প্রথম বৈশাখী ঝড়ের এক ফোঁটা বৃষ্টির সজীবতা জীবনে আসবে । এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না । খুব ভোরে আকাশের এক চিলতে ফর্সাভাব বেড়ার ফাঁক গলে উঁকি দেয় । তখন দড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে । সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি ভর করে সারা শরীরে । ঢুলুঢুল চোখে প্রত্যহ কাজ করতে এগোয় । অবসন্ন বিষাদ মন ছুটে চলে শাল হিজলের বনে । ভরা পূর্ণিমা রাতে আকাশের চাঁদ অন্য রাতের থেকে আলাদা হয় । চাঁদের ষোলকলা পরিপূর্ণ । তেমনি এক চাঁদনী রাতে নূর খালেক শেফাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে ।  এবং বললো শেফা... ও শেফা... তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ?
শেফালী ঘুম থেকে উত্তর দেয় জি শুনতে পাচ্ছি । তয় এতরাইতে আপনি না ঘুমাইয়া এইহানে কি ? নূর খালেক বললো কথা আছে বাইরে চলো । শেফালী বললো বাহিরে ক্যান যামু । নূর খালেক বলে বাহিরে এসে দেখ, আকাশে কি সোন্দর চাঁন উঠছে । না দেখলে আপসোস করবা । আপত্তি থাকার শর্ত্বেও শেফালী ঘুম থেকে উঠে । বাহিরে এসে শেফালী সত্যি অবাক হয়ে যায় । চাঁদকে কোন দিন এত গভীর রাতে উপভোগ করেনি । শেফালীর প্রতিমুহূর্ত গুলো ভালো লাগছে । নূর খালেক আরো বললো চলো সামনে হালদা নদী । নদীর বাঁকে চর জেগেছে । সেখানে একটি নৌকা বাঁধা আছে । তুমি আমি নৌকায় ঘুরে বেড়াব ।
দুরু দুরু বুকে শেফালী এগোয় দুলাভাইয়ের সাথে । বড়বোন শিউলী সন্তান বুকে পরম তৃপ্তিতে ঘুমোচ্ছে । এখন শেফালীর নূর খালেককে বোনের স্বামী হিসেবে মনে হয় না । চারদিকে চাঁদের দুধ শাদা জোসনা আলোকিত । নৌকায় উঠে শেফালী নদীর স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নেয় । আরো মোহনীয় মায়াময়, দেখে বাতাসের আলিঙনে নদীর মৃদু মৃদু ঢেউ । চাঁদের রুপালী আলোয় ভাসমান । দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে । নূর খালেক বললো কি হইচে তোমার আমার লগে ঘুরতে শরম লাগে । শেফা আরো কাছে আসো । আমি তোমার শরম দূর করে দেবো । এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে নূর খালেক একজন প্রেমিক । যার স্পর্শের জন্য অনাদিকাল অপেক্ষায় থেকেছে ।
দুটো হৃদয় কাছাকাছি এসে নিবিষ্ট হতেই শরীরে লোমকূপে উদ্মাদনায় তরঙ্গে দুকুল ভাসিয়ে প্লাবন প্রবাহিত হয় । মানবে না কোন বাঁধা কেবল অথৈই প্লাবন । হঠাৎ বাচ্ছার কান্না শুনে শিউলী ঘুম চোখে ডান হাতের স্পর্শে ছেলের নকশী কাঁথার ছোপ ছোপ পানির স্বচ্ছ ধারা । তাড়াতাড়ি জবজবে ভেজা নকশী কাঁথা পরিবর্তন করে । কচি দুটো ঠোঁটের স্পর্শে অমৃত পানে আঁচলের নীচে আবদ্ধ । মা এবং ছেলে ঘুমের অতল গহ্বরে আড়াল হয় । এদিকে ভোর আসন্ন । শেফা নিজেকে ছাড়িয়ে শাড়ীটা ঠিক করে । বাড়ীর পথে পা বাড়ায় । শাড়ীর আঁচল টেনে ধরে নূর খালেক । অনেক দিন পর একটু তৃপ্তির স্বাদ পেলাম । লজ্জা রাঙানো মুখে শেফা কিছু বলতে পারেনি । শুধু শরীর জুড়ে কাঁপুনি । এত কাঁপুনি যে কোথায় থেকে আসে নিজেও জানে না ।
সকাল বেলা বিছানা ছাড়তেই শেফালী বুঝতে পারে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে । তখনি মনে পড়ে গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা । তবুও কষ্টে রান্না করে বড়বোনকে সকালে খাবার দিতে যায় । হটাৎ শিউলী জিজ্ঞেস করে শেফা তুই কি রাতে ঘুমাসনি ? চোখ মুখ ফোলা ফোলা ক্যান ? শেফালী মাথা নিচু করে বলে কিছু না আপা । রাতে ঘুমাতে গিয়ে মা-বাবা ভাই সবার কথা মনে পড়ে । আসলে এহানে মেলাদিন আছি । তাই ওদের জন্য মনটা কেমন যেন করে । তাই ঘুম কম হইছে । ও কিছু হবে না । বুঝেছি দাঁড়া । তোর দুলাভাইকে দিয়ে খবর পাঠাব । মা-বাবা যেন আসে । তাহলে তোর ভালো লাগবে । কি বলিস ? জি আপা । তুমি যা ভালো মনে কর । শেফালীর মনে ভয় এবং লজ্জা ঢুকে পড়ে । কি করবে শেফালী বোনকে সব কিছু খোলে বলবে না গোপন রাখবে । অস্থিরতায় ভুগতে থাকে । এভাবে মাসের পর মাস পেরুতে থাকে । এদিকে নূর খালেকের প্রবৃত্তির ক্ষুধা দিন দিন বাড়তে থাকে । শেফালী রাতের পর রাত নিজেকে উজাড় করে । বোনের শিশু পুত্রটা বড় হতে থাকে ।
বড়বোন আগের তুলনায় অনেক সুস্থ । একটু মোটা হয়ে গেছে। তবে আগের থেকে মুখের লাবণ্যতা বেড়েছে। আর এদিকে শেফালী ধীরেধীরে মলিনতা ও দুর্বলতা বেড়েছে । তলপেটে যেন কারো বসবাস শুরু হয়েছে । মাঝে মাঝে এমন মোচড় দেয় যে, শরীরের নাড়িভুড়ি এখনি বেরিয়ে আসবে । খাবার খেতে পারে না ঠিক মতো । কাউকে কিছু খুলে বলতে পারে না । গোপান কথা গোপন রয়ে গেল । হঠাৎ একদিন সকালে ছোট ভাই সোহেল উপস্থিত । শেফালী বুঝতে পারে সোহেল তাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবে । বিকেলে নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে ভাইয়ে সাথে বাড়ী ফিরে যায় । শেফাকে দেখে মা বলে কি রে , তোর কি শরীর খারাপ ? প্রতিউত্তরে শেফালী না বলে । তাহলে মুখ চোখ এত শুকিয়ে গেছে ক্যান ? শেফা বললো তেমন কিছু হয়নি । আসলে অনেক কাজ করছি । ছেলে জন্য রাত জাগছি আর অনেক দিন পর বাড়ী আসছি । তো তাই তোমার এই রহম মনে হইতেছে । আইচ্ছা যা আর কিছু বলা লাগবে না । ভাত রান্দা আছে খাইয়া ঘুমাইয়া পর সব ঠিক হইয়া যাইবে ।  
আসার বেশ কয়েক দিন পর শেফালীকে ঘন ঘন বমি করতে দেখে । খাবার খেতে দিলে বলে আমার খেতে ভালো লাগে না । ঘরের কাজ তেমন করে না । উদাস হয়ে বসে থাকে । কখনো ঘুমিয়ে থাকে । মায়ের মনে সন্দেহ হয় । পলকা শরীরটা দিনদিন বাড়তে থাকে । পেটটা ফুলে উঠে । হঠাৎ একদিন শেফালী দুপুর বেলা শুয়ে আছে । মা চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টানে বললো হারামজাদী বল কে তোর সর্বনাশ করেছে ? আইজকে তোকে মেরেই ফেলব । বংশের মুখে চুনকালি দিলি । বিয়ে না হইতে পোয়াতি হইছিস । এই বাচ্চার বাপ কেডা হবে বল ? এই কথা উচ্চারণ করতে করতে সমান তালে মারতে থাকে । শেফালী নির্বাক্ তাকিয়ে আছে । চোখের কোণে কান্নার জল নেই । বাবা মাঠের কাজ শেষ করে দুপুরে বাড়ীতে ভাত খেতে আসে । দেখে শেফালী মাটিতে বসে আছে । মায়ের মুখ থেকে সব শুনে জিভ কামড়ে ধরে । যেন এখনি মৃত্যু হোক । মাটির সাথে মিশে যাক !
এক কান দুই কান করে সমস্ত গ্রামে শেফালী পোয়াতি হওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে । পুকুর ঘাটে, কলতলায়, গ্রামের বৌ-ঝিদের ফিসফিসানি শুরু হয় । এমনকি চায়ের দোকানে পর্যন্ত সমালোচনা হতে থাকে । নূর খালেক খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস । প্রথমে মাঠের ফসলি জমি দেখতে যাই। তারপর গোয়ালের বাঁধা গরু , পুকুর পাড় আশে পাশে ঘুরে বাড়ী ফিরে আসে । এসেই ছেলেকে কোলে নেয় । আয়েশ করে বসে চা-রুটি শেষ করে এবং পান চিবুতে থাকে । এমন সময় শশুড়-শাশুড়ী সাথে শেফা । শেফার চোখের নীচে কালি জমেছে । দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ঘুমাইনি । বুকে হাড় ভেসে উঠেছে । কিন্তু পেট ফুলে উঠেছে । শাশুড়ি ঘরে ডুকেই শিউলীকে ডাকে । শিউলী মা-বাবা আর ছোট বোন শেফাকে দেখে বলে তোমরা কহন আইছো ? কেমুন আছো ? মা-বাবা তোমরা বস । বোন শেফা তুই কেমন আছিস ? উত্তরে কেউ কিছু বলে না । সবাই চুপচাপ !
মা শিউলীকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে । ফোঁপাতে ফোঁপাতে বিলাপ করে আর কাঁদে । মায়ের মুখ থেকে সমস্ত কথা শুনে শিউলী নিস্তব্ধ হয়ে যায় । চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে । এত কিছু ঘটে গেল আমি কিছুই জানতে পারলাম না । মা বলল শেফাকে আমরা কিছুতেই বাড়ী নিয়ে যাবো না । নূর খালেক যখন এক মেয়ে ঘরে থাকতে আরেক মেয়ের দিকে নজর দিছে । নূর খালেক শেফার দায়িত্ব নিবে । শিউলী স্বামীর মুখোমুখি হয়ে বলে তুমি ক্যামুন পুরুষ মানুষ তোমার কোন ধৈর্য নাই । ঘরে বউ থাকতে তুমি শালীর দিকে নজর দাও । তোমাকে আমি খুব ভালো মনে করতাম । চরিত্রবান মানুষ বলে জানতাম । আর অহন তুমি ভালো মানুষের সুন্দর পরিচয় দিলে ?
আর কথা বাড়াইনি । এভাবে কেটে গেলো কয়েকদিন । করো সাথে কেউ কথা বলে না । বাড়ীতে কোন জনমানব নেই বলে মনে হয় । হঠাৎ ছেলেটা কান্নার শব্দ শোনা যায় । সকালে স্বামী নূর খালেককে উদ্দেশ্য বলে আমি তুমার কাছে থাকতে পারব না । তুমি আমার বইনকে নিয়ে থাক । সুখে সংসার করো । জুঁই আর ছেলেটা তোমার কাছে থাকল । আমি বাড়ী ছেড়ে চলে যাচ্ছি । ভেবো না বাপের বাড়ীতে যাবো । ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যখন মায়ের প্রয়োজন হবে । তখন আমার কাছে যাবে । এই কয়েকটা কথা বলে এক কাপড়ে শিউলী স্বামীর বাড়ী ত্যাগ করে । পরের দিন সকাল বেলা  নূর খালেক আট মাসের পোয়াতি শেফাকে বিয়ে করে । একজনের হৃদয় নতুন কিছু পাবার আনন্দে পূর্ণ হলো । আর অন্যজন সব কিছু পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে গেলো । অন্ধকার কষ্টের অতল গহ্বরে ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট