প্রাণের প্রণতি নাও হে মাতৃভাষা
ইলিয়াস বাবর
গুরুজি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাতাসের ভেতর থেকেও বায়ুর উপস্থিতি টের পাই না বলে যে কথাটি জানানÑ তা যুগের স্বপক্ষে বদলে নিয়ে বলতে পারিÑ মাতৃভাষার মায়াময় আবহের মধ্যে থেকেও হয়তো বুঝতে পারি না তার টিকরে পড়া সৌন্দর্যের কথা। হয়তোবা বুঝি কখনোসখনো। একবার বিদেশি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের পরীক্ষায় বিপুল বিদেশী ভাষার মাঝে অ আ দেখে অপার্থিব আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম; অব্যক্ত উল্লাসে ঘেমে একাকার হয়েছিলাম নাতিশীতোঞ্চ অঞ্চলে থাকবার পরেও! চাটগাঁ নগরের রাস্তায় যানযটবহুল সময়েও কি এক অপরিমেয় সুখানুভূতি নিয়ে ঘরে এসেছিলাম সেদিন। এভাবেÑ প্রথম বলতে শেখবার সময়, প্রথম প্রেমে পড়বার সময় কিংবা প্রথম প্রেমপত্র কি কবিতা লেখবার সময় মধুসিক্ত হর্ষরা ভর করে; অত:পর আমরা জেনে যাই মাতৃভাষার পবিত্রতাÑ পেয়ে যাই অবগাহন করবার শক্তিও।
বৈজ্ঞানিক নানাবিধ আবিষ্কারের ঠেলায় আমাদের সুবিধা যেমন হাজার পদের, অসুবিধাও খুব কম না! এই যেÑ আজকের দিনের ফেসবুকিয় ভাষা তো একেবারে বিশ্রি! যেনতেনভাবে আমরা লিখছিÑ যেকোনভাবে ভাবটা দেখাতে পারলেই হলো! তাতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে মুঠোফোনে দেয়া নানা কিছিমের বর্ণমালা-সম্ভার। মূলত আমাদের প্রিয় বাংলা দিনেদিনে সমৃদ্ধ হয়েছে নানা ভাষার ভান্ডার থেকে প্রয়োজনমাফিক শব্দ নিয়ে। অবশ্য পৃথিবীর যেকোন দেশ তার সংস্কৃতি-ভাষাকে বলবান করে প্রয়োজনের নিরিখে, বিশ^গ্রাম ধারণায় এ প্রথাটি অন্যাবশ্যকও নয়। সেদিক দিয়ে নেয়ার সুবিধা যেমন আছে, দেউলিয়া হওয়ার ইতিহাসও কিন্তু একেবারে কম নয়। আকাশ-সংস্কৃতির চরম গ্রাসে পুঁজিবাদি ব্যবস্থার হুজুগে অনায়াসে ঢুকে পড়ে অবাঞ্চিত বিষাশয়টুকুও। তবে যারা, বোঝে বাস্তবতার স্বরূপ, তারা সমুখের পথকে চিনে নিয়েÑ সময়কে ধারন করে এবং যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গের সাথে বাঁচিয়ে রাখে প্রাণের ভাষাও। এতে অভ্যস্থ হতে না পারার বেদনা বিরাট, বিপুল বোঝা নিতে উদাহরণ হতে হয় সমুখের ইতিহাসচর্চায়। লোকপ্রচলিত অনেক ভাষাই হারিয়ে যাচ্ছে অব্যবহৃত হবার যন্ত্রণায়, ভাষা-গবেষকেরা তার ফসিল দেখিয়ে অন্যদের ভয় দেখায়Ñ আদপে ভয়ের কাজ নয় বরং জয়ের কাজই হতে পারে ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখাটা। আমরা হয়তো আশাবাদি হতে পারিÑ আমাদের দেশে জনসংখ্যা তো দিনদিন হুহু করে বাড়ছে, বিশ^ব্যাপি বাড়ছে বাঙালির সংখ্যা; সুতারাং আমাদের ‘নাই’ হবার সম্ভাবনা একেবারেই নাই। তা হতে পরে নাÑ বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের দৈনন্দিনের ভাষাকে কোনভাবেই ভাষাপ্রেমের নমুনায় ফেলা যায় না। আমরা ভাষার জন্য রক্ত দেয়া জাতি বলে যে চেতনা লোকমুখে দেখাই তা-ই যদি ভেতরকার দর্শন হয়, তো মাথার তাজ কিন্তু রক্তাভ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যার জন্ম-উত্থান-প্রসার তার জন্যে চাই আলাদা কিছু। বলাবাহুল্য আমরা ফেনা তুলতে প্রস্তত, বানান ভুলে পাঠ্যপুস্তক কিংবা বিজ্ঞাপনবিল তুলতে পারি আবার সেটা নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভুল বানানটিই ভুল করে থাকি! আসলে আমাদের শংকর-মানসে ভর করে থাকে বাচ্চাকাচ্চাসহ মামদোভূত!
ভাষা-বিষয়ক ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলি, দরদ দেখাই কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই তো ভুলে যাই চেতনতাজাত কর্তব্যের কথা! আমাদের সবকিছুই কি তবে অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে? একুশ তারিখের পর খুব একটা কথা বলি না মায়ের ভাষা নিয়ে। শিক্ষবর্ষ শেষ হলে কি করে ছেলেকে ইংরেজি শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করা যায় তা নিয়ে ভাবি, অর্থের অনৈতিক লেনদেন করি এবং দিনশেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি এই ভেবেÑ আমার সন্তান পড়ে অমুক বিদ্যায়তনে! যুগের প্রয়োজনকে অস্বীকার করবার স্পর্ধা বলতে গেলে সামাজিক মানুষের থাকে না, নানামুখি হাত-পা নিয়ে সে বাঁধা থাকে তারই বলয়ে কিন্তু যুগের কাজি দ্বীন মুহাম্মদ স্যার নেই যে বানানের শুদ্ধি অভিযান চালাবেন! ফলত, সামনে আসে লেখকদের ভূমিকার কথাটুকুও। যুগে যুগে লেখকেরা তো ভাষার সেবা করে যান বিনা স্বার্থে, বিনা অজুহাতে। শাহ মুহাম্মদ ছগিরের সে ঐতিহাসিক কবিতা কখন লেখা? হয়তো আমাদেরই বন্ধু-ভাই-পরিজনেরা যখন উর্দু-সংস্কৃত বা অন্যান্য ভাষা নিয়ে ব্যস্ত তখনই তার এ ঘোষণা জাগিয়ে দিয়ে যায় রীতিমতো। তারও পরে, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নাম বিস্মৃত হওয়া মানে বড়ো রকমের অপরাধ করার কাতারেই পড়ে। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ক্রমাগত মাতৃভাষার স্বপক্ষে বিবৃতি-বক্তৃতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায় নিজের জীবনকে স্বার্থক করেছেনÑ তখন হয়তো আজকের মতো চেতনাজাত ব্যবসায়িক চিন্তাপুঞ্জ ছিল না, ছিল মা-মাটির প্রতি দায়বদ্ধতা। অনেকেই, ভাষাদিবস আসলেই, ফাগুন মাসের কথা বলেন, তা আসলে ভাববার আগে বাস্তবতাকে ধারণ করা দরকার। যেখানে আমাদের দেশের আদালত সমূহ রায় ঘোষণা করেন ইংরেজিতে, কৃষকেরা আর বাংলা মাসের হিসেব রাখেন নাÑ সেখানে বাংলা পঞ্জিকা অনুসরণের ইতিবাচকতা কতটুকু তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বৃটিশেরা আমাদের মাথায় তাদের শিক্ষাব্যবস্থা-আইনকানুন ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে সুচতুরতার সাথে, বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠনও করে যাচ্ছেÑ আমাদের দেশিয় বীজ নিয়ে দিচ্ছে নানাজাতের বিদেশি বীজ; ফলে বাংলা মাসের দিনতারিখ অনুসরণ করবার সুযোগ ব্যাপকহারে সংকোচিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিবান নেতাদেরÑ বিশেষ করে যারা শিল্প-সংস্কৃতির পথে নিয়োজিত তারা বাংলা ভাষার ব্যাপকতাকে কীভাবে বিশ^ব্যাপি ছড়িয়ে দেয়া যায় সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা। হানা টমসন, মারিয়া হেলেন বেরা, ক্লিনটন কি সিলি প্রমুখ বিদেশীরা এমনে এমনে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়েন নাÑ তারা এ ভাষার রূপমাধুরিতে উৎফুল্ল, ভেতকার সৌন্দর্যে আন্দোলিত। আমাদের যারা রাষ্ট্রপরিচালনা বা রাষ্ট্রীয় এসব দফতর দেখেন তারা চাইলে বিদেশীদের বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণার বিষয়টিকে সম্প্রসারিত করতে পারেনÑ তাতে আমাদের ভাষার সৌন্দর্য যেমন বিশ^ব্যাপি টিকরে পড়বে তেমনি আরো অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবেন বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করতে। ভাষার মাস, বইমেলার মাস বলে খ্যাত ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশেই বইমেলা ও এ-জাতীয় নানা আয়োজন দৃশ্যমান হয়। লেখক-পাঠকেরা অপেক্ষা করেন নতুন বই দেখবার-পড়বার এবং জানবার। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক তো মুখের উপরেই বলে দেন মানহীন বই প্রকাশের কথা, ভুল বানানে বই প্রকাশের কথা। যেহেতু বইয়েই ভাষা লুকিয়ে থাকে তার যাবতীয় গুপ্তধন নিয়ে, আমাদের আরো মনোযোগি হওয়া উচিত। লেখকেরা চেষ্টা করে যান নিরন্তর, কেউ পাঠকেরÑ সমগ্র ভাষা অনুসারিদের মানোস-আকাক্সক্ষাকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন কেউবা ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হওয়া অন্যায় নয়, তবে মাতৃভাষা নিয়ে ছেলেমি করা অবশ্যই দোষের। কেননা, পাঠের পর যে অনুভূতি তা পবিত্র, প্রভাব ফেলে বাস্তব জীবনের নানা ক্ষেত্রে।
বাংলা ভাষার শত্রুমিত্র নামে হুমায়ুন আজাদ মহোদয়ের বিখ্যাত বই আমরা দেখি বিভিন্ন বই বিপনিকেন্দ্রে। কিন্তু এই সময়ে, আজকের দিনে বাংলা ভাষার শত্রু কারা? এরকম প্রশ্নে অনেকেই ভ্যাবাচ্যাক খেলেও একেবারে অবাস্তব নয় এটা অবতারণা। উর্দু না হয় ইসলামাবাদে উড়ে গেছে, চলে গেছে শিকড়বাকড়সহ। কিন্তু হিন্দির যে দোর্দন্ড প্রতাপ তা কী দিয়ে রুখা যাবে? আমাদের মায়েরা-মেয়েরা হিন্দি নাটকে যেভাবে আসক্ত হচ্ছেন তার তাৎক্ষণিক ফলাফলে আর কিছু না পাই অন্দরে হিন্দি ভাষা চর্চার হিড়িক দেখতে পাওয়া যায়। কম বয়েসি বাচ্চারা হিন্দি বলতে চেষ্টা করছে, করছেও অহরহ। ইংরেজি আগে থেকেই আছে কিন্তু বিষয়টার প্রাতিষ্ঠানিক একটা ভিত্তি তো আছে! আমরা হিন্দি শিখবো, প্রতিবেশির অনেক গুন-দোষ নিজ ঘরে আসাটা স্বাভাবিকও বটেÑ তাই বলে যে শিশুটির মুখ-ফোটার সাথে সাথেই হিন্দি বুলিতে বোঝাতে চায় দৈনন্দিনতা তা ভবিষ্যতের জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়েই থাকবে। আমরা সব ভাষা থেকে প্রয়োজনমাফিক শব্দ নেবো, নিজেদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করবার জন্যেÑ তাতে যদি দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা জেগে উঠে তো ভয়াবহ! বক্তৃতা দেয়া সহজ, সমালোচনা করাওÑ পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তর করা আসলেই কঠিন। জব্বার-শফিক-রফিকদের রক্তের ঋণ কিছুটা যদি এতেই শোধ করা যায় খারাপ কিসে!
সবচেয়ে আনন্দের বিষয় আমাদের সাহিত্যকর্মি, ছোটকাগজকর্মি কিংবা দৈনিকগুলোর ভাষাপ্রীতি অত্যন্ত উঁচু দরের। অন্তত ভাষার মাস আসলেই নানা রকম সংখ্যা হয়, বিশেষ সংখ্যা হয়। এ সমস্ত আয়োজন আর কিছু করতো না পারুকÑ আমাদের মতো হুজুগে জাতিকে ভাবাতে সাহায্য করে, চর্চা করার সুযোগ উন্মেচিত করে, একটু পেছনের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য করে। আরো মজার ব্যাপার তরুণেরদের বৃহৎ একটি অংশ ভাষা নিয়ে চিন্তা করে, নতুন নতুন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে, নতুন নাটক বানাবার মাধ্যমে, ছবি আঁকার মাধ্যমে মায়ের ভাষাকে তুলে ধরতে চেষ্টা করে প্রাণপণে। নান নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তারা ভাষার অবদানকে বিশ^মঞ্চে উপস্থাপিত করছে নতুন ব্যঞ্জনায়। একটি নতুন চলচ্চিত্র যখন বিশ^মঞ্চে স্বীকৃতি পায়, একজন শিল্পী যখন বিদেশে থেকেও হাতের তুলিতে আঁকে নিজদেশের পাতাকার আদল, কেউ উড়ায় এভারেস্টে উড়ায় বাংলাদেশের পতাকাÑ তাও মায়ের ভাষায়, আমরা পেরেছি বলে, সত্যিই আনন্দিত হতে হয়। কে না জানে আজকে অর্জনের পেছনে আছে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার নিজস্বতা অর্জনের ইতিহাস। হয়তো উপরতলার মানুষদের কাছে মাতৃভাষা বাংলা উপেক্ষা করবার মতোন কিন্তু নিচুতলার মাটির মানুষেরা এখনো পায়ে যদি কোন বইয়ের ছেঁড়াপৃষ্টা পড়ে তো তিনবার কপালে-বুকে লাগায়, সালাম দেয়, প্রাণের প্রণতি জানায়। আদাব-সালামের জায়গায় প্রিয় ভাষাটি যতদিন থাকবে ততদিন কি এ-ভাষাটি হারিয়ে যেতে পারে?