সেলিনা হোসেন : বাংলাসাহিত্যের ধ্রুব নক্ষত্র





সেলিনা হোসেন
বাংলাসাহিত্যের ধ্রুব নক্ষত্র
রাহাত রাব্বানী

বাংলাসাহিত্যে যাঁরা অভিভাবকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন সেলিনা হোসেন তাঁদের একজন। সমৃদ্ধ লেখনী দিয়ে ঋণী করে রেখেছেন বাংলাসাহিত্যকে। বলা যায়, তাঁর সাহিত্যকর্ম এদেশের, সমাজের আয়না। তিনি তাঁর সময়কে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। যার কারণে ইতিহাস থেকে তিনি সরে দাঁড়াননি। বরং এই ইতিহাস তাঁর লেখক সত্তাকে নিপুণভাবে আলোড়িত করে সবসময়।

কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্প চর্চা শুরু করেন সেলিনা হোসেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ এবং ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’।১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায়।

ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার, সাহসের, শক্তির সবচেয়ে বড় অংশ। আর সেলিনা হোসেনের লেখনী এই বিষয়গুলোরই প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ বাংলার ইতিহাস আর সেলিনা হোসেনের সাহিত্যকর্ম একই মঞ্চে। ‘৪৭-এ দেশভাগের পর পাকিস্তানি হায়েনা শিবির আমাদের ভাষার ওপর থাবা বসায়। কিন্তু প্রতিবাদী বাঙালি তা মেনে নেয়নি। মাতৃভাষার সম্ভ্রম রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। এই আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতার সূচনাপর্ব। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সেই বিষয়টিই রূপকের আড়ালে তুলে ধরেছেন ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে। ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন তিনি স্বৈরশাসনের বিপক্ষের একজন।

একাত্তরে একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরে ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযান, অন্যদিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বন্দী নারীদের অকথ্য দৈহিক নির্যাতন ভোগের পাশাপাশি তাদের ফুঁসে ওঠা। বর্বর পাকিস্তানিদের মেরে তাদের অকুতোভয় আত্মদানের মর্মচেরা কাহিনী সেলিনা হোসেনের ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ উপন্যাসকে দিয়েছে ধ্রুপদী সাহিত্যকর্মের মর্যাদা।

সেলিনা হোসেনের লেখনীতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ উঠে এসেছে,উঠে এসেছে মানবিকতা। দেশে ও বিদেশের বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রচনা পাঠ্য।

মা-মেয়ের গভীর সম্পর্কের সফল উদাহরণ তাঁর ‘লারা’ উপন্যাস। উল্লেখ্য যে, ‘লারা’ উপন্যাসটি তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতির দিয়ে সাজানো। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে পোস্তগোলায় প্রশিক্ষণ বিমান দূর্ঘটনায় নিহত দুইজনের মধ্যে একজন ছিলো তাঁর প্রিয় কন্যা ২৬ বছর বয়সি বৈমানিক ফারিয়া লারা।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কর্ম নিয়েও সেলিনা হোসেনের সরব উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে অনুধাবন করা যায়, তাঁর অনুপ্রেরণার এক বড় অংশজুড়ে রবি ঠাকুরের বিচরণ।

গ্রন্থসংখ্যা হিসাবে তিনি শতাধিক গ্রন্থের সার্থক রচয়িতা। সাহিত্য সম্মাননা ও পুরস্কারের সংখ্যাও অনেক। ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০০৯ সালে একুশে পদক এবং  স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৮’র মাধ্যমে দেশসেরা তিনটি পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া পেয়েছেন ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার। শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে লাভ করেন আনন সাহিত্য পুরস্কার। ২০১০ সালে কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেন। শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে দু’বার অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়াও দেশে ও বিদেশে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন তিনি।

১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক নিযুক্ত হয়ে ২০০৪ সালে চাকরি জীবন থেকে অবসর নেন। কর্মময় এসময় তিনি বাংলা একাডেমি অভিধান, বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন’র প্রতিষ্ঠাতা।

১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন । বাংলাসাহিত্য আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র সেলিনা হোসেন। নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যের সাথে যাঁর নিবিড় অংশগ্রহণ এবং নবীনদের প্রেরণার অংশ। সদা হাসিখুশি প্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা। বাংলার আকাশে সেলিনা হোসেনের মতোন অভিভাবক আরো অনেক অনেক বছর খুব বেশি প্রয়োজন।

প্রিয় কথাশিল্পী, আপনি দীর্ঘজীবি হোন। আপনার আলোয় আলোকিত থাকুক আমাদের সোনার বাংলা।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট