উছল আর ঢেউতোলা কবিতার স্বার্থক কবি



উছল আর ঢেউতোলা কবিতার স্বার্থক কবি
ফরিদা ইয়াসমিন সুমি

মাহমুদ নোমান

ছন্দের বালাই নেই, গীতল শব্দের অববাহিকায় কিছু খুচরো চিত্রকল্প আর ফরফর বাতাসে ভাসানো নীল উড়নার মোহনিয়া উপমাতে ছোট্ট কবিতার ঘর  ফরিদা ইয়াসমিনের কবিতার বই ‘প্রজাপতি মন’
। যেন ভালবাসার নানা রঙ নিয়ে উড়াউড়ি করছে প্রজাপতি প্রতিটা কবিতার অক্ষরে অক্ষরে। মনে হয়েছে কোমরে উড়না বেঁধে আবেগের শার্টটি ধুয়ে, সযতনে কপালের ঘামবিন্দুটিও ঝেড়ে শুকাতে দিয়েছেন হালকা রোদে। প্রতিটি কবিতা পড়তে আঁচ লাগে এ রোদের-
তোমার বুকে টেনেছো বলে
হিমালয় আমায় টানে না
তোমার অরণ্যে হারিয়েছি বলে
আমাজনের পথে হাঁটি না
[তোমার মালিকানা পেয়েছি বলে ১১ পৃ ]
আধুনিক কবিতা মানে প্রচ্ছন্ন আড়াল থেকে মানে নেকাবের ভেতর থেকে কথা বলা। অর্থ্যাৎ এক সত্যকে অপর সত্যে প্রকাশ করার নাম পরাবাস্তবতা। ফরিদা ইয়াসমিন সুমির কবিতায় এ দিকটা অস্বীকার করে এটা বলবো না, হয়তো কবির এটা নিজস্বতা। এটাকে আমি শ্রদ্ধা করি। এখনতো এক কবি আরেক কবিকে অস্বীকার বা হেনস্থা করার মহারণে নামে। আমি ওদেরকে প্রশ্ন করি, কেন নামেন...?
হ্যাঁ, জানি উত্তর পাব না। কেন পাব না...? পাব না এ কারণে যে, অন্যকে অস্বীকার করা মানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার হৈ চৈ, এরা এক ধরণের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বটে । রবীন্দ্রনাথের একটা কথা স্মরণযোগ্য এ ব্যাপারে-

‘যিনি প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কবি হইয়াছেন তিনি সহজে কথার কবি, সহজ ভাবের কবি।’
ভাব, ভাবনা, চিন্তা, চেতনা, বক্তব্য ইত্যাদি জীবনসংলগ্ন বা জীবনঘনিষ্ট হতে পারে। শিল্পসাহিত্যে যে জীবনের কথা বলে তারই টিকে যাবার সম্ভাবনা, সে-ই আদৃত হতে পারে মানুষের কাছে। আর যে জীবনবিমুখ সে শুধু ছড়ায় তার উৎকট ভাবের দুর্গন্ধ। আমাকে সেটা কখনো টানে না, যদিও হয় মিলন কখনো না, ভাবের ধর্ষণ কেবল। তবে অনেকে তাতে সুখ খুঁজে পেলে পাক, তা ভাববার অবকাশও নেই।  ফরিদা ইয়াসমিন সুমীর কবিতা সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্ব। মনে হয় তিনি সবার জন্য কবিতা লিখলেন, কেন মনে হবে না...? ভালোবাসাই তো সার্বজনীন, সবার কাছে সমান আবদার। তাই ফরিদা ইয়াসমিন সুমী এ ভালোবাসার খোলস থেকে বেরুতে চান না সেটা না বলে বলবো ভালোবাসাতেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। তাই  ‘প্রজাপতি মন’ কাব্যগ্রন্থটি আপাদমস্তক একটি ভালোবাসাকে মলাটবন্দী করেছে। এ কাব্যগ্রন্থে ফরিদা ইয়াসমিন সুমী অন্ত্যমিলে পাঠককে সাথে নিয়ে কাব্য করার খায়েশে পাঠকের আত্মার খোরাক বা অংশগ্রহণ বিষয়টি জাগিয়ে দিয়েছে। যেমন ‘চলো ভিজি’ কবিতায় লিখলেন-
চলো ভিজি এই অবেলার তুমুল বৃষ্টিতে
প্রেম ধরি চলো দু’জোড়া প্রগাঢ় দৃষ্টিতে
সিঁথিতে সাজাই যতো নীল তারকার ফুল
চুলে বাঁধি কাজলকালো মেঘরাজির দুল
[চলো ভিজি; ১২ পৃ]


ফরিদা ইয়াসমিন সুমির কবিতা সহজাত, সাবলীলতায় স্বীকারযোগ্য এই বলে ঠেস্-গুঁতায় বলা যাবে না এসব কবিতায় নতুনত্ব নেই বা নিরীক্ষা নেই। হ্যাঁ, এটাই ঠিক এদিকে নিয়মমাফিক যাতায়াত না করে নিজস্ব বলয়ে কবিতাগুলোতে স্মার্ট শব্দগুচ্ছে  আলাদা টিউনিং, পাঠককে তৃপ্তিকর অনুভূতি দিতে পারঙ্গম। কেননা এখানে জটিলতা নেই, আন্তরিকতা আছে। আর গদ্যছন্দেও বেশ কয়েকটি কবিতা এই ‘প্রজাপতি মন’ কাব্যগ্রন্থের শৈল্পিক ওজন-উচ্চতার পরিমাপক। বিভিন্ন রুচির পাঠককে কাব্যিক রস্বাদনে ফরিদা ইয়াসমিন সুমির অনন্য মুন্সিগিরি। উছল আর ঢেউতোলার অপরূপ তাল- লয়ে পাঠককে দোলা দিয়ে যাবে ফরিদা ইয়াসমিন সুমির কবিতা, নিঃসন্দেহে-
ক. কান পেতে শোনো
বৃষ্টি ঝরার শব্দ
ভালোবেসে আজ
চলো হই নিস্তব্ধ
[বৃষ্টি ও প্রেম ৬১ পৃ ]
খ. সাগর ঘুরে নোনা হয়ে
আবার এসো তীরে
বুকের মায়া পাতাই রবে
শ্যামল দু’কূল ঘিরে।
[কোনো এক নদীকে ৫৯পৃ]
গ. খুব করে চাইছি,
আকাশে ভীষণ মেঘ জমুক আজ
মেঘের ফাঁকে রুপোলি বিদ্যুৎ চমকাক!
খুব করে চাইছি,
তুমুল ধারায় বৃষ্টি নামুক আজ
বানের তোড়ে খানাখন্দ ভরে যাক!
[খুব করে চাইছি; ৫৭ পৃ]
সত্যিই, ফরিদা ইয়াসমিন সুমির কবিতায় পাঠকের মনের খানাখন্দ ভরে যাক, ঘুচে যাক অপ্রাপ্তি। ভালোবাসায় ভরে যাক পৃথিবী ‘প্রজাপতি মন’ এ...


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট