সত্তা
রওনক নূর
বিয়ের দিনে মেয়েদের হাতের মেহেদীর রং তার স্বপ্নগুলো বুনতে থাকে। ছোট্ট থেকে যে স্বপ্ন নিয়ে একটু একটু করে একটি মেয়ে বড় হয়, সেই রঙিন স্বপ্নগুলো মেহেদীর রংকে আরো গাঢ় করে। কিন্তু রুচিকার চোখের জল তার হাতে আঁকা মেহেদীর স্বপ্নগুলোকে ধূসর করে দিচ্ছে। অথচ এই মেয়েটিই তার বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতো। খুব সাদামাঠা ভাবেই রুচিকার বিয়েটা হচ্ছে। বিয়েতে দুই পরিবারের লোক ছাড়া বাইরের কেউ নেই। এই বিয়েতে রুচিকার মত সবার মনেই কোন আনন্দ নেই। বিয়েটা শুধু রুচিকার বোনের সন্তানটার মুখের দিকে তাকিয়ে হচ্ছে, যে সন্তান আজ থেকে রুচিকাকে মা বলে ডাকবে। রুচিকার মা হওয়ার স্বপ্ন পূরন হলেও বোন হারানোর কষ্টে সব আনন্দ ফিকে হয়ে গেছে।
ছোটবেলা থেকে রুচিকা জানে ও কখনও মা হতে পারবেনা। কিন্তু ওর মনে মা হবার তীব্র আকাঙ্খা সেই বুঝতে শেখা থেকে। বড় বোন সন্তান সম্ভবা হওয়ার পর থেকে তার সব দায়িত্ব রুচিকার উপর ছিলো। সেই থেকে রুচিকা বড় বোনের বাসায়। বোন প্রায়ই রুচিকাকে বলতো আমি না থাকলে তুই আমার বাচ্চার মা হয়ে যাস। আজ বোনের মুখের সেই কথা সত্য হতে যাচ্ছে। বাচ্চা জন্মের সময় বোনের অনাকাঙ্খিত মৃত্যু আজ প্রত্যেকটা সম্পর্ককে বদলে দিচ্ছে।
বাসর ঘরে ঢুকতেই এহসান দেখলো রুচিকা বাবু সোনাকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। অনাকাঙ্খিত হলেও তার একমাত্র শ্যালিকা আজ থেকে তার বউ। যদিও সে চোখে কখনও দেখেনি সে রুচিকাকে। সন্তানের কথা চিন্তা করেই সে রুচিকাকে বিয়ে করেছে। রুচিকা অবশ্য এহসানকে ভাইয়া বলেই ডাকে। খুব কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। প্রতিটি মেয়ে বাসর রাতটা নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে, আর রুচিকার বাসর রাতটা কাটছে বোনের সন্তানকে বুকে নিয়ে। বিয়েটাতে অবশ্য এহসানের অনিচ্ছা থাকলেও রুচিকার ইচ্ছাটা ছিলো। কারন রুচিকা বাবু সোনার মা হতে চেয়েছিলো।
রুচিকা প্রথম দিন থেকে বাবু সোনার মা হয়ে গেছে। এহসান খুব অবাক হয় মেয়েটিকে দেখে । পৃথিবীর কারো বোঝার ক্ষমতা নেই যে রুচিকা বাবু সোনাকে জন্ম দেয়নি। সব সম্পর্কগুলোতে ও স্বাভাবিক থাকলেও এহসানের সাথে এখনও স্বাভাবিক হতে পারিনি। দু’জন মানুষ এক ছাদের নিচে, এক বিছানাতে শুধুমাত্র সন্তানের জন্য কাটিয়ে দিচ্ছে দিনের পর দিন। এহসানও কখনও স্বামীর অধিকার নিয়ে রুচিকার কাছে যায়নি। তবে স্বামীর অন্যান্য সকল দায়িত্ব পালন করতে এহসান সবসময় রুচিকার পাশে থাকে।
রুচিকার সমস্ত কিছু জুড়ে শুধু বাবু সোনা। বাবু সোনা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। আধো আধো মুখে বুলি ফুটছে। তার মুখের প্রথম শব্দটা ছিলো মা। যেদিন প্রথম বাবু সোনা মা বলে ডেকেছিলো সেদিন রুচিকা চিৎকার করে কেঁদেছিলো। তার আনন্দের অশ্রু দেখে এহসানও গোপনে চোখের জল ফেলেছিলো। মা হওয়ার এত তীব্র আকাঙ্খাই মেয়েদেরকে সব রকম সেক্রিফাইস করতে সাহায্য করে।
রুচিকার মা এসেছে ওদের বাসায়। উনি বুঝতে পেরেছেন যে এহসান আর রুচিকা এখনও স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে নেই। বিকালে এহসান আর রুচিকার মা রুচিকাকে বুঝালো যে তাদের সন্তানের জন্য হলেও স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ক তাদের মধ্যে গড়তে হবে। রুচিকা কিছু না বলে চোখ দিয়ে শুধু অশ্রু ঝরালো। শুধু বাবু সোনাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে সে। তার কোন স্বপ্নে এখনও এহসান নেই। শুধুমাত্র মা হবার তাড়নাতে সে এসহানকে স্বামী হিসাবে গ্রহন করেছে। কিন্তু এহসানের কথা যে সে ভাবেনা সেটাও নয়। সে এহসানকে শ্রদ্ধা করে। যে সম্মান তাকে এহসান দিয়েছে তা হয়ত আর কেউ তাকে দিতোনা।
বাবু সোনার হঠাৎ জ্বর আসাতে রুচিকা খুব উদ্বিগ্ন । সারাটা দিন কিছু মুখে নিলোনা সে। মধ্যরাতে এহসানের ঘুম ভাঙাতে সে অবাক হয়ে দেখলো রুচিকা জেগে আছে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বাবু সোনার দিকে। এহসান প্রথম বারের মত রুচিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘কিচ্ছু হবেনা আমাদের কলিজার টুকরার, ও খুব ভালো থাকবে। তুমি ভয় পেওনা।’ এহসানের কথা শুনে রুচিকা কাঁদতে লাগলো। আজ প্রথমবার এহসানকে তার নিজের স্বামী মনে হচ্ছে। খুব নির্ভর করতে ইচ্ছে করছে।
আজ বিয়ের দুই বছর হল রুচিকা আর এহসানের। কিন্তু এহসানের কাছে দিনটি অন্যান্য দিনের মত সাধারন একটি দিন। বাসায় ফেরার সময় কিছু না ভেবেই রুচিকার জন্য এক ডজন কাচের চুড়ি কিনে আনলো এহসান। বাসায় ঢুকেই সে অন্য এক রুচিকাকে দেখতে পেলো। খুব সেজেছে আজ মেয়েটা। সবুজ শাড়ীতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে। কপালে লাল রঙের টিপ ওর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে আরও বহু গুন। আজ রুচিকাকে সত্যিই বউ বউ লাগছে এহসানের কাছে। ঘরে ঢুকতেই রুচিকা এহসানকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আজ থেকে আমি আমার সন্তানের বাবার সত্যিকারের স্ত্রী হতে চাই।’ এহসান কোন কিছু না বলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার সন্তানের মাকে। দুজন দুজনের এতটা কাছে যায় যেখান থেকে একজন আরেকজনকে খুব আপন ভাবে অনুভব করা যায়।