ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ০৫



রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

(গত সংখ্যার পর)
 ওসি সাহেব আমাদের কারো কথায় কান দেন না। উল্টো আরো বলেন, এ কাজ যারাই করেছে, আমি বলবো, উত্তম কাজটিই করেছে। আপনাদেরকেও বলি, ডাকাত যদি হাতে-নাতে পান তো ওটাকে পিষে মেরে ফেলেন। একটা মার্ডার কেস নিবো, এটা সত্য কথা এবং এক মাসের মধ্যে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে চলে আসবো। গ্যারান্টি আমার। আমি যদি গ্যারান্টার হই, তবে আপনাদের কোনো ভয় আছে? যদি ডাকাত হাতে-নাতে ধরতে পারেন, এলাকার লোকজনকে মসজিদের মাইকে ডেকে এনে ওকে পিষে মেরে ফেলবেন।
ওসি সাহেবের মুখ থেকে যখন এসব কথা বের হয়, তখন আমার কাছে মনে হলো কেউ বুঝি আকাশের মাথায় ঠাস করে একটা বাড়ি মেরেছে। তা নাহলে এতবড় একটা শব্দ হলো কেনো। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশের অবস্থা ভালো নয়। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। তখন অনেককিছুই ধুয়ে-মুছে যাবার জোর সম্ভাবনা। তখন আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। বললাম, ওসি সাহেব, আপনার কথা মানলাম, সেটা তো কোনো ডাকাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এই ছেলে তো ডাকাত ছিলো না। সে ছিলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। ভালো ক্রিকেটও খেলতো। তাকে হত্যা করা হয়েছে, কে যে কাজটি করেছে এবং কেনো এ-কাজটি করেছে, তাও আমাদের জানা। বৃষ্টি নামার আগেই যতো দ্রুত সম্ভব আপনি লাশের সুরত-হালের ব্যবস্থা করুন এবং আশা করছি, আপনি আমাদেরকে সঠিক রিপোর্টটাই প্রদান করবেন।
ওসি সাহেব তখন পকেট থেকে গোল্ডলিফ সিগারেটের প্যাকেট বের করে এবং একটা সিগারেটের মুখে আগুন জ্বালিয়ে গভীর আবেশে টানতে থাকে। তাঁর টানার ধরন দেখে আমরা যারা মরণ-ব্যাধি ক্যান্সারের ভয়ে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলাম, আমাদেরও আফসোস বেড়ে যায়। আহা! কী করলাম। সিগারেটের শাদা ধোঁয়া বাতাসে উড়তে উড়তে মিশে যায়, সে-দৃশ্য আমরা পলকহীন চোখে তাকিয়ে উপভোগ করি।
একসময় তিনি মুখ খোলেন। 
এটা যে বাম হাতের কাজ, বুঝলেন কীভাবে? কাটা তো কাটাই। এতে আবার বাম-ডানের কী সম্পর্ক?
তখন কানা ফালুর মেজো ছেলে কামাল লম্বা একটা রাম-দা নিয়ে আসে। এসেই সকলের সামনে সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ডাস্টবিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলা গাছটায় পরপর দুটো কোপ দেয়। একটা ডান হাতে অন্যটা বাম হাতে। কোপ দিয়ে পুলিশকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করে বাম-ডানের পার্থক্য। ঠিক তখনই এক পুলিশ কনস্টেবল তার হাত থেকে দা’টা এক প্রকার কেড়ে নিয়ে ডান হাতে কলা গাছের বাম পাজরে এক কোপ দিয়ে উল্টো বুঝিয়ে দেয় যে, ডান হাতেও বাম হাতের কাজটা করা যায়। অতএব প্রমাণিত হয় না, এটা এমপি মহোদয়ের ভাতিজা মকবুলের কাজ।
লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। রিপোর্ট আসে। রিপোর্টে বাম-ডানের কোনো চিহ্ন থাকে না। আমরাও জানি, রিপোর্টে এসব লেখা থাকে না।
পোস্ট-মর্টেম শেষে লাশ এনে গোর-কাফনের সমাধান করে যখন ঘরে এসে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিই, তখনই শুনি থানা থেকে পুলিশ এসেছে। মোয়াজ্জেম হোসেন মামলা করবে কিনা জানতে চায়। কাকে কাকে সন্দেহ হয়—নাম চায়। তখন একবার ইচ্ছে হয়েছিলো, এমপি মহোদয়ের ভাতিজা মকবুল আহমেদ ওরফে বাওয়া মকবুল, তার সহযোগি শাহিনুল ইসলাম ওরফে ঠেরা শাহিন এবং ঠেরা শাহিনের শালা কাদের। এই তিনটি নাম উল্লেখ করে মোয়াজ্জেম হোসেনকে দিয়ে একটি মামলা দায়ের করে দিই, ঠিক তখনই বুঝতে পারি পুলিশ কোনো কাজ পাচ্ছে না এবং এজন্যে উপর থেকে চাপ আসছে তাদের প্রতি। কাজ দেখাতে হবে। কাজ না করলে আয়ের উৎস সৃষ্টি হবে কীভাবে? পুলিশই বা বেতন পাবে কোত্থেকে? সুতরাং মামলা করতে হবে। মামলা করলেই পুলিশ কাজ পাবে। টাকায় টাকা আনার মতো কাজও কাজ টেনে আনে। এখন যদি মোয়াজ্জেম হোসেনকে যাকে যাকে সন্দেহ হয়, তাদের নাম দিয়ে মামলা দায়ের করার জন্যে পরামর্শ দিই, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে কয়েক হাজার টাকা দিতে হবে। তাহলে পুলিশ তাদের কায়দা মতো মামলাটাকে সাজাবে। তিন জনের জায়গায় দশ জনের নাম ঢুকিয়ে দেবে। সে-সাথে কয়েকটা অজ্ঞাত নামও থাকবে। উপরের চাপে চার্জশিট থেকে মূল আসামিদের নাম কেটে দিলেও বাকি সাতজনের নাম থেকে যাবে। সে-সাতজনের নাম ধরে সাতটি পরিবারকে মহল্লা ছাড়া করবে। এতেও যদি তাদের কাজ হাসিল না হয়, তখন অজ্ঞাত নাম ধরে ঢালাওভাবে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাবে। তখন দেখা যাবে কাজের শতমুখ বেরিয়ে আসছে তাদের সামনে।
মোয়াজ্জেম হোসেন আপনি বলুন, কাকে কাকে আপনার সন্দেহ হয়। শালার বানচুতের বাচ্চারা দেশটারে শেষ কইরা দিলো। আপনি শুধু নামগুলো বলুন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এইসব বানচুতের বাচ্চাদেরকে ধরে থানায় নিয়ে এমন প্যাদানি দিমু না। টাকার জোরে বেরিয়ে এলেও সারাজীবন আঁতুর-ল্যাংড়া হয়ে বাঁচতে হবে। হাতে সময় নেই, আপনি তাড়াতাড়ি করুন।
পুলিশের তাগিদ দেখে মোয়াজ্জেম হোসেন কী করবে কোনো বুদ্ধি না পেয়ে আমাদের দিকে তাকায়। আমরা তখন সাফ বলে দিই, কিছুই করার দরকার নেই। যা হবার হয়েছে। এখন পায়ের দড়ি শিঙে লাগাতে যেয়ো না। তখন পা-শিঙ দুটোই ভেঙে আঁতুর হবার যোগাড় হবে। আমাদের এমন পরামর্শ শুনে মোয়াজ্জেম হোসেন অবুঝ শিশুর মতো চেয়ে থাকে। এতে পুলিশ কী ভেবেছে, জানি না। তবে আর কোনো বাড়তি কথা না বলে হাতের রোল ঘোরাতে ঘোরাতে গাড়িতে উঠে চলে যায়। পুলিশ চলে গেলে আমরাও যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তারপর আবার যথারীতি সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যার হাত ধরে রাত। এ-রাত আমাদের কাছে কালীমূর্তির মতো মনে হয় না। মনে হয় কালী তাঁর রূপ বদলে ঘুমের মায়াবী দেবী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তাঁর কোলে লুকোনো আছে সাত রাজ্যের ঘুম আর শান্তির পরশ। রাতের খাবার খেতে না খেতে কোনো রকম বড়ি ছাড়াই চোখদুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু করতে থাকে। তখন কী আর করা। বাবুর হাটের সিল মারা বিছানার চাদরটা একটা খ্যাচকা ঝাড়া দিয়ে শুয়ে পড়ি এবং দীর্ঘ লোডশেডিং আর গ্রীষ্মের প্রচ- ভ্যাপ্সা গরমের ভেতরও উত্তপ্ত প্রেসার কোকারের মাংসের মতো সিদ্ধ হতে হতে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুমের ভেতর নাক ডাকতে ডাকতে দেহ ছিঁড়ে উড়ে যাই শূন্যের সব রহস্য ভেদ করে। উড়তে উড়তে দেখি আমার সাথে মহল্লার আরো বেশ কজন। তারপর সবাই উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে বেখেয়ালে ঢুকে পড়ি এক স্বর্গীয় দেশে। সেখানে গিয়ে দেখি মা মনসা। ফটকের সামনে দাঁড়ানোর ভাব দেখে মনে হলো তিনি যেনো আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন।
ধর্ম আর যাই হোক দেবী বলে কথা, হাতজোড় করে নমস্কার না জানিয়ে উপায় আছে?
জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে নমষ্কার জানালাম। তিনি খুশি হয়ে হাত ইশারায় বৈঠকখানায় বসার অনুমতি দিলেন।  বৈঠকখানার ভেতরে দেয়ালে অঙ্কিত পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপের চিত্রপট দেখে শরীরটা এক অজানা আতঙ্কে রি রি করতে লাগলো। তারপরও সরীসৃপগুলোর দেহে শিল্পীর তুলির দক্ষতা দেখে চোখ ফেরাতে পারছি না। একটা সাপকে দেখা যাচ্ছে, টিয়া রঙের। ক্যাপশনে লেখা ওয়েস্টার্ন গ্রিন মাম্বা বা এটি ওয়েস্ট আফ্রিকান গ্রিন মাম্বাব বা হ্যালোয়েলস গ্রিন মাম্বা নামেও পরিচিতি। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ। আরেকটাকে দেখা যাচ্ছে ব্রাউন কালারের। এটাকে নাকি ওয়েস্টার্ন ব্রাউন ¯েœক বলে। এটি সুডোনাজা নুচালিস বা গোয়ার্দার নামেও পরিচিত। আরেকটার নাম ব্লাক মাম্বা, আফ্রিকার সবচেয়ে আতঙ্কের নাম। ইন্ডিয়ান কিং কোবরা, এ সাপটা কুচকুচে কালো। টাইগার ¯েœক। নাম দেখে মনে হচ্ছিলো, বাঙালি সাপ বুঝি। পরে ক্যাপশনে তাকিয়ে দেখি ওটা অস্ট্রেলিয়ান। এভাবে এচিস, রাসেল্স ভাইপার, আইল্যাশ ভাইপার, পাফ এ্যাডার, ডেথ এ্যাডার, র‌্যাটল ¯েœক, ফিলিফাইন কোবরা, ফণি মনসা, গোখরো ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য সাপের চিত্রপট দেখতে দেখতে যখন মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে ছিলাম, তখনই দেখি দেবী মনসা বাঙালি নারীর চিরাচরিত মাতৃরূপ ধারণ করে তাঁর নির্ধারিত পদ্মাসনে বসে রহস্যময় হাসছেন।
আমরা তাঁর দিকে ফিরতেই তিনি বলতে লাগলেন, এ চিত্রপটগুলো বিভিন্ন দেশে দায়িত্বরত আমার প্রতিনিধিদের।
ছবিগুলো বেশ সুন্দর।
মিথ্যে বলছো কেনো? তোমাদের মুখ তো দেখছি ভয়ে পা-র হয়ে গেছে। ভয় পেও না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের চেয়ে বাঙালির বিষ শতগুণ বেশি বিষাক্ত। আমাদের ছোবলে যদি মরে একজন, সেখানে তোমরা ফণা তুলে তাকালেই ঘর-গোষ্ঠী মুহূর্তে বিনাস। এবার তোমরাই বলো কার বিষ বেশি।
এভাবে বলবেন না মা। আপনাদের হাতে জীবন-মরণ। আমরা আপনাদের ভক্ত। দাস। আপনাদের সামনে ফণা তুলে দাঁড়াবো; মা, এমন অপবাদ দিয়ে আমাদের নরকবাসী করবেন না।
খাজুইরা আলাপ তো ভালোই শিখেছো দেখছি। যাক এসব। কাজের কথায় এসো। বলো, কী চাও তোমরা? কেনো এতো বিট্টামি করো? যে কাজেই হাত দিই সেখানেই বাগড়া মারো। এতে তোমাদের কী লাভ হচ্ছে, শুনি? ঘরে ঘরে বেকারের সমাবেশ বানিয়ে রেখেছো। তার চেয়ে আমাদের কথা শুন। আমার এবং আমার বাবার একান্ত পূজক হও। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে। চাকরি-বাকরি থেকে শুরু করে যা চাও, সব পাবে। তোমরা স্বীকার না করলেও আমি জানি, বাবা তোমাদের ভালোবাসেন। তোমরা যাতে ভালোভাবে আলো-বাতাস খেয়ে বাঁচতে পারো, সেজন্যে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয়, নাতিশীতুষ্ণ এবং ফলবতী জায়গাটা তোমাদের উপহার দিয়েছেন। যে কারণে তোমরা এখনো বেঁচে আছো। তা না হলে অসুর গোষ্ঠী তোমাদের কী অবস্থা করতো, একবার কল্পনা করতে পারো?
মনে মনে বলি, সুরাসুর উভয়ই ভগবানের কাছের লোক। ক্ষমতার মাঠে একজন সুর অন্যজন অসুর। আর আমরা হচ্ছি খেলার সামগ্রী। ক্ষমতার মাঠের ফুটবল। যে যতো জোরে এবং কৌশলে শর্ট মারতে পারে, আমরা ততোই তার আনুগত্য করি। মাঝে-মধ্যে ফেটে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ি, তারপরও আনুগত্যের কমতি দিই না। একজন ফেলনা হয়ে গেলে অন্যজন গিয়ে হাজির...
প্রকাশ্যে বলি, ঠিকই বলছেন মা। আপনারা আছেন বলেই পৃথিবীতে এখনো সূর্য উঠে। বাতাস বয়। ঋতুবর্তী জমিনে খাবার জুটে।
আমাদের কথাগুলো একটু খেজুরে হলেও সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। ভ্রুতে অহংকারের বাঁক তুলে গ্রিবা উঁচিয়ে অপেক্ষাকৃত শীতল ভাষায় বলতে লাগলেন, ‘আরো পাবে। যদি আমাদের কথা শুনো। আমরা যা করি, তাতেই বিনা বাক্যে সাই দিয়ে যাবে।’
তখন কীভাবে যেনো একটু সাহস পেলাম মনে। বললাম, মা, আপনিও আমাদেরকে দুটো কথা রাখুন।
কও।
মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার দিন। আমাদের দুহাতে দশটি আঙুল আছে, প্রতিটি আঙুলের কর্মও পৃথক পৃথক। আপনি আঙুলের অধিকারগুলো ফিরিয়ে দিন।
আমাদের কথা শুনলে সব পাবে। আকাশ ভর্তি রোদ। কিস্তিতে কিস্তিতে বৃষ্টি। এমন কি যে নরক যন্ত্রণায় জীবন-যাপন করে আসছো, তা থেকেও সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পাবে।
(চলবে)


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট