বউ



 বউ
জাহিদ হোসেন

জানিস আমার বউটা না সুন্দর করে হাসে। তোর ভাবীর সে হাসিতে আমি প্রাণ ফিরে পাই। উৎসাহ আর উদ্দিপনায় মনটা ভরে ওঠে। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো পথিক। ওরা তিন বন্ধু প্রাইমারী লেবেল থেকে কলেজ জীবন,এমনকি কর্মজীবন পযর্ন্ত একসাথে পথচলা । একসাথে একই ক্লাসে পড়া,একসাথে টিফিন, খেলাধুলা এমনকি এক রুমাল ব্যবহার পযর্ন্ত। ছোটবেলা থেকেই একে অপরের সুখ-দুঃখগুলো ভাগাভাগি করে নিত।
    পথিকের কথা শুনে পান্থর মন খারাপ হয়ে যায়। তার বউ সুন্দর করে হাসে না। সোহাগ ভরে আদরও করে না। দিনরাত শুধু খ্যাচর  খ্যাচর। সব সময় তার মেজাজটা যেন তিরিক্ষি হয়ে থাকে।  এই তো সেদিন পান্থ বাইরে থেকে এলে বউয়ের সুন্দর হাসি তো  দূরের কথা বরং কড়মড় করে বাজারের লিষ্টিটা হাতে ধরিয়ে বললো- ‘কোথায় ছিলে এতক্ষন ! গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। এই ধরো বাজারের লিষ্টি। লিষ্টি দেখে দেখে সবগুলো ঠিক ঠিক নেবে আর একটা ডাব ক্রিম নিতে ভুলোনা যেন।’ বাসায় কাজের লোক নেই। অনেক কষ্টে পান্থ গতবছর একটি কাজের ছেলে যোগাড় করেছিলো। সে ছেলেটিও এক মাস যেতে না যেতেই বাজার খরচের টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথার খুনসুটি চলতেই থাকে দিনের পর দিন। সংসারে অশান্তি বিরাজ করে।
সেবা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে- ‘এত কাজ আমি একা করতে পারবো না। হয় কাজের লোক আনো নয়তো হোটেল থেকে খাবার এনে খাও।’ এ নিয়ে কয়েক দফা সেবার সাথে ঝগড়াও হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীতে কয়েকদিন কথাও বন্ধ। মাঝে মাঝেই এরকম  ছোট-খাট ব্যাপার নিয়ে বাক-বিদন্ডতা লেগেই থাকতো।
গভীর চিন্তায় পড়ে যায় পান্থ। সিগারেটের পর সিগারেট শেষ করে, কিন্ত কোন উপায় খুঁজে পায় না। এ বিষয়ে পথিক আর পঙ্কোজের সাথে পরামর্শ করতে হবে। কিন্তু ওদেরকে সন্ধ্যার পর ছাড়া পাওয়া যাবে না। এখন সবেমাত্র তিনটা পনেরো। ছোটবেলায় একবার জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছিল। জ্যোতিষী বলেছিলো- ‘হাতের রেখায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার একাধিক বউ হবে।’ সেই কিশোর বেলায় জ্যোতিষীর কথা শুনে বন্ধুরা তো হেসেই খুন। পান্থ আরেকবার হাতটা পরীক্ষা করাবে। তার বাম হাতটা উল্টে পাল্টে দেখলো সে। সেই সময় জ্যোতিষী ব্যাটা কী দেখতে কী দেখেছে তার বোধগম্য হয়নি। হয়তো দ্বিতীয় বিয়ের রেখাটি এখনও মুছে যায়নি। আজ পথিক আর পঙ্কোজের সাথে দেখা করে জ্যোতিষীর ব্যাপারটা ফাইনাল করবে। কিন্তু সময় তো যাচ্ছে না । অগ্রহায়ণ মাস হলেও পান্থ বারবার কপালের ঘাম মুছছে। বাম হাতটি পকেট থেকে বের করে আবার দেখে। এই মধ্যমাকে পাশ কেটে তর্জনির দিকে এগুচ্ছে দু’ভাগ হয়ে, এই রেখাটিই হবে হয়তো। পান্থ দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় এ হাত দিয়ে আর কোন কাজ করবে না সে, পাছে যদি দ্বিতীয় বিয়ের রেখাটি মুছে যায়। হাতটি আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। এরকম আরো অনেক অগোছালো ভাবনা ভাবতে ভাবতে পান্থ যখন অফিস থেকে বের হলো তখন সূর্যটা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। লাল সিগন্যাল দেখিয়ে বিদায়ের আয়োজন মাত্র। দ্বিতীয় বিয়ের ভাবনাটা তার মনে আকুলি বিকুলি করে। নতুন একটা বউ হবে, হলে মন্দ হয় না। অফিস থেকে ফিরলে পথিকের বউয়ের মতো সুন্দর করে হাসবে, সেবা-যতœ করবে। গভীরভাবে আদর সোহাগ করবে। পান্থ সে আদরে প্রাণ ফিরে পাবে। প্রবল উৎসাহ আর উদ্দিপনায় তার মনটা বাবুই পাখির মতো নেচে নেচে ওঠে। আহ্! কী শান্তি। মনের আনন্দে গুনগুনিয়ে গানও গাইতে থাকে- ‘আহা কি আনন্দ, আকাশে বাতাসে।’
বন্ধু পথিককে হাত দেখিয়ে ব্যাপারটা নিশ্চিত হলো পান্থ। শুনেছি ফিবছর হাতের রেখা নাকি বদল হয়। পরদিন অফিস শেষ করে পান্থকে নিয়ে পথিক জ্যোতিষীর কাছে গেল। ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী জ্যোতিষী সাহেব ভীষণ ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পান্থর হাতটি মিনিট পাঁচেক পরীক্ষা করে বললেন- ‘হাতের রেখায় ষ্পষ্ট দ্বিতীয় বিয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।’ একথা শুনে ভরা যৌবনা নদীর মতো পান্থ খুশিতে খলখল করে নেচে উঠলো। সে আরেকটা বিয়ে করবে। অফিস থেকে ফিরলে নতুন বউ সুন্দর করে হাসবে। ভাত বেড়ে দিয়ে তালপাখার বাতাস করবে। সেবা-যতেœরও কমতি নেই। ভাবতেই মনটা পুলকিত হয়ে ওঠে। গুনগুন করে মনের আনন্দে গান ধরে- ‘ছাইয়্যা দীলমে আনারে.....মোকো লেকে জানারে.....।’

সেবার চটাং চটাং কথা পান্থ’র গায়ে বিষ মাখানো তীরের মতো হানে। স্বামীর মন মেজাজ ভালো নেই জেনেও কাছে এসে বলে- ‘তোমার কী হয়েছে গো, সারাক্ষণ কী এত ভাবো।’ পান্থ বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে- ‘কানের কাছে গ্যাজর গ্যাজর করিস না তো, ভালো লাগে না।’
ধীরে ধীরে স্বামী-স্ত্রীতে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ক’দিন যেতে না যেতেই সেবার অনুমতি না নিয়েই পান্থ বিয়ে করে ফেলে। নতুন বউ পেয়ে তার আনন্দের সীমা নাই। চারদিকে কুসুম কুসুম নিস্তব্ধতা।  বাসর ঘরেও গুনগুন করে গান গাইতে থাকে- ‘এই রাত তোমার আমার, এই ক্ষণ তোমার আমার, শুধু দু’জনে....।’
সেবা মনের দুঃখে কাঁদে আর বিড়বিড় করে বলে- ‘দেখবো এই ভালোবাসা কতদিন থাকে।’ কিন্তু সে কান্নার করুণ আকুতি তাদের এতটুকু বিচলিত করে না।
পান্থ’র স্বপ্ন আজ সার্থক। পৃথিবীর সব চাওয়া পাওয়া আজ তার হাতের মুঠোয়। অনেকদিন পর আনন্দের একটি রাত কাটাবে। সে নতুন বউ পেয়ে আনন্দে গদগদ। নতুন বউয়ের মিষ্টি হাসি দেখবে। যথারীতি বাসর ঘরে বউয়ের ঘোমটা তুলেই দেখলো নতুন বউয়ের হাসি। সে হাসিতে কদুর বিচির মতো দু’চারটি দাঁত ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট