নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে


নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে   
ইজাজ আহমেদ মিলন

আশিক আহমেদ

কৈশোরে সেই ছড়া লেখার মাধ্যমে যার সাহিত্য চর্চা শুরু। এখনো পর্যন্ত তার লেখায় ছেদ ঘটেনি। আজো ক্লান্তহীন লিখে যাচ্ছেন এই মানুষটি। 
প্রতি নিয়তই করে যাচ্ছে স্বপ্নের চাষাবাদ।
স্বপ্নবাজ একজন মানুষ।
সত্য ও সুন্দরের উপাসক কবি ইজাজ আহমেদ মিলন।

যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং অন্যকে স্বপ্ন দেখান। মৃত ছায়া শূন্যমাঠ আর শুদ্ধতার অন্ধ জলে যার স্বপ্নের বসবাস।
এরকম স্বপ্নবাজ মানুষ সমাজে ক’জনই বা আছে।  হাতে গুনা হয়তো দু’চার জন এর চেয়ে বেশী নয়। সবাই স্বপ্ন দেখতে জানে কিন্তু দেখাতে জানে না ইজাজ  আহমেদ মিলন এর ব্যাতিক্রম। কারন তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখার  উৎসাহ যোগান।

তিনি জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন সমুদ্রের অনেক জ্বল সেচেছেন।
অনাহারে কাটিয়েছে  তার দুরন্ত বৈশাখের  ছন্দহীন দিন।  কৈশোরে মাওনা বাজারে বেগুনের ডোল ভরে দিত বিনিময়ে দশ টাকা মায়নে.. তা দিয়েই মা’র পান সুপারি কিনে আনতো। আর বাবার অসুখের জন্য গামছায় মুখ বেধে রিকশা চালিয়ে বাবার জন্য ওষুধ। চাচাদের সাথে যুক্ত হয়ে ঢাকা শহরে রিক্সা চালিয়ে  দু-এক কেজি চাল, ডাল কিনে বাড়িতে ফিরতো এভাবেই চলত তাঁর অভাবের  সংসার।

তাঁর সবচেয়ে যে পথে বেশী চলতে হয়েছে, সেটার মধ্যই থরে থরে বিছানো ছিলো কাটা।  পথের সে কাটা  দু-হাতে একটা একটা উঠিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করেছে।
আধারে পথ ভুলে অকারণে অনেক পথ ঘুরেছে কেউ বাধা দেয়নি তাঁর সামান্য মঙ্গল হবে বলে।  জীবনটা’ই হয়তো পাল্টে যেতো যদি কেউ তাকে  বাধা দিয়ে পথ দেখাতো  গন্তব্যর দিকে। কেউ চায়নি সে গন্তব্যে পৌঁছাক।

পা-ুলিপির ওপর একদিন তাঁর সুদৃষ্টি  পড়েছিলো অবশেষে প্রয়াস পেয়েছিলো বই প্রকাশের।

গন্তব্যর খোঁজে/লাশের গন্ধ/ আমার ও কিছু কষ্ট আছে/ শিশির ভেজা সকাল দিও/ নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে/  মৃত্যুর ও মৃত্যুর আছে/ স্বাধীনতা তুমি কার/ প্রিয়ার খোঁজে/ কবিতার পান্ডুলিপি আজ অগ্নিদগ্ধ /এরকম এক গুচ্ছ ৬৪ টি কবিতা নিয়ে ।

‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ। সত্য ও সুন্দরের উপাসক প্রেম ও দোহের কবি ইজাজ আহমেদ মিলন নিজস্ব   শৈলীর আবহে  সমৃদ্ধ করেন তার সাহিত্য  ভুবন। তার কবিতার পঙ্খিত জুড়ে রূপ বাস্তবতাই বেশি। রূপকের অন্তরালে তিনি বিচিত্র নানা ছন্দময় ভঙ্গিমায়  চারপাশের দারিদ্র আর কুসংস্কারে বেড়ে ওঠা চিত্র নিখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেন। প্রেম ভালোবাসাও তাঁর লেখায় উপেক্ষিত নয়। অসহায় দেবতা জ্ঞান  করে মস্তক অবনিত করেছেন তিনি।  আবার দেশ দরদীর লেবাসে দেশদোহীদের করেছেন তুলোধুনো। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের  কতৃর্ত্ব প্রবল ভাবে পীড়া দেয় তাঁকে।
নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে গ্রন্থটিতে প্রকাশিত অধিকাংশ কবিতাই দেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোতে  প্রকাশিত হয়েছে।


একুশ আসছে। আসছে একুশে বই মেলা। আর  বইমেলার টানে সারাদেশ থেকে তরতাজা কবিতার বই নিয়ে ছুটে আসছে তরুণ কবির দল। একুশে বইমেলা বাংলাদেশের নবীন কবিদের জন্য আতœপ্রকাশের রণক্ষেত্র। এখানে যারা আসে তারা কেউ শূন্য হাতে ঘরে ফেরেনা। একুশ কম বেশী তাদের সবারই  স্বপ্নপুরণ করে। ‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ বইয়ের  বাম পাশের ফ্ল্যাপে এমনটায় লিখে ছিলেন বাংলাভাষার অন্যতম আধুনিক কবি নির্মলেন্দু গুণ  (২০০৯)। সতিই শূন্যহাতে ঘরে ফেরেনি ইজাজ আহমেদ মিলন। একুশ তার স্বপ্ন পূরণ করছে ।

‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ তাঁর প্রথম কাব্য গন্থ (২০০৯) প্রকাশের পর চারদিকে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গ্রন্থটি তাঁকে সফলতার শৈলচূড়ায় নিয়ে যেতে খুব বেশী সময় নেয়নি। এই  কাব্য গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম  (চ্যানেল আই) এবং সিটি ব্যাংক প্রর্বতিত সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরষ্কার (২০০৯) ও একই মঞ্চে পুরস্কার লাভ করনে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সব্যসাচী  সৈয়দ শামসুল হক, কবি  নির্মলেন্দু গুণ,  অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ও কবি হালিম আজাদ। চ্যানেল আইয়ে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠান।

 বাংলাদেশে হাতেগনা কয়েকটি দামি পুরস্কারের মধ্যে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার অন্যতম। পুরস্কার প্রাপ্তিটা তাকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। যাদের সাথে সে পুরস্কার পেয়েছিলো তারা প্রত্যেকেই এক একটি নক্ষত্র। বুদ্ধিজীব সেইদিনের  অনুভূতি সে আজও প্রকাশ করতে পারিনি। তার অভিধানে সেটা প্রকাশের কোন শব্দ বা বাক্য নেই। তবে পুরস্কার প্রদান মঞ্চে বলেছিলেন  ( আবেগাপ্লুত হয়ে) মনে হচ্ছে আমি নোবেল পুরস্কার পেলাম। তার এই বক্তব্যের সাথে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার দ্বিমত করে বলেছিলেন, অপেক্ষা করো আরো বড় কিছু পাবে। তখন এটাকে আর নোবেলের মতো মনে হবে না।


হ্যা, সত্যিই বলেছিলেন আবু সায়ীদ স্যার । বরেণ্য  সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন - ইজাজ এর হাত বেশ শক্তিশালী এবং তিনি একদিন বড় কবি হবেন, যদি তাঁর সাধনায় ছেদ না ঘটে। এর পর প্রবীণ রাজনৈতিক মো: রহমত আলীর পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনী নিয়ে কালের আয়নায় এড.রহমত আলী রচনা করে ব্যাপক সারা ফেলেন। কবি নির্মলেন্দ গুণ গ্রন্থটি প্রসঙ্গে লিখেছেন এড. রহমত আলীর অর্ধ শতাব্দী -ব্যাপ্ত  রাজনৈতিক জীবনে এমন ও অনেক অজানা অধ্যায় ইজাজ আহমেদ মিলন রচিত। এই গ্রন্থটিতে বর্ণিত হয়েছে যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় গবেষক কাজে লাগবে। শব্দের কারিগর ইজাজ আহমেদ মিলনকে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, ইজাজের মতো তরুণ কবিই শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে যান।
ইজাজের দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ বের হয় ২০১২ সালে গ্রন্থটি পাঠ করে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক  প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন ‘তুমি পদ্য বাদ দিয়ে গদ্য লিখো, অনেক ভালো করবে। হুমায়ুন আহমেদর প্রেরনায় প্রখর জীবনবোধের গল্পনিয়ে প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘ছাতিম গাছের মিত ছায়া’  এ গ্রন্থ সম্পর্কে আবদুল  গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন,  এ প্রর্জমের শক্তিমান লেখক ইজাজ আহমেদ মিলন কবিতার মতো গল্প লেখাতেও মুনশীয়ানা  দেখিয়েছেন। ‘কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন  ইজাজ এর কবিতা আমাকে স্পর্শ করেছে। বরেণ্য  সাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন নতুন দিনের কবিরা স্পর্ধাময়, তারা কোন প্রবীণ কবির সনদ পত্রের জন্য হা করে তাকিয়ে নেই।
ইজাজের কোন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। প্রাবন্ধিক ও গবেষক মাহামুদুল বাসার এক প্রবন্ধে লিখেছেন ইজাজ আহমেদ মিলন তারুণ্যের উত্তাল  জলে ভাষা পরিণত এক পদ্ম। সেটার প্রমান তিনি দিয়েছেন বিস্মিত সেই সব শহীদ  শিরোনামের গ্রন্থটিতে।
যাপিত জীবনে অনেক  বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিক দের সানিধ্য পেয়েছে।

দুঃখ আর বেদনাকে জন্মসহোদর করে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। সফলতার ঝুড়িতে অর্জন করছেন একের পর এক পথিকী খেতাব।

গবেষনা মুল্যক সাংবাদিকতায় পেয়েছেন বজলুর রহমান স্মৃতি পদক ২০১৫। যা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার দেশের সেরা পুরষ্কার। 
এবছর ও তার যাপিত জীবন নিয়ে ২০১৮তে  এ বের হয়  আতœকথন : ‘বেদনা আমার জন্মসহোদর’। এ বইয়ের  প্রতিটি পাতা ভেঁজা স্যাতসেতে। প্রতিটি পাতা বেদনায় ভরা।
গুণী ও বরেণ্য কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে এ বছর ও ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার ’ পাচ্ছে। কবি ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন বেদনা আমার জন্ম সহোদর ‘ গ্রন্থের জন্য আয়োজকরা  তাকে মনোনিত করেছেন বলে এক পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছেন। রবীন্দ্র জার্নাল ও দাগ প্রবর্তিত এ পুরস্কার (২০১৮) সত্য ও সুন্দরের উপাসক কবি ইজাজ আহমেদ মিলন ১৯৮৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার  ঘন সবুজে  আচ্ছদিত মাওনার আক্তাপাড়া গ্রামে  পিতা ইদ্রিস আলীর ঔরশে মাতা জমিলা আক্তারের গর্বে  নানা বাড়িতে তাঁর জন্ম। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন উপজেলার চকপাড়া (সলিংমোড়)  গ্রামের আলো বাতাসে তাঁর পৃতভিটায়। স্ত্রী নূরন্নাহার আহমেদ বিউটি, পুত্র মীসাম আহমেদ প্রান্তর ও ইমতিয়াজ আহমেদ রাহীকে নিয়ে তাঁর সংসার।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট