ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৩



জোছনার সুষমা হারিয়ে যায়। শুধু সারি সারি ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বলে। রুবী বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। আকস্মিক উর্মিলার মনে হয়, ওর মেরুদ- বেয়ে শৈত্য বয়ে যাচ্ছে। ও কী কোনো কারণে ভয় পাচ্ছে। ভয় কিসের? বেবী আপা বলেছে, যৌবন ক্ষণকাল শিক্ষা আমৃত্যু মানুষকে বয়ে বেড়ায়।’

তাইতো!

আকস্মিক উর্মিলার ভালো লাগতে থাকে। এতক্ষণে বুকের ভেতর যে উত্থাল-পাথাল ভাব ছিলÑএখন তা আস্তে আস্তে প্রশমিত হচ্ছে। ওর চেতনায় ছায়া ফেলছে। এখন ও শুভপুরে থাকে না। নগরে থাকে। শুভপুরের বন-বাঁদাড়ে ঘোরাঘুরি, এ পাড়ায় ও পাড়ায় দাপিয়ে বেড়ানো উর্মিলার মৃত্যু হয়েছে। শুভপুর উর্মিলার জন্য নিরাপদ আশ্রয়। নগরের বাসিন্দাদের সন্ধিগ্ধ চোখে দেখতে শুরু করেছে। উর্মিলা তুই পালিয়ে যা। কেন পালিয়ে যাবে উর্মিলা? ও গ্রাম ছেড়ে নগরে এসেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যায়। ও বাবাকে বিশ্বাসের কথা বলেছে। বাবা আশান্বিত! ঘুমানোর আগে অসংখ্য আলোর বল চোখে ক্ষীণ আলো ছড়াতে ছড়াতে অনন্তে হারিয়ে গেল। এপাশ-ওপাশ করতে করতে মনে পড়ে। বাবাকে জানানো প্রয়োজন। বাবা কি নিঃসঙ্গ? এক জনম উর্মিলার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলো। সংসারে এতবড় আত্মত্যাগ উর্মিলাকে ভাবিত করে।

উর্মিলা বাবাকে লেখে, বাবা, পরম করুণাময়ের আশীর্বাদে এখানে ভালো আছি। বেবী আপা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমার সঙ্গে থাকে ময়মনসিংহের মেয়ে রুবী। আমার মতো বয়স। কোনো কাজ এখনো শুরু করিনি। এখন সবকিছুই শিক্ষানবিশ। খুব শিগগিরই বেবী আপার সঙ্গে আমার পড়াশোনা নিয়ে কথা হবে। তবে উনি বলেছে, শিক্ষাই মানুষকে পথ দেখায়। বাবা বিশ্বাস করো, যেভাবেই হোক আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছাব। শুভপুরের জন্য পরান পোড়ে। চিন্তা করো না। শরীরের দিকে নজর দিও।

ইতি তোমার উর্মিলা।

চিঠি লিখতে গিয়ে বুক ভরে কান্না এল ওর। চোখ দিয়ে জল গড়ায়।

চিঠি লেখা শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। রুবীও সিটে ঘুমুচ্ছে। ওর বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। লাইটের সুইচ অফ করে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শোঁ শোঁ শব্দে ফ্যান ঘুরছে।

উর্মিলার মাথার মধ্যে এখন বহুবিদ বিষয় কাজ করছে। অন্ধকারে ওর হাত দুটো সমস্ত শরীরে হাতড়ে বেড়ায়।

পা পাতা থেকে ঊরু, জঙ্ঘা, কিউবেক হেয়ার, এবং স্তনের বোঁটায় হাত রাখে। ক্ষণকালের জন্য এক রকম  শিহরণ অনুভব করে। মনে পড়ে পুজোর সময় ওর এক পিসতুতো ভাই স্তন ঝাপটে ধরেছিল। তা ছিল অসহনীয়। ইতরবিশেষ। উর্মিলা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। আজ পুলক অনুভব হচ্ছে। কেন? উর্মিলার অজানা।

স্তনের গড়নে হাত দিয়ে উর্মিলার মনে হলো ও নারী হয়ে উঠছে। কাম-লিপ্সা কাতর আর দশটা নারীর মতো সাধারণ। কামাগ্নির দাহে শতধা খ-িত বাৎসায়নী মানবী। চোখ দুটো জ্বালা করতে থাকে ওর। হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি খায়। কতক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। জানালা দিয়ে রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ক্ষীণকায়া কালো কালো শিশুদের দর্পিত পদচারণা। ওর মনে হয় ওরা মানুষ। অসহায় হোমোসিপিয়েন। ওরা অগণন। নগরে ওরা উদ্বাস্তু। ঘরহীন। ওরা শুভপুরের শিশুদের মতো নয়। ওদের  শরীর পুষ্টিহীন। তাদের খোঁজ নেওয়ার লোক নেই।

হঠাৎ করে ওর পায়ের পাতা ঘেমে ওঠে। মনে পড়ে, বাবাকে কথা দিয়েছে, ভাত এবং মানুষের পক্ষে থাকব।

এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে মধ্যরাতে। টেবিলে রাখা ভাত খায়। রুবী ঘুমুচ্ছে।



০৩.

নিস্তরঙ্গ দিন কাটছে উর্মিলার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখে রুবী অফিসে চলে গেছে। বুয়া রুম, বাথরুম ঝকঝকে পরিপাটি করে রেখেছে। কাপড়- চোপড় সুবিন্যস্ত রাখা আছে আলনায়। টেবিলে সকালের নাস্তা রেখে গেছে। বাথরুম থেকে ফিরে নাস্তা খেয়ে আবারও ঘুমিয়ে যায় উর্মিলা।

গভীর ঘুম। ঘুম ভাঙে বারোটার দিকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙে। উঠতে ইচ্ছে হয় না। ক্লান্তি শরীরে বাসা বেঁধেছে।

লাঞ্চের পর হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল রুবী।

বিছানায় ব্যাগ রেখে বলে, ‘সুখবর আছে। বেবী আপা তোমাকে এবং আমাকে ছয় হাজার টাকা দিয়েছে। কাপড়-চোপড় কেনার জন্য।’

উর্মিলা প্রশ্ন করে, ‘কেন?’

‘জানি না। তবে তোমাকে এবং আমাকে অফিসের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। কী পোশাকে কী চলনে বলনে।’ হঠাৎ করে উর্মিলার মনে পড়ে, আসার সময় বাবা তাকে দু’হাজার টাকা দিয়েছিল।

বলেছিল, ‘নগরে  পরিপাটি থাকতে হয়। ওটাতো শুভপুর নয়। কতরকম মানুষের সঙ্গে দেখা হবে। টাকা ছাড়া নগরে থাকা যায় না।’ বাবার জন্য মমতা বাড়ে। রুবী গুনগুন করতে করতে বাথরুমে ঢুকে যায়। ওর সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে। পৃথিবীর তিন ভাগ জল ধুয়ে মুছে যাচ্ছে চারদিক। সুচি-শুভ্র এ ধরণীর স্নিগ্ধ চরাচর। অস্ফূট বেরিয়ে আসে, আহ!

ইতোমধ্যে বাথরুম থেকে পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে আসে রুবী। রুবীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। গোসল করার পর অসম্ভব কমনীয় লাগছে। রুবীকে গত দু’দিন এমন করে দেখা হয় নাই। রুবী ওর মতো। উর্মিলা রুবীর চেয়ে একটু বেশি ফর্সা। কটিদেশে বাঁক আছে। মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, সারল্যে মাখামাখি। কোনো পঙ্কিলতা স্পর্শ করতে পারেনি। রুবীর  চেহারায় বিষণœতা ভর করেছে। ওর পিঙ্গল চোখ, কথনে আঞ্চলিক টান। উর্মিলার কাছে রুবীর এরূপ মুখচ্ছবি অত্যন্ত আপনার মনে হলো। রুবীর মাঝে প্রিয় সহযোদ্ধার ছায়া আবিষ্কার করে।

‘তোমাকে নিয়ে নিউমার্কেট যাব। নিজেও কেনাকাটা করব। কিছুই তো নেই।’ নিজকে নগরের মেয়ে ভাবতে পারছি না।’ চুলে চিরুনি চালাতে থাকে রুবী।

‘বাবা আমাকে দু’হাজার টাকা দিয়েছে।’ উর্মিলা আশান্বিত কণ্ঠে বলে।

‘তা হলে তো তোমার পোয়াবারো।’

‘কেন?’

‘তুমি ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে পারবে।’

‘তুমিও করবে।’

‘বাবাকে কোনো সাহায্য করতে হবে না। তারপর বোনদের কথা মনে হয়। কত অপূর্ণতা রয়েছে। ক্ষুদ্র জিনিসের জন্য রয়েছে কাঙালপনা।’ রুবীর কণ্ঠে হাহাকার।

‘তুমি তো সুন্দর কথা বলেছ। আমার মা নেই। ছোটবেলা থেকে আমারও কাঙালপনা আছে।’

উর্মিলার দিকে তাকিয়ে রুবী বলে, ‘বিকেল হয়ে আসছে তুমি রেডি হও।’

উর্মিলা ট্রাঙ্ক খুলে গত পুজোয় বাবার দেয়া সালোয়ার-কামিজ বের করে। ভেবেছিল অফিসের প্রথম দিন এটা পরে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে রুবীকে মনে হচ্ছে নগরের সব চাইতে পারঙ্গম মহিলা। নগরের গলি-ঘুপচির গ্রহণ-বর্জনও জানে।

রুম থেকে বেরুতে বেরুতে বিকেল গড়িয়ে এল।

রিকশায় উঠে রুবী বলল, ‘তোমাকে যা লাগছে না!’

উর্মিলা বলে, ‘তোমাকেও।’

‘আমি তোমার মতোন না।’

রিকশার ঝাঁকুনিতে উর্মিলার কুমারী বেনুনি দোল খায়। উর্মিলা  ইতিউতি তাকায়। রাস্তার লোকজন, দোকানপাট, হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো কাধ বাঁকিয়ে দেখে। এ নগরীর মানুষগুলো ক্যামন পরিপাটি। বাবা ঠিকই বলেছে, ‘নগরে সুবেশ থাকতে হয়।’

নগরের সবকিছুই বর্ণাঢ্য। রঙিন। শুভপুরের মতো নিস্তরঙ্গ নয়।

‘তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।’ রুবী প্রশ্ন করে।

উর্মিলা ভয়ানক অবাক হয়। ভাবে, রুবী বলে কী। মেয়েদের আবার ছেলেবন্ধু থাকে নাকি? হঠাৎ করে ওর চোখ-মুখে আরক্ত লজ্জা ছুঁয়ে যায়।

‘না না আমার তেমন কেউ নেই।’

‘তুমি যে রূপবতী! ক’দিন পর নগরীর সব তরুণ তোমার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তুমি সামাল দেবে ক্যামনে।’

‘তুমি যে কী বলো রুবী আমি এসব নিয়ে ভাবি না।’

‘তুমি আসার আগে আমার মধ্যে নানা ভয় কাজ করত। এখন করে না। মনে হয় তুমি আমাকে ভয় থেকে মুক্ত করেছ।’

উর্মিলা কথা বলে না। রিকশা এগোয়। নিউমার্কেটের কাছে আসতেই রুবী হ্যান্ডপার্স থেকে একটি খাম উর্মিলার দিকে এগিয়ে দেয়। খামের মুখ আঠা দিয়ে লাগানো। খামের মাঝ বরাবর লেখা উর্মিলা পাল।

‘বেবী আপা দিয়েছে।’

‘আমি কি কিনব। বুঝতে পারছি না।’

‘তোমার বোঝার দরকার নেই। নগরে আমি তোমার সিনিয়র? আর অফিসের  চাল-চলন এই ক’মাসে কিছুটা হলেও আমাকে প্রভাবিত করেছে। অন্যান্য মেয়েদের অবহেলা, গ্লানি আমাকে কষ্ট দিয়েছে। ধোবাউড়ার মেয়ে। গ্রাম্যতা শরীরে রয়ে গেছে। প্রথম প্রথম নিজেকে ভয়ানক অসহায় মনে হতো। এখন হয় না। বেবী আপা থেকে প্রায় সবাই, গ্রাম থেকে উঠে এসেছে। কিছু আছে কথা বললে মনে হয়, গ্রাম, এ শব্দটি প্রথম শুনল।’

বলতে বলতে নিউমার্কেটের গেটে রিকশা থেমে যায়। পার্স খুলে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসো।’

টুথপেস্ট থেকে ন্যাপকিন পর্যন্ত কেনাকাটা করে ওরা দু’জন যখন নিউমার্কেট থেকে বের হয় তখন রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।

রিকশায় উঠেই রুবী বলল, ‘উর্মিলা যা কিনলাম তা আমি জীবনে কিনিনি। তাছাড়া নগরে না আসলে জানতামই না মেয়েরা এভাবে কেনাকাটা করে। ওপরওয়ালার নিকট প্রার্থনা কর। আমি বিশ্বাসী মানুষ। আমি অনেক কষ্ট করেছি। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, তারপরও আমার প্রতি পক্ষপাত ছিল। সাধ ছিল সাধ্য ছিল না।’

‘এসব কথা বাদ দাও।’ উর্মিলা রুবীকে থামিয়ে দিলো। রাতের নগরের বর্ণিল চেহারা দেখে উর্মিলা আকাশের দিকে তাকায়।

তারাদের মুখ দেখা যায় না। আকাশের চাদর ঘন কালো। তারপরও অসম্ভব ভালোলাগার দোলাচালে দুলতে থাকে উর্মিলা। মানুষ হয়ে জন্মানো এ এক বিড়ম্বনা। মানুষের কত কী নিয়ে ভাবতে হয়। অন্য প্রজাতির কিছুই নিয়ে ভাবতে হয় না। শুধু খাদ্য আর সন্তান উৎপাদন ছাড়া।

নাখালপাড়ার গলিতে রিকশা ঢুকতেই উর্মিলা রুবীকে বলে, ‘তুমি আমার সঙ্গে থেকো। ভগবান সহায় হলে সব বিপদ অতিক্রম করতে পারব।’

‘তুমি আসার পর মনে হচ্ছে আমিও পারব।’
 (চলবে)

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট