নবান্ন



                                                    

নবান্ন
প্রনবেশ চক্রবর্ত্তী

হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসে বিচ্ছেদের করুণ হাহাকার। সোনালী ধানের শিষে যে বাতাসের এতো মাখামাখি ছিল, দোলা দিয়ে যেত সারাক্ষণ, ভরিয়ে তুলতো পাকাধানের শিষে কিঙ্কিণীর কলরোল, তার কণ্ঠে আজ বিষাদের সুর। মাটির কন্যার সেই কঙ্কণের শব্দ, সেই নূপুরের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দিয়ে হরিয়ালি হরিৎক্ষেত্রকে চির বিষণœতায় ভরে দেয় রাবণরূপী চাষীর দল। ধরণীর বুক থেকে যেন টেনে হিঁচড়ে হরণ করে নিয়ে যায় তারা মাটির কন্যা সীতাকে! তাই চারিদিকের গভীর নিঃস্তব্ধতা ও বিষণœতায় আজ ধূসর সেদিনের সেই হরিৎবর্ণ। মায়ের বুক থেকে চিরবিচ্ছেদের বিহ্বলতায় তার আলুথালু কেশ ছড়িয়ে পড়ে চাষীর পিঠে, যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার অঙ্গের ভূষণ।

এক একটা করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহামূল্যবান কণকভূষণ কুড়িয়ে চলে কচি কচি হাতগুলো একটুখানি ক্ষুধা নিবৃত্তির আশায়।

এদিকে, গ্রামে গৃহস্থের প্রকা- অট্টালিকায় খুশির জোয়ার। গৃহলক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটেছে যে। শুদ্ধ বসনে, শুদ্ধাচারে লক্ষ্মী বরণের পালা। শুদ্ধ আচারে অঘ্রাণের প্রথম কাটা ধানের চালে নবান্নের উপাচার। নানাবিধ ফলমূল, মিষ্টান্নের সমাহারে তারই আয়োজন। অতিথি অভ্যাগতদের আনাগোনা। বাতাসে নবান্নের সুঘ্রাণ।

রাজারামের ব্যস্ততার অন্ত নেই। মনিবের ঘরে নবান্ন উৎসব। সময়মতো সব আয়োজন সেরে ফেলতে হবে। নইলে কচি ছেলেটার মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার মতো সংস্থানও যে হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তাই উদয়াস্ত কাজ করে চলে সে। বস্তাভর্তি নতুন ধানের আতব চাল মাথায় নিয়ে নিজের বাড়ির পাশ দিয়ে সরু পথ ধরে মনিবের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে তার ক্লান্ত পা দুটি।

উদয়াস্ত বাবার পথ চেয়ে বসে থাকে অভুক্ত ছেলেটি। কখন বাবা ফিরবে, বাবা ফিরলে তবেই তো দুটো খেতে পাবে সে। তার খিদে যেন আর বাঁধ মানে না। হঠাৎ ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় বাবাকে। নাকে এসে লাগে সদ্য ছাঁটাই করা আতব চালের গন্ধ। ক্ষুধার্ত চোখ দু’টি জ্বলজ্বল করে ওঠে ওর। বাবা তবু বাড়ি ফেরে না। ক্ষুধার্ত ছেলেটা উঠানে পড়ে থাকা গুটিকয়েক কুাড়িয়ে আনা ধানের শিষের দিকে চেয়ে থাকে। বাবার পিছন পিছন হাওয়াই মিলিয়ে যাওয়া নতুন আতবের গন্ধ আবার অনুভব করে সে। ছুটে গিয়ে অপুষ্ট হাতদুটি দিয়ে এক এক করে ধান থেকে চালগুলোকে আলাদা করার বিফল চেষ্টা করতে থাকে।
দাওয়ায় বসে ছেলের খাওয়ার জন্য মাঠ থেকে তুলে আনা কলমীর শাক বাছতে বাছতে মায়ের চোখ দু’টো জলে ভরে আসে।
‘ওটা কি করছিস, বাবা?
‘মা, আমাদের নবান্ন হবে না?
নীরবে চোখের জল মোছে মা। মা হয়ে ছেলের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে না পারার দহনে দগ্ধ হতে থাকে মা।

সারাদিন মহাব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে রাজারামের দিন। মহাসমারোহ ও আতিশয্যের নবান্নে অবসন্ন এবং অবসাদ চিত্তে সে কেবল কাজই করে চলে। নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুসরত মেলা ভার। উদ্ধৃত্ত খাবার এবং উচ্ছিষ্টের ছড়াছড়ি। আবর্জনার পাত্র ভরে উঠে মুহুর্মুহু অপচয়ে। রাজারাম তা বাড়ির বাইরে ফেলে আসে বারবার। যে লক্ষ্মী আবাহনে এহেন আয়োজন, সেই লক্ষ্মীরই কিনা এমন অনাদর, ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে! বিস্ময়ে অভিভূত রাজারাম ভাবতে থাকে,
‘মাগো তুমি এদেরই ঘরে সদা বিরাজ করো, আর যে কিনা সমাদরে কুড়িয়ে আনা দু’চারটে ধানের শিষে তোমায় খোঁজে দিনান্ত, তাকে তুমি দেখাও দাও না! সেই একরত্তি ছেলেটা সারাদিন মাঠে মাঠে ধানের শিষ কুড়িয়েছে মেঠো ইঁদুর আর ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসা পাখিদের মাঝে। জঠরে খিদের জ্বালা, অপুষ্টিতে ক্ষীণকায় ছেলেটার বুকের পাঁজর ঠিকরে হৃৎপি-টা বুঝি বেরিয়ে যাবে যেকোনো সময়। নির্লিপ্ত চোখে অনন্ত খোঁজা তার, যদি তাদের উঠানেও লক্ষ্মীদেবীর পায়ের অস্পষ্ট ছাপটুকু পড়ে। ‘কান্নায় বুক ভারি হয়ে অসে তার। ফেরার সময় বেড়ার ফাঁকে ক্ষুধার্ত ছেলেটার বুভুক্ষু মুখ সে যে দেখে নি, তাতো নয়! অভাবের আগুনে তার জগৎটা যেন রাশি রাশি কালো ধোঁয়ায় ভরে ওঠে। দুঃখে, ঘৃনায় ফেটে পড়তে চায় পিতৃহৃদয়।

ডাস্টবিনে ক্ষুধার্ত কুকুগুলোর মধ্যে খাবারের কাড়াকাড়ি, আর্তনাদে সম্বিত ফেরে রাজারামের; অনতি দূরে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট শিশু; ফেলে দেওয়া খাবারের দিকে চেয়ে থাকা দু’টো চোখ ।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট