হেমন্তে লেখা পদাবলি-২




ফসিল নগর
দীপঙ্কর পাড়ুই

একটা ডাকঘর কত ঠিকানার কেন্দ্রবিন্দু হয়। আমাদের পিকলুদা বলে ‘ত্রিবেনীতে সব লেজেন্ডরা থাকে জানিস’। কথাটা ভেবে দেখেছি শুধুই যে হাস্যকর তা নয়। তর্ক পঞ্চাননের ত্রিবেনী এখনও জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। সপ্তম সভ্যতার ফসিল রয়ে গেছে আমাদের চেতনার কোনো কুঠুরীর ভিতর। চন্ডীমঙ্গলের ছায়া মুক্তবেনীর পথ ধরে গিয়ে কালীদহে দেখে ভোর। বানিজ্য নগরীর সুবর্ণবনিক একুশ শতকে কেউ কেউ হয়ে ওঠে কালকেতু আর ফুল্লরা।

একটা ডাকঘর কত ঠিকানার কেন্দ্রবিন্দু হয়। চিঠি আসে চিঠি যায়। মনের হরফ গুলো ভেসে ভেসে যায় আগ্রহী কোন বন্ধুর কাছে। মনের গূঢ়তম নির্যাস থাকে হয়তো আমাদের মুক্তবেনীর জলে। প্রতিদিন জলসিঞ্চনে আসে মুগ্ধতা।

একটা ফসিল নগর বেঁচে থাকে মনের ভেতর, মনের ভেতর...


একদিন তুমিও ছিলে 
নূরনবী সোহাগ

অভিশপ্ত অন্ধকার।
বিষাক্ত ছোবল ছুঁয়ে যায় ঘাসফুলের ঘুম
একটা সরব উঠোনে ভর করে মৃত্যুর নিরবতা
বুনোকাক হতে পারলে-পূর্বাভাস পেতাম
কতটা নিকটে পৌঁছে গেছে বিভীষিকা
নিষিদ্ধ নগরীর একমাত্র বাসিন্দা ভাবতেই
মনে হয় যেকোনো পথ’ই আমার
নিঃসঙ্গ ঝরা পালকের মতো স্থির
দাঁড়িয়ে দেখি— সিলিংভর্তি শৈশবকুঞ্জ
অথচ আমিও একদিন অবিরাম দাপিয়েছি
কোলাহলে।  ঘুমিয়েছি কত কত বুকে
অনুরূপ হয়তো শৈশবও আমায় দেখে ভাবে
একদিন তুমিও ছিলে আমার দলে 


তোমার লেখা হেমন্তের চিঠি
ইভান অনিরুদ্ধ

কতবছর পর তোমার পেন্সিলে লেখা চিঠি পেলাম!
আজকাল কী কেউ তার প্রিয়জনকে চিঠি লেখে?
কেউ লেখে না, তুমি লিখেছো আমার কাছে ।
তাই বলে ভাবছি না যে, তুমি আমাকে এখনো তোমার প্রিয়জন ভাবো !

তুমি লিখেছো- নভেম্বরে খুব স্নোফল হয়, প্রকৃতি শুয়ে থাকে শাদা
বরফের কফিনে, চারপাশে তাকালে মনে হয় মৃত নগরী ।
এই দৃশ্য তোমার অসহ্য লাগে। নেত্রকোণা শহর- গ্রামের
হেমন্তের কথা তখন খুব মনে পড়ে, তোমার হৃদয় আর্দ্র হয়
ভেতরে ভেতরে কার জন্য জানি হাহাকার হয়, বালিশ ভিজে যায় ।

লিখেছো- আমি যেন হেমন্তের সন্ধ্যারাতের কথা ফিরতি চিঠিতে লিখি,
পারলে সোনারঙ পাকা ধানের একটা ছড়া খামের ভেতর দিয়ে দেই যেন ।

জানতে চেয়েছো- উঠানের পুব কোণায় এলাচিগন্ধী লেবু গাছের তলায়
জোনাক পোকার সম্মিলন ঘটে কী না এই হেমন্তের রাতে ।
একবার তিনটে জোনাকী ধরে আমি তোমার
বুকের ভেতর ছেড়ে দিয়েছিলাম,
তোমার ফর্সা বুক দেখে হয়ত আনন্দে এরা অনবরত
জ্বলছিল আর নিভছিলো ।
তোমার এখন খুব ইচ্ছে আরেকবার যেন আমি সেইরকম করি !

তোমার এসব কষ্টের অনুবাদ পড়ে আমার খুব হাসি পাচ্ছে,
করুণা হচ্ছে অবেলায় এসে তোমার এরকম
স্মৃতি তর্পন দেখে ।

আমি এখন কী লিখবো বলো?
হিম বাতাসের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে কার্তিকের বিষন্ন চাঁদ,
মনে হয় এরকম বেঁচে না থেকে মরে গেলেই ভালো হত!
তবে মরে যাবার আগে খামে ভরে তোমার ঠিকানায় পাঠাবো-
একফালি কার্তিকের চাঁদ, তিনটে জোনাকী , এক থোকা লেবুফুল
অগ্রাণের সোনারঙ ধানের একটা ছড়া
আর তোমার ফর্সা বুকে এই হেমন্তের রাতে আমার যাদুময় স্পর্শ !



হেমন্তের দিন
স্বপন পাল

পাতলা সরের মতো এখানে বাতাসে ভাসে
সান্ধ্য উনানের ধোঁয়া, উঁকি মারা তারারা
স্পষ্ট ঠিক হয়নি তখনও । ঘরে ফেরা
সব ঘাম ধুয়ে মুছে এবার বিশ্রাম নেবে
ক্লান্ত, শক্ত, সুসার শরীর,
যেখানে ধানের গন্ধ এখনো জড়িয়ে আছে
ঘাড়ে, পিঠে, এলোমেলো চুলে ।
এখনই জাগবে প্যাঁচা, চাঁদ দেখা গেলে
আদুরে বাতাসে মাঠময় দুলে দুলে
ধানের যৌবন জ্যোৎস্না গিলে অপরূপ হবে ।
এ তল্লাট ছেড়ে গেছ যারা, অনিশ্চিত
এ জীবন ছেড়ে, একবার দেখে যাও
এই এত বৈভবের রাজ্যপাট ছেড়ে
কাকে বেছে নিয়েছ জীবনে ।
বৎসরের এই ক’টা হেমন্তের দিন
এর জন্য বাকী সব ফেলে আসা যায় ।
এর জন্য সব জ্ঞান, যন্ত্রণা, চাতুরী
নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ফেরা যায়
হেমন্তের জ্যোৎস্নাধোয়া ধানগন্ধী মাঠে ।


হেমন্তের নৈবেদ্য
স্নিগ্ধ নীলিমা

এসেছে হেমন্ত, সবুজে হলুদে দোলানো অবারিত মাঠ,
সবুজ ঘাসের ডগায় মুক্তার মত জমানো শিশিরজল ।
হিম কুয়াশার চাদর বিছিয়ে আসে উত্তরা বাতাস,
নীলাভ আকাশ কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধ সৌম্য দুপুর।

বিলে আর ঝিলে  সাদাশাপলারা  রূপের পশরা সাজায়,
গন্ধরাজ , মল্লিকা আর পদ্ম কাননে ফোঁটে।
ঝরাপাতার  টুপটাপ গান আবেশে জড়িয়ে রাখে,
অতিথিপাখিরা  উড়ে চলে আসে এ দেশকে ভালবেসে।

সোনালি ধানের শীষে কিষাণ  দুচোখের স্বপ্ন আঁকে,
বধুয়াকে এবার কিনে দিবে তার  সাধের নীলশাড়িটি।
বহুদিন পরে মেয়েটিকে সে নায়ইর আনবে বাপের ঘরে,
ভাপা পুলি আর ফিরনি  পায়েস  খাওয়াবে কুটুম ডেকে।

বাড়ির নিকানো উঠোন ভরে গেছে নতুন ফসলে ফসলে,
আঙিনাতে তাই ধান শালিকেরা নাচছে মনের সুখে।
ঘরেঘরে আজ ছোট বড় সব মেতেছে নবান্ন উৎসবে,
চিরায়ত  বাংলার চেনারূপটি  খুঁজে পাই এই হেমন্তে।

হেমন্তিকা
কৃপাণ মৈত্র


শিউলি এখনো ফোটে, কাশ বিবর্ণ
হয়নি এখনো, শিশিরে ধানের ঘ্রাণ,
ফড়িং- আনাগোনা অবিরাম, পিচ্ছল ধানের
শিসে সূর্যের লাজুক রোদ,পরিযায়ী পখিদের
পৃথিবী মন্থন, গরুগুলো হয়েছে উতলা, রাখাল
বালকের চোখে স্বপ্ন বিস্তৃর্ণ মাঠ, মরাই বেঁধেছে
বুক সুখ পেতে শষ্য আলিঙ্গনের,
খামার অপেক্ষায় বুকে তার চরবে ফসল, নবান্নের
আয়োজন, মরা মুখে ফুটবে হাসি,
উপবাসি মরমীর মুখে ফুটবে হাসি, হেমন্তের ডাকে জাগে
মাঠ, ঘাট, উঠনে গোময়ের লেপ, সাঁঝ নামে,
জেগে উঠে তুলসীতলা প্রদীপ শিখায়...


ঘুঘু চরা পেইন্ট হাউস
তাপস গুপ্ত

ভাঙ্গা ভিটেতে চরছে ঘুঘু
দানা হীন ধুলোয় ঘুরে
কি যেন খুঁটছে শালিক,
সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বলে করপোরেশন
সাবধান ঝোলে বিপদজনক
হলুদে লাল রঙে,
শুধু নেই চরিত্রগণ
বৃক্ষের শিকড় জুড়ে অতীত
সব চরিত্র কাল্পনিক।
কুলুঙ্গিতে সেই কবে ছিল
নুন হলুদে মাখানো মাছ,
সেই আঁশটে গন্ধ এখন শহর জুড়ে,
দিন গুলি প্রাণ পেত যৌথ কচুটেপনায়
যুদ্ধের ইতিহাস কত সুরে ভাসত অশ্লিল খেউড়ে
উৎসাহী চোখে কৌতুক ঝিলিক প্রতিবেশী জানালায়,
সাদা লাল শাঁখা পলা
কত রূপসী সন্ধ্যে জমায়েত হতো তুলসিতলায়।
সে সব রূপময় রূপকথা
ইঁটের পাঁজরে অস্থিসার বিগত যৌবনা
গতর ঝরানো চুন সুরকির হাসি
হাঁ করা দেয়াল জুড়ে।
কত সূর্য মাখা ছিল এ দেয়াল
প্রভাতী কলহে পায়রার ওড়া ছিল
নিয়মিত চালগমে,
সে অতীতকে ভ্যাংচায় রাতের বাদুড় পেঁচা
চামচিকে দোহারে ডানা ঝাপটায়,
জ্যোৎস্নায় চাঁদ শুধু চাটাই পাতে
কত অভিশাপ আর কেচ্ছায়
রসালো গল্প জমায় রাতে;
গল্প এবার মাপা হবে মিটারে স্কোয়ার ফিটে
বোধনে ভিত পুজো ক্ষমতার খুঁটি গাড়া হয়
ঘুঘুদের যৌথ ভিটের মাটি খুঁড়ে।
পিট পিটে হাঙর চোখ শুধু অপেক্ষায়,
পেইন্ট হাউসে ধরা দেবে চাঁদ
ঝিকিমিকি রূপকথা বুদবুদ স্কচ ও সোডায়।
বুড়ি নটে গাছ ব্যালকনি জুড়ে
যৌবন ধরে নিজেকে বাঁচায়
টবে থাকা মানি প্ল্যান্টের
সবুজ পাতায়।




নদী পাড়ের হেমন্ত উপাখ্যান
সাইয়্যিদ মঞ্জু
 
প্রকৃতির কাছে খুঁজি হৈমন্তিক কবিতার অনুষঙ্গ
মুখভার কৃষাণী তর্জনী ইশারায় দেখায় নদী
অশ্রু চোখে বয়ান, ফসলি জমি নদী হওয়ার গল্প
কান পেতে শুনে সোনালি ধানের শুন্য গোলাও।

হিম কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে নদী পাড়ে হেমন্ত
ভোরের শুভ্রতায় শিশির নূপুর।

ফসলের প্রান্তরে অকৃত্রিম-অনাবিল হাসি
কৃষাণ-কৃষাণীর ব্যস্তময় ধানরাঙা মুখ
নবান্নের পিঠাপুলির সুগন্ধি ঘ্রাণ
কোথাও কিছু নেই-
আত্মস্থের সম্ভারে ডেকে গেছে
বিলীন সুর খরস্রোতা পদ্মা।

শিউলি ফুল
আলী আহম্মেদ

শিউলি ফুল কুড়ানো সেই দিনগুলো, আজ ধুম্র কূয়াশায় আচ্ছন্ন
মনে পড়ে, এক হাতে কায়দা আঁকড়ে
আরেক হাতে শিউলি তলে ফুল কুড়াতাম উৎফুল্ল চিত্তে
ভোরের শিশিরে ভেজা শিউলি, সে কি তার অনন্য রূপ!
শুভ্রতার পাড়ে যেন এক চিলতে কমলা, ভোরের চোখে কাজল টেনে যায়
ফুলগুলো ছোঁয়ার পর দারুণ এক অনুভূতির সৃষ্টি হতো!

চার চালা টিনের ঘরটা আর নেই, এখন সেখানে প্রাসাদ
চারা বকুলের গায়ে বাদামী বাকল
এখন আর আযানের ধ্বনি শুনে মক্তবে ছুটি না
দল বেঁধে দেখা হয়না মাটির বুকে জড়িয়ে থাকা;
শিউলি ফুলের অপার সৌন্দর্য।

মক্তবের সাথিরা আর নেই, কিংবা আমি নেই
ব্যস্ততা ঘুরিয়ে দিয়েছে পথ, গন্তব্য
দায়ীত্ব বুঝে নিতে গিয়ে অনেক বড় হয়ে গেছি,
মাস শেষে গুনে নিতে হয় মজুরী: বাঁচবো বলে
তাই পিছনে ফিরে যাওয়ার আর সুযোগ নেই।

মাটির গায়ে বিছিয়ে থাকা শিউলি ফুলগুলো নেই
কে জানে! হয়তো প্রত্যক্ষ দেখার আর সুযোগও নেই
তাই তাদের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখি সংগোপনে
বিরহী চিৎকারে তাদের অদৃশ্য বোবা কান্না শুনি কান পেতে
শিউলিগুলো হয়তো জানবেনা কোনদিন,
আমার ফিরে যাওয়ার সে যে কি আকুতি!





যে সব প্রস্থান গল্পে ব্যাকুল দেয়াল
নিঃশব্দ আহামদ

কেবল দাঁড়িয়ে থাকে দেয়াল, নিস্তরঙ্গ চোখে তাকায় দিনপঞ্জি, কেমন খসে যাচ্ছে কোলাহল থেকে একেকটি দিন, আড়ষ্টতার মতো জড়িয়ে থাকে চাকার চেয়ার
দুলতে থাকে ক্রমশঃ যেনো, নিরূত্তাপ দেহ।

এই যে সন্ধ্যা, সম্মোহন বেষ্টন করে রাখে এড়ানো চা-টেবিল, কেবল নির্জন ঘরে প্রেম হয়ে গেছে আমাদের সংলাপ, সব নৈমিত্তিকতা বিরতি হয়ে ফিরে গেছে এই ক্ষণ আয়োজনে- চোখ থেকে শুভ্রতা নিয়ে দীর্ঘায়ূ বুনে আমাদের যোজিত দুরত্ব।

তবু না, কারা যেনো বেশ ধারণ করে এলো, আক্ষেপত্রয়
যদি ভাসায় সে কেবল শব্দ সৃজন না, নয়তো খেয়ালি মিথ আমি আমার ভেতর ছড়িয়ে রেখেছি জলাভূম,
মুগ্ধতার বীজ- বর্ধিষ্ণু চারার মতো পরিচর্যা করে গেছে সমস্ত রোদ।

না, এভাবে বলো না -
যদি কখনো স্বাভাবিকতায় দলিত রেখে যাও কোনো
আহাজারি হয়ে যাওয়া কান্না, তবু ঊল্লাস নাভেতরে তুলে রেখো, এতোটুকু দায়
সারা সময় আমি যে আস্তিনের ঘ্রাণের মতো মিশে আছি হয়ে তোমার, সমস্তকাল।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট