গল্প : স্বপ্নের ঘুণপোকা



স্বপ্নের ঘুণপোকা
শর্মি ভৌমিক

বাইশ বছরের শিবু এখনও মায়ের আঁচল ধরে মামাবাড়ি বেড়াতে যায় হাসিমুখে। মামাবাড়ি বড় শান্তির স্থান শিবুর কাছে। কৈশোরে যে কয়দিন ওখানে থেকেছে, খুব স্বাধীন জীবনযাপন করেছে সে। খাওয়ার চিন্তা নেই, পেটপুরে খেয়েদেয়ে গল্পগুজবে বেশ দিন কেটে যেতো তার। শিবুর বাবার বড় সংসার। পাঁচ মেয়ে, শিবু ও স্বামী- স্ত্রী মিলে মোট আট সদস্যের সংসার সুধীর বাবুর। ছোটখাটো মাছের ব্যবসায় ঠিকঠাক সংসারও চলতো না তার। সকালে খেলে বিকেলে কি খাবে এমন অভাব অনটন যেন সংসারে নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। শিবুর একমাত্র স্কুলশিক্ষক মামা অবিনাশ বাবু শিবুকে পড়াতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে। কিন্তু, পড়ালেখার প্রতি শিবুর অনাগ্রহ অবিনাশ বাবুর ইচ্ছেকে সফল হতে দেয়নি। খুব ছোটবেলা থেকেই বাবার কাজে বেশ মনোযোগ গড়ে ওঠে তার। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুমচোখে মাথায় মাছের খাঁচি তুলে বাবার সাথে বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতো শিবু। বাবার কষ্ট সইতে না পেরেই সেসময় সাহায্য  করতে নেমে পড়েছিলো কিশোর ছেলেটি।
জ্যৈষ্ঠের খরতাপে সুধীর বাবুর অনাহারী শুকনো মুখে যখন মুক্তোদানার মতো ফোঁটা ফোঁটা শুভ্র ঘাম জমে উঠে  তখন শিবু কোমরের ময়লা গামছা খুলে অতি যতেœ আলতে ছোঁয়ায় বাবার কপালের ঘাম মুছে দেয় গভীর ভালোবাসা মেখে। সুধীর বাবু অসহায় দৃষ্টিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেদিনের সেই ছোট্ট শিবুর দিকে। ভাবে, এতো মায়া, এতো মমতা, ও পেলো কোথা থেকে? শিবুর এতোসব গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও পড়ায় অমনোযোগী হওয়ার দোষে অন্তরে ভীষণ ব্যথা অনুভব করে সুধীর বাবু। তাই, একদিন মাছের আড়ত থকে মাছ নিয়ে ফেরার পথে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে একমাত্র বংশপ্রদীপ সন্তানটিকে বললো,
-আইচ্ছা বাপ, তুমি কি সত্যিই আর ইসকুলে যাইবা না? আমার সন্তান কি আমার মতো মূরুখ্য হইয়াই জীবন কাটাইবো?
সুধীর বাবুর বয়স কম হয়নি! আট ছেলেমেয়ের জনক  তিনি। দুটি সন্তান জন্মের পর মারা গিয়ে এখন ওরা  ছয়জন। শিবু তিন বোনের ছোট। ওর ছোট আরও দু’বোন রয়েছে, খুবই ছোট ওরা। জন্মের পর থেকেই বাবার ঘানী টানা দেখে এসেছে শিবু। ঘাড়ে করে মাছের খাঁচি টানতে টানতে বাবার কুঁজো হয়ে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। রাত হলে ঘুমের মাঝে খক খক করে কেশে উঠে সুধীর বাবু। শ্বাসকষ্টে ভালো ঘুম হয় না তার। রাত পোহালেই ছোট ছোট সন্তানদের একাধিক বায়না সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় সুধীর বাবুকে। কণা, মীনা, সীমার পছন্দ  বাজারের তেলের পিঠা আর রসগোল্লা দিয়ে গরম গরম পরোটা ভাজা খাওয়া। ঘরের কোণেই বাজার। বাচ্চাদের এসব আবদার পূরণ করতে গিয়ে বাবাকে কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তা অনুভব করে শিবু, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর মামার বাড়ি থেকে পড়ালেখা করবে না। পড়ালেখা শিখে চাকরি বাকরি করতে করতে বাবাকে আর বাঁচানোই যাবে না! তারচেয়ে এই ভালো, বাড়িতে থেকে বাবার কাজেই সহযোগিতা করবে, মাছের ব্যবসাতেই নিজেকে জড়িয়ে নেবে । বাবাকে ভালোবেসে বাবার কাজটিকেই বেছে নিয়েছে মাতৃপিতৃভক্ত শিবু নামক সহজ সরল ছেলেটি।
আজ বাবার সেই একই কথা আবার! সেই পড়ালেখা! আজকের কথাগুলো যেন কথা নয়, এ যেন অতৃপ্ত হৃদয়ের সকরুণ হাহাকার! বেদনাক্লিষ্ট আর্তনাদে শিবুর বুকও খুব করে কেঁপে উঠে। কিন্তু, আজ আর কিছুই করার নেই তার। পড়ায় বিস্তর গ্যাপ পড়ে গেছে, এখন আর ওটা পূরণ করার উপায় নেই। তাই বললো,
-আইচ্ছা বাবা, সকলেরই কি বই পইড়া জ্ঞানবান হইয়া অফিস আদালতে চাকরি করতে হইবো? সকলের পক্ষেই কি তা সম্ভব, কওতো? আমরা যদি মাছের ব্যবসা না করি, তাইলে মানুষ মাছ খাইবো ক্যামনে? অহন যদি দেশের সকল কিষাণেরা অফিসে চাকরি করতে চায়, তাইলে মানুষ ভাত পাইবো কইত্তে?
-হুন বাপ, আমি সক্কলের কথা জানি না, আমি তুমারে শিক্ষিত কইরা তুলতে চাইছিলাম। তোমার মামা একজন নামকরা মাষ্টর, সেও চাইছিলো তুমি পড়ালেহাডা কর, কিন্তু তুমি এইডা কি করলা বাপ?! তুমি পড়ালেহাডা ছাইড়া দিলা! ক্যান এমন করলা?
কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার কামাল্লা গ্রামের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে ছিলো জমিদারদের বসবাস। এখনও সেই জমিদারী স্থাপত্য বিদ্যমান। বড় বড় শ্যাওলাযুক্ত পুরনো ভাঙ্গাচোরা দালানকোঠা আজো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জমিদারীর সাক্ষ্যস্বরূপ। বিশাল বিশাল দিঘী আজ মৎস্যশূন্য নীরব, আবর্জনায় ভরপুর। শান বাঁধানো পাকা ঘাটলায় জমিদার রমণীদের পায়ের স্পর্শ পড়ে না আর! সব পড়ে আছে শূন্য, খাঁ খাঁ! দিঘীর পাড় ঘেঁষে হাঁটার সময় শিবুর বুকের বাঁপাশ ব্যথায় কিঞ্চিত চিনচিন করে ওঠে। কেন এভাবে সব শূন্য হয়ে যায়? কেন সব পড়ে রয় জনমানবহীন এমন অবহেলায়? অজস্র ভাঁটফুল ফুটে আছে দিঘীটির চতুর্পাশ্বে প্রকৃতির পূর্ণ মহিমা নিয়ে। কেউ কি খোঁজ রেখেছে তার? কোনদিনই হয়তো কারো পূজার ফুল হয়ে উঠেনি ওরা, কেউ দেখেও দেখেনা ওদের, অবিরাম মাড়িয়ে যায় পায়ে পিষ্ট করে। ওদেরও কি রক্ত করবী কিংবা পদ্ম হতে ইচ্ছে হয়? নাকি গোলাপ না হতে পারার যন্ত্রণায় প্রতিদিন বাবা- মায়ের বকুনি খায়? এমন হাজারো ভাবনায় শিবু ধাক্কা খায় হঠাৎ বাবার কথায়। বাবার অপূর্ণতা কি দিয়ে পূরণ করবে শিবু? বাবা যে ওকে শিক্ষিত দেখতে চেয়েছিলো!  সময় চলে যায়, সে কারো জন্য বসে নেই। দিশেহারা মনে শিবু তবুও বলে,
-বাবা, আমি তোমার সন্তান; সন্তান হইয়া যদি তোমার কোন সেবা করতে না পারি; মা বোনদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে না পারি, তাহলে কিসের সন্তান হইলাম আমি? তুমিই যদি না থাক, তবে কে দেখবে আমার সাফল্য? আমি তোমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই বাবা, আমি মায়ের চোখের জল সইতে পারি না আর! আমি চাই নাই তোমরা না খাইয়া মইরা যাও...
বলতে বলতে ঢুকরে কেঁদে ওঠে শিবু। হঠাৎ পথে থমকে  দাঁড়ায় সুধীর বাবু। শিবুকে বুকে চেপে ধরে মুছিয়ে দেয় চোখের জল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তার বুকের ভেতরটাও। ব্যর্থ বাবা হবার অপরাধে ফেনিল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে তার দু’চোখের তীরে।
-বাপরে, পেটের দায়ে আমি এই কাম করি, এই কাম বড় কষ্টের কাম বাপ! আমি কোনদিন চাই নাই তুই এই কাম করস, তুইতো বুঝলি না আমি কি চাইছিলাম! আমিতো তোর সুখ দেখতে চাইছিলাম বাপধন!
চলতি পথে কামিনীর মৃদু গন্ধ মোহিত করে তোলে শিবুর হৃদয়ের অলিগলি। চোখ আটকে যায় ইট খসে পড়া পোড়াবাড়িটির দিকে। সবুজাভ শ্যাওলাপড়া ভাঙ্গা দেয়ালের গায় কি আশ্চর্যভাবে গজিয়ে আছে একটি বড়সড় বটগাছ! মাটি নেই, তবুও শেকড়গুলো হাত পা ছড়িয়ে শ্যাওলা থেকে শুষে নিচ্ছে বেড়ে উঠার যাবতীয়  নির্যাস! গাছটি বাতাসে ডালপালা নাড়িয়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে দুলছে বারবার। জমিদার বাড়ির ভেতরটা  এখন ছোটখাটো একটি সুন্দরবন বৈ কিছু নয়। কিছু গোখরো সাপের বসতবাড়িতে পরিণত হয়েছে বাড়িটির অন্দরমহল। এককালে বড় নিষ্ঠুর ছিলো এই জমিদারেরা। বর্ণবিভেদ করে ওরা মানুষকে ঠকিয়েছে নির্দয়ভাবে। মানুষকে নিম্ন বর্ণের করে রেখে তারা উচ্চবর্ণ হয়ে সিংহাসনে পা ঝুলিয়ে জমিদারিত্ব ফলিয়েছে বহুকাল ধরে। নিম্নবর্ণ বলতে কিছু যে নেই, সেসময় তা ছিলো  সাধারণ মানুষের বোধেরও বাইরে। ওরা নিজেদেরকে ছোট মনে করে জমিদারদেরকে সেবাপূজা করে গেছে তখনকার দিনে। জমিজমা চাষাবাদ করে শূন্যহাতে ঘরে ফিরতো নিম্নবর্ণের মানুষজনেরা। জমিদারদের নিকট তারা ছিলো এক অচ্ছুত বস্তু মাত্র! লঘু  অপরাধের জন্য তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকতো গুরু সব শাস্তির আয়োজন। এরকম হাজারো উপায়ে সাধারণ লোকেরা নিপীড়িত হতো ক্ষমতাশালীদের নিকট।
শিবু এ গাঁয়ে জন্মেছে ঠিকই, তবে জমিদারদের দেখা পায়নি সে। নিম্নবর্ণের করুণ কাহিনীর কথা জেনে জেনে মাঝে মাঝে বড়বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠে শিবু। তাদের অনাচার মেনে নিতে পারে না কিছুতেই।
জমিদার বাড়ির জঙ্গল পেরিয়ে মেঠোপথে পা রাখতেই  এক স্বচ্ছ শীতল বায়ু বয়ে যায় শিবুর দেহের ধমনী ও শিরার সমান্তরাল পথ পরিক্রমণ করে। অজান্তেই একরাশ ঘৃণা বেরোয় যেন নিঃশ্বাসের হাতটি ধরে!
-আইচ্ছা বাবা, পড়ালেখা না শিখলে মানুষ বুঝি ভালা  মানুষ হইতে পারে না? যদি তাই হইবো, তাইলে জমিদার বাড়ির অতো শিক্ষিত লোকগুলি এমন অত্যাচারী হইছিলো ক্যামনে? আমি পড়ালেখার বিপক্ষে না, কিন্তু পড়ালেখা শিইক্ষা অমানুষ হওয়ার বিপক্ষে, বুঝলা বাবা?
-হেইডা আলাদা কতা, বুঝলি? জমিদারেরা ছিলো ক্ষমতালোভী, ক্ষমতার জইন্য হেরা সব করতে পারতো। নিজের পিতারেও সিংহাসনচ্যুত করতে দ্বিধা করতো না তারা। পিতাও সন্তানের গর্দান নিতো অবলীলায়। তাদের কথা বইল্যা লাভ নাই বাপ। তয়, সব জমিদারতো আর খারাপ আছিলো না, কিছু ভালা  নেতারও জন্ম হয় জগতে, তারাই টিকাইয়া রাহে এই বিশ্বডারে।’
শিবু মন দিয়ে বাবার কথা শোনে। খুব ইচ্ছে জাগে ভালো নেতা হবার। সকলের নয়নের মনি হতে কার না ভালো লাগে! তবুও কেন আজকালকের নেতাগুলো তা হতে পারছে না? কেন মানুষের ঘৃণা নিয়ে অবৈধ অর্থের পেছনে দৌড়ুচ্ছে তারা? এদেশেতো বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবরের মতো এক মহান নেতার জন্ম হয়েছিলো, তবে কেন আজকের নেতৃবৃন্দরা সেকথা হৃদয়ে ধারণ করছে না? কেন ব্যক্তিস্বার্থই বৃহৎ হয়ে উঠছে তাদের কাছে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজেদের কুঁড়েঘরের সামনে ছোট্ট উঠোনে এসে পৌঁছায় ওরা বাপবেটা দু’জনে। দুপুর গড়িয়েছে বেশ আগেই। তবুও জ্যৈষ্ঠের সূর্যের তেজ কমেনি। তীব্র দাবদাহে সুধীরবাবুর কুচকুচে কালো মুখ আরো কালো রূপ ধারণ করেছে। তাকে দেখে যেকারো মনে হবে এ যেন একরত্তি ঘুটঘুটে অন্ধকার! কোটরাগত চোখ যেন আঁধারে জ্বলে উঠা ছোট্ট ছোট্ট জোনাকি পোকা!
বাবার ভাঙ্গা গলায় কাশির শব্দ শুনে ঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো শীলা, মিলা, মিনারা। টিওবয়েল চেপে একজগ ঠান্ডা জল নিয়ে এলো তড়িৎ গতিতে। কলের গোড়ায় কাঁদা খুঁড়ে খাদ্য খোঁজা হাসদুটোও প্যাঁক প্যাঁক স্বরে সরব হয়ে উঠলো তাদের আগমনে। কলাবতী ফুলের পাঁপড়িগুলো বাতাসে মাথা দুলিয়ে যেন সাদর সম্ভাষণে মেতে উঠলো নির্জন দুপুরের শেষ প্রহরে!
অজান্তেই মায়াময় এই ভালোবাসার সংসারের ভার এসে পড়লো শিবুর কাঁধের উপর। সুধীর বাবু ভিন্ন স্বপ্ন দেখলেও শিবুর কাছে তা দেখা দিয়েছিলো বিলাসী স্বপ্ন রূপে। তারচেয়ে বরং এইতো ভালো, সবাই মিলে পেটপুরে দুটো ডালভাত খেয়ে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারছি, ভাবে শিবু। ভেবে স্বন্তির নিঃশ্বাস ফেলে নীরবে।
আজ বহুদিন পর মায়ের সাথে মামাবাড়ি এসেছে শিবনাথ (শিবু)। প্রতিদিনকার কর্মক্লান্তি থেকে এইতো কিছু অবকাশ! সুধীরবাবুর সংসারে আগের মতো তেমন অভাব নেই আজ আর। মাছের ব্যবসাও ছেড়ে দিয়েছে শিবু। শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করে এখন বেশ ভালোই রোজগার হয় তার। বাবাকেও অবসর দিয়েছে কষ্টের কাজ থেকে। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, ওরাও ভালোই আছে স্বামী সংসার নিয়ে। মায়ের গায়েও উঠেছে নতুন ছাপার শাড়ী, সোনার নাকফুল, হাতে বাঁধাই করা সোনার শাঁখা। ছেঁড়া আঁচলে মাথায় ঘোমটা টানার দিন ঘুচেছে গীতা রানীর। সুগন্ধি জর্দায় পান খেয়ে দু’ঠোঁট লাল করে মধুর হাসিতে আজকাল ঘর ভরিয়ে তোলে গীতা দেবী। শিবুর চোখ আনন্দে ভিজে উঠে। লেখাপড়া করতে না পারার দুঃখ নিমিষেই উবে যায় হৃদয় হতে।
মামাতো বোন চৈতালীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। খুব বড় ঘর বর পক্ষের! আষাঢ় মাসেই বিয়ে। চৈতালী বয়সে শিবুর বড়। দিদির বিয়ের কথা শুনে মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো তার। নিজের বোনেদের বিয়ে দিয়েছে প্রচন্ড যুদ্ধ-সংগ্রাম করে। সেখানে দায়িত্ব ছিলো কিন্তু কোন আনন্দ ছিলো না। বোনেদের বিয়ে দিয়ে বাবার মাথার বোঝা সরানোই ছিলো তার একমাত্র কাজ। এবার আর সেই ঝামেলা নেই, দিদির বিয়েতে অনেক মজা করবে বলে স্থির করে মনে মনে। অনেকদিন পর মামীর হাতের পায়েস খেয়ে অমৃত মনে হলো শিবুর কাছে। অবিনাশ বাবুর দখিনমুখী বাড়ীটিতে সারাক্ষণ বয়ে যায় শান্তির বাতাস। মামাবাড়ীর সবই যেন স্বর্গীয় মনে হয় শিবুর কাছে।
-অ্যাই শিবু, এদিকে আয় ; দেখ দেখ, গাছে কাঁঠাল পেকে ফেটে আছে;  উঠে পড়, পেড়ে নিয়ে আয় ওটা, গাছতলায় বসেই খাবো, হি হি...
চৈতালী এমনই হাসিখুসি একটি মেয়ে। দিদির কথায় শিবুও তরতর করে উঠে পড়ে গাছে। গাছপাকা কাঁঠালটি পেড়ে তুলে দেয় প্রিয় দিদির হাতে। চৈতালী কাঁঠাল ভেঙ্গে খাইয়ে দেয় ছোট ভাইটিকে। তারপর বলে,
-এবার পুরোটা খা, হি হি!
-আমি একলা এত্তোবড় কাডাল খাইতে পারুম না দিদি, তুমিও খাও।  এই নেও হা করো, দারুণ মজার কাডাল! "
চৈতালী প্রিয় ভাইটির কথা ফেলতে পারে না। খেয়ে নিলো একটি কুশ ভালোবেসে। তারপর বললো,
-গাছে আমও পেকে আছে, পেড়ে খা যতো ইচ্ছে।
শিবু চৈতালীর দিকে তাকায়। কি মায়াবী সরল একটি মুখ! সে চলে যাবে এ বাড়ি থেকে, ভাবতেই বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে ওঠে তার!
-দিদি, আমার একটা কথা রাখবা?
-কি, বল?
-আমিতো গরীব, তোমার বিয়েতে ক্ষুদ্র একটা উপহার দিতে চাই, নিবা তুমি?
শিবুর কথায় কেঁদে ওঠে চৈতালীর কোমল হৃদয়। চৈতালী জানে শিবু গরীব নয়, ওর হৃদয়টা খুব বৃহৎ,  অর্থ দিয়ে এ হৃদয়ের পরিমাপ করা সম্ভব নয়। শিবুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহভরা কন্ঠে বললো,
-কেন নেবো না ভাই? তুই দিদিকে ভালোবেসে একটি উপহার দিবি আর আমি নেবো না! তাই কখনও হয় নাকি? ঠিক নেবো আমি।
শিবুদের সংসারের কথা সবই জানা চৈতালীর। মামা হিসেবে চৈতালীর বাবা অবিনাশ বাবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বোনের পরিবারের জন্য। গীতা রানী অবিনাশ বাবুর সবচেয়ে আদরের ছোট বোন। সংসারের টানাপোড়নের সময় গীতা রানী তার বাচ্চাদের নিয়ে মাসের পর মাস ভাইয়ের সংসারে এসে পড়ে থেকেছে, অবিনাশ বাবু কখনোই অনাদর করেননি বোনটিকে। আজ ভাগ্নেটি বড় হয়েছে, ভালো টাকা রোজগার করছে, এতে অবিনাশ বাবু খুবই সুখী। বোনটি ভালো আছে জেনে নিশ্চিন্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি।
শিবু ছোটবেলায় প্রায়ই আসতো মামার বাড়ি। এবার এসেছে তিন বছর পর। শহরে দালানকোঠার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে, তাই আর বেড়ানো হয়ে উঠে না তেমনভাবে। অনেকদিন পর ভাগ্নেকে দেখে মামা অবিনাশ বাবুও ভীষণ খুশি। বেশি লেখাপড়া না জানলেও শিষ্টাচারের কোন ঘাটতি নেই শিবুর মাঝে, তাই শিবুকে ছোটবড় সকলেই ভালোবাসে। রাতে মামাভাগ্নে একসাথে খেতে বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ জুড়ে বসলো। আলাপের এক ফাঁকে শিবু বললো,
-মামা, একটা কথা আছিলো আমার।
-কি কথা, বল?
-মামা, চৈতালীদির বিয়ের বেনারসিডা আমি বিয়েতে উপহার দিতে চাই দিদিরে, দয়া কইরা আপনে না করবেন না। এইডা আমার মনের ইচ্ছা মামা।
অবিনাশ বাবু ভাবতেও পারেননি শিবু এমন একটি অনুরোধ করবে! তার একমাত্র মেয়ে চৈতালী, তার বিয়ের বেনারসি কিনবে শিবু!
-ভাগ্নে শোন, বেনারসিটা আমিই কিনবো, তুই মন খারাপ করিস না। আসলে, আমি চাই না তুই এতো টাকা খরচ করিস। বেনারসির অনেক দাম, তুই বরং অন্য কোন উপহার দে তোর দিদিকে।
মামার কথায় সত্যিই খুব মন খারাপ হয় শিবুর। মুখ কালো করে বলে,
-মামা, এ নিয়া আপনের ভাবতে হইবো না, আমি বেনারসিই উপহার দিমু দিদিরে। কথা কিন্তু ফাইনাল, মামা।
সরল শিবুর মুখের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ বাবু আর দ্বিমত করতে পারলেন না।
শিবুরা দুদিন বেড়িয়ে বাড়ি  চলে এলো। বাড়ির ঘরটাকে ঠিকঠাক না  করলে আর চলছে না। এ দফায় সম্ভব হচ্ছে না, শহর থেকে কাজ শেষ করে দিদির বিয়ের আগেই ঠিক করে ফেলতে হবে ঘরটাকে, ভাবে শিবু। দিদির বিয়ের পর জামাইবাবু ও দিদিকে একবার আনতে হবে তো! কতো পরিকল্পনা তার! শহরে গিয়ে কাজে খুব মন দিলো শিবু। এ কয়দিন কোন অবকাশ নয়, কাজ আর কাজ নিয়েই থাকার কথা ভাবে সে। চৈতালীদি কতো স্নেহ করে তাকে, তার বিয়েতে যেমনতেমনভাবে গেলে হয়! দিদির বিয়েতে রাজপুত্র সেজে জামাইবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, বুঝিয়ে দেবে কতোটা স্নেহের ছোটভাই সে।
এসব হাজারো ভাবনায় কর্মোদ্যম বেড়ে যায় শিবুর। দেখতে দেখতে দিদির বিয়ের দিনটিও এগিয়ে এলো। তার চোখেমুখে স্বপ্নেরা ঝিকিমিকি খেলা করে চলছে  সারাবেলা। ট্র্যাঙ্কে খুব যতœ করে তুলে রেখে দিয়েছে দিদির বেনারসি কেনার টাকাটা। আজ বিকেলে মার্কেটে যাবে ঠিক করে ফেললো শিবু। সুন্দর দেখে সব থেকে ভালো লাল বেনারসিটা সে কিনবে দিদির জন্য। প্রথমেই শাড়ীর দোকানে বেনারসি পল্লীতে ঢুকলো শিবু। অসংখ্য বেনারসির ভীড়ে কোনটা কিনবে ভেবে কূল পায় না সে। অবশেষে দশ হাজার টাকা দিয়ে সুন্দর লাল টুকটুকে একটি বেনারসি কিনে ফেললো তার দিদির জন্য। দিদির জন্য শাড়ীটি কিনতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শিবু। তারপর, বাবা- মা ও ছোট বোনদের জন্যও কিনলো নতুন নতুন পোশাকআশাক। নিজের জন্য তবে কি কিছুই কিনবে না শিবু?! তার বহুদিনের শখ একটি হাতঘড়ি কেনার। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে নিজের কোন সখ পূরণ হয়নি তার। এবার আর কোন ভাবনা নয়, সাধের ঘড়িটি কিনেই ফেললো শিবু। হাতে ঘড়ি পরে বাবুদের মতো হাত ঝুলিয়ে হাঁটবে সকলের সামনে দিয়ে, কতোইনা সুন্দর দেখাবে তাকে! ভাবতে ভাবতে মলিন মুখে সুখের হাসি ফুটে ওঠে শিবু বাবুর। সোনালী চেইনের স্বপ্নের সেই ঘড়িটি এখন তার ঘরে, ভাবতেই আহ্লাদিত হয় শিবুর হৃদয়।
আর এক সপ্তাহ পরই চৈতালীর বিয়ে । শিবু আজই বাড়ি এসেছে। ঘরটা ঠিক করতে হবে বলেই একটু আগেভাগেই চলে এসেছে বাড়িতে। টিনের চালে মরচে পড়েছে খুব। বহুদিনের পুরনো টিন, স্থানে স্থানে ফুটো হয়ে গেছে। আষাঢ় মাস। রোজকার বৃষ্টিতে ঘরের চালে জল পড়ার আগেই ঘরের ভেতরে যেন জল গড়ায় পাল্লা দিয়ে! দিদির বিয়ে উপলক্ষে ঘরটিও সারাই করা হবে শিবুদের।
দু’জন মিস্ত্রীসহ শিবু নিজেই আজ লেগে পড়েছে ঘরের কাজে। আর মাত্র চারদিন বাকী দিদির বিয়ের। গীতারানীও ভাইজি বিয়ের উত্তেজনায় ভীষণ আবেগাপ্লুত। সুধীর বাবুর মনেও আনন্দের বান ডেকেছে যেন! শিবুর ছোট বোনগুলোও উচ্ছ্বসিত। ওরাও গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদের মতো। আজ চালে নতুন টিন বসাচ্ছে শিবু। নিজ হাতে আনন্দের সাথে ঘরের কাজ করছে সে। কতো সুখের স্বপ্ন মাথায় খেলা করছে তা শিবু ছাড়া আর কে জানে! গুনগুন গান বেজে চলেছে তার অন্তরে। হঠাৎ আকাশ কালো করে মেঘেরা ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলো! বৃষ্টিটা নামবে নামবে করছে। শিবু মিস্ত্রীদের একজনকে ডাকলো,
-ওহ মানিক ভাই, হাতুরিডা দেওতো জলদি, টিনডা খুইল্যা যাইতাছে, তাড়াতাড়ি দেও।
কথাগুলো বলতে না বলতেই একঝাঁক দমকা হাওয়া এসে উল্টিয়ে দিয়ে গেলো ঘরের উপরে বিছানো টিনগুলো। শিবু বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে আটকাতে চাইলো উড়ে যাওয়া টিনগুলিকে। কিন্তু পারলো না! টিনের সাথে নিজেই উড়ে গিয়ে পড়লো মাটিতে। ধারালো টিনের আঘাতে প্রচন্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো শিবু। থেঁতলে গেলো তার গোপনাঙ্গটি। দমকা বাতাসের সাথে ভেসে এলো একটি আর্ত চিৎকার...
-মাগো, ওমা, আমি আর বাঁচবো নাগো মা !
সুধীর বাবু, গীতারানী, দৌড়ে এলো সবাই। সন্তানের এই অবস্থায় বিলাপ শুরু হলো শিবুদের উঠোনে। কান্নার রোলে দৌড়ে এলো পাড়ার সব লোক। এ কি হলো! এ কি হয়ে গেলো, মুখে মুখে এ কথাই যেন সবার! হাসপাতালে নেয়া হলো শিবুকে। নাহ্, কাঁটাছেঁড়া হয়নি কোথাও। ডাক্তার ভালো করে দেখলেন, কয়েকটি ব্যথার ওষুধ দিলেন শিবুকে। প্রথম দিন ব্যথা ক্ষাণিকটা কমলেও দ্বিতীয় দিন ব্যথাটি বেড়ে গেলো কয়েকগুণ!  শিবু ব্যথা ব্যথা বলে চিৎকার করলেও কাউকে বলছে না কোথায় হচ্ছে তার ব্যথা! ডাক্তারও জানতে পারলো না শিবুর গোপন সেই যন্ত্রণার কথা।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মাথার কাছে বসে থাকা মাকে কি যেন বলতে চাইলো শিবু। গীতা রানীর চোখের জল অনবরত ঝরে পড়ছে পুত্রের মাথায়। মাথাটি আগলে মুখের কাছে মুখ এগিয়ে মা জলভরা চোখে জিজ্ঞেস করলো,
-শিবু, বাপ আমার, কিছু কইবা তুমি? কি কইবা বাপ, কও না, কওনা বাপ...?
শক্ত করে মায়ের হাতটি চেপে ধরে শিবু। কোঁকাতে কোঁকাতে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা  করছে সে ।
-মা, আ- আ- মি বুঝি আর দিদির বিয়েতে যাইতে পারুম না, মা! সখের হাতঘড়িডা পরা অইলো না আমার!
শিবুর আর্তিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে গীতা রানী। বিলাপ করতে করতে পুত্রকে প্রবোধ দিতে চাইলো,
-পারবা, পারবা বাপ, তোমার কিচ্ছু অয় নাই, তুমি ভালা অইয়া যাইবা বাপ। ডাক্তার কইছে, তুমি সুস্থ অইয়া যাইবা। এমন কতা কইয়ো না বাপ, আমার কইলজায় যে মানে না! ওহ্, ঈশ্বর, তুমি আমার বাপধনেরে ক্যান এত কষ্ট দিলা? তুমি আমার মানিকরে ভালা কইরা দেও ঈশ্বর ...!
পুত্রকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে গীতা দেবী।
-ওমা, মাগো, তুমি আমার একটা কথা রাখবা মা?  দিদির বিয়ে যেন আমার কেনা বেনারসি শাড়ী পইড়াই অয়, তুমি শাড়ীডা পৌঁছাইয়া দিবা, মা? তুমি আমারে কতা দেও মা, কতা দেও, কতা দেও...
বলতে বলতে কেমন যেন কঁকিয়ে ওঠে শিবু! তার এমনসব কথায় গীতা রানীর মন আশঙ্কায় কুঁকড়ে যায়। অন্তরে কিসের যেন অশনিসংকেত বেজে ওঠে! বুকের বীনায় বেজে ওঠে বিধ্বংসী এক সুর! কোন এক কুডাকে বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠে মায়ের অন্তর।
-শিবু, বাপ আমার, এইসব ভাবে না বাবা, তোমার কিছু অয় নাই, তুমি তাড়াতাড়ি ভালা অইয়া যাইবা, আমরা তোমারে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ডাক্তার দেহামু, তোমার কিচ্ছু অইবো না বাপ...
আর কেউ না জানুক, শিবুতো জানে তার কি হয়েছে! সে প্রতি সেকেন্ডে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে যাচ্ছে  হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থেকে। ক্ষণে ক্ষণে নিঃশ্বাস থেমে যাচ্ছে তার।
-মা, ওমা, আমার আরেকটা কথা আছে মা।
অসহায় দৃষ্টিতে পুত্রের স্বপ্নভরা চোখে তাকায় গীতা রানী। পুত্রের প্রতিটি কথা যে তার বুকে তীরের মতো বিঁধে চলেছে তা কি করে বোঝাবে সে! মায়ের মন মানে কেমন করে?! শুধু কাঁদে আর চেয়ে থাকে পুত্রের বেদনার্ত মুখের দিকে।
-নতুন জামাইরে মুখ দেইখা তুমি নিজের হাতে ঘড়িডা পড়াইয়া দিবা, আমি দূর আকাশ থাইক্যা চাইয়া চাইয়া দেখমু আর আনন্দ করমু, মা। আমার দম বন্ধ হইয়া আসছে মা! বাবার কষ্টটা আমি দূর করতে পারলাম না, আমারে ক্ষমা কইরো তোমরা...
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ শিবুর জিভ আটকে যায়। শিবুর মা ছোট্ট চামচে ওর মুখে তুলে দেয় এক ফোঁটা জল। আবারো জোরে কঁকিয়ে ওঠে শিবু। তার বড় বড় নিশ্বাসে কেঁপে ওঠে হাসপাতাল কক্ষ। গীতা রানীর আর কিছু বুঝতে বাকী থাকে না, শিবু চলে যাচ্ছে, সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেখানে, যেখানে গেলে কেউ আর ফেরে না কোনদিন!
-শিবু, শিবুরে, ও আমার বাপ, কতা কহ, কতা কহ বাপ, চুপ কইরা থাহিছ নারে বাপ, ও ভগবান, এ তুমি কি করলা? ক্যান করলা? আমি কি অন্যাই করছিলাম ওরে আমার ভগবান.....!
সুধীর বাবু ওষুধ আনতে ফার্মেসীতে গিয়েছিলো। এসে পুত্রকে নীরব হয়ে যেতে দেখে এক চিৎকারে ফিট খেয়ে গেলো। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন অট্টহাসিতে হাসপাতাল কক্ষ ফাটিয়ে দেবার উপক্রম করতে লাগলো মানুষটি!
-শিবু, শিবু, ও আমার শিবু, আমারে ছাইড়া তুমি কোনহানে যাইও না, আমি তোমারে ছাড়া বাঁচতে পারুম না..... হা হা হা হা হা! শিবু, ঘুমাইছে, আমার শিবু ঘুমাইছে, ওরে কেউ ডিস্টাব কইরো না..... খবরদার, আমার বাপধনেরে জাগাইও না, কতদিন ঘুমায় না আমার পুলায়, হা হা হা হা হা.....!
শিবুর বাবা- মায়ের সকরুণ আহাজারিতে ভারী হলো প্রকৃতির আকাশ, বাতাস চারিপাশের সবকিছু। গীতা রানী বুক চাপড়ে এলোচুলে বার বার মুর্ছা যাচ্ছে। সুধীর বাবু দেয়ালে মাথা খুঁটছে। শিবু নিথর দেহে সব ব্যথা বিসর্জন দিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে স্থির।
লজ্জায় মরণকে বেছে নিলেও কারো নিকট গোপনাঙ্গের চরম আঘাতের কথাটি কাউকেই বলতে পারলো না হাজারো স্বপ্ন দেখা সেই উঠতি যুববকটি! নীরবে এভাবে বুঝি চলে যায় কেউ কেউ!
চৈতালীর বিয়ের সাতপাক ঘোরা আর দেখা হলোনা শিবনাথের! গোপন ব্যথা বুকে লুকিয়ে হয়তো শ্মশানে গুমরে কাঁদছে নিষ্পাপ ছেলেটি! লাল বেনারসি, হাতঘড়ি সব পড়ে আছে শূন্য টিনের ঘরে, শুধু স্বপ্ন দেখা শিবু আর রইলো না এই পৃথিবীর পরে!
ছেলের শোকে শিবুর বাবা আজ মতিভ্রষ্ট, পাগল। গীতা রানীও চলে গেছে ছেলের টানে ছেলেরই কাছে! ছেলের শোকে পাথর হওয়া গীতারানী সি, এন, জির ধাক্কা খেয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে! সুধীর বাবু সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে, অভাবে দিন কাটিয়েছে, কিন্তু অসুখী জীবন ছিলো না তার। স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালোবাসতো এই মানুষটি। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার ছিলো তার।
আজ কিছু নেই, নিঃস্ব, সর্বশান্ত সুধীর বাবু। শুধু আছে  মুখভর্তি দাড়িগোঁফ! কারো সাথে কোন কথা বলে না আজকাল;  খাওয়া নেই, দাওয়া নেই; শুধু শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ানোই তার একমাত্র কাজ; একা একা হাসে, কাঁদে আর কি যেন বিড়বিড় করে বলে যায় সারাবেলা, কেউ তা বোঝে না.....



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট