ভাঁজ খোলার আনন্দ





ভাঁজ খোলার আনন্দ
এনাম রাজু

ঘুম আসছেনা। কবিতা আসছিলো। লিখতে বসলাম। কিন্তু গানের রূপ নিচ্ছে। আমার কবি সত্ত্বাকে ব্যঙ্গ করছে যেনো ! রাগ উঠলেও বিরক্তির কারণ হিসেবে নিলাম না। তাতে অনুরাগের জল ঢাললাম। কিছু টাকা হলো মনে হয়। কিন্তু কবিতা হলো না।
বাইরে প্রচুর শীত। হালকা বাতাসও আছে। ভ্রুক্ষেপ নাক রে বেলকুনিতে দাঁড়ালাম। লেকের পানিতে বৈদ্যুতিক আলো-ছায়া নজরে পড়ছে। ভালোই লাগছে। এমন সময় সিগারেট হলে মন্দ হতো না। প্রিয়ার ঠোঁটের ছোঁয়ার চেয়েও মধুর হতো। সক্রেটিস সাহেব ঠিকই বুঝে ছিলেন। বহুদিন ধওে সিগারেট হতে কয়েক মাইল দূরে ছিলাম। খুব মিস করতাম। যদিও শুরুটা বেশি দিননা, স্থায়ীও হয়নি।
নানা ভাবনায় ডুবে আছি। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। এমন সময় কে ফোন দেবে? এতো রাতে আমি কারো প্রয়োজনে আসবো- ভাবা কঠিন। কয়েক মাস আগেও এ সময়টা ছিলো শুধুই তিথীর। কল এলে নাম দেখা লাগতো না। ‘হ্যালো’ বললেই হতো। আজ কে কল করলো? মোবাইল হাতে নিয়ে বেশ হাসি পেলো। এলার্ম বাজছে।
এলার্ম আমাকে অতীতে ফিরিয়ে নিলো। অতীতে নিয়ে গেলো আমার মন, আমার সত্ত্বা। ছয়-সাত মাস হবে। এ সময়ের প্রতিটি মিনিট, অপেক্ষা, অভিমান, ভালোবাসা, আলিঙ্গন, চুম্বন, কষ্ট যেন আমাকে মূহুর্তে গ্রাস করে ফেললো। ভাবনায় রিভিউ হচ্ছে- কেমন সে অতীত !

ফেইসবুকে সময় দেওয়া, খুব সকালে গোসল করা, নাস্তা সেরে ডায়াবেটিকস রোগীর মতো হনহন করে পথ চলা, কোচিং শেষে বাসা, আবার পড়াশুনা, শেষমেশ ঘুম। এগুলো ছিলো ডেইলি রুটিনের ছক। তুলির জেদে মাঝে মাঝে চেঞ্জ করতে হতো। কফিশপ ওর খুব প্রিয়। আবদার গুলো রাখলে খুশি হতো। বিরক্ত হতো যখন নিজের বাস ভাড়া কোন এক বুড়ো ভিক্ষুককে দিয়ে ফতুর হয়ে যেতাম। ‘তাহলে তুমি যাও আমি একটু পরে ফিরবো’- শুনলেই বুঝে নিতো সব। মুচকি হাসতো। এভাবেই চলতো দিন। সাথে বিসিএস প্রস্তুতি।

তুলি বিলাস বহুল আবাসিকের বাসিন্দা। থাকে দাদুর রেখে যাওয়া বাড়িতে। প্রতি রবিবার ওর ওখানেই ছিলো আমার আড্ডা। বাবা সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করেন। মাখাদ্য অধিদপ্তরে। একটা ছোট ভাই আছে। দেখতে ছোট হলে বু্িদ্ধতে পাকা। যাকে বলে অকালপক্ক। আমাকে দেখলেই বলতÑভাইয়া, আব্বু-আম্মু বাসায় নেই, তাই টিভি দেখছি। আপু রুমে আছে। তুমি যাও। আমার কার্টুনে ডিসটার্ব করোনা। তারপর মিটমিট হাসতো ! কী বুঝে হাসতো বুঝতাম না।
তুলি আমার ভালো বন্ধু। তখন নতুন ভর্তি হয়েছি। ক্লাস শুরু হয়েছে মাত্র কয়েকদিন। প্রতিদিনই নতুন নতুন কেউ না কেউ ভর্তি হচ্ছে।
সেদিন ক্লাস শেষের কিছু আগে নতুন একটা মেয়েএলো। চেহারা এবং সাইজে ছোট বলে সামনেই বসতাম। পাশেই বসলো মেয়েটি। আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েটা যখন ঢোকে তখনই বুঝেছি বেশ পড়য়া গোছের। কাঁেধ এক ঝোলাবই। আড় চোখে দেখলাম ওই বইগুলো দিয়েই আমার আর ওর মাঝে দেয়াল তৈরিকরে রেখেছে।  হাসি পেলো। চাপা হাসিতে ফেটে পড়লাম। মেয়েটি লজ্জা পেল। বললÑ
হাসছেন কেন?
‘স্যারের কথা শুনে।
‘আমার তো মনে হয় আমাকে দেখে।
‘আমি যে হাসছি তা দেখলেন কী করে? আপনার তো স্যারের দিকে তাকানো কথা, আমার দিকে নয়...
‘আপনি কি সব সময় হাসেন?
‘না তো। যখন ইচ্ছা আর বাস্তাবতার খেলায় নিজেকে অসামঞ্জস্য মনে হয় তখন হাসি।
আবার হাসলাম। মেয়েটি তাকােেলা। মোলায়েম মুখে কেমন একটা অপ্রস্তুত ভাব।
‘এখন হাসলেন কেন?
‘এমনিতেই।
‘আপনি নীলফামারীতে কোন পাগলের ডাক্তার দেখান।
‘আমার মনে হয় ভুল হলো। 
‘কোনটা ?
‘এই যে, নীলফামারী? যতটুকু জানি, পাগলাগারদ পাবনায়। আপনি নিশ্চয় সেটাই মিন করেছেন।
‘এইতো বুঝে নিয়েছেন। পাগলেরা বিনা কারনে হাসে। মনে রাখবেন।

চাপা আওয়াজে কথা কাটাকাটিতেই আমাদের পরিচয়। তারপর থেকে বন্ধুত্ব। যাকে বলে কঠিন বন্ধুত্ব। কিন্তু এক অজানা অচেনা ফাল্গুনী ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে গেলো সব।
তিথী। হ্যাঁ সেই ঝড়। ফেইসবুকে পরিচয়। দেখতে কেমন, আসল না নকল তষনও জানিনা। ম্যাসেজ আদান- প্রদান চলতে থাকে। ক্লাশ টেস্ট শুরু। কোচিং এ পরিচিত মুখচার পাঁচজনের মধ্যে আমি একজন। ভালো ছাত্র হিসেবে। ফলে পড়ালেখার চাপ বেড়ে গেলো। ফেইসবুকেতাই বসা হয়না তেমন। তিথীর সাথে তাই নম্বর আদান প্রদান। নিয়মিত যোগাযোগ হতে থাকলো। কণ্ঠ দারুণ সুরেলা। শুরু হলো বন্ধুত্ব। পওে বন্ধুত্বের সব নিয়ম-শর্ত ভেঙ্গে প্রেম। যদিও দেখা হয়নি। কথা বলতে বলতে এতোটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম যে নিজের ভালো-মন্দ এখন শুধু আমার না, তিথীরও। গল্পের মতো কওে তুলে দিতাম তার কাছে। তুলির সাথে আর সময়ই দেয়া হতো না।
প্রথম দেখায় তার চোখ নিষ্পাপ হয়ে ধরা দিলো আমার কাছে। খোঁজ-খবর নিয়ে প্রেম হয় না, হয় মন থেকে। কারও সাথে আলাপও করলাম না। সে আমার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হলো। শুধুই শান্তি আর সুখ যেনো বিচরণ করছিলো চারপাশে। তুলির মাঝে কিছু পরিবর্তন দেখলাম। আগে এমনটি দেখিনি। ওর মাঝে দেখেছি শুধুই বন্ধুত্ব। কিন্তু এখন অন্যরকম। আমি বন্ধুত্ব হারাতে চাইনি। ফলে তিথীর বিষয়টি বলতে বাধ্য হলাম। তুলি প্রচুর কান্নাকরল। ওর বন্ধুত্বে যে এতো ভালোবাসা ছিলো তার প্রমাণ ওর অশ্রু। তিথীর চেহারা মনে ভেসে উঠতেই ভুলে গেলাম সব।
ভালোবাসার মহলে জমকালো উৎসব লেগেই থাকত। ভ্যাকেশনে কোচিং ছুটি। তিথীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ মনে ফুরফুরে মেজাজ তৈরি করে দিলো। হাজার বছর ধরে যেন কোন রাজা সেন্ট হেলে না কিংবা এলবাদ্বীপে নির্বাসিত জীবনের অবসান কাটিয়ে আবার রাজ সিংহাসন পাওয়ার সুখের দিনটির মতো ছিলো আমার প্রতিটি মুহুর্ত। যখন তাকে কাছে পাওয়ার কথা ভাবতাম বসন্ত এসে পূজার্চনা করতো আমার পায়ে। যেন কোন ভাগ্যদেবী আসছে, আর আমি তার কাছে কিছু চাইলেই সে ‘না’বলবেনা। আবার যখন অভিমান করত আমাকে জেন কেউ আবু গারীব জেলখানায় নির্যাতন করত। প্রতি ভোওে কানে বাজত‘বৃষ্টিহউক, বৃষ্টিহউক’বলে কোন পাখির চিৎকার।
মনের ডালে এখন কোকিলের বসবাস। সাদা মনে কালো রঙের কাকগুলো দল বেঁধে আনন্দ মিছিল করছে। কা-কা শব্দও ভালো লাগে। কাকের ডাক শুনলে কোথাও দুর্ঘটনা হয়েছে ভেবে ভয় পেতাম। এখন আর তা মনে হয় না। দেহের চারদিকে শুধুই বসন্ত।

কয়েক দিন ধরে সেই তিথীর সাথে মন মালিন্য হওয়ার কারণে সিগারেটের মাত্রা বেড়ে গেছে। লক্ষ্য করেছে তুলি। তিথীর সাথে আমার এ্যফেয়ারের কথা শোনার পর থেকে আশে পাশে কম দেখা দিতো। ইদানিং দূর থেকে বেশ ফলো করে। সেদিন রমনায় বসেছিলাম। ও এসে পাশে বসলো। তুলি সিগারেট খেতে দিতোনা। আমি ভুলিনি। কিন্তু আর সহ্য করতে পারছিনা। একটানা ধরালেই নয়। কথায় কথায় অনেক সময় পার হয়েছে। ওয়াশ রুমের নামে যদি একটা...! কিন্তু উল্টোটি হলো। তুলি বললো, ‘তুমি একটু পরে যাও, আমি আসি।’আমি ওর ফিরে আসার দিকে চেয়ে হা হয়ে গেলাম।  তুলির হাতে সিগারেট। ধুয়া ছাড়তে ছাড়তে আসছে। একটা আমাকে বাড়িয়ে দিলো। আমিও কিছু বললাম না। ও-ই শুরু করলো, ‘যদি জানতাম সিগারেটে এতো সুখ, ছ্যাঁকা খাওয়ার সাথে সাথে শুরু করতাম।’ খুব লজ্বা পেলাম। কীমিন করছে বুঝতে দেরি হলোনা। আমি যে তিথীর কাছে খেয়েছি- ও নিশ্চয় জেনে গেছে।
হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেলো। ফেলে দিলো তুলিও। জড়িয়ে ধরলো আমাকে। তারপর হু হু করে কান্না। আমার চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়লো জল। দুজনের কান্নায় ছিলো সত্যতা, ছিলো অতীত।
লেপ্টে থাকা দুটি শরীরের কান্নার ঝাকুনি বলে দিচ্ছেÑ ও কাঁদছে আমার জন্য আর আমি তিথীর...
বনানী, ঢাকা





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট