শরৎ ও শুভ্রতা



শরৎ ও শুভ্রতা
হাসান মাহমুদ বজ্র
দু-বছর পূর্বে আমি এখানে এসেছিলাম পূজার ছুটিতে। বেশ কদিন  বন্ধ পাওয়ায় বেড়ানোর জন্য ছুটে আসি এখানে। বাড়ি থেকে অনেক দুরে,দুর সম্পকের এক খালার বাড়িতে। তখন এই নদীর দু-কূলে ছিলো ঘন কাশফুলের ছড়াছড়ি। যেন কারো যতনে চাষ করা করেছে এ ফুল। প্রথম যখন এখানে আসি, তখন এক  বিকেলে একা একা এই নদীর তীরে হাটতে এসেছিলাম। আমরা যারা চট্টগ্রামের তারা নিতান্তই পাহাড় দেখায় অভ্যস্ত, তাই স্বভাবতই আমাদের নদীর তীরে হাটতে ভালো লাগে। দু-তীরের ঘন কাশবনে ঘেরা নদীর দু-কূল ও নিকটের প্রান্তর নিতান্তই নির্জন। এ যেন বিধবার বুকের নির্জনতা। মাঝে মাঝে সেই নির্জনতার বুক ছিঁড়ে বিধবার বুকের দীর্ঘ শ্বাসের মতো শব্দ করে বাতাস ছুটে আসে । সেই হাওয়া ঝাপটে গুঞ্জরন তুলে কাশের বনে। দুলে উঠে কাশফুল,জলধির তরঙ্গের মতো করে। সেই কী রূপ, এ যেন প্রিয়ার আঁচল। হাওয়া সনে কাশবনের এই সন্ধি মিলন দেখে জেগে উঠে প্রেম ফুঁসে উঠে কবিত্ব। উঠে কবিতার পস্রব বেদনা । ছটপট করছে জন্ম যন্ত্রনায়। এখনি হবে জন্ম একটি কবিতার, ভালো লাগা কিছু শব্দের সনে হবে শব্দের বাসর। ছন্দের চুম্বনে বাক্য পাবে পূর্ণতা। একটু খালি জায়গা দেখে আমি নদীর দিকে মুখ করে বসি শব্দের সনে শব্দের মিলন ঘটানোর প্রয়াসে। নদীটি বড় নয়,তবে নিতান্ত ছোট ও নয়। কিন্তু গভীর তাতে সন্দেহ নেই। কবিরা গভীরতা পরখ করতে পারে অনায়াসে। জীবনের গভীরতা, ভালো লাগার গভীরতা, সম্পর্কের গভীরতা, প্রেম প্রীতি বন্ধন সব গভীরতা কবির চোখে ধরা দেয়। তাইতো কবিরা শব্দের সনে শব্দের মিলন, জীবনের সনে জীবনের মিলন এত সহজে ঘটাতে পারে। এই নদীর জল কাশফুলের মতো নিতান্তই সলিলতার দাবিদার। আকাশের ওই মেঘের মতো সচ্ছ। আকাশের খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলা গুলো নদীর জলের বুকে করে লুকোচুরি খেলা। মাঝে মাঝে পরম আদরে চুম্বনও একে দেয় তার বুকে। আর এই তরঙ্গিণী লজ্জায় মুখ লুকায়। সেই দৃশ্য শুধু কবিই দেখে, আর দেখে দুলে উঠা কাশফুল। হাতের কাছে কিছু নুড়ি পড়ে আছে যৌবন হারানো বৃদ্ধের মতো। প্রেম আর মিলনের এই শুভক্ষণে এই যে বড়ই বেমানান। ছুটে দিই তারে নদীর বুকে। যদি সে পারে ভরা যৌবনের নদী থেকে কিছু প্রেম হাসিল করতে। একে একে সব গুলো নুড়ি ছুটে দিই অথই তটিনীর বুকে।

হঠাৎ চমকে উঠি। ধমকে জাগে হিয়া। পাশে কে মোর? পাশে এ কোন প্রিয়া? রূপে তার চমক ভারী। পলকে মন নিয়েছে কাড়ি। কাশফুল নিতে এসে প্রিয়া করেছে কবির মন চুরি। আহা, যৌবনে মাদল বাজ, কি করি মরি লাজে। কাশফুল দিয়ে মেয়ে সাজাও বাসর, জমিয়ে বসাব আজ প্রেমের আসর।

গাঁয়ের এক চঞ্চলা কুমারী। করতে আসছে কাশফুল চুরি। সাদা কাশের বনে নির্জন প্রান্তরে যেন সাদা ডানার কোন হুর পরী। গায়ের জামা নীল আকাশের নীল রঙে রাঙানো। আর তার উপর সাদা উড়নাটা  নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ। মেঘের ভেলার মতোই হালকা বাতাসে উড়ে তা। শরতের রূপের বর্ণনা দেওয়া নিতান্তই সহজ হলেও নারীর রূপের বর্ণনা বড়ই দুর্বোধ্য। আমার কাছে শুধুই দুর্বোধ্য নয় রীতিমত অসাধ্য। এ রূপে বর্ণনার  হয়না। রূপের ভিতর এ আরেক রূপ । স্বর্গের পরী আদৌ কি এমন। যদি এমন হয় হে বিধাতা আমার আজই স্বর্গে তুলে নাও। এই স্বর্গ কুমারী আমি ছুঁয়ে দেখতে চাই। তার টানা চোখ দুইটি বড়ই স্থির। এ যেন রূপ কথার মায়াবী হরিণীর চোখ। সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো তার ঠোট। টানা দুটি ভ্রু যেন পূর্ব-পশ্চিমের  দু' দিগন্ত ছুয়েছে। আর এসব দেখে কবি হারিয়েছে চেতনা।

দিন যেতে যেতে পরিস্থিতিটা এমন হয়েছিলো যে, আমি ও শুভ্রতা কেউ কাউকে ছাড়া কিছুই যেন ভাবতে পারি না। সেই কাশবনে প্রথম দেখার পর শুভ্রতাকে আমি বহুকষ্টে জয় করেছিলাম। যদিও শুভ্রতা প্রথম দেখাতেই আমার মন প্রাণ দেহ সবিই জয় করে নিয়েছে প্রথম পলকেই। এসব দু-বছর আগের কথা। কাশবনে আমাকে দেখেই মেয়েটা তখন ফিরে যাচ্ছিলো। সে খুবই বিস্মৃত হয়েছিলো আমাকে দেখে। আসলে এই নির্জন প্রান্তরে এ সময় সে কাউকে  আশা করেনি। আর কেউ এদিকে তেমন একটা আসেও না। এমন সময় অপরিচিত কাউকে দেখে যে কেউই একটু অবাক হবে। শুভ্রতাও অবাক হলো। ভয় যে পায়নি তাও নয়। আমাকে দেখে সে দ্রুত ফিরে যাচ্ছে। আর  আমি অানমনে তাকে অনুসরন করি । এ যেন মেঘের ভেলার পিছনে ছুটা। ছুঁতে চাইলেও ছোঁয়া যায় না। আনমনে হাটতে হাটতে আমার হলো কাল। একেবারে কাঁদা পানিতে ডুবাডুবি। কাঁচা রাস্তার মাঝে তৈরী হওয়া গর্ত আমাকে সাঁতার কাটিয়ে ছাড়লো। সবই কোপাল। ততক্ষণের সখি আমার দৃষ্টির বাহিরে।

যত দুরে যাও মেয়ে, নিস্তার নেই। তোমায় আমার হতেই হবে।এরপর প্রায় দিন দশেক ধরে রাজ্য জয় করার মতোই সাধনা করে আমি শুভ্রতার মন জয় করেছিলাম। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে যাই। শুভ্রতার সাথে তখন থেকে আমার ফোনে আলাপ হতো নিয়মিতই। শুভ্রতা লুকিয়ে  কল দিতো আমায়। প্রতিদিনই কথা হতো। আর একদিন মিস হলে নিদ্রা আমাদের ছুটি দিতো। শুভ্রতারতো ক্ষুধাও পালাতো।  প্রথম বার শুভ্রতার এলাকা হতে চলে যাওয়ার পর আমার  আর শুভ্রতার সাথে দেখা হয়নি। তবে আলাপ হতো নিয়মিত।
-শুভ্রতার সাথে আমার পরিচয়ের দু-বছর পর একদিন শুভ্রতার বড় ভাই বিষয়টা জেনে যায়। ফলে পুরো পরিবার শুভ্রতার সাথে কর্কশ আচারণ করতে শুরু করে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর শুভ্রতা আমাকে ফোন করে বলেছিলো আর কথা হবে না। এরপর শুভ্রতার সাথে আমার এক মাস যাবৎ কথা হয়নি। মন চাইতো শুভ্রতার কাছে উড়ে চলে যেতে, কিন্তু একদিকে পরিক্ষা অন্যদিকে পরিবার উপেক্ষা করে যাওয়াটা ছিলো অসম্ভব। আর মানসিক সাহসেরও ছিলো যথেষ্ট অভাব । যদি পরিবারের উপেক্ষা করতে পারতাম তাহলে পরিক্ষা না দিয়ে হলেও চলে যেতাম প্রিয়ার কাছে, কিন্তু মা বাবার অনুমতি ছাড়া পরিক্ষার মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার সাহস হয়নি। যদি না জানিয়ে যেতাম তাহলে সব তছনছ হয়ে যেত। পরিবারের ছোটছেলে বলে কথা।  আমি জানতাম শুভ্রতা আমার সাথে কথা না বলে ভালো নেই। শুভ্রতা আমার সাথে কথা না বলে একদিন ও থাকতে পারতো না। তবে পরিস্থিতিটা ছিলো এমনই কোন ভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে আমি প্রতিদিনই শুভ্রতার বাড়িতে ফোন করতাম। সহ্য করতাম তার পরিবারের অকথ্য গালি-গালাজ। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই পরিক্ষার শেষ করেই বাড়িতে না বলে আমি শুভ্রতার বাড়ি যাবো। সেখানে আল্লাহ যা করে তাই হবে। কারণ আমি এবং শুভ্রতা কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচার চিন্তা ও যেন করতে পারি না। আমার শেষ পরিক্ষার আগের দিন রাতে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে শুভ্রতা কল করে। ফোন ধরে শুভ্রতা  কাঁদতে থাকে।  কাঁদার জন্য কথা বলতে পারে না সে। শুধু এটুকুই বলে "একবার দেখতে চাই তোমায়"। লাইনটা কেটে যায়। এরপরে এই নাম্বারে কল করে শুভ্রতাকে আর পাইনি। এর  কিছুক্ষণ পরে শুভ্রতার বাবা আমাকে কল করে কাঁদতে থাকে। শুভ্রতা খুবই অসুস্থ, আমাকে দেখতে চাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে সেখানে যেতে। দীর্ঘদিন মানসিক বিপর্যয়, অনিদ্রা ও খাবার অনীহা হেতু শুভ্রতা মারাক্তক ভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। আমি আর থাকতে পারিনি,  যদি আমার ডানা থাকতো তাহলে উড়ে যেতাম শুভ্রতার কাছে। কিন্তু তাতো অসম্ভব। আমি ইমারজেন্সি টিকেট কেটে বাড়িতে না বলেই শুভ্রতার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হই। পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরের দিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমি এখন সেখানেই বসে আছি, যেখানে আমার আর শুভ্রতার প্রথম দেখা হয়েছিলো। নদীর কিনারের কাশফুল গুলো ঝুপসে গেছে। এই কিনারা যেন আগের চাইতে আরো বহুগুনে নির্জন। যেন পৃথিবীর সকল নির্জনতা এসে ভিড় করেছে এখানে। নদীর কুলকুল শব্দ আর কানে আসছে দক্ষিণের শীতল বায়ুর সাথে। পাখিরা যেন আজ ডাকতে ভুলে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাক ক্রমশ বাড়ছে।এখন রাত, আকাশের চাঁদটা আজ কেন যেন হাসছে না। নিথর হয়ে যেন আকাশের বুকে কাঁদছে। তার  বোবা জোছনা যেন এই প্রান্তরকে আরো ভীষন শীতল আর নিরব করে দিয়েছে। জোনাকী পোকা গুলো কাশের ঝাঁড়ে নিরবে কাতরায়।আর আমি বসে আছি আমার প্রিয়ার পাশে, শুভ্রতার খুব কাছে। দোষটা হয়তো আমার ছিলো শুভ্রতা। এতো অভিমান কেন করলে শুভ্রতা? কেন আমায় এত ভালোবাসলে? ভালোবাসলেই যখন আর একটু অপেক্ষা কেন করলে না ? আমি এসেছি শুভ্রতা, দেখ তোমার খুব কাছে। নিরব কবর হতে কোন উত্তর আসে না। রাত গভীর হতে থাকে,  আর চারদিক ভারী  হয়ে উঠে এক অতৃপ্ত প্রেমিকের আর্তচিৎকারে।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট