ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : সৌর শাইন : পর্ব : ০১




ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন


দাবানল

ভাওয়াল গড় ও মধুপুর শালবনের অগ্নিকা-ে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে ধারণা করা হয় আগুনের সূত্রপাত বনের অভ্যন্তরে একটি বাংলো বাড়ির বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে। সে বাংলো বাড়িতে গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায় আটত্রিশ বছর বয়সী এক যুবককে। বৃহৎ বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াতে সরকার, বৃক্ষ ও প্রকৃতি মন্ত্রণালয় পড়েছে চরম সমালোচনার মুখে। সবধরনের মিডিয়ার দৃষ্টি তখন দেশের অন্যতম বৃহত্তর বনাঞ্চল শালবনের দিকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বিপর্যয় কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত ভাওয়াল ও মধুপুর বনাঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি থাকবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বৃহৎ জেলা জুড়ে দাবানলের বিস্তার ঘটেছে!

প্রথমদিকে বনাঞ্চলের স্থানীয় জনগণ আগুন মোকাবেলার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের প্রায় সবগুলো ইউনিট ধীরে ধীরে যোগ দেয়। একযোগে কাজ করা সত্ত্বেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটেনি। আগুন ক্রমেই আশঙ্কা সীমার বাইরে চলে যেতে থাকে। লাগামছাড়া এ দাবানল পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ভয়াবহ এই অগ্নিকা- কি ষড়যন্ত্র নাকি দুর্ঘটনা, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। দাবানল এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে বন্য পাখিদের চিৎকার চেঁচামেচি। ওরা নিরুপায় হয়ে এদিক-সেদিক উড়াউড়ি করছে। বহুপাখি হাইওয়ে রোড ও বনের পার্শ্ববর্তী নদ-নদীর পাড়ে জড়ো হয়েছে। হাইওয়ে রোড থেকে যতদূর দেখা যায়, পুরো বন ধূ ধূ ধূসর। কালো কঙ্কালের মতো গাছ, ডাল-পালা ও মাটিতে ছাই ছড়িয়ে আছে। পোড়া বৃক্ষের পাশে পড়ে আছে বন্যপ্রাণীর দেহভস্ম। বানর, হনুমান, বনবিড়াল, বাগডাশ, সজারু ও মেছোবাঘগুলো বন ছেড়ে ভয়ঙ্করভাবে লোকালয়ের দিকে ছুটছে। অসহায় প্রাণীদের চোখে নিরাপত্তার আকুতি। নিয়তির এ নির্মম খেলা ভারি করুণ! লোকালয়ে ছুটে যাওয়া পশুদের নিয়ে মানুষ খুবই আতঙ্কগ্রস্থ! জানা গেছে, দিশেহারা গ্রামবাসী আত্মরক্ষার্থে কয়েকটা বেপরোয়া মেছোবাঘ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। বনের পাশের গ্রামগুলোও আগুনে পুড়েছে, পুড়েছে মানুষের ভাগ্য, পুড়েছে ঠিকানা।
সেসব গ্রামের মানুষ ও গবাদি পশু গৃহহারা হয়ে ঠাঁই নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কেউ কেউ হারিয়েছে ওদের স্বজন। আগুনে পুড়ে ও ধোঁয়া বন্দি হয়ে শিশু ও বৃদ্ধদের মৃত্যুর সংখ্যা সবচে বেশি। বহুসংখ্যক পশু, হাঁস-মুরগির খামার পুড়ে নিমেষে ছাই হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার সম্বল হারিয়ে ওদের শুষ্ক চোখ এখন নিঃস্ব সীমানার দিকে।

গতসপ্তাহে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে বনাঞ্চলের আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। তবে সে যৌথ অভিযানের সাথে প্রকৃতির করুণা আশীর্বাদ হয়ে নেমেছিল বৃষ্টি। অন্যথায় হয়তো পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করত।

অনুমান করা হচ্ছে গত দু’সপ্তাহের এ অগ্নিকা-ে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অন্যদিকে ধারণা করা হচ্ছে এ অগ্নিকা- ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক পরিবেশকেও চরমভাবে প্রভাবিত করবে। এর সাথে অন্যান্য দুর্যোগের আশঙ্কা তো রয়েছেই। অভিযান চলাকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে রোড ও ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে রাজধানীর সাথে উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের যোগাযোগ স্থবির হয়ে পড়ে। যার ফলে ব্যবসায়ীদের পড়তে হয়েছে চরম ক্ষতির মুখে।



মিডিয়ার দৃষ্টি

শালবন অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়েছিল একটি বাংলো বাড়ি থেকে। নিউজে সে বাড়িটির বর্ণনা ও ভিডিও চিত্র বার বার দেখানো হয়েছে। বাড়িটি গ্রামের রাস্তা থেকে কিছুটা বনের ভেতরে। বাড়ির চারপাশেই শালগাছে ভরপুর। বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হলেও, ঘরের ভেতর বহু বই-খাতা পোড়া ছাইয়ের স্তুপ দেখে মনে হয় এগুলো উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পোড়ানো হয়েছে। যাই হোক, সে ঘরে থাকা যুবকটির প্রসঙ্গ বার বার ওঠে এসেছে। যুবকটির নাম সোম মজুমদার। তিনি দুর্ঘটনায় ব্যাপকভাবে আহত হন। তবে অগ্নিকা-ের পরপরই তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তারপর থেকে চিকিৎসাধীন।

দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সোম মজুমদার অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ খবর শোনে গণমাধ্যম কর্মীরা তার সাক্ষাতকার নেবার জন্য ছুটে যায়। সেখান থেকে জানানো হয়, সোম পুরোপুরি সুস্থ নন। সুতরাং তার পক্ষে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।
পরবর্তীতে সাক্ষাতকার নিতে গেলে, সোম মজুমদারের বৃদ্ধ পিতা ফারদিন মজুমদার সরাসরি বাধা দেন। তিনি বিষয়টি নাকচ করে বলেন, সোম এ ঘটনার ব্যাপারে কোনো প্রকার সাক্ষাতকার দেবে না।
কিন্তু গণমাধ্যম এটা কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না। তারা প্রচার করে, দেশের এত বড় বিপর্যয়ের পেছনে কী কারণ বা রহস্য লুকিয়ে আছে তা জানা অবশ্যই প্রয়োজন। মিডিয়া প্রশ্ন তোলে, কী এমন ভয়ের কারণে সোম মজুমদার সাক্ষাতকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করছে?
পরদিনই সোম মজুমদার তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দেন, ঘটনার বর্ণনা দিতে আমার কোনো ভয় নেই। সাংবাদিক ভাইদের বলছি, ‘আপনারা আগামী সপ্তাহের যেকোনো দিন, সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করুন। আমি অগ্নিকা-ের সূত্রপাত কিভাবে হলো তার বর্ণনা দেব। গা শিউরে ওঠা সে ঘটনা কারোর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হবে কিনা জানি না।’

পরবর্তী সপ্তাহে সোম মজুমদার একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ঘটনার বিবৃতি দেন। যা তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ ডেকে আনে। সোম মজুমদারের ঘটনা বর্ণনা থেকে বেরিয়ে আসে অগ্নিকা-ের একটি অদ্ভূদ কারণ। বিষয়টা কারোর কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। অতি অস্বাভাবিক এ ঘটনার ব্যাখ্যা শুনে, সবার রোষানল গিয়ে পড়ে সোম মজুমদারের উপর। অনেকেই অভিযোগ করেন ও যুক্তি দাঁড় করান এই অগ্নিকা-ের জন্য দায়ী সোম মজুমদার। এখন তিনি নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যে আজব ঘটনা প্রচার করছেন। কেউ কেউ তাঁর ব্যক্তিজীবনের ঘটনা উল্লেখ করে, তাকে মানসিক রোগি বলে দাবি করেন।

সোম মজুমদার প্রথমদিকে পরিবেশবাদীদের চরম ক্ষোভের মুখে পড়ে। পাবলিক প্লেসে কেউ কেউ তাঁর প্রতি চরম দুর্ব্যবহার, রূঢ় আচরণ প্রদর্শন করে, এমন কি হত্যার হুমকিও দেয়। তখন তিনি খুবই অসহায় ও নিরুপায়। এরূপ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সোম মজুমদারের জীবন আশঙ্কা ক্রমেই বেড়ে ওঠে। একদিন টিভি নিউজে দেখা যায়, সোমের বৃদ্ধ পিতা ফারদিন মজুমদার অশ্রুসজল চোখে দু’হাত জোড় করে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাচ্ছেন। এই ঘটনাগুলো প্রায় সবার কাছে পরিচিত। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে তুলকালাম কা- ঘটিয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন পরের কথা। তখন মিডিয়ার স্বভাবসুলভ দৃষ্টি অন্যদিকে মোড় নিলো। জনতা যে খবরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে, মিডিয়ার নজর সেদিকে। জনগণের আবেগ ও মনের বিপরীত পৃষ্ঠাকে সমীহ করে চলাই কিছু তোড়জোড় গণমাধ্যমের ধর্ম। ঘটনাটা অন্যসব ঘটনার নিচে চাপা পড়ল।


রহস্যজনক মৃত্যু

কিছুদিন আগে, সৌরক বিশেষ কিছু কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিল। সেখানে ওর দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ শালবন অগ্নিকা- ওর মন খারাপের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাতে ঘুমের মধ্যেও সে দাবানলের দৃশ্য দেখতে পায়। প্রায়ই আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। অতিষ্ঠ হয়ে সে টিভি নিউজ দেখা বন্ধ করে দেয়। অভয়মিত্র ঘাটে দাঁড়িয়ে কর্ণফুলি নদীর দৃশ্য দেখে। মন খারাপকে দূরে ঠেলে দেবার কিছু পরিকল্পনা সে ভাবনার ভেতর সাজায়। সেগুলো লিখে ফেলারও চিন্তা করে। কিন্তু লিখতে গিয়ে ওর কলম ভিন্নদিকে সরে যায়। নতুন একটা সায়েন্স ফিকশনের ভাবনা উঁকি দেয়। উঁকি দেয়া ভাবনাটাকে ওর পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখা শুরু করে। ঘটনার প্যাঁচকে মাপা যায়, এমন ধাঁচের একটি নামও ঠিক করল। “মিস্ট্রি টায়াঙ্গেল”। লেখার কলম বেশ কয়েক পর্ব দৌড়ে গেলেও হঠাৎ হোঁচট খায়। তারপর লেখা এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। যখন বুঝল চট্টগ্রামের আবহাওয়ায় এ লেখা খুব বেশিদূর এগোবে না। তখন সে লেখাটা বন্ধ করে রাখল, অন্য কাজে মনোনিবেশ করল।

একদিন সকালের ট্রেনে সৌরক ঢাকায় ফিরছে। হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনে, হেড লাইন দেখে চমকে ওঠে। সেখানে লেখা,“লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে সোম মজুমদারের রহস্যজনক মৃত্যু”। বিস্তারিত খবরে লিখেছে, সেই সাথে গুরুতর আহত হয়েছেন সিনিয়র টিভি সাংবাদিক মৃদুল হাসান, সোম মজুমদারের বন্ধু অনীল উৎসবসহ আরো কয়েকজন। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেলে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। পত্রিকার রিপোর্টে মূল ঘটনা এড়িয়ে পরবর্তী পরিস্থিতির প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। দুর্ঘটনার সঠিক কারণও উল্লেখ নেই। ঘটনাটি সৌরককে ভাবিয়ে তুলল।

সোম মজুমদার ছিল একটি অচেনা সাধারণ নাম। তিনি কোনো সুপার স্টার নন। তবু তর্ক-বিতর্কের বদৌলতে তাকে এখন সারাদেশ চেনে। কিছু বিশেষ কারণে চ্যানেল “অনুসন্ধান” সোম মজুমদারকে নিয়ে একটি লাইভ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন সিনিয়র রিপোর্টার মৃদুল হাসান, সৌরক যাকে মৃদু ভাই বলে ডাকে। অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল ব্যাপক। এক সপ্তাহ আগে থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা শুরু হয়। সৌরকেরও ইচ্ছে ছিল, সরাসরি অনুষ্ঠানটি দেখার। কিন্তু কিছু ব্যস্ততা ও নিয়ন্ত্রিত সময় তা হতে দিলো না।

ঢাকায় ফেরার পরপরই সৌরক বিষয়টি পুরোপুরি জানার চেষ্টা করল। ওর কয়েকজন মিডিয়াকর্মী বন্ধু তাদের ধারণা থেকে বলল, লাইভ অনুষ্ঠানে সোম মজুমদারকে হয়তো পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সৌরক কোথাও সঠিক কোনো সংবাদ পেল না। কেবল ধোঁয়াশা মাখা কিছু তথ্য ওর কানে পৌঁছল।

দুর্ঘটনার পরবর্তী সময় থেকে “অনুসন্ধান” চ্যানেলে ঐ লাইভ অনুষ্ঠানের খ-িত অংশ বার বার স¤প্রচার করা হয় ও শোক জানানো হয়। নিউজে জানায় সোম মজুমদারের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মৃত্যুর কারণ জানানো হবে। তবে ডাক্তার ধারণা করছে, তিনি ব্রেইন স্টোকজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে থাকতে পারেন। এদিকে ঘটনা তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি ইমার্জেন্সি ইনভেস্টিগেশান কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন প্রদান করা হবে।

সেদিন বিকেলেই সৌরক মনোযোগ দিয়ে ভিডিও ক্লিপটা দেখল। মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিটের ভিডিও। সরাসরি স¤প্রচারকৃত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করা হয় শালবনের ভেতর ঐ বাংলো বাড়ি থেকে। যেখানে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়েছিল। দেখেই আন্দাজ করা যায় বাংলোটি বেশ পুরনো। ঘরের ভেতর একদিকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো কয়েকটা বড় ধরনের আলমারি। ঘরের অন্যপাশে কতগুলো পোড়া কাঠ ও ছাইয়ের স্তুপ। দেয়াল ও ছাদের দিকে ক্যামেরা ধরতেই ফুটে ওঠে পোড়া কালির ছাপচিত্র।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সোম মজুমদার প্রথম দিকে খুব স্বাভাবিকভাবে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনার চক্রে চক্রে ওঠে আসছিল, সোম মজুমদারের পিতামহ গণিতবিদ ডক্টর রিয়ন সাহেবের (প্রকৃত নাম আবুল কালাম মজুমদার) ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা ও বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের সমীকরণ সমূহ। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ও দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরেন। দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল তিনি মাথায় প্রচ- আঘাত পেয়েছেন। মাথা ফেটে রক্তপাত হলো। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন মৃদুল হাসান। তিনি সোম মজুমদারের পাশের চেয়ারে বসা ছিলেন। সোম মজুমদারের চিৎকারের পরপরই মৃদুল হাসান চেয়ার থেকে পড়ে যান। ততক্ষণে সে ঘরে সৃষ্টি হয় প্রলয় কা-। ক্যামেরাটা অনবরত কাঁপতে থাকে। পুরনো বড় বড় আলমারিগুলো একে একে মেঝেতে পড়তে শুরু করে। আলমারি চাপা পড়ে ক্যামেরাটা বিচূর্ণ হয়ে যায়। তারপর স¤প্রচার বন্ধ।

পুরো ঘটনাটি সৌরককে দারুণভাবে ভাবিয়েছে। সিনিয়র রিপোর্টার মৃদু ভাইয়ের জন্য ওর খুব খারাপ লাগছিল। মৃদু ভাইয়ের সাথে ওর সখ্য তৈরি হয় অক্ষিপট সাহিত্য আড্ডা থেকে। তাঁর দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তি শুনতে বেশ ভাললাগে। তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও সুচিন্তিত যৌক্তিক সমালোচনা বোধশক্তি সম্পন্ন যে কাউকে অনায়াসে নাড়া দিবে। বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই মানুষটি সৌরককে বরাবরই দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। মৃদুল হাসানও সৌরককে খুব ¯েœহ করতেন।
রাতে সৌরক ওর বন্ধু নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক মৌন মিহিরের সাথে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা বলল। মৌন মিহিরও মৃদু ভাইয়ের ঘটনায় খুব বিধ্বস্ত। মৌন জানাল, মৃদু ভাইকে আজ সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল থেকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ওরা দু’জনই ঠিক করল আগামীকাল মৃদুল হাসানকে দেখতে যাবে।

ভোর। সৌরক তখন বিছানায়। ঘুমো স্বপ্নে বিভোর। সে একটি টিভি নাটকের স্ক্রিপ্টে ইডিটিংয়ের লাঙল চালাচ্ছে। ঠিক তখনই মৌনর কল বেজে ওঠে। ইডিটিংয়ের ব্যস্ততায় ছেদ পড়ে। সৌরক চোখ বন্ধ রেখেই কলটা রিসিভ করে।
সৌরক।
বল।
আমি তোর বাসার সামনে। দ্রুত নেমে আয়।
এত সকালেই চলে এলি।
শুনলাম মৃদু ভাইয়ের অবস্থা ভাল নয়। মাথায় সাংঘাতিক আঘাত পেয়েছেন। তাঁকে আজই সিঙ্গাপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সৌরক আর স্থির থাকতে পারল না। শার্ট-প্যান্ট পরে নিচে নেমে, ট্যাক্সিতে মৌনর পাশে বসল। তারপর সোজা স্কয়ার হাসপাতাল।

মৃদুল হাসানকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তাঁর সিটিস্ক্যান ও এমআরআই রিপোর্ট ভাল নয়। সন্ধ্যার ফ্লাইটে তাঁকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হলো। সৌরক খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সোম মজুমদারের বন্ধু অনীল উৎসব ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি। সৌরক ও মৌন সেখানে ছুটে যায়। দেখে তার পরিস্থিতিও গুরুতর।

ময়না তদন্তে সোম মজুমদারের ব্রেইন স্ট্রোক প্রমাণ হয়নি। লক্ষণ দেখে ধারণা করা হয়, তিনি শ্বাসরুদ্ধ ও মাথায় আঘাত জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মাথায় আঘাতের চিহ্নগুলো খুব অদ্ভুত! এটা আলমারি কিংবা মেঝেতে পড়ে চাপ লাগার মতো আঘাত নয়। কেউ যেন পুরো মাথাকে চারদিক থেকে চাপ দিয়ে প্রায় থেঁতলে দিয়েছে!

অন্যদিকে জরুরি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বের হলো। ঘটনাটিকে অস্বাভাবিক ও আকস্মিক বলে অভিহিত করা হয়। এরূপ ব্যাখ্যাহীন রিপোর্ট দেখে সৌরক খুব অবাক হলো। সৌরক ও মৌন বিষয়টি নিয়ে একটু গভীরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলো। মৌন বলছিল, এখানে কেমন মিথ্যা আর ষড়যন্ত্রমূলক গন্ধ পাচ্ছি।
ওরা দুজনই কয়েকবার ভিডিও ক্লিপটি দেখল। অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারেনি।
মৌন বলল, ভূ-তত্ত্ব অধিদপ্তর জানিয়েছে সেদিন ভূমিকম্পের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাহলে এমন হবে কেন?
নিশ্চয়ই এই ভিডিও ক্লিপের বাইরে রয়েছে কোনো রহস্য ও রোমাঞ্চকর ঘটনা।
আমারও তাই মনে হয় সৌরক।
পাঁচদিন পর সিনিয়র রিপোর্টার মৃদুল হাসানের মৃত্যু সংবাদ শোনা যায়। কষ্টে সৌরকের হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছিল। মৃদু ভাইয়ের ফর্সা রাশভারী মুখটা বার বার ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁর দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তি ধ্বনিত হয় ওর কানে। সৌরকের দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মৃদু ভাইকে হারানোর ব্যথা কখনোই সে ভুলতে পারবে না।


কালো কু-লী

কিছুদিন পরের কথা। মরহুম সোম মজুমদারের বন্ধু অনীল উৎসব খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠেছেন। কথাও বলতে পারেন। সৌরক ও মৌন ঠিক করল ল্যাবএইড হাসপাতালে যাবে। ওরা অনীল উৎসবের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনতে চায়। মৃদু ভাইয়ের মৃত্যু কি কোনো দুর্ঘটনা না হত্যাকা-? এই প্রশ্নটাই ওদেরকে বার বার আঘাত করছে।

অনীল উৎসব বললেন, মিডিয়ার সমালোচনা সোমকে মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল করে ফেলে। ও এসব বিতর্ক একদম সহ্য করতে পারেনি। জীবনের প্রতি ওর বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। মৃদু ভাইয়ের সাথে মূল ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করার পর, উনি সোম ও তার বাবার একটি সাক্ষাতকার নিয়ে রিপোর্ট প্রচার করে। তারপর উনি একটি লাইভ অনুষ্ঠানে সোমের পুরো ঘটনা তুলে ধরার পরিকল্পনা নেন। যেখানে দর্শক ফোনকলের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারবে, তাদের মতামত দিতে পারবে। মৃদু ভাইয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী শালবনের ঐ বাংলো বাড়িটিকে ভ্যেনু করে সরাসরি অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, খুব সুন্দরভাবে লাইভ অনুষ্ঠান স¤প্রচার শুরু হয়। আমরা ক্যামেরার পেছনে ছিলাম। লাইভ অনুষ্ঠানটা কিভাবে প্রচার হচ্ছে তা মৃদু ভাইয়ের নির্দেশে অনলাইনে চেক করেও দেখছিলাম।
হঠাৎ পোড়া গন্ধ নাকে আসে। সেই সাথে ঘরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আমি সোমের পিছনে একটি ছাই রঙের শেপ দেখতে পাই। এটি অন্য কেউ দেখেছে কিনা জানি না, ভিডিওতে সে শেপ এসেছে কিনা তাও জানি না। তৎক্ষণাৎ সোম ওর মাথা দু’হাতে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে। মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি আলমারিগুলো ঠেলে আমাদের উপর ফেলে দিচ্ছে। একটি আলমারি সোম ও মৃদু ভাইয়ের উপর পড়ে। পরের মুহূর্তে আরেকটি আলমারি ক্যামেরাম্যান জাহিদ ভাইয়ের উপর পড়ে। আমি তার সাথেই ছিলাম, আমিও আঘাত পাই, সেই সাথে ক্যামেরাটা আলমারির তলায় চাপা পড়ে স¤প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। তখনও আমার জ্ঞান আছে। দেখতে পাই সোম ছটফট করছে, একটি নারীর ছায়া বার বার ওর কাছে আসছে। যদিও সেখানে কোনো মহিলা ছিল না। ছায়াটা যখন কাছে আসছে, তখন সে স্বস্তি পাচ্ছে। ছাই রঙের শেপটি সে ছায়াকে দূরে ঠেলে সোমের মাথা ও গলার চারপাশ ঘিরে চেপে ধরে। তখন সে শেপটিকে কালো কু-লি মনে হচ্ছিল। এক সময় দেখতে পাই সোম নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। ওর ছটফট চিরতরে সান্ত হয়ে যায়। তারপরেই ছাই রঙের স্যাপটি একে একে সবার ওপর হামলে পড়ে। তখন সে নারী ছায়াটি দূরে সরে যায়। আমাকে যখন আক্রমণ করে তখন মাথায় প্রচ- চাপ অনুভূত হয়। একমুহূর্ত পরেই জ্ঞান হারাই।

ওরা দু’জন অবাক হয়ে ঘটনাটি শুনল। বিশ্বাস অবিশ্বাস ওরা কিছুই জানে না। তবে এই অস্বাভাবিক ঘটনা সৌরক কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।
সে বলল, উৎসব ভাই, আমি আপনাকে অনুরোধ করব, মূল ঘটনাটি খুলে বলার জন্য। ভৌতিক, অদ্ভুত বা অসংজ্ঞায়িত কোনো কিছু আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনীল উৎসব বললেন, সৌরক ভাই, এরূপ ঘটনা বিশ্বাস না করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ব্যাখ্যাহীনতার পেছনে কী কারণ লুকিয়ে আছে তা আপনাদের জানা উচিত।
মৌন বলল, আপনি নির্ভয়ে বলুন। আমরা সবকিছু শুনব।
অনীল উৎসব বলে ওঠলেন, কিছু ঘটনার ব্যাখ্যাহীন দ্বন্দ্বে আমিও ভুগছি। সোম বেশ কিছুদিন আগে ঐ বাংলো বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করে। বলা যায়, অনেকটা বিলাসী ভাবনা থেকে ওর বনে বাস করা। শালবনের ভেতর বাংলো বাড়িটি ওর দাদাজানের রেখে যাওয়া একমাত্র সম্পত্তি। সোম, সেখানে থাকাকালীন বহু অস্বাভাবিক ঘটনার মুখোমুখি হয়। যা কেবল সে জানে, আমার কাছে কিছুটা শেয়ার করলেও, তা আমি অবিশ্বাসের হাসিতে ছুঁড়ে দিয়েছি। ওর কাছে জানতে পারি এই অস্বাভাবিকতার যোগসূত্র রয়েছে শালবন অগ্নিকা-ের পেছনে। সোমকে যখন সবাই ঘৃণা করছিল, তখন সে পুরো ঘটনা লেখার সিদ্ধান্ত নেয়। লেখার কথা আমাকে সে অনেকবার জানিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, অগ্নিকা-ের ঘটনাটা লেখা সম্পন্ন হলে, সোমের বই প্রকাশ করব। পাগল মিডিয়ার ও হুজুগে মানুষদের ভুলগুলো শোধরানো খুব প্রয়োজন। ও মৃত্যুর আগের দিন অনুরোধ করে বলেছিল, লেখাগুলো যেন ওর মৃত্যুর পর প্রকাশ পায়। অর্থাৎ বইটি আত্মজীবনী হিসেবে গৃহীত হোক তাই সে চেয়েছিল। কে জানত, তার পরদিনই এ ঘটনা ঘটবে। এভাবে ওর মৃত্যু হবে।
বলতে বলতে অনীল উৎসব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন।
সৌরক বলল, একটু শান্ত হউন। আমরা পুরো বিষয়টা জানতে চাই।
মৌন বলল, সোম মজুমদারের লেখাগুলো কোথায় আছে? সেগুলো কি আমরা পড়তে পারি?
লেখাগুলো সোমদের বাসায় থাকতে পারে। ওর বাবার সাথে যোগাযোগ করলে এ ব্যাপারে জানা যাবে।
সৌরক বলল, এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
অনীল উৎসব বললেন, সৌরক ভাই, আমার নিজস্ব কোনো ধারণা নেই। আমি বাস্তবিকভাবে হতভম্ভ! তবে এ ঘটনার সাথে সোমের দাদাজানের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সোম বলেছিল তাঁর দাদাজান গণিতবিদ ড. রিয়ন মজুমদার বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের সূত্র আবিষ্কার করেন। সে সূত্রটির পেছনে ভিন্ন মাত্রিক জগতের শত্রু হানা দিতে থাকে। সোমের কথাকে আমি পাত্তা দেইনি। আসলে সে সময় কথাগুলো শুনতে চাইনি। কিন্তু এ হত্যাকা-ের পর, আমার ধারণা চতুর্মাত্রিক জগতের কোনো এক আগুন্তুক এই ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে।

আত্মজীবনীর সন্ধান

অনীল উৎসব সুস্থ হয়ে ওঠলেন। একদিন সৌরক ও মৌনকে তিনি সোমদের বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে ওরা সোমের বাবা বৃদ্ধ ফারদিন মজুমদারের সাথে সাক্ষাত করে। অনীল উৎসবের মুখে পুত্রহারা পিতা যখন শুনলল, ওরা সোম সম্পর্কে জানতে এসেছে। তখন তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তবে তিনি ঐ বাংলো বাড়ি ও ড. রিয়ন মজুমদার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। বললেন, ড. রিয়ন সাহেব, আমার পিতা হলেও, তাঁর সাথে আমাদের তেমন যোগাযোগ ছিলো না। রিয়ন সাহেব ঐ বাংলো বাড়িতে বাস করতেন, টিভি নিউজের মাধ্যমে সর্বপ্রথম আমরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারি।
মৌন বলল, সোম মজুমদারের আত্মজীবনীটি আমরা পড়তে ইচ্ছুক।
বৃদ্ধ বললেন, আমি তো সে সম্পর্কে কিছুই জানি না, বাবা।

অতঃপর অনীল উৎসব বললেন, চাচা, আমি দেখেছি সোম চকলেট রঙের একটি খাতায় ওর আত্মজীবনী এবং অগ্নিকা-ের ঘটনা সম্পর্কে কিছু লিখছিল। ওর লেখা শেষ হয়েছে, তাও বলেছে। আপনি অনুমতি দিলে, সোমের ঘরে খুঁজে দেখব।
ঠিক আছে, যাও দেখো।
ফারদিন মজুমদার অনুমতি দেবার পর ওরা সে ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকেই অনীল উৎসব দৌড়ে টেবিলের উপর থেকে চকলেট রঙের খাতাটি হাতে নিলেন।

সৌরক ও মৌন লেখাগুলো দেখল।
মৌন বলল, আমরা লেখাটা পড়তে চাই। অনুমতি দিলে নেব।
অনীল উৎসব সোমের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ফটোকপি করে উনাদের একটি কপি দেই।
ফারদিন মজুমদার সায় দিতেই, অনীল উৎসব বেরিয়ে গেলেন। এদিকে একজন কাজের লোক অতিথি সমাদরের আয়োজন স্বরূপ চা নাস্তা পরিবেশন করল।

ওরা ফিরে আসার আগে ফারদিন মজুমদার বললেন, শোনো বাবা, আমার ছেলে এক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেও, বিগত পাঁচ ধরে সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। দয়া করে আমার ছেলেকে পাগল ভেব না, প্লিজ।
মৌন বলল, না, আঙ্কেল। আমরা জাস্ট লেখাটা পড়ব। মিডিয়ার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।

চলে আসার আগে সৌরক পাশের কক্ষে উঁকি দিয়ে সোম মজুমদারের মাকে দেখল। উনি প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যায়।
ফারদিন মজুমদার বললেন, অনেক বছর হয়েছে বিছানায়। ছেলের মৃত্যুর সংবাদ জানাইনি। কিছু বুঝতে পেরেছে কিনা জানি না, বেশ কদিন ধরে কথা বলা বন্ধ। আগে অল্প অল্প কথা বলত, এখন তাও বলে না। বলতে বলতে বৃদ্ধ কেঁদে ফেললেন।

ফেরার সময় বাইরে বেরিয়ে অনীল উৎসব দু’জনকে বললেন, আপনারা লেখক মানুষ। সোমের এই ইচ্ছেটা পূরণ করবেন তো? খরচটা না হয় আমিই বহন করব। আপনারা চেষ্টা করলে..।
সৌরক বলল, কথা দিলাম ভাই। ভাল প্রকাশনী থেকে বইটা প্রকাশ পাবে। উনার মৃত্যুর অংশটাও ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

পা-ুলিপির পৃষ্ঠা

তখন সন্ধ্যা। সৌরক ও মৌন ধানম-ি লেকের পাড়ে বসে আছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওরা সোম মজুমদারের বাবাকে নিয়ে কথা বলছিল।
সৌরক বলল, লোকটার জন্য ভীষণ মায়া হয়। একমাত্র সন্তানকে হারাল, ঘরে স্ত্রীটাও মৃত্যু পথযাত্রী। উনার অবস্থাও একইরকম।
মৌন একটা নিশ্বাস ফেলল।
হ্যাঁ, শীঘ্রই তাঁর বেঁচে থাকার সাথে যোগ হবে একাকিত্ব!
পা-ুলিপিটা ভালভাবে পড়তে হবে। ভেতরের ঘটনাটা জানার পর হয়তো কিছু বুঝতে পারব।
মৌন অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, সৌরক শোন, পা-ুলিপিটা আমি আগে পড়ব। ওটার প্রতি প্রথম থেকেই আমার আগ্রহ।
শোন, আজ ওটা না পড়লে আমার ঘুমও হবে না, ক্ষুধাও মিটবে না। তাছাড়া এই ভূতটা মাথা থেকে দূর করতে না পারলে, নতুন লেখাটাতে গতি আনা, ইম্পসিবল হয়ে পড়বে।
কী লিখছিসরে?
সে তেমন কিছু না, চিটাগং গিয়ে শুরু করেছিলাম “মিস্ট্রি টায়াঙ্গেল” সায়েন্স ফিকশন।
মৌন হাসল। ঠিক আছে। পা-ুলিপিটা তুই-ই পড়। তবে সময় সীমিত।
থ্যাংকস মৌন। তোর নতুন কোনো নাটক লেখা হয়েছে?
না। তবে লিখব ভাবছি। সোম মজুমদার ও মৃদু ভাইয়ের ঘটনা নিয়ে।

গল্প আড্ডা ও খুনসুটি শেষে রাত ন’টার দিকে সৌরক বাসায় ফিরে এল। মধ্যরাতে সে সোম মজুমদারের পা-ুলিপিটা পড়া শুরু করল। না, মিডিয়া সোম মজুমদারকে পাগল বলুক আর যাই বলুক, তাঁর হাতের লেখা বেশ স্পষ্ট ও সুন্দর! ভাষাটাও সাবলীল। পড়তে গিয়ে বিরক্ত হবার সুযোগ নেই।

সৌরক লেখাটা একটানা পড়ে যাচ্ছে। উল্টাচ্ছে পা-ুলিপির একের পর এক পৃষ্ঠা।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট