চিঠি




চিঠি
আনোয়ার রশীদ সাগর

নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ ও এলোমেলো বিষন্নতা নিয়ে বসে আছি পড়ার টেবিলে। হুড়পাড় শব্দ করে পদ্মার পাড় ভাঙে, ফিসফিস করে দু’এক ফোটা বৃষ্টি নেমেই থেমে যায়। মেঘগুলো কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মেঘের ফাকে চাঁদের জ্যোৎস্না হেসে উঠছে,আমার অবাধ্য মনও মেঘের সাথে বার বার চলে যাচ্ছে-ফিরে আসছে। অজানা অচেনা পথে হাঁটার মত, চোখ বুজলে দেখতে পায় আমাকে...
ইস তুই না বড় হ্যাবলা?
লালিমা কথা বলেই আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি ওর হাসি-খুশি মুখবয়টা বার বার দেখতে পায়।
আবার লালিমা আমার ওড়না ধরে টেনে বলে, দেখলি না স্বপ্ন তোর জন্য চিঠি রেখে গেল।
আমি মুখ ফসকিয়ে বলে ফেলি, কোথায়?
লালিমার সজনে ডাটার মত হাতটা উত্তর দিকে উঁচু কওে দেখানোর চেষ্টা করে বলে, ঐ যে সাইন্স বিল্ডিংএর জানালার উপর ইটের নিচে।
আমি পা বাড়াতেই ইংরেজির শিক্ষক ছড়ি হাতে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করল। ওরে বাবা, আজ ডিসিপ্লিন রচনা মুখস্ত করে আসতে বলেছিল। আমার বুকের মধ্যে  ভুমিকম্পন শুরু হয়ে যায়, পড়া তো হয়নি। স্যার দাঁড় করিয়ে হাতে সপাং সপাং মারে, অপমান করে।
আমার পড়া হবে কি করে?- গতরাতে বরপক্ষ ছেলেসহ আমাকে দেখতে এসেছিল। হাতে সোনার আংটি পরিয়ে রেখে গেছে। ছেলে ইউরোপের কোন এক দেশে থাকে। বুকের মধ্যে সম্পানের নাও বয়ে যায় সারারাত।
আমাকেও নিয়ে যাবে বিদেশে। সবেমাত্র দশম শ্রেণিতে পড়ি।
চেয়ারম্যান সাহেব বাবার বন্ধু, তাই বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন করে দিবে। বিয়ে হয়ে যাবেই।
স্যার ক্লাসে এসেই বলে, কার কার পড়া হয়নি? -দাঁড়াও।
যথারীতি দাঁড়িয়ে পায়ের দিকে মুখ করে, মাথা নিচু করে থাকলাম। যারা যারা আমার মত দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতের উপর চলছে লাঠির আঘাত। স্যার আমার কাছে আসতেই, আমি ডান হাতটা সোজা করে স্যারের সামনে মেলিয়ে দিলাম। স্যারের চোখ আমার রাঙা হাতের সোনার আংটির দিকে। আমার মুখের দিকেও  দু’ একবার তাকালো; তারপর বলল, তোমার বিয়ে নাকি?
আমি মাথা নিচু করে, নিরবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।
হঠাৎ দড়বড় শব্দে বৃষ্টি নেমে এলো। বাইরে জানালার কাছে কলাগাছের পাতার উপর বৃষ্টির ফোটা জোরে জোরে আঘাত করায় যেন স্মৃতির পাতা থেকে ফিরে এলাম।
শামীমের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার, এক বছর হতে চলল। বিয়ে করে বাসর ঘর করে, সোনার গহনা-পোষাক-টাকা-পয়সায় ভরিয়ে দিয়ে চলে গেছে বিদেশে। যাওয়ার সময় বলে গেছে, মন দিয়ে পড়বা, বেশি বেশি ইংরেজি শিখবা। কিন্তু আমার চারিদিকে হাহাকার, মানুষের আহাজারি। পদ্মার ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। দুই তিন কিলোমিটার ভাঙতে ভাঙতে  আমাদের বাড়ির পাশে চলে এসেছে।
 একাকিত্ব আমার চারপাশ আটকিয়ে ধরেছে। মেঘের মত ভেসে যাচ্ছি উদ্দেশ্যহীন। ইটের নিচের চিঠিটা খুঁজি সারাক্ষণ। কি লিখেছিল স্বপ্ন? স্বপ্ন আমার সাথেই পড়তো। স্বপ্নকে  ও স্বপ্ন’র চিঠিকে  জানার আগ্রহ মাঝে মাঝে আমাকে পাগল করে তোলে, উতলা হয়ে ওঠে মন। কাশফুলের ঝরা পাপড়ির মত কল্পিত চিঠির উপর মনটা আছড়িয়ে পড়ে। পদ্মার ভাঙনের মত স্মৃতির ধারগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ে। দূরে আধো-আলো ছায়ায় দেখা যাচ্ছে, বাড়ন্ত কদম গাছটি পদ্মার ভাঙনের সাথে হেলে পড়ছে।
দু বছর পরের ঘটনা।
আমার স্বামী আসবে করে করেও বাড়ি আসে না। টাকা পাঠায়।  মোবাইলে কোনদিন কথা বললে, ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। মোবাইলে কথা বলতে হলেও, কোন মোবাইল ব্যবসায়ীর দোকানে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। মোবাইল ব্যবসায়ী ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম। তবে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট সে। আপা বলে ডাকতো। দু’সপ্তাহ বা তিন সপ্তাহ্ পর পর সংবাদ দিত, আপা দুলা ভাই অমোকদিন বিকালে ফোন করবে আপনাকে আমার দোকানে থাকতে বলেছে। যেতাম, অপেক্ষা করতাম। ফোন করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো বা কোন কোনদিন রাতও হয়ে যেতো। আমি ওই দোকানে গেলে বেশ কয়েকজন ছেলে এসে আড্ডা দিত। বুঝতে পারতাম আমাকে নিয়ে ওদের আলোচনা চলতো। এও বুঝতাম আলোচনার বিষয় থাকতো বেশ রোমান্টিক। মাঝে মাঝে মনে হতো, মিশে যায় ওদের সাথে। একদিন ওদের সাথে সিনেমা হলেও ঢুকেছিলাম, সিনেমা দেখেছিলাম। যেদিন সিনেমা হলে সিনেমা  দেখছিলাম, সেদিনই লিলিমা আর তার স্বামীও সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। কাকতালীয় ভাবে আমি আর লিলিমা এক জায়গায় পাশাপাশি সিটে বসেছিলাম। লিলিমার স্বামী ওর ডান দিকে আর আমি ওর বামদিকের সিটে বসেছিলাম। উহ্ যাদের সাথে সিনেমা দেখতে এসেছিলাম, ে দেখেছিলাম, তাদের আফসোস। আমি যেন ওদের হাত ছাড়া হয়ে গেছি। চাঁদ হয়ে আলো ছড়িয়েছি ওদের মনে অথচ মেঘ এসে বরষা ঝরিয়েছে ওদের মুখে।
এর মধ্যে আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাটা হয়ে গেল। বাড়ির কাছে যে স্কুলে পড়তাম, ওই স্কুলে একাদশ শ্রেণি খোলায়, ওখানেই লেখাপড়া করতাম। বেশ রিলাক্সে সময় কাটছিল। স্বপ্ন জেলা শহরের কলেজে পড়তো। পরীক্ষা দিয়ে ও বাড়ি এসেছে। আমাদের গ্রামের ছেলে হলেও,  তেমন কথা হয়নি ওর সাথে। শুধু চিঠি দিতো, আমি পাগলের মত ওর আবেগপূর্ণ চিঠিগুলো পড়তাম। হয়তো আমি চিঠি পড়ে মুগ্ধ হয়ে জোছনাময় অথবা আলোময় দুপুর খুঁজছি, ছুটে চলেছে আমার মন টুনটুনি পাখির মত বসন্ত দুয়ারে, ফুলে ফুলে, ঘুরে ঘুরে, ফুটন্ত পাপড়িগুলো ঝরাতে চায়। নতুন চৈত্রদিনের প্রত্যাশায় সারাক্ষণ মৃদু ওম বাতাস  ও তপ্ত ছায়ার সন্ধানে চলি।
        একদিন বেরিয়ে পড়লাম, অজানা-অচেনা পথে। স্বপ্ন এর দু’জন বন্ধু স্বাধীন আর উদয় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কলকল শব্দে মাঠ থেকে, ক্যানেল দিয়ে, নদীতে পানি নামছে। বেশ খানিক আগে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ভীষণ অন্ধকার ছিল আকাশটা। কালো মেঘে রাতটাকে আরো কালো করে তুলেছিল।
এখন বেশ পরিস্কার ঝকঝকে লাগছে পরিবেশ। আকাশের মাঝখানে চাঁদটা ঝলমল করে হাসছে, যেন দুপুরের সূর্যমূখী ফুল ফুটেছে-মেলে দিয়েছে পাপড়িগুলো। আমি স্বাধীন আর উদয়ের মাঝে হাটছি।নদীর ধার দিয়ে হেটে চলেছি। স্বাধীনের ডাকে সাড়া দিয়েছি।
‘স্বপ্ন’ এর সাথে  মুখোমুখি কথা না  হলেও, শুধু ওর আবেগে ভরা চিঠিগুলো পড়েই ঘর ছেড়েছি। আমার শরীর ভর্তি গহনা রয়েছে। বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা যা ছিল, সব সঙ্গে নিয়েছি। কোথায় যাচ্ছি জানিনা, শুধু জানি ছায়ার মত, বন্ধু-সহপাঠী স্বপ্ন আছে আমার সাথে। যাকে নিয়ে আমার কল্পনা, আমার উড়–উড়– বাসনা, সারাক্ষণ পাখা মেলে থাকে, তার কাছে যাচ্ছি।
দূরে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ঝড়-জঙ্গল ছেড়ে ক্যানেলের ধারে এক পায়ে দাঁড়ানো একটি তাল গাছের নিচে পৌছালাম। জ্যোৎস্নালোয় দেখা যাচ্ছে, একটা টিনের বেশ বড় বাড়ি। ওই বাড়ি থেকে স্বপ্ন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কয়েকবার চুমু খেলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটনাটা ঘটছে এবং আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর পাতলা বুকটা আমার নরম বুকে লেপটে আছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছি দু'জনেই। কয়েক মিনিট পর আমার ডানহাতটা চেপে ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। ওই বাড়ির ভিতর গিয়ে দেখতে পেলাম, একজন কাজী আর দু’জন লোক বসে আছে। কাজী সাহেব খুব তাড়াতাড়ি আমাদেরকে ওজু করে তার সামনে গিয়ে বসতে বলল। স্বপ্ন খুব দ্রুত ওজু করল। আমার বেশ খানিক দেরি হল। আমার মাথায় যেন কোন কাজ করছে না, হ্যাঙ হয়ে গেছে। তারপর যখন তালাকনামায় স্বাক্ষর করলাম তখন বুকটায় যেন বড় কোন পাথর এসে চেপে বসল। চোখে পানি টলটল করছে। আমি কিছুই বলতে পারছি না। না কবুল অথবা না তালাক। শুধু একের পর এক হুজুর কাগজ এগিয়ে দিচ্ছে আর আমি স্বাক্ষর করে দিচ্ছি। আমি কি শাড়ি বদল করছি, না ঘর বদল করছি, বুঝতে পারছি না। আমার এতদিনের সমস্ত আবেগ ও অনুভূতি বিকল হয়ে গেছে। বার বার বাবা-মা আর স্বামীর কথা মনে হচ্ছে। যেন আমার স্বামী শামীম, আমাকে ফোন করে বলছে, ভাল করে লেখাপড়া করবা, মা-বাবাকে দেখবা। যা লাগবে, শুধু বলবা। ওর কণ্ঠ আমাকে ব্যস্ত করে তুলেছে। মৌ, মৌ আমার মৌ, ভাল থেকো, সোনা-মধু ফোন করো...। এ যেন বাস্তব এক চিঠি, আমাকে বার বার উতলা করে তুলছে, মৌ কিছু বলো, আমিই শুধু বলছি, তুমি কিছু বলো। আমি খিলখিল করে হেসে পড়েছি। অমনি আমার সামনে বসা হুজুর চুমকিয়ে উঠেছে। যেন ভয় পেয়ে গেছে।
স্বপ্ন, স্বাধীন ও উদয় হুজুরের সাথে মোনাজাত করছে। তখন আমি হাউমাউ করে কাঁদছি। আকাশটা আবার মেঘে ঢেকে গেছে। ঝরঝর করে বৃষ্টি নেমে গেল। আমার শামীমের দেওয়া গহনাগুলো, আমার শরীরকে ধিক্কার দিতে লাগল। আমি উড়ছি খোলা আকাশে, বৃষ্টির মধ্যে। ভারী ভারী গহনা ছুঁড়ে ফেলে পাতলা হচ্ছি। স্বপ্ন এর আবেগপূর্ণ চিঠিগুলো ভিজে ভিজে যাচ্ছে, বৃষ্টির ফোটায়। কালো কালো কাগজে ছড়ানো কালি, কাগজের পাতা থেকে ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে। সাদা খন্ডখন্ড কাগজ ভেসে যাচ্ছে নর্দমায়।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট