নীরার নীল শাড়ি ও কয়েকটা কদমফুল



নীরার নীল শাড়ি ও কয়েকটা কদমফুল
রফিকুল নাজিম



শাওয়ার ছেড়ে আসা নীরাকে আয়নার সামনে সদ্য ফোটা পদ্মফুলের মতোই লাগে। আজও লাগছে। এই দিনে নীরা খুব সাজতে পছন্দ করে। প্রতিবারই নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরে, সাথে সাদা ব্লাউজ, হাতে পরে সাদা-নীল রেশমি চুড়ি। টানা টানা চোখের পাতায় লেপ্টে থাকে মায়ার কাজল, ঠোঁটে জড়িয়ে যায় গাঢ় লাল লিপস্টিক এবং কপালের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা কালো টিপ পরে। ঠিক যেন অমরাবতী, অনন্যা। অদ্ভুত এক আলো ঠিকরে পরে তার চোখে মুখে। নীরার চোখে শতাব্দীর ব্যাকুলতা, সমানতালে পায়ে পায়ে হাঁটে অস্থিরতা। নীরা কিছু একটা খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। রাগে গজগজ করে ডাকছে তমালকে। এদিকে তমাল কানে তালা দিয়ে বিভোর ঘুমে ডুবে আছে। রাগে কটমট করতে করতে বেড রুমে ঢুকে তমালের শরীর ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করছে
তমাল, আমার বেলি কোথায়? এই তমাল, শুনছো-আমার বেলিফুল কোথায়?
তমাল আড়মোড়া দিয়ে আধেক চোখ খুলে দেখে নীরার অগ্নিমূর্তি। তমালের বুঝতে আর বাকি রইলো না-আজ ০২ শ্রাবণ। আজ নীরার দিন। এই দিনে নীরার বেলী ফুলের মালা চাই-ই চাই। তমাল কিছু না বলেই ডাইনিং রুমের দিকে ছুটে গেলো। সাদা একটা কাগজের ঠোঙা নীরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এই নাও তোমার বেলি ফুলের মালা।’
ঠোঙা থেকে মালাটা বের করে নীরা দেখলো ফুলগুলো একদম তাজা। মনে হলো কেউ মাত্র বাগান থেকে তুলে এনে মালা গেঁথে রেখেছে। কিছুটা অবাকই হয় নীরা। কিন্তু নীরা এইদিনে অহেতুক কোন কথা বলতে পছন্দ করে না। নীরা খোঁপায় মালাটা পরেছে। এইদিনে নীরা ক্রমেই হুমায়ুন আহমেদের রূপার মতোই সুন্দরীতমা হয়ে উঠে। আজ ০২ শ্রাবণ ; আবীরের সাথে দেখা করতে যাবে নীরা।


নীরা আবীরকে প্রথম দেখেছিলো এক আবৃত্তি সন্ধ্যায়। টিএসসির মিলনায়তনে। হাবাগোবা টাইপের একটা ছেলে। অনেকদিনের অত্যাচারে রঙ পোড়া জিন্স, গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি, পায়ে চটি স্যান্ডেল, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তার ডান কানে গোজা রক্তজবা। সবেমাত্র আবীর নিজের লেখা ‘নীরা, তোমাকেই ভালোবাসি’ কবিতাটি আবৃত্তি করে মঞ্চ থেকে নেমে আসছে। কী ছান্দসিক ছন্দে হাঁটছে একজন কবি ও বাচিক শিল্পী! নীরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আবীরের যাদুকরী কন্ঠ, কবিতার পুংক্তিতে লুকানো সম্মোহনী টান পুরোপুরি গ্রাস করেছে তাকে। নীরা পাথরমূর্তির মতো নিশ্চল। নীরার খুব ইচ্ছে করছে কবিকে একবার শুকনো মুখে ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু নীরা নড়তে পারছে না। দ্রুত পায়ে আবীর বের হয়ে গেলো। তবুও পুরো হল রুম জুড়ে থেকে গেলো আর থেকে গেলো নীরার মনের সংরক্ষিত এলাকা জুড়ে।

তারপর থেকে নীরা কতশত বার আবীরকে ফেসবুকে খুঁজেছে। ক্যাম্পাসে ইতিউতি করে খুঁজেছে আবীরকে। দেখা পায়নি প্রিয় মানুষটার। হঠাৎ একদিন নীরার হলের বড় আপু একটি কবিতা ফেসবুকে শেয়ার করে। তিনি কবিতাটি শেয়ার করেছেন ‘খড়ের মানুষ’ নামের একটি পেইজ থেকে। ‘খড়ের মানুষ’ কবি আবীর রুদ্রের কবিতার পেইজ। নীরা এই কবিতাটির আবৃত্তি শুনেছিলো বন্ধুদের আড্ডায়। তারপর থেকে নিয়মিতই নীরা পেইজটিতে লাইক কমেন্ট করে সক্রিয় থাকে। তারপর শুরু হয় ম্যাসেঞ্জারে কবিতার ব্যবচ্ছেদ। চলে ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্ন। এভাবেই হৃদয়ে কড়া নাড়ে দু’জন দু’জনকে। শুরু হয় আবীর ও নীরার অধ্যায়।

আবীরের বাড়ি নরসিংদী। বাবা নেই। কোনো রকম টিউশন করে চলে পড়াশোনা। ক্যাম্পাসে খুব একটা আড্ডা দিতে দেখা যায় না তাকে। ক্লাশ পরীক্ষা, টিউশন আর পত্রিকা অফিসে দৌঁড়াদৌড়ি করেই কাটে আবীরের দিন। আবীর কিন্তু বেশ সুদর্শন ছেলে। তবে এলোমেলো থাকতে পছন্দ করে সে। মনে হয় চুলে চিরুনি পড়ে না অনেকদিন। কখনো ফেয়ার এন্ড লাভলির প্রলেপ পড়েনি মুখে। তবুও খুব একটা মন্দ লাগে না দেখতে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো-আবীরের শরীরে এখনো কাঁদামাটির সোঁদা গন্ধটা লেগে আছে।

নীরার বাড়ি পটুয়াখালী। খুব আদুরে একটা মেয়ে। চমৎকার গান করে। দু’তিনবার ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক মঞ্চে নৃত্যও করেছে। ছিপছিপে গড়নের নীরা। উচ্চতা, ফিগার, ত্বকের রঙ-সব মিলিয়ে অনন্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ১ম বর্ষে কত সিনিয়র ভাই যে নীরাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছে! আল্লাহ্ মালুম। কিন্তু ব্যবসায়ীর মেয়ে হিসেবে নীরা হয়তো আগে থেকেই লাভ ক্ষতির অংকে পটু। তাই কারো ইশারার সাড়া দেয়নি। এখন তো ৩য় বর্ষের এই নীরাকে ক্যাম্পাসের ছোটবড় সবাই ভয় পায়। পাশ দিয়ে গেলেও কেউ মনে মনে শিষ দিতেও ভয় পায়। মনে মনে মন কলা খেতেও আঁতকে উঠে সবাই। ক্যাম্পাসে এমন গল্পও প্রচলিত আছে যে, কয়েকজনের নাকি অমাবস্যা পূর্ণিমা আসলে কানের নিচে এখনো ব্যথা করে খুব। দস্যি মেয়ে বলতে যা বুঝায় আর কি!


সেই নীরাই কিনা একটা গেঁয়ো আনস্মার্ট ভূতের প্রেমে পড়েছে! পুরোটা সময় নীরার সর্বস্ব জুড়ে থাকে এই ভূত। নীরা রোকেয়া হলের ৩১১ এর বাসিন্দা। এখন নীরা নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। মনটা ভীষণ অবসন্ন-ক্লান্ত। গত ৪ মাস ৯ দিন হয় আবীরের সাথে মোবাইলেও কথা হয় নীরার। কিন্তু কোনো ভাবেই নীরা বুঝতে পারছে না আবীর তাকে পছন্দ করে কিনা। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে তার। নিজেও বলতে পারছে না মনের লুকানো কথাগুলো। আর বলবেই বা কি করে!
ফেসবুকে বন্ধুত্ব করার পর এখনো তো সামনাসামনি তাদের দেখাই হয়নি। ক্যাফেটেরিয়ার কফির শূন্য পেয়ালা হুদাই পড়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড মাইগ্রেইনের পেইন হচ্ছে নীরার। নাহ, আজ অজ্ঞাতনামা এই সম্পর্কের একটা নাম দিয়েই ছাড়বে  সে। নীরা খুব কটকটা স্বভাবের, বড্ডো জেদি মেয়ে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করলো আবীরকে-
-হুম। কোথায় আছেন? গত দু’দিন ধরে আপনার কোন হদিস নেই। কল রিসিভ করেন না। আমার সাথে এমন করছেন কেন?’ রাগে অভিমানে এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকে নীরা। ওপাশ থেকে কোন রা নেই। উত্তর নেই। খুব নির্লিপ্তভাবে শুনেই যাচ্ছে আবীর। নীরা এবার একটু আদুরে গলায় বলতে শুরু করে, ‘আমার বুঝি কষ্ট হয় না? কারো জন্য মনটা খুব পোড়ে-কেউ কি সেটা অনুভব করতে পারে? যদি আমাকে কেউ উটকো ঝামেলা মনে করে- সরাসরিই তো বলতে পারে। তখন না হয় আমি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি হয়ে যেতাম।’ এবার মুখ খুলে আবীর, ‘এসব কি আজেবাজে বকছেন! নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি হবেন কেন? আমি এতো খুঁজতে পারবো না তখন। এতো ধৈর্য্য আমার নেই। আমি চাই আপনি থাকেন। ঠিক এভাবেই। আমার কবিতার শক্তি হয়ে। ছান্দসিক পঙক্তি হয়ে।’ কথাগুলো নীরার কাছে একজীবনের আরাধ্য। এই মুহূর্তে সে নীল একটা আকাশে সাঁই সাঁই করে উড়ছে। নীরার চোখে প্রজাপতি ডানা মেলেছে। আজ সে আবীরের গলায় অন্য কিছু পাচ্ছে। ভিন্ন এক আকুলতা।
আবীরের মনেও অযুত কবিতা এসে ভীড় করে আছে। পরিচিত ব্যবহারিক ভালোবাসার শব্দগুলো মানবিক স্বীকৃতি চাচ্ছে। নীরবতার প্রাচীর ভেঙে নীরা বললো, ‘তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। সন্ধ্যায় তোমার সময় হবে? ‘নিজের অজান্তেই নীরা আবীরকে তুমি বলে সম্বোধন করে ফেলছে। আবীর মুচকি হেসে বললো, ‘হুম, দেখা হলে খারাপ হবে না।’
হুম। আমাদের দেখা হবে কবে? প্রশ্ন করে নীরা।
‎হুমমমম, ০২ শ্রাবণ।’
কিছুটা চিন্তা করে জানালো আবীর।
‎আজ তো আষাঢ়ের ২৭ তারিখ। ০২ শ্রাবণ আসতে তো আরো অনেক দেরী। চলো আজই দেখা করি।
‎না। অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়।
‎সেদিন কিন্তু আমি তোমার পাশে বসবো।
‎হুম। সেদিন দেখা যাবে।
‎আমার একটা আবদার আছে। বলবো?
‎বলেন।
‎আমাদের প্রথম সাক্ষাতে তুমি ‘নীরা, তোমাকেই ভালোবাসি’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনাবে। তোমার এ কবিতা আমার খুব প্রিয়।
‎হুম। সেদিন আপনার সব ইচ্ছে পূরণ করতে চেষ্টা করবো।
‎সত্যি? বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে নীরা। ‘আমার সব ইচ্ছে  কিছু পূরণ করবে!’ আবীর জিহ্বায় কামড় দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো, ‘কবিরা সচরাচর উদারপন্থীই হয়। ‘তারপর তাদের মৌনতায় কেটে যায় আরো কিছু সময়। নীরবতা ভেঙে নীরা জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, তুমি সেদিন কি পরে আসবে?’
‎আমি তো সবসময় পাঞ্জাবিই পরি। আপনি কি পরবেন?
‎তুমিই বলো।
‎জানেন নীরা- সেই কবে থেকে আমার মনে গোপনে এক মায়াবতী বাস করে!
‎মানে! মায়াবতী! কে সে? তোমার গার্লফ্রেন্ড?
‎আরে না। আমার কল্পনায় প্রায়ই একটা মেয়ে হুটহাট চলে আসে। আবার ফিরে যায়। আলেয়ার মতোই তার আসা যাওয়া। ইচ্ছে করেই সে মুখটা আড়াল করে রাখে। আমাদের মধ্যে মায়া হয় কিন্তু সে মায়া নক্ষত্রের মতোই হঠাৎ ছিটকে পড়ে অন্ধকারে।
‎মনে হয় কোনো খারাপ জ্বীন তোমাকে আছর করেছে! সাবধানে থেকো। দেখবে কোনদিন তোমার আবার ঘাড় না মটকে দেয়! মিষ্টি একটা হাসির ছলাৎ শব্দ ভেসে আসে দূরালাপনি যন্ত্রে। আবীর চোখ বুজে অনুভব করতে পারে নীরার উপস্থিতি। যেনো খুব কাছেই আছে নীরা।
-‎আচ্ছা নীরা, আপনি বর্ষা রাণী সেজে আসবেন।
-‎কি বলছো- আমি তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতেছি না! ক্লিয়ারকাট বলো।
-‎হুম। তুমি নীল শাড়ি পরবে। কাজল আঁকবে চোখের পাতায়, সাথে সাদা ব্লাউজ, হাতে নীল সাদা রেশমি চুড়ি, কপালের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট কালো টিপ পরবে। আমি তোমার কানে গুঁজে দিবো একটা লাল টকটকে রক্তজবা।
নীরা আবীরের কথাগুলো শুনে অবাকই হয়। তবুও মেনে নেয়। নীরা রুমমেট পিউকে নিয়ে নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে কিনে নীল সুতি শাড়ি, চারুকলার গেইট থেকে কিনে নীল সাদা রেশমি চুড়ি। বাতেনের দোকান থেকে কিনে গলার মালা। নীরার যেনো আর তর সইছে না। আর একটা রাত সকালের ছোঁয়া পেলেই আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নীরা আর আবীরের দিন। পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটবে। মনে অজান্তেই আবীরের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিবে। আবীর বাম হাত দিয়ে নীরার চুলে হাত বুলিয়ে দিবে। নীরার চোখ বুজে আসবে। মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যাবে দ্রুত। আরো কত ভাবনা যে আসে মাথায়! নীরা নিজেই বোকার মতো একা একা হাসে। নিজেই নিজের মাথায় ঢুস দেয়। যেনো মাথা থেকে পাগলা এক ভূতকে তাড়াচ্ছে।

রাতে ভালো ঘুম হয়নি নীরার। সকাল থেকেই রেডি হচ্ছে সে। কয়েকবার কল করেছে আবীরকে। কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। হয়তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাই আবীরকে আর বিরক্ত করেনি নীরা। গোসল সেরে এসেই সাজতে শুরু করেছে সে। আজই প্রথম শাড়ি পরবে নীরা। তার পছন্দের পোশাক জিন্স, টপস্, আর সামাজিকতার খাতিরে কালেভদ্রে থ্রি-পিস পরে। তার রুমমেট পিউ সুন্দর করে শাড়ি পরাতে পারে। হলের এ ব্লকের সবাই পিউর কাছে শাড়ি পরতে আসে। হ্যাঁ, নীরাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ। মনে হচ্ছে আবহমানকালের শুদ্ধ বাঙালিয়ানার মূর্ত প্রতীক হলো আজকের নীরা!
নীরার ফোন বেজে উঠলো। আবীর কল করেছে। ঘুম ঘুম গলায় আবীর নীরাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘নীরা, এত্তো সকালে এত্তোগুলো কল! কোনো সমস্যা হয়েছে আপনার?’ আবীরের এমন উজবুকের মতো কথা শুনে নীরার শরীরে আগুন ধরে গেলো। মেজাজটা পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেলো। তবুও রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে বললো, ‘আজ ০২ শ্রাবণ। আমাদের দেখা করার কথা। মনে পড়েছে? ‘আবীর আমতা আমতা করে বললো, ‘আপনি কি রেডি হয়ে গেছেন?’ নীরা শান্ত গলায় বললো, জ্বি,জনাব। আমি সেই কখন রেডি হয়ে বসে আছি। তোমার আর কতক্ষণ লাগবে?’ আবীর অপরাধীর মতো আত্মসমর্পণ করার মতো বললো, সরি, নীরা। আমি আসলেই আমাদের দেখা করার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা, আমি এক ঘন্টার মধ্যেই আসছি।’ নীরা রাগে গজগজ করতে করতে কলটা কেটে বিছানায় মোবাইল ছুঁড়ে ফেলে। পিউ বিষয়টা আঁচ করতে পেরে বললো,‘আপু, ভাইয়া হয়তো রাত জেগে লেখালেখি করেছে। কবি মানুষ তো একটু ভুলো মনেরই হয়। চলে আসবে। এখানে শান্ত হয়ে বসো তো। সত্যি মাইরি, তোমাকে যে কি লাগছে না! আগুনফুল।’ এই রাগের ভিতরও মুচকি হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলে পড়লো।’ এই তো আমার লক্ষ্মী, আপুটা।’ পিউ নীরার গালটা টেনে দিয়ে বললো। সফট একটা রিং টোন সেট করা নীরার মোবাইলে। আবীরের জন্য বিশেষ এই রিং টোন। সেটাই বেজে উঠলো। দ্রুত পায়ে কলটা রিসিভ করলো নীরা। আবীর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,‘আপনার হল গেইটে দাঁড়িয়ে আছি। একা একা নিজেকে খুব ছেঁচড় মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসেন।’ নীরা তিনতলা থেকে মনে হলো উড়ে উড়ে নামলো। পেছন থেকে পিউ হাসতে হাসতে বললো,‘আপু, ধীরে যাও। পড়ে যাবে তো!’

গেইটে গিয়ে তো অবাক হয়ে গেলো নীরা। আবীর জিন্সের সাথে নতুন হলুদ পাঞ্জাবি পরেছে। চুলগুলো মোটামুটি গোছানো। কাঁধে ঝুল ব্যাগের এক কোণে একা একা হাসছে একটা রক্তজবা ফুল। তার মানে আবীর অভিনয় করেছে! নীরা মনে মনে ভাবে। নীরার হাসি দেখে আবীরও ১৬৪ ধারার মতো স্বীকারোক্তিমূলক চাপা একটা হাসি দেয়। নীরার পড়নে নীল সুতি শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, চোখের পাতায় কাজল টানা। হাতে সাদানীল কাচের চুড়িগুলো দূত্যি ছড়াচ্ছে। আবীর ব্যাগ থেকে রক্তজবাটা নিয়ে নীরার কানের কাছে গুঁজে দেয়। নীরার মনে হলো বুকের মধ্যে শত শতাব্দীর জমা বরফগুলো গলে গেলো। ভেসে গেলো তার অনাগত আগামীর চরাচর। ওরা হাঁটছে পাশাপাশি। নীরা আজ পুরোপুরি বোবা। কোনো কথাই তার আসছে না মুখে। বরং কোনো কথা না হোক। এভাবেই কেটে যাক অযুত বছর। আবীর নীরবতা ভেঙে বললো, ‘আজ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। ঠিক যেন অপ্সরা। পদ্মবিলের পরী।’ কথাগুলো শুনে নীরা আরো বেশি লজ্জা পেলো।

হেঁটে হেঁটে ওরা গিয়ে বসলো শিখা চিরন্তনের ওপাশটায়। একটু নিরিবিলি এদিকে। আবীর নীরাকে জিজ্ঞেস করলো, কি যে জরুরি কথা বলবেন? ‘হুম। আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলছি।’ কোনরকম ভনিতা ছাড়াই  হাতের কাছের দূর্বাঘাসগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে দিলো নীরা। যেন সময় নষ্ট করতে চাচ্ছে না নীরা। আবীর কিছু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নীরা এতোটা সহজে সরাসরি মনের কথাটা বলে দিবে- তার কল্পনায়ও ছিলো না। ‘কি, কিছু বলছো না কেন? তোমার কিছু বলার নেই?’ নীরা প্রশ্ন করে আবীরকে। আবীর ব্যাগ থেকে একটা পুরাতন ডায়রি বের করে। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললো,‘গতরাতে ঘুম হয়নি একদম। সারারাত তোমার কথাই ভেবেছি। ভাবতে ভাবতে একটা কবিতা লিখেছি। শিরোনামঃ অন্ততঃ আমার একটা তুই থাকুক। শুনবে?’ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় নীরা। আরেকটু সরে এসে আরো কাছে এসে বসে নীরা। একটা সময় টুপ করে আবীরের হাত ধরে। আবীর মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবৃত্তি শুরু করে।

সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে দুজন। খাওয়া দাওয়া ও টুকিটাকি কেনাকাটা করে এখন বের হলো আজিজ সুপার মার্কেট থেকে। পৌনে পাঁচটা বাজে। সন্ধ্যায় নিকেতনে টিউশন আছে আবীরের। তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে হচ্ছে। যদিও কারো ইচ্ছে করছে না এখনই ছেঁড়ে যেতে। তবুও অগত্যা মধুসূদন! যাদুঘরের দেয়াল ঘেষে সমান তালে হাঁটতে থাকে দু’জন। শাহবাগের কর্ণারে এসে নীরা খেয়াল করলো রাস্তার ঐ পাড়ে মাঝ বয়সী একজন মহিলা ছোট্ট বালতিতে কতগুলো কদমফুল নিয়ে বসে আছে। নীরা আবীরকে দেখিয়ে বললো, ‘আমার কদমফুল খুব পছন্দ। কয়েকটা এনে দিবে?’ আবীর বালতি থেকে সাতটা কদমফুল বেছে বেছে নিলো। খালার কোলে ঘুমিয়ে আছে একটা তুলতুলে ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটার হাতে ১০০ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলো। নীরা মোবাইলে তোলা সারাদিনের ছবিগুলো খুঁটেখুঁটে দেখছিলো। হঠাৎই একটা বিকট শব্দ হলো। কয়েকটা কদমফুল এসে ছিটকে পড়লো নীরার সামনে। এক্স করোলা একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে চলে গেলো এলিফ্যান্ট রোডের দিকে। নীরা দেখছে সবকিছু। পাথর চোখে। রক্তাক্ত আবীর শুয়ে আছে কালো পিচের রাস্তায়। গলগল করে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে এলোমেলো। স্পট ডেট। লোকারণ্য শাহবাগ। পুলিশ। নীরা কেবল একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর নীরার নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের বিছানায়।

৩.
গাড়িটা মূল রাস্তায় পার্ক করে তমাল। যেনো নীরা বিরক্ত না হয়। ডাক্তারের কড়া সাজেশন হলো নীরাকে নীরার মতো থাকতে দিতে হবে। না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই প্রতিবারই নীরার অগোচরে নীরার পেছনে পেছনে পলাশপুর আসে তমাল। এখানেই আবীরের পারিবারিক গোরস্তান। আজও নীরা নীল শাড়ি পরেছে। আবীরের চাওয়ার মতো করেই প্রতিবারই সেজে আসে এখানে। নীরা অনেকক্ষণ কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে হাউমাউ করে কাঁদে। হাঁটু গেড়ে বসে কবরের পাশে রাখে কয়েকটা কদমফুল। প্রতিবারই শ্রাবণের দ্বিতীয় দিন নীরা শিশুর মতো করে। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে আসে নীরার শরীর। ততোক্ষণ পর্যন্ত তমাল অপেক্ষা করে। বাঁশ ঝারের পাতায় পাতায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। প্রতিবারই নীরার ফেরার সময় বৃষ্টি শুরু হয়।এবারও তাই হলো। তমাল নীরাকে তুলে ধরে নিয়ে আসছে মূল রাস্তার দিকে। নীরা কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে। বৃষ্টির বেগটা মনে হয় কিছুটা বেড়ে গেলো! তমালের কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছে নীরা। বাম হাতে নীরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে তমাল। নীরা কাঁদছে। তমালও ডান হাতে নিজের চোখটা মুছে সংগোপনে !

শ্যামলী আবাসিক এলাকা,
মাধবপুর,হবিগঞ্জ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট