সঞ্জীব চৌধুরী : যাঁর কবিতাই গান, গানেই বিপ্লব



সঞ্জীব চৌধুরী
যাঁর কবিতাই গান, গানেই বিপ্লব

মনসুর আহমেদ

আমি তোমাকেই বলে দেব/কী যে একা দীর্ঘ রাত/আমি হেটে গেছি বিরান পথে/আমি তোমাকেই বলে দেব/সেই ভুলে ভরা গল্প/কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়/ছুয়ে কান্নার রঙ ছুয়ে জোছনার ছায়া!
সঞ্জীব চৌধুরী
জন্ম: ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৫- মৃত্যু: ১৯ নভেম্বর, ২০০৭)

হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে যে টগবগে তরুণ রাজপথে গণমানুষের কথা বলেছে সে আর কেউ নয়, আমাদের সঞ্জীব চৌধুরী। কবি, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, নাট্যকার এবং সংগঠক হিসেবে খ্যাতি ছিল মেধাবী সব্যসাচী মানুষ সঞ্জীব চৌধুরীর। গানে গানে তিনি যেভাবে প্রতিবাদের ভাষা রপ্ত করেছিলেন তা বাংলা সংগীতে বিরল! শাসকদের চোখ রাঙানিতে যখন কম্পিত গোটা বাংলা, প্রত্যেক সাধারণ মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ যেখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করা হচ্ছে সেখানে তিনি ঠিকই শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ তোলেন তার গানের মধ্য দিয়ে। এবং তিনি গানে গানে বলে গেছেন মানব জীবনের গাঁথা প্রেম, বিরহ, সমাজ, রাজনীতি, প্রতিবাদ, দ্রোহ সমানভাবে তার গানে লেপ্টে আছে। নব্বই দশকে গনতন্ত্র যখন যাদুঘরে আর মানুষের অধিকার যখন শাসক গোষ্ঠীর হাতে তালুবন্দি, গান আর কবিতা পাগল সঞ্জীব চৌধুরী রাজচক্ষুকে বৃদ্ধাআঙ্গুলি দেখিয়ে দলবল নিয়ে আন্দোলনে সরব ছিলেন। মানুষের কথা বলার অধিকার সবাই রাখে কিন্তু সবার হিম্মত হয়না জেগে উঠার। অনেকটা একরোখা মনোভাবের সঞ্জীব চৌধুরী পৃথিবীর স্বপ্নবিলাসী মানুষের কথাই বলেছেন গানে গানে। তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রথাগত সৃষ্টিতে কখনও বিশ্বাসী ছিলেন না। গান এবং কবিতা কে উচ্চমাত্রার আধুনিকতার ছোঁয়ায় পৌঁছে দিয়েছেন ভক্ত হৃদয়ে। মেধাবী কিশোর সঞ্জীব পারিবারিক আড্ডা বেশ জমিয়ে তুলতেন নিজের বানানো ভূতের গল্প শুনিয়ে। কোন কিছুই তাঁর কাছে কঠিন হয়ে উঠেনি। স্বাভাবিক সাদামাটা ভাবেই কাটিয়ে দিলেন ছোট্ট জীবনটা। ঝলমলে আকাশের একটি তাঁরা হঠাৎই আলোকরশ্মি থেকে দূরে চলে গেল। চারদিকে কেমন জানি অন্ধকার, আহা রে! এভাবেই পৃথিবীর আলো বাতাস ছেড়ে অকালে চলে গেলেন আমাদের সঞ্জীব চৌধুরী। বিশাল শূন্যতার মাঝে আজও অনেক চিৎকার, চেচামেচি শুনি, তবুও নীল আকাশের কান্না থামেনি।

সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং এর জলবান লক্ষ্মী বাউলের পাশের মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উনাদের আদিনিবাস সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার দশঘর গ্রামে। সেখানকার জমিদার শরৎ রায় চৌধুরী ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরীর পিতামহ। উনার মামার বাড়ী মাকালকান্দি গ্রামে জমি ক্রয় করে পিতা ননীগোপাল চৌধুরী এবং মাতা প্রভাষিনী চৌধুরী বসতি স্থাপন করেন। নয় ভাই বোনের  মধ্যে এ তাঁর অবস্থান সপ্তম। শরীরে জমিদার বংশের রক্ত থাকার পরও সঞ্জীব চৌধুরী পুঁজিবাদ আর সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। প্রতিটি লড়াই সংগ্রামে তার সক্রিয় অবস্থান ছিল। সঞ্জীব চৌধুরী হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করেন, পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে যাওয়ায় তিনি বকসি বাজার নবকুমার ইনস্টিটিউট ভর্তি হয়ে ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড মার্ক পেয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। উনার এই রেজাল্টে খুশি হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ একদিন স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেন এবং ১৯৮০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, এমনকি বড় বোন ড. নীলিমা চৌধুরীর মাধ্যমে ব্যাঙ্গালোরে স্কলারশিপ এ ভর্তির সুযোগ পেয়েও ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে। পরে বিষয় পাল্টে মনের বিষয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সঞ্জীব চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতা পেশার মাধ্যমে। কাজ করেছেন আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়। ফিচার সাংবাদিকতায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল তার সৃষ্টিশীলতা। বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত ফিচার বিভাগ শুরু হয় তাঁর হাত ধরেই। বাংলাদেশে ফিচার সাংবাদিকতার জনক বলা চলে তাকে।

সঞ্জীব চৌধুরীর মধ্যে কাব্যপ্রতিভাও ফুটে উঠে অসাধারণ ভাবে। নিজেও কবিতা লিখতেন আবার আবৃত্তিতেও বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। শুধু কবিতাই নয়, বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছিলেন তিনি। তার লেখা গল্পগ্রন্থ ‘রাশপ্রিন্ট’ আশির দশকে বাংলা একাডেমী কর্তৃক সেরা গল্পগ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত হয়। আহমদ ছফাও সঞ্জীব চৌধুরীর লেখনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমনিতে নাটকের স্ক্রিপ্টও লিখতেন সঞ্জীব চৌধুরী। নীল ক্লিনিক, রাশপ্রিন্ট, কোলাজ নামের তিনটি  কবিতা, ছোট গল্প, নাটক এর পান্ডুলিপি কে একত্রিত করে এসময়ে বরেণ্য আবৃত্তি শিল্পী শিমুল মোস্তফা ১৯৯০ সালে ‘রাশপ্রিন্ট’ নামে সঞ্জীব চৌধুরীর একমাত্র গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করেন। সঞ্জীব চৌধুরীর ছোট বোন বাবলী চৌধুরী জানান, বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দলছুট’ এর প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জীব চৌধুরীর সংগীত জগতের কোন উস্তাদ নেই। নিজে নিজেই শিখেছেন গান, তবে উনার মা প্রভাষিনী চৌধুরী ভাল ধামাইল গান ও ধর্মীয় গান জানতেন, মায়ের কন্ঠে শোনা গানই সঞ্জীব চৌধুরীর প্রেরণা। সঞ্জীব চৌধুরীর কথা বলতেই গেলে চলে আসে আরেকটি নাম বাপ্পা মজুমদার। ১৯৯৫ সালে ছন্নছাড়া তরুণ বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী ‘দলছুট’ ব্যান্ডের জন্ম দেন। ১৯৯৭ সালে দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’ প্রকাশিত হওয়ার পরেই চারদিকে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। এরপর ‘হৃদয়পুর’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আকাশচুরি’, ‘জ্যোছনা বিহার’, ‘টুকরো কথা’, ‘আয় আমন্ত্রণ’ নামে আরো কয়েকটি অ্যালবাম বেরিয়েছে এই ব্যান্ড থেকে। এর মধ্যে এ  ‘স্বপ্নবাজি’ ছিলো সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম।

হাওর বাঁওড় সবুজ প্রকৃতির বুকে বেড়ে উঠা সঞ্জীব চৌধুরী নব্বই দশকের উত্তপ্ত রাজনৈতিক বাংলাদেশ উত্তাপ ছড়িয়েছেন নিজের খেয়াল খুশি মত, বাম ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত সঞ্জীব চৌধুরীর ভিতরে কখনও ভয় বাসা বাঁধেনি। এই পঁচা-গলা পোষাকি সিস্টেম এবং শ্রেণী বৈষম্যের সমাজের বিপরীতে সঞ্জীব চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন একরোখা তেজী বিপ্লবীর মত, স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যবাদী সমাজের, পা বাড়িয়ে ছিলেন আলোকিত পথে, বেঁচে থাকার কথা বলার জন্য রাজপথে ছিলেন সরব। কখনও দেশের রাষ্ট্র প্রধান, আবার কখনও উনাদের চামচাদের মুখোশ উন্মোচনে সোচ্চার ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। অবরুদ্ধ সময়েও তার গান থামে না। চারদিকে যখন বেয়নেট আর জলপাই রঙের ওড়াওড়ি, তখনও তিনি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলেছেন স্বপ্নের কথা, আর্তনাদের কথা, শান্তির কথা। পৃথিবীর পথে পথে শান্তিকামী সঞ্জীব চৌধুরীর স্বপ্ন পিচ ঢালা পথে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত। বিশ^ মুড়লরা চিবিয়ে খাচ্ছে একে অন্যের হাড়। তবুও স্বপ্নরা পাখির দলে, উড়ছে আকাশে বাতাসে। প্যারোডি গানের এর মধ্য দিয়েও তিনি সমাজে মানুষের জন্য প্রেরণা জাগিয়েছেন অনেক শক্তিশালী ভাবে। কবিতা এবং গানে প্রতিনিয়তই বলে গেছেন গণমানুষের কথা। শ্রম ঘাম বিক্রি করে খেটেখুটে খাওয়া মানুষের কথা সঞ্জীব বলেছেন অনেক বেশি। এখনও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে চিয়ারম্যান মেম্বররা সুবিধামত লুট করছে গরীবদের রিলিফ, খাবিখা, খাবিটা সহ বিভিন্ন প্রজেক্টের টাকা। সঞ্জীব চৌধুরীর দেখানো পথে কিছু মানুষ এখনও প্রতিবাদী আন্দোলনে থাকলেও সংখ্যায় অনেক কম। স্বপ্নের কাছে কথা রেখে বলতে পারি অথবা একদিন অসংখ্য সঞ্জীব; বুর্জোয়া জনপ্রতিনিধির গলা টিপে ধরবে। মুক্ত আকাশে, মুক্ত মনে ঘুরে ভেড়াবে খেটে খাওয়া মানুষের হৃদয়ে। কতটা সহজই বলে দিয়েছেন এক পলকেই চলে গেল, রিক্সা কেন আস্তে চলে না।

চাপ চাপ কষ্ট, ফালি ফালি বেদনা গানের ভিতর, দীর্ঘ রাতের বুকের প্রান্তে আমাদের ফেলে দিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী হেটে যায় বিরান পথে, কবির হাজার বছরের পথে! তিনি গানের মধ্যে বলে যান সম্পর্কের অভিজ্ঞানের ভুল ইতিহাসে, কান্নার রং আর জোছনার ছায়ার ভিতর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়! “চোখটা এতো পোড়ায় কেন/ ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও/ সমুদ্র কী তোমার ছেলে/ আদর দিয়ে চোখে মাখাও?” শুধু কী বিরহ? প্রেমের আকুল আবেদনও ফুটে উঠেছে তার গানে। প্রেমিকার প্রতি এক পাগল প্রেমিকের আবেদন প্রকাশ করতেই গানে গানে উজ্জীবিত সঞ্জীব চৌধুরী। “গাড়ি চলে না চলে না/চলে না রে, গাড়ি চলে না/ চড়িয়া মানব গাড়ি/ যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি/ মধ্য পথে ঠেকলো গাড়ি/ উপায়-বুদ্ধি মেলে না।” বাউল শাহ আব্দুল করিমের লেখা এ গানের কথাগুলোর মতো সত্যিই থেমে গেছে সঞ্জীব চৌধুরীর জীবন গাড়ি। সে কণ্ঠ দিয়ে তার আর কোনো নতুন গান জন্ম নেয় না। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

সঞ্জীব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য কিছু জনপ্রিয় গান, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘চল বুবাইজান’, ‘আকাশচুরি’, ‘হৃদয়পুর’, ‘গাড়ী চলে না’, ‘সমুদ্র সন্তান’, ‘তোমার ভাঁজ খোলো'’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আমি ফিরে পেতে চাই’, ‘সমুদ্র সন্তান’ প্রভৃতি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের রাত জাগা তরুণেরা তার গান গেয়ে হলে ফেরে, ঘরে ফেরে কিংবা তারা আর ঘরে ফেরেই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সবুজ ঘাস গালিচায় এখন আর রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সঞ্জীব চৌধুরী, শিমুল মোস্তফা, কামরুজ্জামান কামু সহ একদল গান ও কবিতা পাগলদের প্রাণবন্ত আড্ডা নেই। সঞ্জীব চৌধুরীর গিটারের সুরে রুদ্র আর শিমুল কবিতা আবৃত্তি করেননা। কামু মনের সুখে কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে নতুন কবিতার গন্ধ পাচ্ছেন না। তবে হে, টিএসসির ‘সঞ্জীব চত্বরে’ সঞ্জীব উৎসব উদ্যাপন করে প্রতি বৎসর সঞ্জীব ভক্তরা। তিনি তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে পরম শ্রদ্ধায় চিরকাল স্মরণীয় হয়ে বেঁচে থাকবেন।

সম্পাদক, লিটলম্যাগ ‘শব্দকথা’।
রামকৃষ্ণ মিশন রোড, হবিগঞ্জ।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট