ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৯
















ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
উৎসব আমার মেসেজ পেয়ে খুব চিন্তিত হয়। সকালে আমি তখন ঘুমে। উৎসবের কল পেয়ে সজাগ হলাম। রিসিভ করতেই উৎসব বলে ওঠল,
সোম, তোর কী হয়েছে?
সংক্ষিপ্ত আকারে ঘটনাটা বললাম।
তোর কি আবার মাথা খারাপ হয়েছে? সারাক্ষণই নীলাকে নিয়ে ভাবিস। যতসব উদ্ভট কথা বলিস।
কী এমন উদ্ভট কথা বললাম?
এই যে কোথাকার চতুর্মাত্রিক জগতের অযুতের কথা বলছিস। এই যে নীলার কথা বলছিস। যে নীলা..
উৎসবকে থামিয়ে বললাম, তুই তো বলবি যে নীলা আমাকে ছেড়ে আমেরিকা চলে গেছে, তার ফিরে আসার প্রশ্নই উঠতে পারে না। তাই তো? শোন, সে ফিরে এসেছে। বিশ্বাস কর উৎসব।
শোন সোম, আমি নীলার ফ্যামিলিতে খবর নিয়ে আসল সত্যটা জেনেছি।
কী সত্য জেনেছিস? ওর আমেরিকার স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার খবর, আর আমার কাছে ফিরে আসার খবর?
না। শোন সোম, এমন পাগলামি করিস না। যে নীলা দু’বছর আগে মারা গেছে, তাকে নিয়ে এমন কাল্পনিক গল্প কেন ফাঁদছিস?
কী বলছিস উৎসব! তোকে চ্যালেঞ্জ করছি নীলা বেঁচে আছে। তুই উল্টাপাল্টা কথা বলছিস। তোর বিশ্বাস না হলে এখানে আসার প্রয়োজন নেই। যেভাবেই হোক বিপদ-আপদ কাটিয়ে আমরা ঠিকই আজ ঢাকায় ফিরে যাব। তোর গাড়িরও প্রয়োজন নেই।
সোম। এভাবে রেগে যাসনে। নীলার মৃত্যুর খবরটা তোকে আগে জানানো হয়নি, কারণ তুই এমনিতেই অসুস্থ! গত কয়েকবছর ধরে তুই সুস্থ আছিস। আমরা চাইনি তোর অবস্থা আবার খারাপ হোক। তোর কথা অনেকটা বিশ্বাস করেই, নীলার বাবার সাথে কথা বললাম। তিনি তোর এসব কথা শুনে অবাক হয়েছেন। তাছাড়া নীলার কোনো জমজ বোনও নেই, যে তোর সাথে নীলার মতো অভিনয় করবে। মানসিকভাবে শক্ত হ দোস্ত, এভাবে হেরে যাস নে।
উৎসব, তোর এসব গল্প আমি শুনতে চাই না। তোর সাথে আর একটা কথাও বলতে চাই নে।
প্লিজ, শোন সোম, আমি একটু পরেই রওনা দিচ্ছি তুই ভাবিস নে। আমি আসব।
কল কেটে দিলাম। নীলাকে নিয়ে উৎসব এ অদ্ভুত কথা কেন বলল? শুধু উৎসব কেন যাকেই নীলার কথা বলেছি, সবাই কেমন অবাক হওয়ার ভান করেছে। আরতি, অনিতা,.......নীলার কথা শুনে চোখ কপালে ওঠায়। সবাই এমন করে কেন? আসল কথা হচ্ছে হিংসে। নীলাকে ফিরে পাবার আনন্দকে মাটি করে দেবার ষড়যন্ত্র!
নীলা দু’বছর আগে মারা গেছে। কি অদ্ভুত কথা! আমার চোখের সামনে যাকে দেখছি সে কে? ও নীলা ব্যতীত অন্য কেউ তো নয়। নীলার ভালবাসা তো মিথ্যে নয়। আমাকে সবাই পাগল ভাবছে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, এক সময় আমি পাগল ছিলাম। নীলাকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা আমার পাগলামির মধ্যে কেটেছে। নীলা যেমন শশীকে হারিয়ে নিজেকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমিও আমাকে অনিশ্চয়তার ¯্রােতে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। চিকিৎসার নামে আমাকে ঘর বন্দি করে রাখা হয়েছে। বছরের পর বছর পাগলাগারদেও কাটাতে হয়েছে। অথচ, আমি পুরোপুরি পাগল ছিলাম না। এদেশের চিকিৎসকেরা যা নয় তাই রোগীদের উপর চাপিয়ে দেয়। বহু কৌশলে নিজেকে সুস্থ হিসেবে উপস্থাপন করেছি। অতঃপর একটা মুক্ত জীবন। এখানে যা ঘটেছে সবই সত্যি! এসব যদি কেউ বিশ্বাস করতে না চায়, তবে আমি কী করব? আর বিশ্বাস না করলেও আমার কিছু আসে যায় না। আমাকে আবারও পাগল বলা শুরু করবে। আমি তো পাগল নই। আমি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।
নীলাকে কল দিলাম।
নীলা।
বলো সোম।
তুমি দ্রুত চলে এসে। আমি রেডি হচ্ছি। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা রওনা দেবো।
তুমি অপেক্ষা করো। আমি আসছি খুব বেশি দেরি হবে না।
হুম। তাই করো।
উৎসব আসুক বা না আসুক,আমি নীলাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাব। অযুতের হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। আমি ব্যস্ত হয়ে ব্রিফকেস ও ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার ডায়েরিটি খুব যতেœ ব্রিফকেসে রাখলাম। নীলকান্তমণি পাথরগুলো গুনে গুনে একটি ছোট্ট প্যাকেটে রাখছি। তেইশটি মার্বেল পাথর। তখনই শুনতে পেলাম কেউ ডাকছে।
আঙ্কেল....
দরোজার দিকে তাকাতেই দেখি মাহিদ দাঁড়িয়ে।
মৃত্যু আশঙ্কার ছাপ কাটিয়েও হাসার চেষ্টা করলাম।
মাহিদ, কোথা থেকে এলে? ভেতরে এসে বসো।
ছেলেটি ঘরে এসে চেয়ারে বসল।
বাড়ি থেকে এলাম। একটা গুড নিউজ আছে। আজ আমাদের নয়নপুরে মেলা বসবে, আপনি যাবেন?
না, মাহিদ। আমি আজই ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
কবে ফিরবেন?
হয়তো আর ফিরব না।
মাহিদ নীলকান্তমণিগুলো দেখে বেশ আনন্দের সাথে সেগুলো হাতে নিয়ে দেখে। আমি বিরক্ত হলেও বাধা দেইনি।
মার্বেলগুলো তো খুব সুন্দর! তাজ্জব ব্যাপার এগুলোর ভেতরে আলো দেখা যায়।
হ্যাঁ, মাহিদ। পাথরগুলো খুব সুন্দর ও মূল্যবান। সাবধানে দেখো, যাতে না হারায়।
ব্যাগ গোছানোর কাজে মন দিলাম। হঠাৎ মিজান মিয়ার কথা মনে পড়ল। সে কি এখনো আসেনি?
মাহিদ, আজ গেইটে তোমাকে মিজান মিয়া বাধা দেয় নি?
না, আঙ্কেল। ওখানে কাউকে দেখতে পাইনি।
আশ্চর্য! এত সকাল হয়ে গেল তারপরও সে আসেনি। ঝড়-ঝাপটা যাই থাকুক, সে তো প্রতিদিন সকালে এসে হাজির হয়। বাজারে চলে যায় নি তো? আর বাজারে গেলে তো টাকা চাইতে আসত।
বারান্দায় গিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম, মিজান...মিজান..। কোনো সাড়া নেই। তার মানে সে এখনো আসেনি। আমার সাথে মাহিদও বারান্দায় এল।
সে বলে ওঠল, ওয়াও, দারুণ তো আঙ্কেল!
কী?
মাহিদ একটি মার্বেল পাথর রোদের দিকে ধরে তাকিয়ে আছে।
আঙ্কেল এ মার্বেলটার ভেতরে সংখ্যা আর কতশত চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
আমিও তাকালাম। সত্যিই তাই।
মাহিদ, ঐ মার্বেলগুলোও নিয়ে এসো।
মাহিদ মার্বেলের প্যাকেট নিয়ে এল। রোদের আলো পড়তেই প্যাকেটটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। প্রতিটি মার্বেল রোদের আলোয় দেখলাম। প্রত্যেকটি মার্বেলে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা ও চিহ্নের সমাবেশ। খুব অদ্ভুত ব্যাপার! এ দৃশ্য দেখে কৌতূহলী মাহিদ উৎসাহে টগবগ করছে। সে ছোট টেবিলটা টেনে বারান্দায় নিয়ে এল। প্যাকেট থেকে মার্বেল পাথরগুলো বের করে টেবিলে রাখলাম। মার্বেলগুলোর মধ্যে একটি আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে। রেখাটা সোজাভাবে একটি মার্বেল থেকে আরেকটি মার্বেলকে ছুঁয়ে গেছে। এলোমেলো মার্বেলগুলো রেখা আলোর মাধ্যমে অনায়াসে ওদের পারস্পরিক সহগ মার্বেলকে যেন চিহ্নিত করে নিয়েছে। এ আশ্চর্য কা- দেখে আমরা দু’জনই হতবাক! আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি আলোর বিচ্ছুরণ। মাহিদ হঠাৎ মার্বেলগুলোর দিকে হাত বাড়াল। যে মার্বেল থেকে প্রথম আলোটা শুরু হয়েছে সেটাকে সে আলাদা করল। তারপর পরবর্তী মার্বেলটা রাখল, এভাবে প্রায় সবগুলা মার্বেল সাজিয়ে একটি সরল রেখায় দাঁড় করাল। মাহিদ দুটো মার্বেল সেখান থেকে আলাদা করে ফেলল। সে মার্বেল দুটো অনুজ্জ্বল। উজ্জ্বল মার্বেলগুলোর সাথে সে দুটোর তেমন মিল নেই। তখনই মনে পড়ল এ অনুজ্জ্বল মার্বেল দুটো আলমারিতে ছিল। আসলে খাটের গোপন বাক্সের চাবি ছিল এ মার্বেল দুটো।
বিস্ময়ে চোখ জ্বলে যাচ্ছে। একুশটি মার্বেল এক সারিতে। হঠাৎ মার্বেলগুলোর উজ্জ্বলতা বাড়তে লাগল। আমি ও মাহিদ চোখ বন্ধ করে ফেললাম। উজ্জ্বলতা কমার পর চোখ মেলে তাকালাম। মাহিদই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মার্বেলগুলো বার বার পরখ করে দেখল।
বলে ওঠল, আঙ্কেল এ মার্বেলগুলোর ভেতরে একটি বীজগাণিতের ম্যাজিক আছে। সবগুলো মার্বেল মিলে মনে হচ্ছে একটি বহুপদী চতুর্ঘাত বিশিষ্ট উৎপাদক।
আমিও কয়েকবার মার্বেলগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। ঠিক তাই। সারির এগারোতম মার্বেলটিতে কোনো সংখ্যা নেই, আছে একটি সমান চিহ্ন। না, এটা কোনো উৎপাদক নয়। কোনো সাধারণ বীজগাণিতিক রাশি নয়। এই সেই মহাঅভেদ, ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলার গাণিতিক রূপ!
মার্বেল পাথরগুলো প্যাকেটে ভরে মাহিদের হাতে দিলাম। বললাম, ধরো, এগুলো ব্রিফকেসে কাপড়ের ভাঁজে রাখব। আমরা দু’জনই ঘরে ঢুকলাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার ব্যাগ গোছানো শুরু করলাম। ঠিক কখনই নীলা এল।
সোম।
নীলা আমার দিকে ১৯৬৯ সালের ডায়েরিটি বাড়িয়ে দিলো। কদিন আগে এই ডায়েরিটি নীলা নিয়ে গিয়েছিল। যা কেন্দ্র করে অযুত আমার প্রতি রাগান্বিত।
ডায়েরিটিতে কী পেলে?
কিছুই না। ১৯৬৯ সালে কিছু রাজনৈতিক ঘটনা, বিশ্বপরিস্থিতি ও মেঘাদ্রি সম্পর্কিত প্যাঁচাল। অথচ ঐ নোটবুকে ইঙ্গিত দেয়া আছে, ১৯৬৯ সালের ডায়েরিটিতেই সেই ফর্মূলাটি আছে।
হেসে বললাম, ভেব না নীলা। ফর্মূলাটি পাওয়া গেছে। এখন আমাদের সেফ জোনে যাওয়া উচিত। তারপর সবকিছু দেখা যাবে।
নীলা তখন ক্রোধ মাখানো স্বরে বলল, না, সোম। এতটা ভেঙে পড়ো না। অযুতকে বধ করার সূত্র আমার জানা আছে। আজকেই ওর শেষ দিন। আমি এখন ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলাটি দেখতে চাই।
নীলার দৃঢ় চোয়াল দেখে সত্যিই অবাক হলাম। কথা না বাড়িয়ে ঐ ডায়েরিটি বের করে ওকে দিলাম। বললাম, নীলা এ ডায়েরিটি এই খাটের পাটাতনের গোপন বক্সে লুকানো ছিল। এখানে বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের সূত্রটির বর্ণনা রয়েছে। আর ভাষাটা মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকের আদলে তৈরি বাংলা হায়ারোগ্লিফিক।
নীলা একমনে ডায়েরিটি পড়া শুরু করল। মাহিদ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বলে ওঠলাম, নীলা, উৎসবের কথা মনে আছে?
কোন উৎসব?
সে কি, উৎসবকে ভুলে গেলে?
মনে পড়েছে বলো।
সকালে ওর সাথে কথা হলো। ও আসবে আমাদের নিয়ে যেতে। অযুতের কথা ওকে জানিয়েছি।
কখন আসবে?
হয়তো দ্রুতই আসবে। ওর সাথে একটা বিষয় নিয়ে আমি রাগ করেছি।
নীলা ডায়েরির পাতা উল্টিয়ে তাকাল।
কেন রাগ করেছ?
ও তোমার ফিরে আসার কথা বিশ্বাস করেনি। শুধু উৎসব নয় বেশ কয়েকজন তোমার ফিরে আসাকে মেনে নিতে পারেনি। কেন বলো তো? ওরা কি আমাদের সুখ সহ্য করতে পারে না?
নীলা ডায়েরিটা রেখে আমার কথায় মনোযোগ দিলো।
উৎসব আর কী বলল?
সে এক উদ্ভট হাস্যকর কথা। তুমি নাকি দু’বছর আগে মারা গিয়েছ। হা হা হা
নীলার মুখে সামান্য হাসির রেখা।
চা বা কফি হলে ভাল হতো। পাশের দোকান থেকে আনাতে পারবে?
দোকানে যেতে হবে কেন? আমিই তোমাকে চা তৈরি করে দিচ্ছি। কফি আছে কিনা সিওর জানি না। তুমি অপেক্ষা করো, কিছুক্ষণের মধ্যে চা গরম চলে আসবে।
মাহিদকে ইশারা দিতেই সে আমার সাথে নিচে নেমে এল। ওর হাতে টাকা দিয়ে বললাম, মোড়ের দোকানে একটু মিনিপ্যাক কফির খোঁজ নেবে। পেলে খুব ভাল হয়। মাহিদ চলে গেল। রান্না ঘরের দিকে গেলাম। চুলা জ্বালিয়ে কেটলিতে চায়ের পানি বসিয়ে দিলাম। সাত-আট মিনিট পরে মাহিদ ফিরে এল। সে অনেকগুলো মিনিপ্যাক কফি এনেছে।
শোনো মাহিদ, ওপরের ঘরে দুটো কাপ রয়েছে, চট জলদি নিয়ে এসো। মাহিদ দৌড়ে গেল। পর মুহূর্তে সে ফিরে এল। ওর মুখ তখন ফ্যাকাশে! কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে।
মাহিদ, তোমার কি হলো?
আগুন! আগুন লেগেছে আঙ্কেল!
কী বলছ? কোথায় আগুন?
ঐ ডায়েরিটা পুড়ে যাচ্ছে।
নীলা কোথায়?
আঙ্কেল নীলা কে? ওখানে কেউ তো নেই। ডায়েরিটা আপনা আপনি পুড়ে যাচ্ছে।

দৌড়ে উপরে এলাম। নীলা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটি বড় ম্যাগনিফ্লাইং গ্লাস। সে গ্লাসের রৌদ্র শিখা টেবিলের উপরে রাখা ডায়েরিটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে।
নীলা, এসব কী করছ? প্লিজ, গ্লাসটা ওখান থেকে সরাও।
নীলা হাসছে। আমি হতভম্বের মতো ওকে দেখছি। অবশেষে নীলাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। ও বারান্দার মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। মাহিদ জগ ভরে পানি নিয়ে এসেছে। জ্বলন্ত ডায়েরিটার উপর পানি ঢেলে দিলাম। ততক্ষণে সব শেষ! পানির ¯্রােত ও কাগজ ভস্ম একাকার হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল।
নীলা ততক্ষণে ওঠে দাঁড়িয়েছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তৃপ্তি ও হালকা হাসির রেখা ওর চোখে।
কেন এমন করলে? এ ডায়েরি তোমার কী এমন ক্ষতি করেছে?
সোম, এ ডায়েরি অস্তিত্বকে সংকটের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। তাই সব পুড়িয়ে ভস্ম করে দিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, ঐ ডায়েরিটিতেই ফর্মূলাটি আছে। তাই সেদিন ওটা তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম।
আমার পুরো পৃথিবী মহাঝড়ে তছনছ হতে লাগল। শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যাচ্ছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। নীলা আমাকে জড়িয়ে ধরল।
সোম। কী হলো তোমার?
সরে যাও প্লিজ। তুমি আমার নীলা নও। মিথ্যাবাদী, প্রতারক।
হ্যাঁ, আমি তোমার নীলা নই। আমি ক্রিটিনা। আমি যা করেছি তা বহুমাত্রিক জগতের সকলের কল্যাণের জন্য করেছি।
সম্ভবত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাহিদ আমার চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো।
আঙ্কেল...আঙ্কেল।
হ্যাঁ, মাহিদ। আমার কী হয়েছিল?
আপনি একা একা কথা বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
মাহিদ আমার কপাল বার বার ম্যাসেজ করে দিচ্ছিল।
আঙ্কেল, আপনার এখন কেমন লাগছে? গঞ্জ থেকে ডাক্তার ডেকে আনব?
না, মাহিদ। আমি এখন ঠিক আছি।
অস্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম, ছদ্মবেশী ক্রিটিনা অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। উৎসবের কথাই সত্য। নীলা সেজে কেউ আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।
নীল...আ। তুমি নীলা নও, তুমি ক্রিটিনা। তাহলে কেন নীলা সেজে অভিনয় করলে। বলো..।
ততক্ষণে ক্রিটিনা এক অচেনা তরুণীর রূপ নিয়েছে।
বলছি, সোম। আজ তোমাকে সব বলব। কারণ আমার জীবন ফুরিয়ে এসেছে। আমি এখন মৃত্যুর দুয়ারে দ-ায়মান। দ্বিমাত্রিক জগতে আমাদের বসবাস। সে জগত এই পৃথিবীর মতো নয়। সেখানকার সবকিছু ছবির দৃশ্যের মতো। স্পষ্ট দেখা যায়, তবে ছুঁয়ে দেখতে গেলে পুরো পরিবেশ চিত্রের মতো মসৃণ একাকার মনে হবে। তবু সেখানে সবকিছুর অস্তিত্ব বিরাজমান। আমরা আমাদের দ্বিমাত্রিক জগতকে খুব ভালবাসি। কেউ আমাদের জগতকে দখল করুক, তা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। কোনো ষড়যন্ত্রও সহ্য করতে পারি না। আমি ত্রিমাত্রিক জগতে প্রবেশ করেছি, আমাদের মহাপরিচালকের নির্দেশে। আমাদের উদ্দেশ্য ও কাম্য স্থিতিশীল জগত। যেখানে কেউ কারোর জন্য আশঙ্কা হয়ে দাঁড়াবে না।
দ্বিমাত্রিক জগতের জ্ঞান পর্যবেক্ষক কমিটি বিভিন্ন উপায়ে জানতে পারে চতুর্মাত্রিক জগতের গণিতবিদেরা ত্রিমাত্রিক জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। তখন থেকেই আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে থাকি। কারণ চতুর্মাত্রিক জগতের প্রাণী অতিশক্তিশালী। ওরা হয়তো একদিন ত্রিমাত্রিক জগতকে দখল করে ফেলবে। তারপর দ্বিমাত্রিক জগত দখল করতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। সেই আশঙ্কা থেকেই কর্তৃপক্ষ বিশেষ উপায়ে আমাকে ত্রিমাত্রিক জগতে পাঠায়। এখান থেকে আমি কখনোই দ্বিমাত্রিক জগতে ফিরে যেতে পারব না, তা জেনে শুনেই এসেছি। তোমাদের পৃথিবীতে আসার আগে দ্বিমাত্রিক জগতবাসী আমাকে মৃত্যুসংবর্ধনা দিয়েছে। শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে অভিহিত করেছে। ওদের ভালবাসা আমাকে মৃত্যুভয় ভুলিয়ে দিয়েছে। আমি জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সোম, বিশ্বাস করো, আমি তোমার ভালবাসায় মুগ্ধ। তোমার সাহায্য না পেলে হয়তো এ কাজটা কখনোই সফল হত না। এটা সত্য তোমার সাথে ছলনা করেছি। কারণ অন্যদিকে অযুত যেকোনো মূল্যে এ সূত্রটি দখল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বিশ্বাস করো সোম, এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। প্রথমদিকে রিয়ন সাহেবকে নিয়ে বিশদ পড়াশোনা করেছি। তারপর থেকে আমি তোমাকে অনুসরণ করেছি। তোমার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কেও জেনেছি। যখন জানতে পারলাম তোমার হৃদয়ের দূর্বলতম স্থানটি নীলা। তখনই আমি এই সিদ্ধান্ত নেই। আমাকে ক্ষমা করো, সোম। অযুতের হাত থেকে মুক্তি পাব কিনা জানি না। বেঁচে গেলেও আমি কখনো দ্বিমাত্রিক জগতে যেতে পারব না। একটা সত্য জেনে রাখো, অযুত তোমার দাদাজানকে হত্যা করেছে। হয়তো তোমাকেও সে আক্রমণ করবে।
তা আমি জানি ক্রিটিনা। এখন এ স্থানটা আমাদের ত্যাগ করা উচিত।
মাহিদ আমার মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। ভাবছি উৎসবকে কল দেব। ওকে সবকিছু জানানো প্রয়োজন।
আঙ্কেল, একা একা কার সাথে কথা বলছেন?
মাহিদ ক্রিটিনাকে দেখেনি। তাই সে এমন প্রশ্ন করছে। এরূপ আচরণ মিজান মিয়ার মধ্যেও দেখেছি। আমাকে ভয় পেত বলে, মিজান সরাসরি কিছু বলতে পারত না। সবকিছুকে নিজের অজ্ঞতা হিসেবে ধরে নিত।


বেলা গড়িয়ে দুপুর। সবকিছু গুছিয়ে উৎসবের অপেক্ষায় আমরা বসে আছি। উৎসব ফোনে জানিয়েছে সে পথে আছে। আমি ওকে পুরো ঠিকানাটা ভালভাবে বুঝিয়ে বললাম। মাহিদ এখনো ফিরে যায় নি। ও আমাকে বিদায় জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে।
অন্যদিকে বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছে। অজ¯্র দুশ্চিন্তা মাথার ভেতর কম্পন তৈরি করছে। কখন অযুত আবির্ভূত হয়, কে জানে? সে কি আমাদের পিছু নেবে? ঢাকায় যাবার পরও কি সে ক্রোধে জ্বলতে থাকবে? তারপর কি একদিন আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরবে? হয়তো শেষ নিশ্বাস না ফেলা পর্যন্ত, সে আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখবে। তারপর, ডেড বডিটা ঐ হাতঘড়ির মতো ধুমড়ে মুচড়ে দেবে। আ! কি জঘন্য!
ক্রিটিনার প্রতি পরম শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলো। ওর সিদ্ধান্তকে হৃদয় থেকে স্বাগত জানিয়েছি। কি প্রয়োজন বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণ? আমরা কি আমাদের নিজস্ব জগত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারি না? কিন্তু ইতোমধ্যে চতুর্মাত্রিক জগতের চতুর প্রাণীরা ত্রিমাত্রিক জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ওরা স্থায়ীভাবে ওদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। কারণ ওদের প্রবেশের সময় সীমার স্থায়িত্ব খুব স্বল্প। তবে ওদের প্রবেশ প্রতিহত করা খুব জরুরি। অন্যথায় সমস্যাটি চরম আকার ধারণ করবে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কে তৈরি করবে প্রতিরক্ষা বলয়?
সোম।
কি হলো ক্রিটিনা?
তুমি ফিরে যাও। অযুতকে মোকাবেলা করার জন্য এটাই আমার উপযুক্ত সময়। আমি জিতে গিয়েও পিছু হটতে চাই না।
কিন্তু, ক্রিটিনা...।
কোনো কিন্তু নয় সোম। অযুতকে ঘায়েল করার তথ্য-সূত্র আমি জানি।
ওর প্রতি আমারও বিদ্বেষ রয়েছে।
হঠাৎ ক্রিটিনা চিৎকার শুরু করল।
সোম, সরে যাও...।
ক্রিটিনা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানার দিকে ঠেলে দিতেই একটা আলমারিটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ক্রিটিনা ওর নিজস্ব শক্তিবলে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। মাহিদ ভয় পেয়ে আলমারি ডিঙিয়ে দরোজার দিকে চলে গেল। ছেলেটি ভয়ে কাঁপছে। কিছুই বুঝে ওঠতে পারছে না। কি ঘটছে এখানে?
অযুত আমাদের সামনে দৃশ্যমান হলো। মাহিদ ওকে দেখতে না পেলেও আমি ও ক্রিটিনা অযুতকে দেখতে পাচ্ছি। আজও সে আমার তারুণ্যের চিত্রকে নকল করেছে। এ অবয়বটি প্রথমদিকে দেখার পর মনের ভেতর অতীত হারানো হাহাকার জেগে ওঠত। আজ রাগে-ক্রোধে আমি জ্বলে যাচ্ছি। ইচ্ছে করছে ওকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলি।
অযুত ক্রিটিনাকে চেপে ধরল। ওর দু’হাত পেছন দিকে নিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর ওকে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আমি বিছানার ওপর হতভম্ব হয়ে বসে আছি। কিছু একটা করতে হবে।
মিঃ সোম। অতিচালাকি তুমি যেমন পছন্দ করো না। আমিও ঠিক তাই। চা বানানোর ফাঁদ! আমাকে বোকা বানিয়ে ডায়েরিটা হাতিয়ে নিলে। তা বেশ করেছ। এই মুহূর্তটা তোমার চালাকির উপহার।
অযুত, তুমি চরম মিথ্যুক। রিয়ন সাহেবকে তুমি হত্যা করেছ।
হ্যাঁ, স্বীকার করছি। এর সাথে এটাও শুনে রাখো, ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলাটি না পেলে তোমাকেও বাঁচতে দেবো না।
ক্রিটিনা, নিম্ন জগতের রমণী, তুমি সাংঘাতিক সাহসের স্বাক্ষর রেখেছ। এখন ১৯৬৯ সালের ডায়েরিটি দাও।
ক্রিটিনা হাসল। বলল, সোম ওকে ঐ ডায়েরিটি দাও।
আমি ১৯৬৯ সালের ডায়েরিটি অযুতের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে ডায়েরির পাতা উল্টিয়ে পড়তে শুরু করল। পনের মিনিট কেটে গেল। ক্রিটিনা হো হো স্বরে হেসে ওঠল।
অযুত ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, বিশ্রীভাবে হাসছ কেন?
চতুর্মাত্রিক জগতের চতুর অযুত তুমি হেরে গিয়েছ। ওই যে দেখতে পাচ্ছো ওখানে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রিয়ন সাহেবের বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের সূত্র! বাংলা হায়ারোগ্লিফিকে লেখা, যা তোমার কাছে চিরদিন দুর্বোধ্য ছিল। সব এখন ছাই রঙে একাকার।
অযুত দৌড়ে বারান্দায় গেল। টেবিলের জমানো ছাই ধরে সে হু হু করে কেঁদে ওঠল। ওর কান্নার দৃশ্য আমাকে কাঁপিয়ে তুলল। ও মুখটা যে আমারই। দরোজার পাশে মাহিদ অবুঝের মতো চারপাশ অবলোকন করছে। ও কেবল আমাকে দেখতে পাচ্ছে। হয়তো সবকিছু আজব, কিংবা আমার পাগলামি হিসেবে ভেবে নিচ্ছে।
অযুত ওপাশে যাবার পর আমি ক্রিটিনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ইশারা পেয়েই আলমারি ডিঙিয়ে ওর হাতের বাঁধন খুলে দিলাম। তারপরই অযুত ফিরে এল।
মিঃ সোম! কেন করেছ এ কাজ?
ক্রিটিনা বলে ওঠল, না, অযুত। সোম নয় ক্রিটিনা করেছে এই কাজ। কারণ, আমরা চাই প্রতিটি জগতের জীব শান্তিতে বসবাস করুক। জগত ভ্রমণের ফাঁদ পেতে উঁচু জগতের বাসিন্দারা নিম্ন জগতকে শোষণ শাসন করবে তা হতে পারে না।
আমি বললাম, অযুত, তুমি ফিরে যাও। এছাড়া তোমার কোনো পথ নেই।
না, আমি ফিরব না।
নইলে তোমাকে চরম শাস্তি পেতে হবে।
এখানে আমার মৃত্যু অসম্ভব। সুতরাং আমি নির্ভয়ে হিং¯্র হতে পারি। সোম, ক্রিটিনা তোমাদের বধ করতে আমাকে কোনো আশঙ্কা সমীকরণ পাড়ি দিতে হবে না। হা হা হা।
অযুত, তোমার মৃত্যু সূত্র আমি ভুলে যাইনি।
মুহূর্তে অযুতের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। চিৎকার করে বলতে লাগল, না, তা হতে পারে না।
অযুত ছুটে গিয়ে ক্রিটিনার কণ্ঠনালী চেপে ধরল। ক্রিটিনা চিৎকার করে ওঠল। ক্রিটিনাও অযুতের কণ্ঠ চেপে ধরেছে। আমি ওঠে গিয়ে অযুতকে সজোরে ঘুষি মারলাম। সে দরোজার কাছে ছিঁটকে পড়ল। মাহিদ মুহূর্তে বারান্দার দিকে সরে গেল। আমি অযুতকে অনবরত আঘাত করছি। এদিকে সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হঠাৎ সে আমার পেটে ঘুষি মারে। আমার দেহটা প্রচ- বেগে দেয়ালে ধাক্কা লেগে উপর থেকে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। মাথায় আঘাত লাগতেই দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তখনও সেন্সলেস হইনি। অযুতের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
আমার মৃত্যুসূত্র তোমার জানা আছে ক্রিটিনা?
হ্যাঁ।
অযুত পর পর ওকে কয়েকবার আঘাত করল।
ক্রিটিনা কান্না ও চিৎকার মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, সোম অজ্ঞান হয়ে গেলে? অযুতকে শাস্তি দিতে হবে। শোনো সোম, অযুতের মৃত্যু সূত্রটা মনোযোগ দিয়ে শোনো।
ক্রিটিনা সূত্রটি বলার আগেই অযুত মুখ চেপে ধরল।
আমার মৃত্যু সূত্র বলবে? তোমার জিহ্বা আমি কেটে ফেলব।
টেবিলের ড্রয়ার খুলার শব্দ শোনা গেল। অযুত হয়তো কাঁচি নেবার জন্যই ড্রয়ার খুলেছে। সত্যিই তাই।
অযুত বলে ওঠল, এই কাঁচি দিয়ে তোমার জিহ্বা কেটে ফেলব।
একমুহূর্ত পরে ক্রিটিনার আর্তনাদ শুনতে পেলাম। অনেক চেষ্টা করেও চোখ দুটো খুলতে পারলাম না। আমি যেন নীলার চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। নিরুপায় অসহায়ের মতো পড়ে আছি। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। মাহিদ আমার কাছে ছুটে এলো, চোখে মুখে পানিও ছিঁটিয়ে দিলো। সম্বিত ফিরে পেয়ে ওঠে বসলাম।
আঙ্কেল, আমার খুব ভয় হচ্ছে।
ভয় নেই, মাহিদ। তুমি সাবধানে বাইরের দিকে যাও।
তাকিয়ে দেখলাম। চেয়ারে ক্রিটিনার নিথর দেহ। পাশে দাঁড়ানো অযুত। সে ক্রিটিনার ডায়েরিটি উল্টে পাল্টে দেখছে। দু’মিনিট পর ডায়েরিটি সে ছুঁড়ে ফেললো। আলমারি খুলে ডায়েরি বই খাতা সবকিছু মেঝেতে ছড়িয়ে দিলো। ও পাগলের মতো বই খাতা ছিঁড়তে লাগল। তারপর সে বাইরে বেরিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ওর উন্মাদযজ্ঞ চলল। হঠাৎ দেখলাম মেঝেতে আগুন ধরে গেছে। আমি বারান্দায় ছুটে গেলাম। দেখতে পেলাম সে ম্যাগনিফ্লাইং গ্লাসটা রোদের দিকে তাক করে মেঝেতে বই খাতার উপর ফোকাস দিচ্ছে। আগুন বেড়েই চলছে। তৎক্ষণাৎ অযুতের মাথার পেছন দিকে চেপে ধরলাম। মাথার পেছনে একটি ক্লিপের মতো কিছু রয়েছে। সেখানেই প্রচ- জোরে চেপে ধরেছি। ওর হাত থেকে ম্যাগনিফ্লাইং গ্লাসটা পড়ে গেল। ও সর্বোচ্চ চেষ্টায় পেছনে হাত বাড়িয়ে আমার মাথায় আঘাত করছে। প্রতিটি আঘাতে আমি বিধ্বস্ত হচ্ছি। তবু তার ধড় থেকে হাত সরাইনি। এক সময় দু’জনই বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেলাম। মাথায় আঘাত পেলাম। চোখ দুটো বন্ধ করে যন্ত্রণা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। অযুতের দেহ অনেকটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। তখনো আমি সে ক্লিপে প্রেসার দিচ্ছি। অযুত কাবু করার এ তথ্য মূলত ওর ডায়েরি থেকে জানতে পেরেছি। অযুতের নিথর দেহ পড়ে আছে। আমি একটিবার মাথা তুলে তাকালাম আশপাশে কেউ নেই। মাহিদকেও দেখতে পেলাম না। ঘরের ভেতর আগুন জ্বলছে, পুড়ছে আমার বিছানা। আগুনের উঁচু শিখা জানালা পেরিয়ে করে বাইরের শাল গাছটাকেও পুড়তে শুরু করেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছি। মনে হচ্ছে এখুনি মারা যাচ্ছি।

হঠাৎ উৎসবের গলার আওয়াজ পেলাম। উৎসব চিৎকার করে বলছে, সোম তোর কী হয়েছে?
আমি কিছুই বলতে পারছি না। উৎসব যখন আমাকে ধরে দাঁড় করাল, তখন অযুতের দিকে চোখ গেল। সে স্থির বিকল হয়ে পড়ে আছে। ওর মৃত্যু ত্রিমাত্রিক জগতে সম্ভব নয়। তাই ওর মৃত্যু ধ্রুবক হয়ে থাকবে। উৎসব আমাকে দু’হাতে ধরে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে। তখন অযুতকে দেখে আমার ঝাপসা দৃষ্টি চমকে ওঠল। ওর দেহটি মেঝেতে পড়ে আছে। একটি ছাই রঙের অবয়ব সে দেহ থেকে ওঠে দাঁড়াল। একি! এটা তো অযুত!
ওর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আমাকে বিদ্ধ করল। সেকে-ের মধ্যে অযুত ম্যাগনিফ্লাইং গ্লাসটি তুলে আমার মাথায় প্রচ- জোরে আঘাত করল। উৎসব চিৎকার করে ওঠল। আমাকে সে কাঁধে তুলে সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগল। যন্ত্রণাভরা দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম অযুতের দেহটা আবারো এগিয়ে আসছে।
পরবর্তী আঘাতটা আসার আগেই একটি ছায়া অযুতের ছাই অবয়বকে দূরে ঠেলে দিলো। সে ছায়াটি আর কারো নয়, দ্বিমাত্রিক জগতের মিষ্টি মেয়ে ক্রিটিনার। সেদিন এটাই ছিল আমার দেখা শেষ দৃশ্য। সীমাহীন আঘাত অবসাদ ও যন্ত্রণা আমাকে গ্রাস করল। সারা পৃথিবীর ঘুম অন্ধকার দু’চোখে জড়ো হতেই আমি জ্ঞান হারিয়ে তলিয়ে গেলাম।  [চলবে...]


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট